তাবুক অভিযানের মাধ্যমে মূলতঃ আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছিলেন, যার ফলে ইসলামের শত্রুপক্ষের লোকেরা এ রাষ্ট্রকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়েছিলো। একই সাথে, এ অভিযান বহির্বিশ্বে ইসলামের উদাত্ত আহবানকে ছড়িয়ে দেয়ার পদ্ধতি হিসাবে তাঁর উত্তরসূরীদের কাছে একটি চমৎকার দৃষ্টান্তও হয়ে থাকলো।
আল্লাহর রাসূল (সা) তাবুকের অভিযান থেকে ফিরে আসার পরপরই ইয়েমেন, হাজরামাউত ও ওমান সহ আরব উপদ্বীপের সমস্ত দক্ষিনাঞ্চল রাসূল (সা) এর আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে। শুধু তাই নয়, তারা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্বকেও মেনে নেয়।
হিজরী নবম সালে, এ অঞ্চলের দূতেরা উদ্বিগ্ন চিত্তে একে একে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর কাছে আসতে লাগলো এবং তাদের ও তাদের গোত্রভূক্ত লোকদের ইসলাম গ্রহনের স্বীকৃতি দিলো। এ সমস্ত ঘটনার ফলশ্রুতিতে, সমস্ত আরব ভূ-খন্ডে ইসলামী রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুধু আরবের অভ্যন্তরীন বিষয়গুলোর মধ্যে মূর্তিপূজারীই যা একটু সমস্যা তৈরী করছিলো। কারণ, মুহাম্মদ (সা)-এর কৃত চুক্তি অনুযায়ী পৌত্তলিকদের মূর্তিপূজা করা কিংবা কাবাঘর তাওয়াফ করার অনুমতি ছিলো। এ চুক্তিতে পরিষ্কার ভাবে বলা ছিলো যে, তারা নির্ভয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করতে পারবে এবং পবিত্র মাসে তাদের কোন প্রকার ক্ষতি করা হবে না।
কিন্তু, এ অবস্থা বেশীদিন চলতে দেবার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ ছিলো না। কারণ, কতোদিন আর ইসলামের আকীদার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী মুর্তিপূজারীদের পবিত্র কাবাঘরে আগমনকে সহ্য করা যায়? কিভাবে এই সম্পূর্ন বিপরীতধর্মী দুটো বিশ্বাসের মানুষেরা একত্রিত হয়ে পবিত্র এ ঘরকে তাওয়াফ করতে পারে, যখন এই দুটি বিশ্বাসের মধ্যে একটির আগমনই হয়েছে মূর্তিপূজাকে সম্পূর্ন রূপে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে? এছাড়া, এ জনপদের সকলেই যখন ইসলামী রাষ্ট্র ও এক আল্লাহর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃতের কাছে মাথা নত করেছে, তখন কি মূর্তিপূজারীদেরকে তাদের খেয়াল-খুশী অনু্যায়ী ছেড়ে দেয়া যায়? তাছাড়া, মূর্তিপূজা ছিলো একটি সম্পূর্ন পরিত্যক্ত ও ভ্রান্ত বিশ্বাস, যা সমাজের সামগ্রিক ঐক্যের জন্যও ছিলো বিপদজনক। তাই, এ পরিত্যক্ত বিশ্বাসকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন করা ছিল অপরিহার্য।
তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর মুসলিমরা যখন আবু বকর (রা)-এর নেতৃত্বে হজ্জ্বের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, ঠিক এ সময়েই আল্লাহতায়ালা মুশরিকদের উদ্দেশ্য করে রাসূল (সা)-এর কাছে সুরা আত-তাওবা নাযিল করেন। আল্লাহর এ নির্দেশ পেয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) আলী ইবন আবি তালিবকে আবু বকর (রা)-এর সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দেন এবং মক্কার জনসাধারনকে আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াত শুনাতে বলেন। মক্কায় গিয়ে আলী ইবন আবি তালিব আবু হুরায়রাকে সঙ্গে নিয়ে মক্কার জনগণকে নাযিলকৃত আয়াতসমূহ তিলওয়াত করে শোনান।
“আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ হতে অব্যাহতি (ঘোষনা করা) হচ্ছে ঐ মুশরিকদের (অঙ্গীকার) হতে, যাদের সাথে তোমরা সন্ধি করেছিলে।” [সুরা আত-তাওবাঃ ১]
সুরা তওবার উপরোক্ত আয়াত হতে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পর্যন্ত তিলওয়াত করেন,
“আর এই মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমরা সকলে মিলিত ভাবে যুদ্ধ করো, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে মিলে যুদ্ধ করে। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথেই রয়েছেন।” [সরা আত-তওবাঃ ৩৬]
এ আয়াত পর্যন্ত তিলওয়াত করার পর আলী (রা) কিছুক্ষন নীরব থাকলেন। তারপর, চিৎকার করে বললেন, “হে মানুষেরা! অবশ্যই কোন অবিশ্বাসীই জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং কোন মুশরিকই এ বছরের পর থেকে হজ্জ্ব করতে পারবে না। আর, কেউ কাবাঘরকে নগ্ন হয়ে প্রদক্ষিন করতে পারবে না। আজকের পর থেকে যাদের সাথে মুহাম্মদ (সা)-এর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি আছে, সেই চুক্তি ব্যতীত আর কোন চুক্তি হবে না।”এ চারটি নিদের্শ আলী (রা) জারি করলেন এবং জনসাধারনকে নিজ নিজ বাড়ী ফিরে যাবার জন্য চারমাস সময় দিলেন। ঐ বছরের পর থেকে আর কখনো কোন মুশরিক হজ্জ্ব করতে আসেনি, না তারা আর কোনদিন নগ্ন হয়ে কা’বাঘরকে প্রদক্ষিন করেছে।
এরপর, আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত ইসলামিক আক্বীদাহর ভিত্তিতে নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের ছত্রছায়াই সমস্ত আরব ভূ-খন্ডে আল্লাহর বাণী বিস্তৃতি লাভ করতে আরম্ভ করলো। সুরা বারা’য়াহ(তাওবা), সবচাইতে শেষ সুরা, নাযিল হবার সাথে সাথেই সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে মূর্তিপূজা সমূলে উৎপাটিত হলো এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সমাপ্ত হয়ে গেল। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সকল ধ্যান-ধারনা এবং ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতীত অন্য সবকিছুর শাসন-কর্তৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। আর, এভাবেই সমস্ত মানবজাতির কাছে দ্বীন ইসলামের আহবান পৌঁছে দেবার শক্তিশালী ভিত্তি প্রস্তুত হলো।