প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরানের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করবেন কি? অন্য কথায়, ইরান কি আঞ্চলিক রাজনীতিতে স্বাধীনভাবে মার্কিন প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারে অগ্রসর হয়? আমরা কি বলতে পারি যে, ইরান এ অঞ্চলে একটি মতবাদ প্রচার করতে চায়, যার নাম জাফরী মাযহাব? সবশেষে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে আমেরিকার প্রকৃত অবস্থান কি?
উত্তর: প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হলে আমাদেরকে প্রথমে সংক্ষেপে ইরানের সরকারের বাস্তবতা, বিপ্লবের পর থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক পথ পরিক্রমা, প্রজাতন্ত্র ঘোষণা এবং এসব কিছুর সাথে আমেরিকার সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে হবে:
১) ইরানি বিপ্লবের শুরু থেকেই আমেরিকার সম্পৃক্ততা ছিল সুস্পষ্ট। ফ্রান্সের নিউফ্ল-লে-শ্যাঁতো’তে (Neauphle-le-Château) খোমেনীর অবস্থানকালে হোয়াইট হাউসের প্রতিনিধি দল তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিল। তখন খোমেনী আমেরিকার সাথে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে মার্কিন সংবাদপত্রগুলো এই ঐকমত্য এবং সেখানে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ব্যাপারে রিপোর্ট প্রকাশ করে… সাম্প্রতিককালে ইরানি প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট আবুল হাসান বানু সাদর ১/১২/২০০০ তারিখে আল-জাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ সত্যগুলো প্রকাশ করে। সে নিশ্চিত করে যে, ফ্রান্সের নিউফ্ল-লে-শ্যাঁতো’তে (Neauphle-le-Château) খোমেনীর অবস্থানকালে হোয়াইট হাউসের প্রতিনিধিদল সেখানে আসে। ইয়াজদি, বাজারকান, মুসাভি এবং আরদিবাইলি তাদেরকে স্বাগত জানায়… এ দু’পক্ষের মধ্যে অনেকগুলো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় অক্টোবরে প্যারিসের শহরতলীতে। সে সময় রিগ্যান ও বুশ গ্রুপ এবং খোমেনীর গ্রুপের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না – এ শর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করার ব্যাপারে খোমেনী তার সম্মতি প্রদান করে। এর কিছুদিন পরে একটি ফরাসি বিমানে খোমেনী তেহরানে পৌঁছামাত্র তার হাতে শাসনভার তুলে দেয়ার জন্য আমেরিকা শাহপুর বখতিয়ারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আমেরিকা ইরানি সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের হুশিয়ার করে দেয় যেন তারা খোমেনীর ক্ষমতা গ্রহণের পথে বাধা না দেয়।
তখন থেকে খোমেনী নেতা ও শাসকে পরিণত হয়। এরপর অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে সঙ্গতি রেখে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আদলে ইরানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। পশ্চিমা সংবিধানের অনুকরণে ইরানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে; প্রজাতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভাজন, সংসদীয় কর্মকান্ড, ক্ষমতা পৃথকীকরণ ও যোগ্যতার মাপকাঠি ইত্যাদি পুঁজিবাদী সরকার ব্যবস্থার অনুকরণেই করা হয়েছে। ‘ইরানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম এবং বার জাফরী মাযহাব’ উক্তিটি অধিকাংশ মুসলিম দেশের সংবিধানের মতই – যা থেকে বুঝা যায় না যে, রাষ্ট্র ইসলামের ভিত্তিতে চলবে অথবা এর বার্তা হবে ইসলাম। বরং এ ধরনের উক্তি সরকারী ডিক্রি ও ছুটির দিনের সাথে সম্পর্কিত। এর দ্বারা লোকদের বিশ্বাস ও উপাসনাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে – যার মাধ্যমে জীবনের কিছু বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে। ইরানি সংবিধান থেকে বুঝা যায় না যে ইসলামের আকীদা এই সংবিধানের ভিত্তি অথবা এই মাযহাব রাষ্ট্রীয় বার্তা বা পররাষ্ট্রনীতির একটি লক্ষ্য; বরং প্রকৃতপক্ষে এটি দেশপ্রেম নির্ভর বা জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক। পুঁজিবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে ইরানি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; যেমন: জাতিসংঘ এবং ওআইসিতে অন্তর্ভুক্তি। ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও কোন কিছুই ইসলামের ভিত্তিতে নয়। সুতরাং এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইরানি রাষ্ট্র কোন বিশেষ বার্তাকে বহন করে না অথবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের ভিত্তিতে করা কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে না। বরং জাতীয়তাবাদী বা দেশপ্রেমজনিত প্রবণতা ইরান সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট – যা বর্তমান ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সীমানা বজায় রাখার নীতির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। বিপ্লবের শুরুর দিকে আমরা খোমেনীর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। আমরা আমেরিকার সাথে সহযোগিতা না করার এবং আমাদের প্রণীত সংবিধানের মত একটি ইসলামি সংবিধানের ঘোষণা দেয়ার জন্য তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। ইরানের সংবিধানের ত্রুটি বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে খোমেনীর উদ্দেশ্যে আমরা একটি খোলা চিঠি দিয়েছিলাম। খোমেনী আমাদের উপদেশ গ্রহণ করেনি এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদের আদলে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এমন সংবিধান নিয়ে অগ্রসর হয়েছে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
২) রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মাযহাব উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা যায়, এটি একটি বার্তা বা পরিকল্পনা হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি অথবা এর উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কিংবা সংবিধান প্রণীত হয়নি অথবা সংবিধানের অনুচ্ছেদসমূহ এই মাযহাব থেকে উদ্ভূত হয়নি। বরং শাসন, বৈদেশিক নীতি, সশস্ত্র বাহিনী ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সাথে সংশিস্নষ্ট ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়সমূহ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে গৃহীত হয়েছে; যেভাবে সৌদি আরবের শাসকেরা তাদের ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে হিজাজ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হাম্বলী মাযহাবকে ব্যবহার করে। তাছাড়া তাদের সাথে কাজ করতে চায় এমন কোন অনুসারী বা সমর্থকের ক্ষেত্রে ইরান স্বীকারোক্তিমূলক দিকটি (confessional aspect) ব্যবহার করে। এটি তাদের মধ্যে উগ্র জাতিগত বিভক্তির বোধকে উসকে দেয় এবং এ কারণে জাতীয় স্বার্থে তাদের ব্যবহার করা সহজতর হয়। এর মাধ্যমে জাফরী মাযহাব বা শিয়া মতবাদের প্রসার ঘটানো হয় না। বাস্তবতা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যদি ইরানি জাতীয় স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, তাহলে ইরান শিয়া বা জাফরী মতবাদকে সাহায্য করে না। ধর্মনিরপেক্ষতা অবলম্বন করলে যখন স্বীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়, তখন ইরান ইসলাম, শিয়া বা জাফরী মতবাদকে দূরে ঠেলে দিতে দ্বিধা করে না। তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত ইরাকি ও সিরীয় সরকারকে সাহায্য করছে। শিয়া অধ্যুষিত সৌদি আরবের পূর্বদিকের প্রদেশগুলো তেলসমৃদ্ধ হওয়ায় ইরান সৌদি আরবকে দুর্বল করার জন্য অনেকবার সেখানকার গণজাগরণকে সমর্থন দিয়েছে। বাহরাইনের ক্ষেত্রেও ইরান একই ধরনের নীতি প্রয়োগ করেছে যার জন্য বাহরাইনকে সৌদি আরবের সৈন্য তলব করতে হয়েছে…
জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী হলে ইরান মাযহাবগত বিষয়কে তোয়াক্কা করে না। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন হতে চায় এবং লোকেরা ইরানের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য সীমান্ত ভেঙে দেয়। ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে আগ্রাসী রাশিয়া নিজেদের কর্তৃত্বের বাইরে কোন ব্যবস্থা সেখানে যেন প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং পুরনো কমিউনিস্ট দালালদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য বাকুতে প্রবেশ করে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। মুসলিমরা তাদের অধিকার লংঘনকারী রাশিয়ার বশ্যতা ও কমিউনিস্টদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল অথচ রাশিয়ার আক্রমণের মুখে আজারবাইজানের লোকদের ইরান কোন সাহায্য করেনি। যদিও বাস্তবতা হল আজারবাইজানের অধিকাংশ মুসলিম ইরানের রাষ্ট্রীয় মাযহাব অনুসরণ করে। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার মদদে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের ২০ ভাগ ভূমি দখল করে নেয়। এতে ১০ লাখেরও বেশী লোক তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়। তখনও ইরান আজারবাইজানের লোকদের কোন রূপ সাহায্য করেনি। এ করুণ পরিস্থিতি এখনও বিদ্যমান। অথচ ইরান আজারবাইজানের বিপরীতে আর্মেনিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে ! শুধু তাই নয়, ইরান এমন কিছু গ্রুপকে সাহায্য করেছে যাদের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই; যেমন: লেবাননের মিচেল আওনের দল অথবা নাবিহ বেরি এবং অন্যান্যদের ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন – যারা মার্কিন পদাঙ্ক অনুসরণকারী।
৩) আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের সব কর্মকান্ডই আমেরিকার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়, যার কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া হল:
ক. লেবাননে ইরান তার মাযহাবের অনুসারীদের নিয়ে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেছে, যা লেবাননের মূল সেনাবাহিনী থেকে পৃক একটি বিশেষ বাহিনী। লেবানন সরকার এই বিশেষ বাহিনী ও তাদের সামরিক অস্ত্রকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ইরান ভাল করে জানে যে লেবাননে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত সরকার যা আমেরিকার রাজনীতিকে অনুসরণ করে। লেবানন সরকার আর কোন দলকে অস্ত্র বহন করার অনুমোদন দেয় না অথবা অন্য কোন দলকে সামরিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে স্বীকৃতি প্রদান করে না। লেবাননের ইরান সমর্থিত এই সশস্ত্র দল সিরিয়া সরকারের সমর্থন নিয়ে ইরানের মত আমেরিকার সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে। বাশার আল-আসাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা ইরানি এই সশস্ত্র হিযবকে সিরিয়ার ভেতরে হস্তক্ষেপ করতে লেবানন সরকারকে বাধা প্রদান করেনি। বরং আমেরিকা লেবাননের সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত রেখে এই দলকে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পরোক্ষ অনুমোদন দিয়ে রেখেছে।
খ. আমেরিকা ইরাক দখল করার পর অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। তাই আমেরিকা তখন ইরাকের ভেতরে ইরানকে প্রবেশ করাল নিজস্ব মাযহাবের লোকদের প্রভাবিত করতে; যাতে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মুক্তি আন্দোলনকে প্রতিরোধ করাযায়, এমনকি মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের দাঁড় করানো যায়, পরস্পরকে বিরোধে জড়িয়ে ফেলা যায়, এবং দখলদারিত্ব ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থাকে বৈধতা প্রদান করা যায়। বিশেষ করে ২০০৫ এর পরে আমেরিকা ইবরাহিম আল-জাফরী ও পরবর্তীতে আল-মালিকির নেতৃত্বাধীন ইরানপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জোটকে ক্ষমতায় আরোহণ করতে অনুমোদন দেয়। এই সরকারগুলো আমেরিকার মদদে প্রতিষ্ঠিত এবং পরস্পর সর্ম্পকযুক্ত। ইরাকে দখলদারিত্বের আনুষ্ঠানিক অবসানের পর আমেরিকার প্রভাব বজায় রাখতে ইরানি মদদপুষ্ট মালিকি সরকার নিরাপত্তা ও কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করে – যা থেকে বুঝা যায় যে, দখলদারিত্ব বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের কর্মকর্তারা সহায়তা করায় ও ইরাকে মার্কিন প্রভাবকে সুনিশ্চিত ও স্থিতিশীল করতে কাজ করায় ইরানের ভূমিকায় আমেরিকা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। ইরানের কর্মকর্তারা আমেরিকাকে এভাবে সহযোগিতা করার কথা স্বীকারও করে। মার্কিন দখলদারিত্বের পর পরই ইরান ইরাকে দূতাবাস খোলে। দখলদারিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০০৫ সালে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল খারাজি ইরাক সফরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আল-জাফরি নির্বাচিত হয়নি। দু’পক্ষই ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে নিন্দা করেছে। জাফরি যখন ইরান সফর করে তখন ইরাক ও ইরানের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; যার মধ্যে নিরাপত্তা ও সীমান্ত পারাপার নিয়ন্ত্রণ করতে গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তি, বিদ্যুৎ গ্রিড স্থাপনের মাধ্যমে বসরা ও ইরানকে যুক্ত করা এবং বসরা ও আবাদানের মধ্যে একটি তেল পাইপলাইন স্থাপন করার চুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০০৮ সালে প্রত্যক্ষ দখলদারিত্বের মধ্যে ইরানি প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ইরাক সফর করে। আহমাদিনেজাদ প্রায়শই আমেরিকা ও ইহুদী রাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে ঝড়ো হাওয়ার মত মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালাত যদিও তার কাজ কখনই তার বক্তব্যের অনুরূপ নয়। সেসময় ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আহমাদিনেজাদ নিবিড়ভাবে আমেরিকার নীতি অনুসরণ করছিল। দখলদারিত্বের মধ্যে আহমাদিনেজাদ ইরাক সফর করে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করার দুই সপ্তাহ আগে আবার ইরাক সফর করে মালিকি সরকারের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে। অথচ মালিকি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব ও প্রভাব বজায় রাখার জন্য। ২০১০ সালে আমেরিকার দখলদারিত্বের মধ্যে আহমাদিনেজাদ আফগানিস্তান সফর করে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্বের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বরত কারজাই সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।
গ. ইরান ইয়েমেনেও একই কাজ করে। সেখানে সে আল-হুথী গ্রুপের উপর প্রভাব বিস্তার করে ও এটিকে অস্ত্র সরবরাহ করে। এই গ্রুপটিকে ইরান ইয়েমেনের বৃটিশ দালাল আলি সালিহ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ধর্মনিরপেক্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোকেও ইরান সহায়তা দেয়। তারাও একইভাবে আমেরিকার মিত্র এবং দক্ষিণ ইয়েমেনে আমেরিকার প্রতি অনুগত ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ঘ. ইরান ও সিরীয় সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ পুরনো; বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে প্রথম ইন্তিফাদার সময় থেকে এ সম্পর্ক বিদ্যমান। এরপর থেকে সিরিয়ার মুসলিমদের দমন-নিপীড়ন করার ক্ষেত্রে ইরান সিরীয় সরকারকে সহায়তা করে আসছে যাতেকরে মার্কিন দালাল আসাদ পরিবারকে সমর্থন দিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনা নিরবিচ্ছিন্ন রাখা যায়। সিরিয়ার শাসক বাথ পার্টি একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী পার্টি, একথা জানা সত্ত্বেও ইরান সিরিয়ার শাসক পরিবার ও দলকে সাহায্য করেছে। বাথ পার্টির শাসন ব্যবস্থা সাদ্দাম হোসেনের শাসন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর সাথে ইরান যুদ্ধ করেছে। যদিও ইসলামের সাথে এই যুদ্ধের কোন সম্পর্ক ছিল না, বরং সাদ্দাম ইসলাম ও তার নিজের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সাদ্দাম আমেরিকার সাথে যুক্ত এটি খুব সচেতনভাবে জেনে ইরান এই যুদ্ধ করে। ইরান মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসেনি এবং যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে বরং এর উল্টো কাজটিই করেছে; অপরাধী কুফর সরকারের জন্য বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে এবং ইরান অব্যাহতভাবে এরূপ করে আসছে। ইরান সরকার সিরীয় নেতৃবৃন্দের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখে এবং এর মধ্যে রয়েছে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। আসাদ সরকারকে সমর্থন দিতে ইরান প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সিরিয়ার জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে হ্রাসকৃত মূল্যে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করেছে। আসাদ সরকার যখন পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তখন সিরীয় জাগরণে ইরানি হস্তক্ষেপের মধ্যে এ ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্কের ছাপ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ইরান হস্তক্ষেপ না করত, ইরানি হিজবুল্লাহ্’র সৈন্যবাহিনী ও ইরানের প্রতি অনুগত মালিকি’র মিলিশিয়া প্রেরণ না করত, তাহলে ইতিমধ্যে বাশার এবং তার সরকারের পতন হয়ে যেত। কুসায়ের ও হোমসের গণহত্যা এবং আজকে আল-ঘাওতায় রাসায়নিক হামলাসহ অন্যান্য ঘটনা থেকে ইরানের এ হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়।
ঙ. আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে বলা যায়, ইরান আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্ব সমর্থন করেছে। কারজাইকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসিয়ে আমেরিকা কর্তৃক গঠিত সরকারের গৃহীত সংবিধানকেও ইরান সমর্থন দিয়েছে – এসবই আমেরিকার প্রতি ইরানের সেবা প্রদানের নমুনা। যখন আমেরিকা তালেবানদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন ইরান আফগানিস্তানের উত্তর অংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি উল্লেখ করে যে, ‘যদি আমাদের সৈন্যরা তালেবানদের সাথে যুদ্ধ না করত, তবে আমেরিকা আফগানিস্তানের পাক খাওয়া জলাভূমিতে ডুবে যেত’ (আল-শারক আল-আওসাত পত্রিকা, ৯/২/২০০২)। আবুধাবিতে ১৩/১/২০০৪ তারিখে অনুষ্ঠিত উপসাগর ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ শীর্ষক কংগ্রেসে সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট খাতামি’র আইন ও সংসদ বিষয়ক উপপ্রধান মোহাম্মদ আলি আবতাহি বলেছিল, ‘যদি ইরান সহায়তা না করত, কাবুল ও বাগদাদের কখনই সহজে পতন হত না।’ (ইসলাম অনলাইন নেট, ১৩/১/২০০৪)
নিউইর্য়কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানকালে ২৬/৯/২০০৮ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদও একই ধরনের বক্তব্য দেয়। সেখানে সে বলে, ‘ইরান আফগানিস্তান বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এই সহযোগিতার বিনিময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর সরাসরি হুমকি প্রদান করছে। ইরাকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও আমাদের দেশ আমেরিকাকে সহায়তা প্রদান করেছে।’
৪) পরমাণু কর্মসূচীর ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বছরের পর বছর ধরে এটি একটি জায়গায় স্থবির হয়ে আছে, যদিও ইহুদী রাষ্ট্র ইউরোপের সমর্থন ও প্রণোদনা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে একাধিকবার এ প্রোগ্রামে আক্রমণ চালানোর হুমকি দিয়ে আসছে। আমেরিকা ইহুদী রাষ্ট্রের এ প্রচেষ্টায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে ও তাকে তা করতে বাধা প্রদান করছে। আজ পর্যন্ত আমেরিকা বাধা প্রদান করে আসছে… ১২/৮/২০১৩ তারিখে মার্কিন চীফ অব স্টাফ জেনারেল মার্টিন ডেম্পসে এ উদ্দেশ্যে ইহুদী রাষ্ট্র সফর করে এবং এর উপর ভিত্তি করে একই তারিখে কুয়েতি কুনা এজেন্সি ইসরাইলের সেনাবাহিনীর রেডিও চ্যানেলের বরাত দিয়ে একটি খবর প্রচার করে, ‘আমেরিকান বিমান বাহিনীর কমান্ডার মার্ক ওয়েলচ ইসরাইলে সপ্তাহব্যাপী একইরকম গোপন সফর শেষ করার কিছুদিনের মধ্যেই ডেম্পসির সফর শুরু হয়।’ সফর উপলক্ষ্যে উভয়পক্ষ চলমান গবেষণামূলক কাজ সম্পর্কে কথা বলা থেকে বিরত থাকে। আমেরিকার অনুরোধে এ অঞ্চলে ব্যাপক অস্থিরতা ও ইরানে আঘাত হানার ব্যাপারে ইসরাইলি পরিকল্পনার কারণে ওয়েলচের সফর গোপন রাখা হয়। কুনা এজেন্সি আরও জানায়, ‘বিশ্লেষকগণ বিশ্বাস করে যে, হাসান রুহানি ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে একটি সুযোগ দিতে নিকট ভবিষ্যতে ইসরাইল যাতে ইরানের বিরুদ্ধে কোন নাটকীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে সে ব্যাপারে আমেরিকান সেনাবাহিনীর কমান্ডারগণ তাদেরকে বুঝাবে।’
সাদ্দামের সময়ে ১৯৮১ সালে নির্মাণাধীন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে হামলা চালাতে ইহুদী রাষ্ট্রকে আমেরিকা অনুমতি দিলেও শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করা ইরানের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোতে আক্রমণ করতে সে বাধা প্রদান করে; যা থেকে বুঝা যায়, এ অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থে নিয়োজিত ইরানি সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তা করা হচ্ছে। ভীতি সঞ্চার করার মাধ্যমে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উপর আমেরিকার প্রভাব বজায় রাখতে আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইরানকে নিবারক (deterrent) হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আমেরিকা মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখতে ইরানকে ব্যবহার করে।
একটু আগে ফিরে যাই; ২০০৩ সালে সংলাপ শুরুর সময় থেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচীর ব্যাপারে আমেরিকা কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বদলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতি মনোযোগী হয়। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতাশ হয় ও ইসরাইল উষ্মা প্রকাশ করে। সংলাপ চলাকালে আমেরিকা প্রত্যেকবার সমস্যার সমাধানকল্পে সামরিক নয় বরং আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার প্রস্তাব দিয়েছে। ‘ইসরাইলি’ শঙ্কাকে প্রশমিত করতে আমেরিকা উপর্যুপরি হস্তক্ষেপ করেছে, কারণ আমেরিকা ইরান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চায় এবং নিউক্লিয়ার ইস্যুকে জিইয়ে রেখে পারমাণবিক বোমা উৎপাদন পর্যন্ত পৌঁছতে চায়। ইতোমধ্যে এ সমস্যাটি মোটেও সমাধান করা যায়নি, বরং আমেরিকা এটিকে জিইয়ে রেখেছে যাতে করে একজন ত্রাসসৃষ্টিকারী (অর্থাৎ ইরান) অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে ভয় দেখাতে পারে এবং উপসাগরে আমেরিকান সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি অব্যাহত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
এভাবে ব্যবহার করা ছাড়াও, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র মোকাবেলা করা ও এ থেকে রক্ষা করার ছুতোয় তুরস্ক ও মধ্য ইউরোপে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে যাচ্ছে আমেরিকা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৃদ্ধির ন্যায্যতার ক্ষেত্রে এ যুক্তিটি শীর্ষে রয়েছে।
৫) আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে শত্রুতার ব্যাপারে বাহ্যিকভাবে যা দেখা যায়, তা বুঝতে হলে নিম্নের বিষয়গুলোর দিকে আলোকপাত করতে হবে:
ক. বিপ্লবের আগে ও পরে মার্কিনবিরোধী পরিবেশ ও জনমত সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমেরিকাকে লোকদের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং শাহ ও তার নিপীড়নকে সমর্থন দেয়ায় মার্কিনীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আমেরিকাকে তখন বড় শয়তান বলা হত। সে কারণে ইরানের শাসকেরা দু’পক্ষের মধ্যকার আলোচনা পুনরায় শুরু করা ও পরবর্তীতে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি সরাসরি ঘোষণা করতে পারেনি। বিশেষ করে প্যারিসে খোমেনীর সাথে আমেরিকার বৈঠকের কথা, খোমেনীর বিপ্লবে ইরানী সেনাবাহিনী যাতে হস্তক্ষেপ না করে সে ব্যাপারে আমেরিকার চাপ প্রয়োগ করার কথা…এসব গোপন কিছু নয়, সে কারণে আমেরিকার সাথে বসার জন্য ইরান সরকারের অভিনব ঘটনার প্রয়োজন ছিল। ১০/৪/১৯৭৯ সালে আমেরিকান দূতাবাসে জিম্মি ঘটনা সংঘটিত হয় এবং সে কারণে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এর মাধ্যমে খোমেনি আরও শক্তিশালী হয় এবং প্রতিপক্ষকে আঘাত করা ও ইরান-আমেরিকা সম্পর্কের বাস্তবতাকে আড়াল করা সম্ভবপর হয়। পরবর্তীতে আমেরিকান উৎসসমূহ উল্লেখ করে যে এটি ছিল একটি পরিস্কার আমেরিকান নাটক। হাসান বনি সাদরও আল জাজিরার সাথে পূর্বে উল্লেখিত সাক্ষাৎকারে একইরকম কথা বলে, ‘সেটি ছিল আমেরিকানদের সাথে একরকম চুক্তি ও তাদেরই পরিকল্পনা এবং খোমেনী তাকে বুঝানোর পর সে এ ব্যাপারে একমত হয়।’ ২০/১/১৯৮২ সালে উভয়পক্ষ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যাকে আলজিয়ার্সের সম্মতিপত্র বলা হয় এবং এর মাধ্যমে জিম্মিরা ছাড়া পায়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিগ্যান যেদিন ক্ষমতায় আরোহণ করে সেদিন জিম্মিরা মুক্ত হয় এবং চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমেরিকা কার্যত খোমেনীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে মেনে নেয়। চুক্তির মাধ্যমে উভয় পক্ষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং এক পক্ষ অপর পক্ষের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না তা নিশ্চিত হয়। চুক্তিতে আরো বলা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরবর্তীতে নতুন সরকারের অনুরোধে ইরানের বাজেয়াপ্ত হওয়া সম্পদ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার আমেরিকা ফেরত দেয়…
খ. বহুদিন ধরে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার মত পরিবেশ সৃষ্টি করতে ইরানের শাসকগণ কাজ করে আসছে। যদিও ইরানি কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুসারে তাদের মধ্যে গোপন সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রয়েছে ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, এবং এখনও তারা তা অব্যাহত রেখেছে… যেন বর্তমান পরিস্থিতি উভয় পক্ষকে লাভবান করে। আর, আমেরিকার সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগকে আড়াল করার জন্য ইরান তাদের সাথে শত্রুভাবাপন্ন হওয়ার ভান করছে। এর মধ্যে দিয়ে বাস্তবে ইরান আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে, আমেরিকা ইরানের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং তা এ অঞ্চলে ইউরোপ ও ইসরাইলের ভূমিকাকে সীমিত রাখতে আমেরিকাকে সাহায্য করে। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে ইরানবিরোধী মনোভাবের কারণে আমেরিকা এ অঞ্চলে চতুরতার সাথে নিজ স্বার্থ হাসিল করতে পারে। শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ ইরানিদের দ্বারা আমেরিকার দালাল হিসেবে অভিযুক্ত হয়, যেমন: প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট বানি আল সদর। সে সময় আমেরিকার সাথে সম্পর্কের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত বিদ্যমান থাকায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানির সাথে আমেরিকার সম্পর্ককে ইরান-গেট এবং ইরান-কন্ট্রা নামে অভিহিত করা হলেও সে সময় এরূপ বিরোধিতা না থাকায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়নি। মাঝে মাঝে সংস্কারপন্থী ও মধ্যপন্থী এবং রক্ষণশীল ও মৌলবাদী হিসেবে প্রেসিডেন্টরা অভিহিত হলেও এবং শাস্তি পেলেও ইরানের নীতিতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখা যায়নি। যদিও আমেরিকার বিরুদ্ধে কেউ কখনও কঠিন বক্তব্য বা কখনও হালকা বক্তব্য দিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের কাজ কখনই সেসব বক্তব্যের অনুগামী নয় এবং সেসব বক্তব্য বাস্তবে প্রতিফলিতও হয়নি। একইভাবে ইরানের প্রতি মার্কিন অবস্থানও পরিবর্তিত হয়নি, যদিও রিপাবলিকানদের থেকে কঠিন বক্তব্য পাওয়া গেছে ও ইরানকে তারা শয়তানের অক্ষশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং ডেমোক্রেটদের থেকে নমনীয় বক্তব্য পাওয়া গেছে। কিন্তু আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর ও চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যখন প্রেসিডেন্ট রুহানি নতুন সরকার গঠন করে, তখন সে বলে, ‘তার সরকার হুমকি ও উত্তেজনা রোধ করাকে পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে গ্রহণ করবে’ (রয়টার্স, ১২/৮/২০১৩)। রুহানি ‘জাতিসংঘে ইরানের সাবেক দূত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষিত এবং ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে অবনতিশীল সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গোপন সমঝোতার আওতায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিলে অপরিহার্য অংশগ্রহণকারী মুহাম্মাদ জাওয়াদ সারিফকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে’ (রয়টার্স, ১২/৮/২০১৩) নিয়োগ দেয়। রুহানি নির্বাচিত হবার পর আরও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, ‘আমরা ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি দেখতে চাই না। প্রজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, উভয় দেশকে ভবিষ্যত নিয়ে আরও বেশী চিন্তা করা উচিত এবং অতীতের সমস্যাসমূহ নিরসন করা ও সঠিক সমাধানের জন্য এক সাথে বসার চেষ্টা করা উচিত’ (রয়টার্স, ১৭/৬/২০১৩)। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা এর উত্তরে তাকে বলে, ‘ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগকে পুরোপুরি প্রশমিত করতে একটি কূটনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইরান সরকারের সাথে সরাসরি সংলাপে বসতে প্রস্তুত’ (একই সূত্র)। এর অর্থ হল ইরান আমেরিকার সাথে গোপনে কাজ করার অধ্যায়ের ইতি টানতে চায় এবং খোলাখুলি কাজ করার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে; কিন্তু ভিন্নরূপে, যাতে সে আঞ্চলিক বিষয়ে সম্পর্ক নিরূপক হিসেবে আঞ্চলিকভাবে একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠে।
৬) উপরের আলোচনা থেকে আমরা যে উপসংহারে আসতে পারি তা হল:
শাসনের জন্য আনুষ্ঠানিক মতবাদ হিসেবে ইরান যা উল্লেখ করেছে সেটিকে সে একটি বার্তা বা পরিকল্পনা হিসেবে তুলে ধরেনি এবং এ মতবাদের ভিত্তিতে সে সরকার গঠন করেনি কিংবা সংবিধান প্রণয়ন করেনি এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদসমূহও এর ভিত্তিতে নয়। বরং শাসনব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক ও নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত সংবিধানের মূল ধারাসমূহ নেয়া হয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে, যা সৌদি শাসনব্যবস্থার মত যেখানে সে অঞ্চলের প্রচলিত মতবাদ হাম্বলী মাযহাবকে শাসকেরা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইরানের পররাষ্ট্রনীতি এ অঞ্চল, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে। উদাহরণস্বরূপ, এক দশকেরও বেশী সময় ধরে ইরাক ও আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখতে ওয়াশিংটনকে ইরান সহায়তা করেছে এবং এছাড়াও লেবাননে তার হিযবের মাধ্যমে সে রাজনৈতিক প্রভাববলয়কে বিস্তার করেছে। সাম্প্রতিককালে আল-আসাদকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে সিরিয়াতে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে জোটবদ্ধ হয়েছে। সুতরাং ইরাক, আফগানিস্তান, লেবানন ও সিরিয়াতে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় ইরান কাজ করছে। এ অঞ্চলের বাইরে আমেরিকা ইরানের আচরণকে সফলভাবে ব্যবহার করে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলকে ভারসাম্যহীন নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ করে এবং ইরান ভীতিকে কাজে লাগিয়ে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে।
ইরান আমেরিকার সাথে একই পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং সে সব কিছু বুঝে এই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরান তার সীমা সম্পর্কে অবগত এবং সে কারণে তা অতিক্রম করে না; এমনকি চতুরতার আশ্রয় নিতে বা সত্যকে ঢেকে রাখতে যদি উঁচু গলায় কথা বলতে হয় তখনও – যেমনটি ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়াতে আমেরিকার জন্য ব্যাপক আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসা আহমাদিনেজাদের সময় ঘটেছিল। সে কারণে আমেরিকা তার স্বার্থ পূরণে ইরান সরকারকে এমন সেবাদাস হিসেবে দেখতে পায় যে, মার্কিন সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী চক্র এ সরকারকে পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পায় না। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে তারা এরকমই ঘোষণা করে যখন একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে ইরান ও আমেরিকার সম্পর্ক ও এটি কেমন হওয়া উচিত সে ব্যাপারে রবার্ট গেটস বলে, ‘কেউই ইরানের সরকারকে পরিবর্তন করতে চায় না… আমরা নীতি ও আচরণের পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করতে চাই, যাতে করে সে এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য অস্থিরতা ও ত্রাসের কারণ না হয়ে সুপ্রতিবেশী হতে পারে।’
৪ শাওয়াল, ১৪৩৪ হিজরী
২১আগস্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ