কমিউনিজমের রাজনৈতিক বিবর্তন

সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদী সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদী সভ্যতা উভয়ই যখন পৃথিবীর আলো বাতাসে টিকে ছিল, তখন এই দুই সভ্যতার মধ্যকার পার্থক্য বোঝার উপায় স্পষ্ট ছিল। কালক্রমে বস্তুবাদী সভ্যতার পতন হলো-পৃথিবীর আলো বাতাস ছেড়ে সেটা ঠাঁই করে নিল সচেতন বস্তুবাদীদের কাগজে-কলমে পৃথিবীর দখল চলে গেল ভোগবাদীদের একক আধিপত্যে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটা ঘটতে শরু করল এরপর, যখন ভোগবাদী আর বস্তুবাদী সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য ঘুচতে লাগল আর বস্তুবাদীরা ভোগবাদী সভ্যতার গৌরবে আহ্‌লাদিত হয়ে উঠতে শুরু করল। ভোগবাদীদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে উদ্ভাবিত ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতিশীলতা’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘বৈজ্ঞানিকতার দোহাই’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা বস্তুবাদীরা ধীরে ধীরে নিজেদের ঈমান-আকীদার অংশ করে নিল এবং এখন আমরা দেখছি পশ্চিমা ভোগবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের নতুন প্রজেক্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে (WAR ON TERRORISM) বস্তুবাদীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে তত্ত্বে, ভাষণে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের আন্তরিক (?) সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদীদের রাজনীতি- বিশেষত মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে – টিকে আছে, তাদের নিজেদের চিন্তা-আদর্শের ধারে নয়, জনসমর্থনের ভারেও নয়, বরং তা ভোগবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের সচেতন কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদেরই চাপিয়ে দেয়া রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে নির্বিঘ্ন রাখার জন্যে।

বাংলাদেশে বস্তুবাদী বামরাজনীতির প্রধান ক্ষেত্র উচ্চশিক্ষার বিশেষতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে তার পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমাজ, রাজনীতি, জীবন, সংসার সবকিছুকে সামনে রেখে চিন্তাভাবনা, গবেষণা, বিশ্লেষেণ করা সহজ ও সুবিধাজনক এবং রাজনৈতিক ফলে অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল ও সামাজিকভাবে ভারসাম্যহীন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের উক্ত উপাদানগুলোর উপযোগী উপস্থিতির কারণে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সচেতনতা ও কর্মকাণ্ড যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। সাম্রাজ্যবাদীদেরও খুব স্বাভাবিকভাবে বস্তুবাদী রাজনীতির চাষের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণকেই ‘বীজতলা’ হিসাবে বেছে নিয়েছে। সুবিধাবাদী রাজনীতি ও অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের ফল স্বরূপ দেশময় বিস্তৃত নানা রূপের শোষণ নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে কাল্পনিক সাম্যবাদ আকর্ষণীয় তত্ত্ব বটে। তার উপর পাশ্চাত্যের কাঙ্ক্ষিত ছাঁচে তৈরী রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুকরণ প্রিয় রাষ্ট্রপরিচালকদের সুদীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র চালনা আর লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষাহীন রাজনীতির ফলে সৃষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার মধ্যে স্বতঃ চিন্তাশীল তারুণ্যের জন্য অবলম্বন হিসেবে ধরা দেয় ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’, ‘বিজ্ঞান চেতনা’, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’, ‘বিবর্তনবাদ’ ইত্যাদি আপাতঃ ভারী ভারী তত্ত্ব। কিন্তু জ্ঞানগর্ভের এসব তত্ত্বের বাস্তবায়ন হয় বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতির নয়া মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিত- ইসলাম বিরোধীতার মাধ্যমে। ভারতীয় আধিপত্যবাদী ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের আশ্রিত মিডিয়া বিশেষের ‘প্রগতিশীলতা’র বাহ্বা পেয়ে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের অধিকাংশই টিকে থাকে আর বেড়ে উঠতে থাকে এক জন কার্যত ভোগবাদী বুর্জোয়া রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক তল্পিবাহক হিসেবে, যদিও আলোচনার টেবিলে সে পুরোদস্তুর ‘সাম্যবাদী’ কর্মী, নিজের পুস্তকি চিন্তা- আদর্শের প্রমাণ দিতে গিয়ে যে কল্পিত তত্ত্বের দায় ঠেকাতে নিজেদের উদ্ভাবিত গণ্ডীবদ্ধ চিন্তার তর্ক হাজির করে যার সবটাই অতিরিক্ত পরিমাণে অবাস্তব তত্ত্ব পড়ার বদহজম।

‘বীজতলা’ ছেড়ে যখন সমাজ-রাষ্ট্রের মূল জমিতে হাজির হয় তখন তারা কল্পিত তত্ত্ব ও বাস্তব দুনিয়ার পার্থক্য বুঝতে পারে। এখানে পুস্তকি তত্ত্বের আলোচনার টিবিলটা আরো ছোট, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাঠ-ময়দান আরো ব্যাপক এবং বর্তমান বাস্তবতায় মেরুকরণ আরো প্রকট। নতুন বাস্তবতায় স্বল্প সংখ্যক সমাজতন্ত্রী সততার বশে ঝাপসা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে আন্দোলন চালিয়ে যান। অধিকাংশই পৃথিবীর বাস্তবতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। তাই করতে গিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্বের লেজ খসে পড়ে; কাল্পনিক সাম্যবাদী তত্ত্বের লোম ঝরে যায়; মাথায় শুধু থেকে যায় ইসলাম বিদ্বেষের শিং, নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে টিকে থাকতে সেটার গুরুত্ব অপরিসীম। এভাবে বিবর্তিত হয়ে তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রী নতুন ফসল হিসেবে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘরে ওঠে। এখন নতুন জীবনের রূপ- রস- গন্ধে, নতুন তত্ত্বের ডিগবাজিতে তাদের পথ- পন্থা বদলে যায়, একবিংশ শতাব্দির রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদে তাদের এক সময়কার শ্রেণীশত্রু বুর্জোয়া রাজনীতিকরা এখন তাদেরই রাজনৈতিক বন্ধু বনে যায়, আর বিবর্তিত সমাজতন্ত্রী তার দ্বান্দ্বিক চেতনার দাবি মেটাতে শত্রু হিসেবে বেছে নেয় সাম্রাজ্যবাদীদের ঘোষিত শত্রু ‘ইসলাম’ কে। এখনকার সময়ে ভোগবাদী ও বস্তুবাদী রাজনীতিক কিংবা বুদ্ধিজীবীদের আর আলাদা করে চিনবার উপায় নেই। ইসলাম বিদ্বেষই উভয়ের তথাকথিত প্রগতিশীলতা ও বুদ্ধিজীবীকার মূল সনদ। শুধু রাজনীতি নয় সমাজের যে ক্ষেত্রেই যাক্‌ না কেন এসব বিবর্তিত সমাজতন্ত্রীরা তাদের তত্ত্বের বাকীসব চরিত্র হারিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সুর মিলিয়ে ক্রমাগত মৌলবাদ বিরোধিতার নামে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ায় আর ইসলামের যে কোনো চিহ্ন দেখামাত্রই তাকে জোর গলায় ‘জঙ্গি’, ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ব পুঁজিপতিদের বাহ্বা কুড়ায়। সাংবাদিক ও কলামিস্ট সঞ্জীব চৌধুরীর ভাষায় ” আরো কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক ‘মুক্তমনা’ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী শিখে ফেলেছেন যে, দাঁড়ি-টুপি ওয়ালা মুসলমানদের জঙ্গি বলে কষে গালি দিতে পারলে বিদেশি শক্তিমানদের দরবারে সুগন্ধি তামাক দিয়ে সাজানো কল্কে পাওয়া যায়।” বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা সত্যায়িত প্রগতিশীল ধারার পত্রিকাগুলোর কর্ণধার এক এক জন এমনি বিবর্তিত সমাজতন্ত্রী। পাশ্চাত্যের তোষণে, ভারতের পোষণে টিকে থাকা প্রগতিশীলতার প্রলেপ লাগানো বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এবং সাম্যবাদী তত্ত্বের শেষে গন্ধটুকু পর্যন্ত দূর করতে আধুনিকতার তেলে ভাজা তথাকথিত সুশীল সমাজও এ ধরনের বিবর্তিত সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত। কেউ কেউ নতুন পরিবেশের প্রতিযোগিতায় নিজেদের জন্য সুবিধাজনক স্থান বেছে নিতে চায় না বা পারে না। তারা অধিকাংশই স্থায়ীভাবে বুর্জোয়া রাজনীতির সাংস্কৃতির তল্পিবাহক হয়ে থেকে যায়। তারা নিজেদের মুক্তমনা, উদারপন্থী, সংস্কৃতিমনা হিসাবে সাজাতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের ধ্যান-ধারণাগুলোকে নানা রূপে, ছন্দোবদ্ধ ছলাকলায় হাজির করে আর গাঁজার কল্কিতে বিপ্লবী টান দিয়ে এক সময়কার সাম্যবাদী রাজনীতির স্মৃতি রোমন্থন করে। এসব বিবর্তিত সমাজতন্ত্রীরা যেখানেই থাক তাদের একটি মাত্র মূল চরিত্র টিকে থাকে, আর তা হলো ইসলাম-বিদ্বেষ। কথায়, কাজে, লেখায়, তত্ত্বে, তর্কে, সবক্ষেত্রে তারা ইসলাম বিরোধিতা করে নিজেদের জ্ঞান গরিমার প্রকাশ ঘটায়।

বিজয়ী সভ্যতাকে সাধারণ দৃষ্টিতে সব সময় অবিনাশী মনে হলেও পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও তার মধ্যদিয়ে সভ্যতা পরিবর্তনের ইতিহাস। বস্তুবাদী সভ্যতার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে গেলেও বহমান ভোগবাদী সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতারও পতন অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর মানুষের জন্য পরবর্তী সভ্যতা, জীবন ব্যবস্থা কী হবে? বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বলা যায় সেটা হবে ইসলাম। এটা শুধু বর্তমান পৃথিবীতে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যমানতা থেকে নয় বরং আধিপত্যের শিখরে থাকা পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকদের ইসলামের প্রতি আচরণ থেকেই বুঝা যায়।

WAR ON TERRORISM এর নামে সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামকেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে। NATO’র সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল Willie Class এর ভাষায় “The alliance has placed Islam as a target for its hostility in place of the Soviet Union”। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন “The militants believe that controlling one country will Muslim masses, enabling them to overthrow all moderate governments in the region, and establish a radical Islamic empire that spans from Spain to Indonesia” এখানে Militants হিসেবে যাই বুঝানো হোক না কেন মার্কিন শক্তির মূল ভয়টা যে ইসলামি সভ্যতার পুনর্জাগরণের- প্রেসিডেন্ট বুশের ভাষায় যা স্পেন থেকে ইন্দোনেশিয়া ব্যাপী বিস্তৃত কট্টরপন্থী ইসলামি সাম্রাজ্য-তা সহজেই বুঝা যায় কিংবা প্রায় একই সময়ে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের দেয়া ভাষণ They demand the elimination of Israel; the withdrawal of all westerners from Muslim countries, irrespective of the wishes of people and governments; the establishment of effectively taleban states and sharia law in the Arab world en route to one caliphate of all Muslim nations – এখানেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মূল ভয় ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান যা মূলত খিলাফত ব্যবস্থা যদিও ব্লেয়ার সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সেটাকে তালেবান রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করেছেন। ইরাক হামলার পূর্বে দেয়া ভাষণে Donald Rumsfled বলেছিলেন Iraq would serve as the base of a new Islamic Caliphate to extend throughout the middle east which would threaten the legitimate government in Europe, Africa and Asia. This is their plan. They have said so. We made terrible mistake if we fail to listen and learn – এখানেও তাদের ইসলামি খিলাফতের উত্থানের ভয় স্পষ্ট। সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝতে ও শুনতে ভুল করে নি। তারা তাদের সভ্যতার প্রধান শত্রু হিসেবে ক্রমবর্ধমান ও ক্রম উত্থানশীল ইসলামি সভ্যতাকে বেছে নিয়েছে। শুধু ভাষণে নয়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বর্তমানে তার বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি ক্রমাগত সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। আর এ কাজে তারা যথারীতি তাদের কাছে সদ্য পরাজিত বস্তুবাদী সভ্যতার নেতা-কর্মীদের যথাযথভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে। বস্তুবাদীদের- নিজেদেরই উদ্ভাবিত তত্ত্বানুযায়ী- তাদের সাথে পুঁজিবাদীদের মূল বিরোধিতা যেহেতু অর্থনৈতিক, কাজেই সাম্রাজ্যবাদীরা খুব সহজেই তাদের এসব দুর্বল শত্রুদের মুসলিম দেশগুলোতে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি বজায় রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এবং সেটাই করে তারা এসব দেশের পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদী সমাজ কাঠামোর Immunity বাড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বের রাজনীতির বাস্তবতায় সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদীদের নতুন শত্রু ইসলামের মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদীদেরই দেয়া ভ্যাকসিন হিসাবে কাজ করছে (ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে মূলত নির্দিষ্ট জীবাণুকে মৃত বা দুর্বল করে মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় যা ঐ মানুষের শরীরের Immunity বাড়িয়ে দেয় ফলে পরবর্তীকালে শক্তিশালী অ সক্রিয় জীবাণু ঐ শরীরে বংশ বিস্তার করতে পারে না)। পুঁজিতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদীরা একসময় তাদের শত্রু সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে ঠেকানোর জন্য তৎকালীন তালেবান সরকারকে সহযোগিতা করেছিল, এখন তারা বিশ্বব্যাপী ইসলামের রাজনৈতিক উত্থানকে স্তব্ধ করার জন্য বস্তুবাদী রাজনীতির নেতা কর্মীদের, তাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, ব্যবহার করছে। এই কথাটাই বুঝা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের বক্তব্য থেকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ১৯৮৯ সালে দেয়া সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তৎকালীন এই বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে যখন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতনের পর এই মতাদর্শের কর্মীদের নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়: What about activists? রোনাল্ড রিগান বলেছিলেন “We will feed them, we will keep them alive. They will help us to fight with radicals as like radicals help us to fight the”।

সুগন্ধি তামাকের কল্কেতে যাদের আসক্তি ধরে গেছে, তথাকথিত প্রগতিশীলতার রসে যারা মজে গেছে, সুশীল, বুদ্ধিজীবী সীল গায়ে লাগানোর কিংবা টিকিয়ে রাখার স্বপ্নে যারা বিভোর হয়ে আছে তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের হাতিয়ার হয়েই থাকবে। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর হিসেবে ক্রমাগত মৌলবাদের গন্ধ খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু যে বাম রাজনীতি এক সময় গণমানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেখানে কি এখনো সৎ ও সচেতন নেতা-কর্মী নেই? যারা শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের পাতা ছক অনুসরণ করবে না, যারা শুধুমাত্র তত্ত্বে নয় উপস্থিত সমাজ ও বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতায় পরিবর্তনের সূত্র খুঁজে সঠিক পক্ষে অবস্থান নেবে?

এটা ঠিক যে, সভ্যতা পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণ বৈষয়িক জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই, ভাববাদী আদর্শের ভাবলুতায় নেই, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বিচারের জ্ঞান-গভীরতায়ও নেই এবং এটাও ঠিক যে এটা সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়া কিংবা উৎপাদনের হাতিয়ারের মধ্যেও নেই। বরং তা নিহিত থাকে পরিবর্তনশীল সমাজের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান মানুষ, জীবন ও জগৎ-সংসার সম্পর্কে ক্রিয়াশীল ধারণার মধ্যে এবং তার উপরই নির্ভর করে অর্জিত হয় বৈষয়িক জ্ঞান, গড়ে ওঠে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ, চিহ্নিত হয় শত্রু-মিত্র, নির্ধারিত হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপরেখা, ঠিক হয় উৎপাদনের হাতিয়ারসহ সকল বস্তুগত অধিকরণের নিয়ম নীতি আর অধিকারীর কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ। বস্তুবাদীরা যখন বলেন “The final causes of social changes and political revolution in society are to be sought, not in men’s brain, not in means better insight into eternal truth and justice, but in the means of production and exchange (Engels)” – সেটাও মূলত তাদের বস্তুবাদী দর্শন থেকে উদ্‌গত সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব। বস্তুবাদী দর্শন-ই বস্তুবাদী সভ্যতার রূপরেখা, নিয়ম-নীতি, সমাজ-কাঠামো, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি ঠিক করে দেয়। একইভাবে পুঁজিতান্ত্রিক ভোগবাদী সভ্যতা ও তার সমাজের রূপরেখা, নিয়মনীতি, সমাজ কাঠামো, ন্যায় অন্যায়ের বোধ ঠিক করে দেয়। মানুষ, জীবন ও জগৎ-সংসার সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা ও তার ভিত্তিতে তৈরী সমাজ-কাঠামো, নিয়ম-নীতি, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি, সামাজিক সম্পর্কের সূত্র, সাংস্কৃতিক উপরি-কাঠামো, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্য-কলাপের পথ পন্থা- এ সবকিছুই ‘ইসলাম’ তার নিজস্বতার ভিত্তিতেই দেয়। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের কথিত ‘Evil Empire’ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতনের পর তার উত্তরসূরী বুশ-ব্লেয়ারদের চিহ্নিত নতুন ‘Evil Ideology’ হচ্ছে উদীয়মান জীবনাদর্শ ইসলাম। এই বোধটুকু বুঝে, শুনে, নিরপেক্ষ চিন্তা ভাবনায়, বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে গেলে বস্তুবাদীদের বেশ খানিকটা সৎ সাহসের দরকার আছে। আর সেটাকে উপেক্ষা করে শুধু ইস্যু ভিত্তিক কিছু কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার মধ্যদিয়ে যদি তারা আশা করেন যে, একসময় সাম্রাজ্যবাদ দূর হয়ে বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা, সমাজ কাঠামো তৈরি হয়ে যাবে তাহলে তা ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দেয়ার মতো হবে এবং তাতে আঞ্চলিক আদিপত্যবাদী, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দেয়া নানান খেতাবে, ‘লোকে যাতে বুদ্ধিমাসন বলে হঠাৎ ভ্রম করতে পারে’ এতটুকু বুদ্ধির জোরে খেতাব দাতাদের যথেষ্ট উপকার করা হবে কিন্তু দেশ ও দশের মুক্তির দিক নির্দেশনা দেয়া যাবে না।

Leave a Reply