ইহুদীরা আসলে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য কখনোই তেমন কোন হুমকী ছিল না। আরবরাই মূলতঃ আল্লাহর রাসূল (সা)-এর শাসন কর্তৃত্বের সামনে হুমকী হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বিশেষ করে কুরাইশরা ছিল এ ব্যাপারে অগ্রগামী। এজন্যই তিনি (সা) ইহুদীদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, যেন ইহুদীরা তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেয় এবং রাসূল (সা)-এর শত্রুপক্ষের সাথে কোনরকম মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ না হয়। কিন্তু, ইহুদীরা যখন দেখতে থাকে যে, ইসলামী রাষ্ট্র দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং হেযাযে মুসলিমদের শাসন-কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে, তখন তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করে। বদরের যুদ্ধে কাফিরদের উপর মুসলিমদের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর তারা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের মিথ্যা অপপ্রচারের মাত্রা বৃদ্ধি করে, এমনকি আল্লাহর রাসূল (সা)-এর বিরুদ্ধেও তারা ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করে।
ইহুদীদের এ দূর্বৃত্তপনা ও চক্রান্ত ঔদ্ধত্যের কথা একসময় আল্লাহর রাসূল (সা) এবং মুসলিমদের কাছে পৌঁছে যায়। এর ফলশ্রুতিতে, ইহুদী ও মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রচন্ড ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা। দুই পক্ষই একে অন্যকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে। এদিকে, সময়ের সাথে সাথে ইহুদীদের ঔদ্ধত্য দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। ইহুদীদের মধ্যে বনু উমার ইবন আউফ গোত্রের আবু আফাক নামের এক ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা) এবং সাহাবীদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক কবিতা আবৃত্তি করতো। আসমা বিনত মারওয়ান নামের এক মহিলা সবসময় ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলতো এবং রাসূল (সা)-কেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। মুসলিম নারীরা পথ-ঘাটে যাতায়াত করার সময় কা’ব ইবন আশরাফ নামের এক ইহুদী তাদের দিকে অশ্লীল বাক্য ছুঁড়ে দিত। এমনকি, সে মদীনা থেকে মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য উত্তেজক কবিতা আবৃতি করতো। এ পর্যায়ে, মুসলিমরা তাদের এই অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তাদের এই আশায় হত্যা করে যে, এতে হয়তো ইহুদীরা ভীত হয়ে এ সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু, এরপরেও ইহুদীরা তাদের এই ঘৃণা মিশ্রিত মিথ্যা অপপ্রচার ও অত্যাচার চালিয়ে যায় এবং এর মাত্রা চুড়ান্ত ভাবে বৃদ্ধি করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের বিভিন্ন ভাবে সর্তক করেন এবং তারা যদি এই সমস্ত জঘন্য কার্যকলাপ থেকে বিরত না হয়, তবে তার পরিণতি কি হতে পারে সেটাও তাদের জানিয়ে দেন। কিন্তু, কোনকিছুই তাদের নিবৃত করতে পারে না। এছাড়া, আল্লাহর রাসুলের এ সর্তক বাণীকে তারা গুরুত্বের সাথেও গ্রহন করে না। বরং, তারা মুহাম্মদ (সা) এর এ সকল উপদেশকে পুরোপুরি প্রত্যাখান করে চরম বিদ্বেষের সাথে তাঁকে বলে, “শোন হে মুহাম্মদ! তুমি বোধ হয় ভাবছো আমরা তোমারই লোক। কিন্তু, নিজেকে ভ্রান্তির মধ্যে রেখো না। যুদ্ধ সম্পর্কে কোন রকম জ্ঞান ছাড়াই তুমি শত্রুর মুকাবিলা করেছো এবং সৌভাগ্যবশতঃ ফলাফল তোমার পক্ষেই এসেছে। আল্লাহর কসম, আমরা যদি কোনদিন তোমার সাথে যুদ্ধ করি তাহলে তুমি দেখবে আমরাই প্রকৃত যোদ্ধা।”
এ পর্যায়ে আসলে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর মদীনার ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এরপর মুসলিমরা বনু কাইনুকার দূর্গ ঘেরাও করে এবং কাউকে তাদের বসতি থেকে বের হতে না দিয়ে ১৫ দিন অবরুদ্ধ করে রাখে। এমনকি অন্যান্যদের তাদের কাছে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেয়া থেকেও বিরত রাখে। এ অবস্থায় ইহুদীদের মুহাম্মদ (সা)-এর আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর ফয়সালাকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এরপর, রাসূল (সা) তাঁর স্বীয় অনুগ্রহে ইহুদীদেরকে তাদের সমস্ত ধন-সম্পদ ও মালামাল নিয়ে মদীনা ত্যাগ করার অনুমতি দেন। এ ফয়সালা মেনে নিয়ে তারা মদীনা ত্যাগ করে ওয়াদী আল-কুরা নামক স্থানে কিছুদিন অবস্থান করে। তারপর, তারা মদীনার আরও উত্তরে যাত্রা করে আল-শামের সীমান্তবর্তী অঞ্চল আদরা’তে পৌঁছায়। বস্তুতঃ বনু কাইনুকা গোত্রকে বহিস্কার করার পর মদীনার ইহুদীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায় এবং যে সমস্ত ইহুদীরা মদীনায় রয়ে যায় তারা বহিস্কৃত হবার আশঙ্কায় মুসলিমদের কর্তৃত্বের কাছে আত্মসর্মপণ করে। কিন্তু, যখন তারা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে তাদের ভেতর আবারও পুড়নো ঘৃন্য অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। বিশেষ করে, ওহুদের ময়দানে মুসলিমদের পরাজয়ের পর তাদের ভেতর প্রতিহিংসা আর ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠে। আবারও তারা মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করে এবং এক পর্যায়ে তাঁকে হত্যা করার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়।
আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের এ গোপন চক্রান্ত সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করলেন এবং তাদের এ সব ঘৃণ্য চক্রান্তের প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচন করার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করলেন। একদিন তিনি (সা) আবু বকর, ওমর এবং আলী সহ দশজন সাহাবাকে নিয়ে ব্যবসায়িক কাজে বনু নাযির গোত্রের বসতিতে গেলেন। আল্লাহর রাসূল (সা)-কে দেখে ইহুদীরা কৃত্রিম আনন্দ উদ্ভাসিত হলো এবং সাদরে তাঁকে বরণ করলো। কিন্তু, কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি (সা) তাদের আচার-আচরনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন। একজন ইহুদীকে তিনি (সা) একপাশ থেকে হেঁটে যেতে দেখলেন এবং আরেক ইহুদীকে তিনি (সা) যে বাড়ীতে বসে ছিলেন সেখানে ঢুকতে দেখলেন। বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় তিনি (সা) দ্রুতবেগে সেখান থেকে উঠে গেলেন এবং এমন ভাবে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন যাতে মনে হলো তিনি (সা) আবার কিছুক্ষন পরেই ফিরে আসবেন। এর মধ্যে শুধু একটু সময়ের জন্য থেমে তিনি (সা) একজন সাহাবীকে বললেন, তিনি (সা) ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন সে এখানে অপেক্ষা করে। রাসূল (সা)-এর আকস্মিক প্রস্থানে ইহুদীরাও দ্বিধাদ্বন্দের ভেতরে পড়ে যায়। কারণ, উপরে উপরে তারা মুসলিমদের সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরন করছিল। সাহাবাগণ এখানে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আল্লাহর রাসুলের খোঁজে বাইরে বের হবার সিদ্ধান্ত নেন। শেষপর্যন্ত তারা রাসূল (সা)-কে মসজিদে নববীর মধ্যে খুজে পান এবং নবী (সা) তাদেরকে ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের কথা অবহিত করেন। এরপর, আল্লাহর রাসূল (সা) মুহাম্মদ ইবন মাসলামাহকে বনু নাযির গোত্রে পাঠিয়ে ইহুদীদের মদীনা ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। বনু নাযির গোত্রকে এ নিদের্শ বাস্তবায়িত করার জন্য দশদিন সময় দেয়া হয়েছিল অর্থাৎ, দশদিনের মধ্যে তাদের দেশ ত্যাগ করার আদেশ দেয়া হয়েছিল। দশদিন পরও তারা দেশত্যাগ না করায় রাসূল (সা) তাদের বসতি ঘেরাও করেন। অবশেষে, বনু নাযির রণে ভঙ্গ দিয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ খায়বারে বসতি স্থাপন করে। আর, বাকীরা আল-শামের আদরা’ অঞ্চলে চলে যায়।
তারপর থেকে মদীনা ইহুদীদের দূর্বৃত্তপণা থেকে মোটামুটি ভাবে মুক্ত হয়ে যায়। শুধু, বনু কুরাইযা নামে একটি বৃহৎ ইহুদী গোত্র মদীনায় রয়ে যায়। কিন্তু, চুক্তি ভঙ্গের কোন কাজ না করায় আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের ব্যাপারে নীরব থাকেন।
কিন্তু, এ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি আসলে খুব স্বল্প সময়ের জন্যই বিরাজ করে। কারণ, বনু কুরাইযা স্বচক্ষে বনু কাইনুকা’ ও বনু নাযির গোত্রের পরিণতি দেখেছিল। এছাড়া, অবস্থানগত দিক থেকে দূর্বল থাকায় মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়েও তারা ক্রমশঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিল। ফলে, হুয়াই ইবন কা’ব এর নিকট হতে কুপ্রস্তাব পাবার পর তারাও দ্রুত তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলিমদের ধ্বংস করতে আসা শত্রুপক্ষের সাথে মিত্রতা করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায়। মূলতঃ মুসলিমদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার এই ষড়যন্ত্রে শরীক হয়ে তারা রাসূল (সা)-এর সাথে তাদের কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে। আবারও তারা তাদের কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতার মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়। এ কারণেই, মুহাম্মদ (সা) সম্মিলিত শত্রুবাহিনীর হুমকী থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই বনু কুরাইযাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৫ রাত তাদের দূর্গ ঘেরাও করে রাখেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় দূর্গ থেকে বের হতে না পেরে তারা তীব্র মানসিক যন্ত্রনায় আচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহতায়ালা তাদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করে দেন।
এ পর্যায়ে তারা আল্লাহর রাসূল (সা)-কে খবর পাঠিয়ে বলে, “আমাদের কাছে আবু লুবাবাহকে পাঠিয়ে দিন যেন আমরা সমস্যা সমাধানে তার সাথে পরামর্শ করতে পারি।”আবু লুবাবাহ্ ছিল তাদের প্রাক্তন মিত্র গোত্র বনু আউসের প্রতিনিধি। তাকে দেখা মাত্রই তারা তার কাছে ছুটে আসে। ইহুদীদের নারী ও শিশুরা তার কাছে এসে কাঁদতে শুরু করে। তাদের কান্না দেখে আবু লুবাবাহ্ খুবই দুঃখিত হন। এরপর, ইহুদীরা বলে, “হে আবু লুবাবাহ্! তোমার কি মনে হয় আমাদের মুহাম্মদের ফয়সালা মেনে নেয়া উচিত?” আবু লুবাবাহ্ “হ্যাঁ,” সূচক উত্তর দেয় এবং তার হাত দিয়ে গলার দিকে নির্দেশ করে ফয়সালা মেনে না নেয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে সর্তক করে। তারপর তিনি ফিরে আসেন। কা’ব ইবন আসাদ সমঝোতা করার জন্য কিছু প্রস্তাব দেয় কিন্তু ইহুদীরা তাও প্রত্যাখান করলে সে বলে, “তোমাদের মুহাম্মদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”এরপর, ইহুদীরা মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে খবর পাঠায় যেন, তিনি (সা) তাদেরকে খালি হাতে শহর ত্যাগ করে আদরা যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু, তিনি (সা) তা প্রত্যাখান করেন এবং তাদেরকে তাঁর ফয়সালা মেনে নেবার জন্য চাপ দিতে থাকেন।
এ অবস্থার পরপ্রেক্ষিতে ইহুদীরা তাদের প্রাক্তন মিত্র আউসকে বিষয়টি ফয়সালা করার অনুরোধ জানায়। আউস গোত্র আল্লাহর রাসূল (সা)-এর কাছে আসলে তিনি (সা) তাদের বলেন, “হে আউস, তোমাদের মধ্য হতে যে কোন একজন যদি তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে কি তোমরা এতে সন্তুষ্ট থাকবে?” উত্তরে তারা বলে, “হ্যাঁ, আমরা তা গ্রহন করবো।”এরপর, রাসূল (সা) বলেন, “ইহুদীদের বলে দাও তোমাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকেই যেন তারা নির্বাচিত করে।”
ইহুদীরা আউস গোত্র থেকে সা’দ ইবন মু’য়াজকে বিচারক হিসাবে নির্বাচিত করে। সা’দ উভয় পক্ষ থেকে এ প্রতিজ্ঞা নেয় যে, সে যে সিদ্ধান্ত দেবে উভয়পক্ষকেই বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিতে হবে। দুই পক্ষই এতে সম্মত হবার পর, সা’দ বনু কুরাইযাকে তাদের অস্ত্রসস্ত্র সহ দূর্গ থেকে বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন এবং তার সামনে তা রাখতে বলেন । ইহুদীরা তার নির্দেশ অনুযায়ী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আসে। তারপর, তিনি তার বিচারের রায় দিয়ে বলেন, বনু কুরাইযার পুরুষদের হত্যা করা হবে, তাদের সমস্ত সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে এবং তাদের নারী ও শিশুদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে গ্রহন করা হবে। বিচারের এ রায় শোনার পর আল্লাহর রাসূল (সা) উচ্চকন্ঠে বলেন, “তাঁর শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আল্লাহ এবং মুসলিমরা তোমার ফয়সালাকে গ্রহন করেছে এবং আমার পক্ষ থেকে আমি অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করবো।”এরপর, তিনি (সা) মদীনার বাজারে গিয়ে সেখানে বড় বড় গর্ত খোঁড়ার নির্দেশ দেন। দলে দলে ইহুদী পুরুষদের সেখানে আনা হয়। তারপর, তাদের শিরচ্ছেদ করে গর্তের ভেতর পুঁতে ফেলা হয়। তিনি (সা) ইহুদীদের সমস্ত ধন-সম্পদ, জমি-জমা, খেজুরবাগান এবং নারী ও শিশুদেরকে মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করে দেন। আর, নিজের জন্য এর থেকে এক পঞ্চমাংশ রাখেন। তিনি (সা) এ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছুটা সা’দ ইবন যায়িদ আল-আনসারীকে অস্ত্রসস্ত্র ক্রয় করার জন্য দেন। সা’দ নযদে গিয়ে ঘোড়া ও অস্ত্রসস্ত্র কিনে নিয়ে আসে, যা মুসলিম সেনাবাহিনী ও তাদের অস্ত্রভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে।
এভাবেই বনু কুরাইযাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। কিন্তু, মদীনার আশেপাশের অন্যান্য ইহুদী গোত্রগুলো তখনো ঘাপটি মেরে ছিল। এদের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী ছিল খায়বারের ইহুদী গোত্রগুলো। তারা আল্লাহর রাসূল (সা)-এর সাথে কোনরকম চুক্তি করতেও প্রস্তুত ছিল না। এছাড়া, হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে মুসলিমদের ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে তারা গোপনে কুরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্রও করেছিল। ফলে, তাদের স্বাধীন উপস্থিতি ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত করছিল হুমকীর সম্মুখীন। এজন্য, কুরাইশদের সাথে হুদাইবিয়া সন্ধি করার পরপরই আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সেনাবাহিনীকে খায়বার জয়ের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপর, খায়বার জয় করার লক্ষ্যে, ১৭০০ মুজাহিদ যাত্রা আরম্ভ করে, যাদের মধ্যে ১০০ জন ছিল অশ্বারোহী। আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে তারা ছিল নিশ্চিত। এরপর, মুসলিম বাহিনী খায়বারে গিয়ে ইহুদীদের দূর্গ ঘেরাও করে রাখে এবং তাদের ধ্বংস করার প্রস্তুতি নেয়। ওদিকে, দূর্গের ভেতর ইহুদীরা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতে থাকে। সালাম ইবন মাসকাম নামের এক ইহুদী প্রস্তাব দেয় যে, তারা তাদের নারী-শিশু ও তাদের ধন-সম্পদ আল-ওয়াতিহ্ ও আল-সালালিম দূর্গে নিরাপদে রেখে আসবে। আর, তাদের অস্ত্রভান্ডার লুকিয়ে রাখবে না’য়িম দূর্গে। এরপর, ইহুদী যোদ্ধারা সালাম ইবন মাসকামের নেতৃত্বে নাতাত দূর্গের অভ্যন্তরে অবস্থান নেবে।
দুইপক্ষের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ হয় নাতাত দূর্গের কাছে, তারপর আরম্ভ হয় ভয়াবহ আক্রমণ, আর পাল্টা আক্রমণ। বর্ণিত আছে যে, ঐ দিনের যুদ্ধে ৫০ জন মুসলিম যোদ্ধা আহত হয়েছিল। আর, ইহুদীদের নেতা সালাম ইবন মাসকাম নিহত হওয়ায় আল-হারিছ ইবন আবি যয়নাব তাদের নেতৃত্ব গ্রহন করেছিল। এক পর্যায়ে, ইহুদী নেতা আল-হারিছ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দৃঢ় চিত্তে মুসলিমদের মুকাবিলা করার জন্য দূর্গের বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু খাযরাজের যোদ্ধারা তাকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
ইহুদীদের অবরুদ্ধ করে মুসলিমরা ধীরে ধীরে তাদের আক্রমণকে আরও শানিত করে। আর, অন্যদিকে ইহুদীরা তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এভাবে কিছুদিন পার হয়। এরপর, একদিন আল্লাহর রাসূল (সা) আবু বকর (রা)-কে না’য়িম দূর্গ ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি বীরের মতো যুদ্ধ করেন, কিন্তু তাকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়। পরদিন, রাসূল (সা) ওমর (রা)-কে একই দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। কিন্তু, তিনিও শূন্য হাতে ফিরে আসেন। সবশেষে, তিনি (সা) আলী (রা)-কে ডেকে বলেন, “এই পতাকা হাতে এগিয়ে যাও যে পর্যন্ত না আল্লাহ তোমাকে বিজয় দান না করেন।”এ নির্দেশের পর ’আলী (রা) দূর্গের দিকে রওনা হয়ে যান। দূর্গের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর কিছু ইহুদী যোদ্ধা বের হয়ে এসে তাকে আক্রমণ করে। এক ইহুদীর আঘাতে তার হাত থেকে বর্ম পড়ে যায়। এরপর, আলী দূর্গের দরজা শক্ত করে ধরেন এবং এ দরজাকেই ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে যুদ্ধ করতে থাকেন। দূর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস না করা পর্যন্ত তিনি দরজা ধরেই আক্রমণ চালাতে থাকেন। তারপর, তিনি দূর্গের এ দরজাকে অস্থায়ী সেতু হিসাবে ব্যবহার করে বাকী মুসলিমদের ইহুদীদের সুরক্ষিত আস্তানায় ঢোকার ব্যবস্থা করে দেন।
না’য়িম দূর্গকে নিজেদের কব্জায় আনার পরপরই মুসলিমরা ইহুদীদের অন্যান্য দূর্গগুলো আক্রমণ করতে আরম্ভ করে এবং একটার পর একটা দূর্গ ধ্বংস করে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে। শেষপর্যন্ত, তারা আল-ওয়াতিহ্ এবং আল-সালালিম দূর্গকে আক্রমণ করতে এগিয়ে যায়। এ পর্যায়ে, ইহুদীরা বিজয়ের আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়ে মুসলিমদের কাছে আত্মসর্মপণ করে। তারা শান্তিচুক্তির বিনিময়ে মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে তাদের জীবন ভিক্ষা করে। আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাদেরকে খায়বারে বসবাস করার অনুমতি দেয়। তবে, যুদ্ধের নীতিমালা অনুযায়ী ইহুদীদের সমস্ত সম্পদ মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের এ শর্তে খায়বারে বসবাস করার অনুমতি দেয় যে, এখানকার সমস্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফলমূল ও শস্যের অর্ধেক তারা মুসলিমদের দেবে আর বাকী অর্ধেক তারা মজুরী হিসাবে রেখে দেবে।
এভাবে, খায়বারে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে, ফাদাকের ইহুদীরা খায়বারের ইহুদীদের আত্মসমর্পণের কথা জানতে পেরে প্রাণভয়ে তাদের উৎপাদিত অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করে। এরপর, আল্লাহর রাসূল (সা) ওয়াদি আল-কুরা হয়ে মদীনায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নেন। মুসলিম বাহিনীর প্রত্যাবর্তন কালে কোন রকম যুদ্ধ ছাড়াই তায়মা’র ইহুদীরা মুসলিমদের জিযিয়া দিতে সম্মত হয় এবং তাদের আধিপত্য মেনে নেয়।
এ সমস্ত ঘটনার ফলশ্রুতিতে, সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইহুদীদের শাসন-কর্তৃত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর, এভাবেই আল্লাহর রাসূল (সা) সমগ্র আরবে তাঁর শাসন-কর্তৃত্ব বিস্তৃত করে ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেন।