ইবাহা যারাই বলে থাকেন ইসলামে ইবাদতের ‘তউকিফি’ (অর্থাৎ ওয়াহি দ্বারা সুনির্দিষ্ট) ইস্যুগুলো ছাড়া বাকি সব *একশন (কাজ)* বাই ডিফল্ট মুবাহ বা হালাল, তারা ইসলামী আইনবিজ্ঞানের (উসুল আল ফিকহ) বিষয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে খুব ভয়ংকরভাবেই উম্মাহকে ভুল পথে চালিত করছেন। পর্যাপ্ত ধারণা না থাকায় আমাদের অনেকের মনে এটা গেঁথে গেছে (কিছু ভ্রান্ত প্রচারনার দ্বারা) কোন বিষয় যদি ইসলামের সাথে কনফ্লিক্ট না করে এবং ঐ ব্যাপারে কোন শরিয়ার নুসুস (দলীল) যদি না থাকে, তাহলেই তা মুবাহ বা হালাল। এই ভয়ংকর চিন্তার কারনেই মুসলিম উম্মাহকে “ইসলামিক গণতন্ত্র”, “ইসলামিক সমাজতন্ত্র”, “সোশ্যাল জাস্টিস” ইত্যাদি কুফরি চিন্তা গলধঃকরণ করানো হয়েছিল। খিলাফত ধ্বংসের বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে যারা অবহিত নন, তারা এই বিষয়টিও হয়তো জানেন না কাফেররা মুসলিম ভূমিগুলোকে বাইরে থেকে আক্রমণ পরে করেছিল। প্রথমে ভেতর থেকে ধ্বংস করা হয়েছিল কিছু ভ্রান্ত উসুলি কা’ইদাহ (নীতি) প্রয়োগ করে যার ভেতর ছিল এইটিও – “সকল কিছুই বাই ডিফল্ট মুবাহ”। এই নীতির দ্বারা ঐ পশ্চিমা চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত মুসলিম পণ্ডিতরা বলা শুরু করেছিল যে রাজনীতি “তউকিফি” (আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত) না এবং সব কাজই বাই ডিফল্ট হালাল, এবং তা বলেই ফ্রেঞ্চ পেনাল কোড ও রোমান আইন এবং গণতন্ত্র মুসলিম খিলাফতে ঢোকানো হয়েছিল বিখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা।
এক্ষেত্রে দেখা যায় যেসব ফকিহ বা উসুলিয়্যুন এই চিন্তার প্রচার-প্রসার ঘটান, তারা নীচের কা’ইদাহ (নীতি) টি সর্বদাই উল্লেখ করে থাকেনঃ
“সব বস্তুর ‘আসল’ বা অরিজিন হল ইবাহা (বা হালাল)” [আল আসলু ফিল-আশইয়া আল ইবাহা]
এখানে উল্লেখ্য ফিকাহ শাস্ত্রবিদরা শুধু বস্তু/জিনিস (আশইয়া) এর ক্ষেত্রে এই কা’ইদাটি ব্যবহার করতেন (আফ’আল বা কাজের ক্ষেত্রে না)। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে বলেছেন,
وَخَلَقَ لَكُمْ مَا في الأَرْضِ جَمِيعاً
“এবং তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর বুকে যা আছে সবই সৃষ্টি করেছেন”
আয়াতটিতে আল্লাহ বস্তুকে ‘আম ভাবে উল্লেখ করেছেন তাই সকল বস্তু বাই ডিফল্ট হালাল, এবং যেগুলো হারাম সেগুলো উল্লখে করা আছে।
কিন্তু সমস্যা হয় যখন বস্তুর (আশইয়া) সাথে একশন বা কাজ (আফ’আল) কে মিশিয়ে ফেলে এই কা’ইদাহটি দ্বারা জাস্টিফাই করানো হয়। এটি একটি কমনসেন্স যে বস্তু আর একশন কখনই এক বিষয় হয় না। আমরা বলতে পারি না ‘ছুরি’ (বস্তু) আর ‘ছুরি মারা’ (একশন) এক বিষয়। তাই অতীতে স্কলাররা প্রয়োজনবোধই করেননি এই নীতির ক্ষেত্রে বস্তুকে একশন থেকে আলাদা করে বোঝানোর।
তাই আফ’আল (একশন) এর ক্ষেত্রে ‘আসল’ (অরিজিন) হল –
“হুকুম আশ-শার’ঈর মাঝে নিজেদের কাজকে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে শরিয়াহর সাথে লেগে থাকা”।
তাই যদি আল্লাহ কোন কাজের জন্য ইবাহা (অনুমতি) দেয় তাহলে তা হবে মুবাহ আর যদি আমরা অনুমতি না দেখতে পাই তাহলে “আদিল্লাহ আশ-শারিয়্যাহ” (শরিয়াহর দলীল) থেকে হুকুম বের করে আনতে হবে। এটা বলার কোন সুযোগ নেই যেহেতু শরিয়াহ এক্ষেত্রে এপারেন্টলি নীরব তাই আমরা সেই একশন সমূহ পালন করতে পারবো।
যারা এই বস্তুর সাথে একশনকে মিলিয়ে দেখেন তারা আবার “মুবাহ” (যা করলে কোন সাওয়াব বা গুনাহ নেই) কে ভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তারা মনে করেন যেসব বিষয়ে শরিয়াহ কোন তিরস্কার (হারাজ)করে না বা শরিয়াহ নিশ্চুপ, সেগুলোই হল মুবাহ। তাই তিরস্কারের অনুপস্থিতিই হল “অনুমতি” (ইবাহা)। তারা রাসূলের(সা) কথাটি উল্লেখ করেনঃ
وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَفْو
“এবং যে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা হয়েছে সেসব বিষয়ে মাফ করে দেয়া হয়েছে”।
এভাবেই নিকট অতীতের স্কলাররা গনতন্ত্রকে জায়েয করেছিল এই যুক্তিতে যে গণতন্ত্রও “শুরা” (পরামর্শ) ও সামাজিক ন্যায় দ্বারা পরিচালিত এবং সকল বস্তুই যেহেতু বাই ডিফল্ট হালাল, তাই গণতন্ত্রও এডপ্ট করা যাবে। এবং বর্তমানেও অতীতের সেই বিষাক্ত চিন্তা অনেক স্কলাররাই বহন করছে।
তাই এটা জেনে নেয়া ভাল, উসুল আল ফিকহের ক্লাসিক্যাল বইগুলোতে কোথাও বলা নেই; কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে হারাজ (তিরস্কার) এর অনুপশ্তিতিই হল “অনুমতি” (ইবাহা), কারন কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে হারাজ এর অনুপস্থিতি ইঙ্গিতবহন করে না যে ঐ কাজ বা বস্তুটি মুবাহ। আবার ব্যাপারটি এমনও না যে ঐ হারাজটিকে তুলে নেয়ার অর্থই হল “অনুমতি”। তাই, কোন বিষয় মুবাহ হওয়ার অর্থ হল উক্ত বিষয়ে হুকুমদাতা (আল্লাহ) মানুষকে কোন কাজ করা বা না করার ক্ষেত্রে বাছাই করার অপশন দিয়েছেন, এবং এই বাছাইয়ের অপশনটিও শরিয়াহর দলীল দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
যারা উপরে বর্ণিত হাদিসটির (“এবং যে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা হয়েছে সেসব বিষয়ে মাফ করে দেয়া হয়েছে”) এভাবে ব্যাখ্যা দেন যে শরিয়াহ কিছু বিষয়ে নিশ্চুপ রয়েছে তাই ওসব বিষয় মুবাহ, তারা হাদিসটির ভুল ব্যাখ্যা দেন। বিষয়টি এমন না যে শরিয়াহ কোন ব্যাপার এক্সপ্লেইন করে নাই এবং এই চিন্তা করাও পাপ কারন আল্লাহ বলেছেন:
“আজকে আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম…” [মা’য়িদা, ৩]
তিনি আরও বলেছেন:
“আমরা এই কিতাব নাযিল করেছি সবকিছুর ব্যাখ্যা দিয়েই” [নাহল, ৮৯]
তাই ওপরের হাদিসটিতে রাসুলুল্লাহ (সা) বোঝাতে চেয়েছেন সেসব টেক্সট গ্রহণ করো যা তোমাদের দেয়া হয়েছে। আর যে বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাস করা হয়নি তা নিয়ে কিছু জিজ্ঞাস করো না কারণ হয়তো তা আবার হারামও হয়ে যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছিলেন:
ذَرُونِي مَا تَرَكْتُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ . فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَاجْتَنِبُوهُ . وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرِ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ
“আমাকে চাপ দিও না সেসবের বাইরে কিছু বলতে যা আমি তোমাদের ইতিমধ্যেই বলেছি। তোমাদের আগে যারা এসেছিল তারা অতিরিক্ত প্রশ্ন করা এবং তাদের নবীদের সাথে বিতর্ক করার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি যদি তোমাদের কিছু করতে নিষেধ করি তাহলে তা থেকে দূরে থাক এবং যদি কিছু করার আদেশ দেই তাহলে তোমাদের সাধ্যমতো করার চেষ্টা করো” [মুসলিম]
তাই মূল কথা হল ইসলামে এমন কিছু নেই যা শরিয়াহ এক্সপ্লেইন করেনি। তাই কোন কিছু মুবাহ বলতে নিলেও আমাদের আগে দলীল ঘাটতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে শরিয়াহ উক্ত বিষয়টিকে মুবাহ ঘোষণা দিয়েছে।
আবার অনেকেই যুক্তি দিয়ে থাকেন নিউক্লিয়ার বোমা, উড়োজাহাজ তৈরি ইত্যাদি একশনগুলোর ক্ষেত্রে তো কোন শরিয়াহ বিধান নেই। তাই এই কাজগুলো যদি আমরা ইবাহা ধরে করতে পারি, তাহলে কেন সকল কাজের ‘আসল” (অরিজিন) এর ক্ষেত্রে আমরা একই কথা বলতে পারি না? এই বিষয়ে ফুকাহাদের মত হল কিছু চিন্তা থাকে আকিদা এবং আহকাম সঙ্ক্রান্ত, এবং কিছু থাকে ‘উলুম (বিজ্ঞান), মাদানিয়্যাহ (প্রযুক্তি), উদ্ভাবন/উৎপাদন, দক্ষতা ইত্যাদি সঙ্ক্রান্ত। তাই দ্বিতীয় বিষয়ের (যেগুলো আকিদা বা আহকাম সঙ্ক্রান্ত নয়) ক্ষেত্রে যদি শরিয়াহ দ্বারা নিষেধকারী কোন দলীল না থাকে, তাহলে তা গ্রহণ করা যায়। রাসূলুল্লাহ(সা) একবার কিছু কৃষক এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাদের বললেন:
أَنْتُمْ أَدْرَى بِأُمورِ دُنْيَاكُمْ
“তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে আমার চেয়ে অধিক সচেতন”
বদরের যুদ্ধের সময় সাহাবা আল-হুব্বাব বিন আল-মুনধির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) কে যুদ্ধ-কৌশল সঙ্ক্রান্ত এক প্রশ্ন করেছিল। রাসূলের পরিকল্পনাটি কি ওয়াহি ছিল নাকি রাসুলের নিজস্ব মতামত ছিল তা ঐ সাহাবা জানতে চেয়েছিল, উত্তরে রাসুলুল্লাহ বলেছিলেন:
بَلْ هُوَ الرَّأْيُ وَالحَرْبُ وَالمَكِيدَة
“অবশ্যই এটা আমার মতামত, যুদ্ধবিগ্রহ ও ধূর্ত (বিষয়ের ক্ষেত্রে)”
ঐ সাহাবার পরামর্শে রাসুলুল্লাহ যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করেছিলেন। কারন তা ওয়াহি ছিল না। তাই নন-আহকাম/আকিদার বিষয়ের ‘আসল’ এর ক্ষেত্রে ইবাহা (অনুমতি) আছে যদি কোন বিপরীত টেক্সট আমরা না পাই শারিয়াহ তে। গণতন্ত্র কিন্তু সরাসরি আকিদা বিরোধী।
মোদ্দা কথাঃ সকল বস্তু বাই ডিফল্ট হালাল এবং সকল একশন এর ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের শরিয়াহ দ্বারা সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কোন ভাবেই বস্তুর সাথে একশনকে এক করে দেখলে হবে না। কারন একশনের ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন:
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“এবং আল্লাহর রাসূল যা কিছু তোমাদের জন্য এনেছেন তা গ্রহণ করো এবং যেসব থেকে দূরে থাকতে বলেছেন তা পরিত্যাগ করো” [হাশর, ৭]
তাই ওপরের আয়াতের ‘তালাব’ (আবেদন) টিতে যে ‘মা’ (যা কিছু) শব্দটি এসেছে তা ‘আম আকারে এসেছে। এবং এই তালাব হোক সেটা “তালাব উত তারক” (কোন কাজ পরিত্যাগ করার আবেদন) বা তালাব উল ফি’ল (কোন কিছু করার আবেদন) হল তালাব জাযিম (সুনির্দিষ্ট আবেদন) যা মেনে চলা ফরয। তাই সকল একশনের ক্ষেত্রে খুঁজতে হবে শরিয়াহর নুসুস (দলীল) কি বলছে। এটাই হল আফ’আল এর ক্ষেত্রে ‘আসল’।
আবু ঈসা