[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
সমস্ত আরব উপদ্বীপের জনগোষ্ঠী দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করার পর এবং আরব ভূখন্ড থেকে মূর্তিপূজা নিশ্চিহ্ন হবার পর আল্লাহর রাসূল (সা) ইন্তিকাল করেন। এ সময় সমস্ত আরব উপদ্বীপ ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত এবং সম্পূর্ন ভাবে ইসলামের আকীদাহ্ ও শাসনব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত আইন-কানুন দিয়ে শাসিত। আল্লাহতায়ালা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করা, মুসলিমদের উপর তাঁর নিয়ামতকে সম্পূর্ন করা এবং দ্বীন ইসলামকে তাঁর পছন্দনীয় জীবনব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করার পরই রাসূল (সা) ইন্তিকাল করেন। এর মধ্যে প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর রাজা ও শাসকবৃন্দের কাছে দূত পাঠিয়ে এ অঞ্চলের জনসাধারণকে ইসলামের দিকে আহবান করা এবং মু’তাহ ও তাবুকের প্রান্তরে সৈন্যদল পাঠিয়ে রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করাও অন্তর্ভূক্ত ছিল।
এরপর খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও এ বিজয় অভিযাত্রা চলতে থাকে। খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় সর্বপ্রথম ইরাক জয় করা হয় এবং এ সময় এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ছিল পারস্য ও আরব জাতির মিশ্রণ; যারা খ্রিষ্টান, মাযদাকিয়া এবং জরুষ্ট্রিয়ান ধর্মে বিশ্বাস করতো। এরপর, জয় করা হয় পারস্য এবং তারপর আল-শাম অঞ্চল। পারস্য অঞ্চলে জরুষ্ট্রিয়ান, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী লোকেরা বসবাস করতো এবং পারসিকরা এ অঞ্চল শাসন করতো। অপরদিকে, আল-শাম ছিল রোমানদের উপনিবেশ যেখানে রোমান সংস্কৃতি ও খ্রিষ্ট ধর্মের প্রাবল্য ছিল। এ অঞ্চলে প্রধানত সিরীয়, আর্মেনীয়, ইহুদী, আরব এবং স্বল্প সংখ্যক রোমান বসবাস করতো। এরপর, মুসলিমরা মিশর জয় করে এবং এ অঞ্চলেও কপ্ট, ইহুদী এবং রোমান জাতির লোকেরা মিশ্রিত ভাবে বসবাস করতো। এরপরের পালায় বিজিত হয় উত্তর আফ্রিকা, যেখানে আফ্রিকার বার্বার জাতি রোমানদের শাসন-কর্তৃত্বের নীচে বসবাস করতো। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে উমাইয়াদের শাসনামলে সিন্ধ, খাওয়ারিজম এবং সমরকান্দ জয় করে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত করা হয়। এ সময়েই আল-আন্দালুস জয় করা হয় এবং একে ইসলামী রাষ্ট্রের একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়।
এ সমস্ত বিজিত অঞ্চলের মানুষেরা ছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর; তাদের ছিল বিভিন্ন ধরনের ধর্মবিশ্বাস, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, প্রথা ও আইনকানুন। স্বাভাবিক ভাবেই তারা মানসিক ও আচরনগত দিক থেকে একে অন্য থেকে ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সুতরাং, এ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মবিশ্বাসের মানুষকে একটি নির্দিষ্ট জীবনব্যবস্থা, ভাষা, সংস্কৃতি ও আইনকানুন দিয়ে শাসন করে তাদের একটি একক জাতিতে পরিণত করা ছিল সত্যিকারের একটি ব্যাপক ও দুরূহ কাজ এবং এ কাজে সফলতা অর্জন করা ছিল অসাধারন ও বড় মাপের সাফল্য। কিন্তু, ইসলামী জীবনাদর্শের মাধ্যমে বিরাট এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এবং (পৃথিবীর ইতিহাসে) এ সফলতা অর্জন করেছে শুধু ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামের পতাকাতলে এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থার নীচে আসার সাথে সাথেই তারা (বিজিত জনগোষ্ঠী) এক উম্মাহ্ বা জাতি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে; আর তা হল মুসলিম উম্মাহ্। বস্তুতঃ ইসলামী আকীদাহ্ এবং শাসনব্যবস্থাই ছিল অসাধারন এ সাফল্যের মূলভিত্তি। ভিন্ন ধরনের এই সব জনগোষ্ঠীকে সফলতার সাথে একটি জাতিতে পরিণত করার পেছনে অনেক ধরনের কারণ রয়েছে। কিন্তু, নিম্নবর্ণিত কারণগুলো এগুলোর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ:
১. ইসলামের শিক্ষা।
২. জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে এবং কাজেকর্মে মুক্ত অঞ্চলের জনসাধারণের সাথে মুসলিমদের স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করা।
৩. বিজিত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর দ্রুত ইসলাম গ্রহণ।
৪. ইসলাম গ্রহণকারীদের জীবনাচরণে আমুল পরিবর্তন এবং এর মাধ্যমে অসহনীয় জীবন থেকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনে উত্তরণ।
বস্তুতঃ ইসলামের শিক্ষা দ্বীন ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করার বাধ্যবাধকতা অর্পণ করে এবং যখন যেখানে সম্ভব এ আলোকিত বাণীকে ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। এ কারণেই জিহাদের মাধ্যমে অন্যান্য অঞ্চল বা ভূখন্ড জয় করার প্রয়োজন হয়; যেন সে অঞ্চলের মানুষেরা খুব সহজে ইসলামের আলোকিত আদর্শ এবং এর ন্যায়ভিত্তিক আইনকানুনের যথার্থতা অনুধাবন করতে পারে। ইসলাম আবার যে কোন ব্যক্তি বা জাতিকে ইসলাম গ্রহণ না করে তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার স্বাধীনতাও দেয়। এক্ষেত্রে, তাকে শুধমাত্র ইসলামের লেনদেন ও শাস্তি সংক্রান্ত বিধিবিধানকে মেনে চলতে হয়। শেষোক্ত এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এই বিষয়টিই মূলতঃ মুসলিম ও অমুসলিম জনসাধারণের কর্মকান্ডের মাঝে একাত্মতা ও বন্ধন তৈরী করে। তারা একই ব্যবস্থা দিয়ে শাসিত হয় এবং জীবনের সমস্যাগুলোকে একই ব্যবস্থা দিয়ে সমাধান করে, যা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখে। ঐক্যের এ ভিত্তিই অমুসলিমদেরকে মুসলিমদের মতোই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে সাহায্য করে। তারা তখন একই জীবনব্যবস্থার অংশীদার হয়ে এবং একই রাষ্ট্রের অভিভাকত্বের নীচে থেকে একই রকম মানসিক সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে।
এছাড়া, ইসলামের শিক্ষা শাসিত জনগোষ্ঠীকে জাতি, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে বিবেচনা না করে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতে শেখায়। এ কারণে, ইসলামের সামাজিক ও শাস্তি সম্পর্কিত আইনকানুনগুলো কোন রকম পার্থক্য ছাড়াই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর কার্যকরী করা হয়।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
“কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতা বা ঘৃনা যেন তোমাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত না রাখে; তোমরা ন্যায়বিচার কর; আর, এটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই, আল্লাহ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে খুব ভাল করে জানেন।” [সুরা মায়িদাহঃ ৮]
ইসলামী রাষ্ট্রে আইনের চোখে সকল মানুষ সমান। রাষ্ট্রের শাসক জনগণের বিষয়াদি দেখাশুনা করবে এবং জনগণকে শাসন করবে। আর, রাষ্ট্রের নিয়োজিত বিচারক (কাজী) কোনরকম পক্ষপাতদুষ্টতা ছাড়া জনগণের মাঝে বিদ্যমান বিবাদসমূহ নিষ্পত্তি করবে। এলক্ষ্যে, বিচারক প্রতিটি নাগরিককে মানুষ হিসাবে (মুসলিম বা অমুসলিম হিসাবে নয়) বিবেচনা করে তাদের সমস্যা সমাধান করবে এবং ঝগড়া-বিবাদের ফয়সালা করবে। বস্তুতঃ ইসলামী শাসনব্যবস্থাই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঝে সত্যিকারের সমতা ও ঐক্য নিশ্চিত করে।
ইসলাম শাসকদের নির্দেশ দিয়েছে যেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সহায়তায় রাষ্ট্রের সমস্ত উলাইয়াতে (প্রদেশ) বসবাসকারী মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চিত করা হয়। প্রদেশের সংগৃহীত রাজস্ব যাই হোক না কেন কিংবা সংগৃহীত সে রাজস্ব জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট হোক বা না হোক। এছাড়া, ইসলাম রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কোষাগারের জন্য বিভিন্ন উলাইয়াহ থেকে কর আদায় করে তা একত্রিত করে একটি একক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলনের নিদের্শ দিয়েছে, যেন বিজিত অঞ্চলগুলো উলাইয়াহ হিসাবে দৃঢ় ভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হয় এবং তাদেরকে একটি একক ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সহায়তা করে। বস্তুতঃ ইসলামী শাসনব্যবস্থা এরকম একটি ব্যবস্থাকে সাফল্যের সাথে নিশ্চিত করেছিল এবং এক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেছিল।
এছাড়া, বিজিত অঞ্চলগুলোর বসবাসকারী মানুষের সাথে মুসলিমদের সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা, এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ইসলাম গ্রহন করা ও মুসলিমদের সাথে তাদের একীভূত হয়ে যাবার ব্যাপারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। কোন অঞ্চল বা ভূখন্ড জয় করার পরপরই সাধারনত মুসলিমরা সেখানে বসবাস করতে আরম্ভ করত এবং সে জনগোষ্ঠীর মানুষকে ইসলাম ও ইসলামের সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করত। মুসলিমরা তাদের প্রতিবেশী হিসাবে বাস করতো, সকল কর্মকান্ডে তাদের অংশীদার হত এবং একই দেশের নাগরিক হিসাবে একই আইনকানুন দিয়ে শাসিত হত। ইসলামী রাষ্ট্রে কখনই শাসক আর শাসিত কিংবা বিজয়ী আর বিজিত হিসাবে জনসাধারণ বিভাজিত হয়নি; কিংবা, মুসলিম ও আদিবাসীরা আলাদা কোন জনগোষ্ঠী হিসাবে বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস করেনি। তারা সকলেই ছিল রাষ্ট্রের নাগরিক যারা প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে একে অপরকে সবসময় সহযোগিতা করতো। মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর এ ধরনের আচরণ বিজিত জনগোষ্ঠীর কাছে একেবারেই নতুন ছিল। বস্তুতঃ এ শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে জনগণের কাতারে রেখে তাদেরকে ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে শাসন করেছিল এবং এর ভিত্তিতেই তারা জনগণের সেবা ও তাদের বিষয়াদি দেখাশুনা করেছিল। ফলে, এ অঞ্চলসমূহের জনগোষ্ঠী অবাক বিস্ময়ে শাসকগোষ্ঠীর এমন এক আচরণের সাক্ষী হয়েছিল, যে ব্যাপারে তাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তারা উন্নত চরিত্রের শাসকদের কাছ থেকে পেয়েছিল অত্যন্ত চমৎকার আচরণ, যা তাদেরকে এই শাসকবর্গ ও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। শাসক ও সাধারন মুসলিমরা আহলে কিতাবের (ইহুদী ও খ্রিষ্টান) নারীদেরকে বিয়ে করতো, তাদের জবাই করা পশুর মাংস ও খাবার খেত। এ সকল আচরণ মূলতঃ তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে; কারণ, তারা শাসক ও শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের উপর আরোপিত ইসলামী জীবনাদশের্র প্রভাব ও সৌন্দর্য স্বচক্ষে অবলোকন করেছে। ফলশ্রুতিতে, তারা ধীরে ধীরে মুসলিমদের সাথে একীভূত হয়ে একটি একক উম্মাহ্ বা জাতিতে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইসলাম গ্রহণ করা কোন বিশেষ সময় বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং, প্রতিটি দেশের মানুষই দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছে। আসলে, বিজিত অঞ্চলগুলোতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত— মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। ফলে, পরবর্তীতে ইসলাম আর বিজয়ী মুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে বিজিত এইসব জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে মুসলিমদের সাথে একীভূত হয়েছে এবং এক উম্মাহ’তে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া, ইসলাম নও মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে উন্নততর করে তাদেরকে সামগ্রিক ভাবে পরিবতর্ন করেছিল। এর ফলে, তাদের মাঝে ইসলামী আকীদাহ্ দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কাজ করেছিল তাদের জীবনাদর্শের ভিত্তি হিসাবে। আর, এ জীবনাদর্শ থেকেই উৎসরিত হয়েছিল তাদের জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন রকম ধ্যান-ধারণা। ইসলাম তাদেরকে অন্ধ ও কুসংস্কাচ্ছন্ন বিশ্বাস থেকে তুলে এনে যৌক্তিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ পরিবর্তন তাদেরকে মূর্তিপূজা, অগ্নিপূজা, ট্রিনিটি তত্ত্ব বা তিন খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস, ব্যক্তিপূজা এবং এ জাতীয় বিভিন্ন বস্তুর উপাসনা, যা তাদের চরম বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের মূল কারণ ছিল, এগুলো থেকে এক আল্লাহ’র উপাসনার দিকে ধাবিত করেছিল। আর, এক আল্লাহ’র উপাসনাই তাদের অন্তরসমূহকে ক্রমাগত করেছিল আলোকিত। ইসলাম তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়েছিল এবং তারা কোরআন-সুন্নাহ’র বর্ণনার ভিত্তিতেই বিষয়টি অনুধাবন করেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল পরকালের পুরস্কার ও শাস্তির উপরও। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর দৃঢ় বিশ্বাস থাকায় তারা বুঝতে পেরেছিল ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। ফলে, তারা ধাবিত হয়েছিল অনন্ত-অসীম ও চিরসুখের জীবনের খোঁজে। একইসাথে, তারা এতটুকু অবহেলা না করে দু’বাহু উম্মুক্ত করে এ জীবনকে যাপন করেছিল। তারা আল্লাহতায়ালা নির্ধারিত সঠিক পন্থা ও নির্দেশনা দিয়ে জীবন যাপনের প্রতিটি সরঞ্জামকে ব্যবহার করেছিল ও উপভোগ করেছিল জীবনের আনন্দ ও প্রাচুর্য্যকে।
ইসলাম আসার পূর্বে, এ সমস্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের কর্মকান্ডের মূলভিত্তি ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্থাৎ, ব্যক্তিস্বার্থই ছিল তাদের সকল কমর্কন্ডের মূল নিয়ামক। কিন্তু, ইসলাম গ্রহনের পর তাদের কাজের ভিত্তি পরিবর্তিত হয়ে হালাল-হারামে পরিণত হয়। মূলতঃ আল্লাহতায়ালা যা কিছু আদেশ করেছেন এবং নিষেধ করেছেন সে সবকিছুর উপর গড়ে উঠা ভিত্তিই তাদের সমস্ত কাজের মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। তাদের সমস্ত কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়ে যায় আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর, কাজের মূল্য নির্ধারিত হয় কাজের পেছনে নিহিত উদ্দেশ্য থেকে। যেমনঃ যদি, কাজটি হয় নামাজ কিংবা জিহাদ, তাহলে এটি হয় আধ্যাত্মিক কাজ; যদি হয় ক্রয় বা বিক্রয় সংক্রান্ত, তাহলে এটি হয় বস্তুগত কাজ; সহমর্মিতা বা বিশ্বস্ততা হয় নৈতিক কাজ; বিপদে কাউকে সাহায্য করার বিষয়টি হয় মানবিক কাজ ইত্যাদি। মানুষ কাজের পেছনের উদ্দেশ্য এবং কাজের মূল্যের ব্যাপারে পার্থক্য করতে আরম্ভ করে। ফলে, জীবন সম্পর্কে তাদের পূর্বের সকল ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ইসলাম নির্ধারিত কাজের ভিত্তিতেই জীবনকে পরিমাপ করা হয় এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ নির্ধারিত হয়।
ইসলাম মানুষকে সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা শেখায়। ইসলাম পূর্ব সময়ে, সুখ মানুষের জৈবিক ও প্রবৃত্তিগত চাহিদা পূরণের মধ্যে নিহিত ছিল। পরবর্তীতে তা পরিবর্তিত হয়ে আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জন করাতে পরিণত হয়। আসলে, এর মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। কারণ, সুখের প্রকৃত অর্থ হলো, মানবাত্মার চিরস্থায়ী শান্তি। আর, শুধুমাত্র বস্তুগত উপকরণের মাধ্যমে জৈবিক ও প্রবৃত্তিগত চাহিদা পূরণ করে চিরস্থায়ী এ শান্তি লাভ করা কখনও সম্ভব নয়। বস্তুতঃ এ রকম সুখের নাগাল একমাত্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব।
এভাবেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া মানুষের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গীকে ইসলাম প্রভাবিত করেছে। জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের জীবনের সকল কর্মকান্ডকে আমূল পরিবর্তন করেছে। পরিবর্তন করেছে তাদের কাজের গুরুত্বের ক্রমধারাকে (Order of Priorities); Some went up in value, others came down. গুরুত্ব নির্ধারনের ক্ষেত্রে মানবজাতি সবসময়ই তার নিজের জীবনকে সবচাইতে উপরের অবস্থানে রেখেছে এবং জীবনাদর্শ এসেছে তার পরের অবস্থানে। কিন্তু, ইসলাম পুরো ব্যাপারটিকে একেবারে উল্টিয়ে দিয়েছে; ইসলাম জীবনাদর্শকে রেখেছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে, এমনকি মানুষের নিজের জীবনের চাইতেও আদর্শকে উপরের স্থান দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি বোঝার পর, ইসলামের প্রয়োজনে মুসলিমরা অকাতরে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে আরম্ভ করে এবং ইসলামী জীবনাদর্শ যে নিজ জীবনের চাইতে বহুগুণে মূল্যবান তারা এ সত্যকেও সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে শুরু করে। একইসাথে, তারা এটাও বুঝতে পারে যে, ইসলামের জন্য কঠিন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করা মুসলিমদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এভাবেই, জীবনের বিভিন্ন বিষয়গুলো সঠিক ক্রমধারা অনুযায়ী জায়গা করে নেয়। জীবন হয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত। মুসলিমরা অর্জন করে আত্মার চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তি; কারণ, তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করাই ক্ষনস্থায়ী এ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য।
এভাবে, নও মুসলিমদের জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ (Ideals) সম্পর্কে ধ্যান-ধারণাও পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতীতে এ সমস্ত মানুষের সর্বোত্তম আদর্শের ব্যাপারে ভিন্ন ধরণের এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ধ্যান-ধারণা ছিল। কিন্তু, ইসলাম গ্রহণ করার পর তারা জীবনের এক ও একমাত্র এবং চুড়ান্ত এক আদশের্র সন্ধান পেল। এর ফলে, জীবনের যে সমস্ত বিষয়গুলো তাদের কাছে খুব অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে সবকিছুর মাপকাঠিই একেবারে বদলে গেল; বদলে গেল মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অর্থ। পূর্বে তাদের কাছে মূল্যবোধের অর্থ ছিল ব্যক্তির সাহসিকতা, মার্জিত আচরণ ও শ্রদ্ধাবোধ এবং গোত্রীয় সমর্থন, বিত্তবৈভবের অহংকার, উচ্চ বংশমর্যাদা, Generosity to the point of extravagance. গোত্র বা সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য/বিশ্বস্ততা, দয়ামায়াহীন প্রতিশোধস্পৃহা এবং এই ধরণের অন্যান্য গুনাবলীর উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হত। কিন্তু, ইসলাম তাদের পুরনো এ সব ধ্যান-ধারণাকে পরিবতর্ন করে দিল। বস্তুতঃ ইসলাম এ সবকিছুকে খুবই নগন্য বিষয়ে পরিণত করলো। এ সমস্ত বিষয়ে ইসলামের বক্তব্য ছিল যে, মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এ সব বিষয় গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে পারে; তার ব্যক্তিগত লাভ বা লোকসানের উপর ভিত্তি করে নয়। কিংবা, উচ্চ মর্যাদা লাভ বা অহংকারের বশবর্তী হয়ে নয়। এজন্যও নয় যে, এগুলো বংশপরম্পরায় চলে আসা রসম-রেওয়াজ/রীতিনীতি, প্রথা কিংবা ঐতিহ্য, যাকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বরং, ইসলাম এ সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর নির্দেশের পূর্ণ আনুগত্য করাকে বৈধতা দিয়েছে। ব্যক্তিগত, গোত্রীয়, সামষ্টিক এবং জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে শুধু ইসলামের হুকুম-আহকামের কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের নির্দেশ দিয়েছে।
এভাবেই, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের মনমানষিকতা ও আচরণকে ইসলাম পুরোপুরি রূপান্তরিত করেছে; বদলে দিয়েছে তাদের ব্যক্তিত্ব এবং জীবন, মানুষ ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী। জীবনের সকল কাজ কোন ভিত্তির উপর সম্পাদিত হবে সে বিষয়ে ধ্যান-ধারণাকেও পুরোপুরি পরিবর্তিত করেছে। ইসলাম মানুষকে বুঝতে শিখিয়েছে যে, এই ক্ষনস্থায়ী জীবনের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আর তা হল, নিজেকে প্রতিনিয়ত ক্রটিবিচ্যুতি থেকে মুক্ত করে মহৎ গুনাবলীর দিকে ধাবিত করা। এছাড়া, মুসলিমরা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনকেই সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে হৃদয়ে ধারণ করেছিল এবং সর্বশক্তি দিয়ে এ লক্ষ্য অর্জন করারও চেষ্টা করেছিল। যা তাদেরকে পূর্বাবস্থা থেকে আমূল পরিবর্তন করে পরিণত করেছিল নতুন এক সৃষ্টিতে।
এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই মূলতঃ ইসলাম গ্রহণকারীদের তাদের ইসলামপূর্ব অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করেছিল। ইসলাম জীবন সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন ধ্যানধারণা ও লক্ষ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মাত্র ধারণা ও লক্ষ্যে পরিণত করেছিল। ঐক্যবদ্ধ এই ধারণার ভিত্তিতেই তারা জীবনের সকল বিষয়াদি পরিচালনা করতো। ইসলাম তাদের বিভিন্ন ধরণের স্বার্থকে পরিবর্তন করে একটি মাত্র স্বার্থের নীচে তাদের একত্রিত করেছিল; আর, তা ছিল শুধু ইসলামের স্বার্থ। তাদের জীবনের বিভিন্ন লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল; আর, তা হল আল্লাহর বাণীকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া। পরিণতিতে, স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ একটি একক জাতি বা উম্মাহ’তে পরিণত হয়েছিল; আর, তা হল ইসলামিক উম্মাহ্।