ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ২৭ (হুনায়ুনের যুদ্ধ)

হাওয়াজিন গোত্রের লোকেরা যখন শুনতে পেল কিভাবে মুসলিমরা মক্কা জয় করে নিয়েছে, তখন তারা আশঙ্কা করতে লাগল যে, তারাও হয়ত মুসলিমদের আক্রমণের শিকার হতে পারে কিংবা তাদের ঘরবাড়ী মুসলিমদের হাতে ধ্বংস হতে পারে। এজন্য, সম্ভাব্য এ বিপদ মুকাবিলার জন্য তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। মালিক ইবন ’আউফ আল-নাদরি হাওয়াজিন ও বনু ছাকিফ গোত্রের যোদ্ধাদের একত্রিত করে মুসলিমদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে উতাস উপত্যকায় পৌঁছাল।

মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের ১৫ দিন পর হাওয়াজিন ও বনু ছাকিফ গোত্রের ধেয়ে আসা এ সৈন্যবাহিনীর সংবাদ মুসলিমদের কাছে পৌঁছাল। সাথে সাথে তারা তাদেরকে মুকাবিলা করার প্রস্তুতি নিল। এদিকে, মালিক তার সৈন্যদল সহ উতাস উপত্যকায় অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে উপত্যকার সবচাইতে দূর্গম অঞ্চল হুনায়ুন এলাকায় অবস্থান নিল। এখানে, সে খুবই সর্তকতার সাথে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার বাহিনীকে সজ্জিত করল। মুসলিমরা উপত্যকায় প্রবেশ করা মাত্রই সে তার বাহিনীকে আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছিল, যাতে মুসলিম বাহিনী অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অত্যন্ত সর্তকতার সাথে পুরো পরিকল্পনা করে তারা উপত্যকায় মুসলিমদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগল।

এর কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিমরা হুনায়ুন উপত্যকায় প্রবেশ করে। আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কা থেকে দুই সহস্র যোদ্ধা এবং মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে আগত আরও ১০,০০০ যোদ্ধা নিয়ে যাত্রা করেন। এই অপরাজেয় বাহিনী নিয়ে তিনি (সা) বিকেল বেলায় হুনায়ুনের উপত্যকায় পৌঁছান। এখানে তাঁরা পরদিন সুবহে সাদিক পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়ে একেবারে উষালগ্নে উপত্যকার অভ্যন্তরে যাত্রা করেন। মুসলিমদের সেনাবাহিনী যখন উপত্যকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল তখন আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাদা খচ্চরের পিঠে আরোহন করে তাঁর সৈন্যবাহিনীর পেছনের দিকে ছিলেন। এরপর, হাওয়াজিনের নেতা মালিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হয় শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণ। অন্ধকার ভেদ করে চতুর্দিক থেকে বৃষ্টির মতো বর্শার আঘাত আসতে থাকে। অর্তকিত এ আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মুসলিম বাহিনী দিশেহারা হয়ে যায়। আক্রমণ যেহেতু চর্তুদিক থেকে আসছিল, মুসলিমরা চর্তুমূখী এ আক্রমণকে কি করে প্রতিহত করবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপর, ভয়ে আতঙ্কে কেউ কারো দিকে লক্ষ্য না করে প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিক পারে পালিয়ে যায়। তারা দলে দলে মুহাম্মদ (সা) এর পাশ দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল এবং তাঁর দিকেও লক্ষ্য করছিল না কিংবা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল না। শেষপর্যন্ত শুধু আল-আব্বাস এবং আল্লাহর রাসূল (সা) যুদ্ধক্ষেত্রে রয়ে গেলেন। এছাড়া, বাকী সবাই পরাজিত হয়ে নিজ নিজ জীবন রক্ষায় পালিয়ে বাঁচল। মুহাম্মদ (সা) যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন, তাঁর চারপাশে রইল শুধু আনসার, মুহাজির ও তাঁর পরিবারের সম্বনয়ে গঠিত ছোট্ট একটি দল। তিনি (সা) তাঁর লোকদের ডেকে বললেন, “ওহে মানুষেরা, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” কিন্তু, তারা মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর আহবান শুনতে ব্যর্থ হল এবং পেছন দিকে না তাকিয়ে পালাতে থাকল। হাওয়াজিন ও ছাকিফ গোত্রের লোকেরা তাদের ধাওয়া করে যাকে যেখানে পেল হত্যা করল।

এটি ছিল আল্লাহর রাসুলের জীবনের সবচাইতে জটিল ও সঙ্কটপূর্ণ এক অভিজ্ঞতা। এ অভিযানের চরম হতাশাজনক পরিসমাপ্তি ছিল তাঁর কাছে অচিন্তনীয়। সাহাবা, তাঁর শক্তিশালী বাহিনী ও মক্কার নও মুসলিমদের পুর্ণ উদ্যেমে পলায়নপর অবস্থার মধ্যে তিনি (সা) দৃঢ় চিত্তে অবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাদেরকে ফিরে আসার জন্য বারবার আহবান করতে লাগলেন। এদের মধ্যে যারা খুব সম্প্রতি (মক্কা বিজয়ের পর) ইসলাম গ্রহন করেছিল, তারা প্রকাশ্যেই ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করতে লাগল। তারা মুসলিমদের এ পরাজয়ে বিদ্বেষে পূর্ণ আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। কালদা ইবন হাম্বল বলল, “নিশ্চয়ই, আজ সমস্ত যাদুটোনার পরাজয় হয়েছে।”শায়বা ইবন ’উসমান ইবন তালহা বলল, “আজ আমার মুহাম্মদের উপর প্রতিশোধ নেবার দিন।” আবু সুফিয়ান উপহাসের সাথে বলল, “তাদের (সেনাবাহিনীর) এ পলায়ন থামবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা সমুদ্র তীরে পৌঁছায়।”

এরকম একটা নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনা মূলতঃ তাদের পলায়নকেই তরান্বিত করেছিল, যারা মক্কায় খুব সম্প্রতি ইসলাম গ্রহন করেছিল এবং নিজেদের হীন উদ্দেশ্য ও প্রকৃত চেহারা আড়াল করতে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর সাথে এ যুদ্ধে শরীক হয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ সময় মুহাম্মদ (সা) যে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত জঘন্য। কিন্তু, পিছু হটে যাবার কোন চিন্তা না করে, তিনি (সা) অবিচল চিত্তে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং তাঁর সাদা খচ্চরের পিঠে আরোহন করে শত্রুপক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। এ সময় তাঁর চাচা আল-’আব্বাস ইবন ’আবদ আল-মুত্তালিব রাসূল (সা) এর সাথে ছিলেন। আর, আবু সুফিয়ান ইবন আল-হারিছ ইবন ’আবদ আল মুত্তালিব (not to be confused with Abu Sufyan ibn Harb Abu Mu’awiyah) রাসূল (সা) এর বাহনের নাকের রশি ধরে সাথে সাথে এগুতে থাকলেন যেন, এটি কোন বিপদজনক অবস্থানের দিকে যেতে না পারে। এ পর্যায়ে, আল-’আব্বাস চিৎকার করে বললেন, “হে আনসার, যারা তোমরা আল্লাহর রাসূলকে আথিতেয়তা ও নিরাপত্তা দিয়েছ! হে মুহাজির, যারা তোমরা বৃক্ষের নীচে তাঁর কাছে শপথ করেছ! মুহাম্মদ (সা) এখনও বেঁচে আছে, সুতরাং, তোমরা ফিরে আস।”

আল-’আব্বাসের পূণঃপূণঃ এই আর্তনাদ উপত্যকার চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। পরাজিত পলায়নপর মুসলিমরা অবশেষে তার আহবান শুনতে পেল। তাদের মনে পড়লো আল্লাহর রাসুলের কথা। মনে পড়লো জিহাদের দায়িত্বের কথা। সহসাই তারা অনুভব করলো এই লজ্জাজনক পরাজয়ের ভয়াবহ পরিণামের কথা। তারা অনুভব করলো, যদি এখানে আজ পৌত্তলিকরা তাদের গুঁড়িয়ে দেয়, তাহলে যে দ্বীন রক্ষায় তারা নিঃশেষে জীবন দিয়েছে, তার পরিসমাপ্তি এখানেই ঘটবে। শেষপর্যন্ত, আল-’আব্বাসের আহবানে সাড়া দিয়ে তারা রাসূল (সা)-এর চারিদিকে সমাবেত হতে লাগলো এবং পূর্ণ উদ্যেম ও সাহসিকতার সাথে একে একে পুণরায় যুদ্ধে যোগ দিতে লাগলো। এরপর তারা আবারও এক বিশাল বাহিনীতে পরিণত হল এবং যুদ্ধ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করলো। ঘটনার এ নাটকীয় পরিবর্তনের পর আল্লাহর রাসূল (সা) ধীরে ধীরে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে, একমুঠো  নুড়ি পাথর তুলে শত্রুপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “আজ তোমাদের মুখ ধূলিমলিন হোক!”

এরপর, মুসলিমরা জীবনের পরোয়া না করে হাওয়াজিন ও ছাকীফ গোত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালায়। ভয়ঙ্কর এ আক্রমণের মুখে কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌত্তলিকরা বুঝে যায় যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে না গেলে ধ্বংস অনিবার্য। পালাবার সময় তারা তাদের ধনসম্পদ ও নারীদের ফেলে রেখেই চলে যায়, যেগুলো পরে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসাবে মুসলিমদের হস্তগত হয়।

পলায়নপর পৌত্তলিকদের পিছু পিছু মুসলিমরা ধাওয়া করে এবং তাদের মধ্যে অনেককে বন্দী করে। এমনকি তারা উপত্যকার ভেতর লুকিয়ে থাকা মুশরিকদেরও খুঁজে বের করে হত্যা করে। তাদের দলনেতা মালিক ইবন ’আউফ তায়েফে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এভাবেই আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের সাহায্য করেন অভাবনীয় এক সাফল্য অর্জন করতে এবং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নীচের আয়াতগুলো নাযিল করেন,

“অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে যুদ্ধে বহুক্ষেত্রে (কাফিরদের উপর) বিজয়ী করেছেন এবং হুনায়ুনের দিনেও, যখন সংখ্যাধিক্যের গর্ব তোমাদেরকে উম্মত্ত করেছিল। অতঃপর, তোমাদের সেই সংখ্যাধিক্য তোমাদের কোনই কাজে আসেনি, আর ভূ-পৃষ্ঠ নিজের প্রশস্ততা সত্তেও তোমাদের জন্য সঙ্কীর্ণ হয়েছিল। অতঃপর, তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন পূর্বক পলায়ন করলে। তারপর, আল্লাহ নিজ রাসুলের প্রতি এবং অন্যান্য ঈমানদারদের প্রতি নিজের পক্ষ থেকে সাকিনাহ্ (সান্তনা, স্বস্তি) নাযিল করলেন এবং এমন বাহিনী (ফেরেশতা) পাঠালেন যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর, কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন। আর, এটাই হচ্ছে তাদের কর্মের ফলাফল। অনন্তও আল্লাহ যাকে চান তাকে সুযোগ দান করেন। আর, আল্লাহ হচ্ছেন অতি ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।” [সুরা তওবাঃ ২৫-২৭]

শত্রুকে পরাজিত করার পর এ যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ ধনসম্পদ যুদ্ধলব্ধ মালামাল হিসাবে মুসলিমদের হস্তগত হয়েছিল। এ যুদ্ধে প্রায় বিশ হাজার উট, চলি-শ হাজার ভেড়া এবং চার হাজার রূপার বর্ম মুসলিমদের হাতে আসে। অসংখ্য পৌত্তলিক নিহত হয়। আর, প্রায় ছয় হাজার পৌত্তলিক যুদ্ধবন্দী হয়। এদের সবাইকে ওয়াদি আল-যি’রানাহ নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। মুসলিমদের মধ্যে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে, তারা সংখ্যায় অনেক ছিল এবং কিছু সীরাতের বর্ণনা অনুযায়ী প্রায় দুটো মুসলিম গোত্র পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।

এরপর, আল্লাহর রাসূল (সা) যুদ্ধলব্ধ মালামাল ও বন্দীদের আল-যি’রানাহতে রেখে দলবল নিয়ে তা’য়িফ ঘেরাও করেন, যাদের কাছে মালিক ইবন ’আউফ পরাজিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তা’য়িফ ছিল বনু ছাকিফদের বাসস্থান। পুরো তা’য়িফ নগরী ছিল সুরক্ষিত দূর্গ সদৃশ এবং এ অঞ্চলের লোকেরা ছিল অবরোধ যুদ্ধে পারদর্শী। এছাড়া, এরা ছিল অত্যন্ত বিত্তশালী ও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। বনু ছাকিব গোত্রের লোকদের তীর চালনায় ছিল অসাধারণ দক্ষতা। মুসলিমদের কোন দল নগরীর দিকে অগ্রসর করার চেষ্টা করা মাত্রই তারা বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করে মুসলিম যোদ্ধাদের হত্যা করছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই মুসলিমরা বুঝে ফেলে যে, দূর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এজন্য, তারা মুহাম্মদ (সা)-এর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় শত্রুর তীরের নিশানার বাইরে অবস্থান গ্রহন করে। এমতাবস্থায়, আল্লাহর রাসূল (সা) কামানের মতো গোলা নিক্ষেপকারী এক অস্ত্রের সাহায্যে তা’য়িফের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেবার জন্য বনু দাওস গোত্রের সাহায্য চাইলেন। তা’য়িফ অবরোধ করার চারদিন পর দাওস গোত্র তাদের এ যুদ্ধাস্ত্র সহ মুসলিমদের সাথে যোগ দেয়। এরপর, মুসলিমরা নতুন এ যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে দূর্গ আক্রমণ করে। আর, ট্যাঙ্কের মতো এক বাহনে চড়ে মুসলিমরা দূর্গের দেয়ালের কাছাকাছি গিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল যেন খুব তাড়াতাড়িই দূর্গের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু, অগ্রসর হওয়া মাত্রই তা’য়িফের যোদ্ধারা তাদের দিকে জ্বলন্ত ধাতুর টুকরা ছুঁড়ে মারতে থাকে যাতে ট্যাঙ্কগুলো পুড়ে যায় আর মুসলিমরা আত্মরক্ষার্থে পালাতে থাকে।

এ সুযোগে শত্রুপক্ষ তাদের দিকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করে মুসলিম যোদ্ধাদের অনেককে হত্যা করে। সরাসরি দূর্গ ধ্বংস করতে না পেরে যুদ্ধকৌশল হিসাবে মুসলিমরা তাদের আঙ্গুর বাগান কেটে পুড়িয়ে দেয় যেন ছাকিফ গোত্র আত্মসর্মপন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু, তারপরও বনু ছাকিফ আত্মসর্মপন না করায় মুসলিমরা অবরোধ উঠিয়ে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরমধ্যে পবিত্র মাস শুরু হয়ে যায়। আল্লাহর রাসূল (সা) যুল আল-ক্বা’দা মাসের প্রথম দিনে তা’য়িফ থেকে অবরোধ উঠিয়ে মুসলিমদের সহ মক্কা যাত্রা করেন। যাত্রাপথে যুদ্ধলব্ধ মালামাল ও বন্দীদের জন্য তারা আল-যি’রানাহতে কয়েকদিন অবস্থান করেন। এ সময়কালে, অনেক সমস্যা সমাধান করার সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (সা) এটাও ঘোষনা দেন যে, যদি মালিক ইবন ’আউফ ইসলাম গ্রহন করে, তবে তিনি (সা) সমস্ত ধনসম্পদ সহ পরিবারের সবাইকে তার কাছে ফিরিয়ে দেবেন। এ সংবাদ মালিক ইবন আউফের কানে পৌঁছানো মাত্রই সে ত্বড়িৎ বেগে মুহাম্মদ (সা)-এর নিকটে হাজির হয় এবং ইসলাম গ্রহন করে। মাত্র কিছুদিন পূর্বে মুহাম্মদ (সা) যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তা’য়িফ ঘেরাও করেছিলেন, আশ্চর্যজনক ভাবে সেই একই ব্যক্তিকে তিনি (সা) তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী সমস্ত সম্পদ ফিরিয়ে দেয় এবং সেইসাথে তাকে অতিরিক্ত ১০০ উটও দান করেন।

এ ঘটনার পর মুসলিমরা আশঙ্কা করে যে, এভাবে হাওয়াজিন গোত্রের যে কেউ এসে দাবী করা মাত্রই যদি মুহাম্মদ (সা)-তার সম্পদ ফিরিয়ে দিতে শুরু করে তবে তাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে অবশিষ্ট আর কিছুই থাকবে না। এজন্য তারা দাবী করে যে, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হোক, যেন সকলে তাদের প্রাপ্য বুঝে পায়। এ বিষয় নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাদের এ কানাঘুষা  মুহাম্মদ (সা)-এর  কান পর্যন্ত পৌঁছায়। এ কথা শোনার পর, তিনি (সা) জনসম্মুখে পার্শ্ববর্তী উটের কুঁজ থেকে একটা লোম উঠিয়ে তাঁর আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ধরে বলেন, “হে মানুষেরা! আল্লাহর কসম তোমাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে আমার নিজের জন্য এক পঞ্চমাংশ ব্যতীত অতিরিক্ত আর কিছুই নেই, এমনকি এই লোমের সমপরিমাণও নেই। আর এই এক-পঞ্চমাংশ সম্পদও আমি তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেব। সুতরাং, কেউ যদি অন্যায় ভাবে একটা সূঁচ পরিমান জিনিসও নেয়, তবে কিয়ামতের দিনে এটা হবে তার জন্য খুবই অপমান ও যন্ত্রনার কারণ এবং এজন্য সে ও তার পরিবারবর্গ চুড়ান্ত ভাবে অপমানিত হবে।” আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর জন্য (আল্লাহ থেকে নির্দিষ্ট) একপঞ্চমাংশ সম্পদ রেখে বাকী সম্পদকে সাহাবাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। তাঁর নিজের সম্পদকে তিনি (সা) যাদের অন্তর জয় করার প্রয়োজন ছিল তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন, বিশেষ করে ইসলাম গ্রহনের পূর্বে যারা তাঁর ঘোরতর শত্রু ছিল তাদেরকে তিনি (সা) এ সম্পদ দান করে দিলেন। তিনি (সা) আবু সুফিয়ান, তার ছেলে মুয়া’য়িয়া, আল-হারিছাহ ইবন আল-হারিছাহ, আল-হারিছাহ ইবন আল-হিশাম, সুহাইল ইবন ’আমর, হাওয়াইতিব ইবন ’আবদ আল-উজ্জা এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রধানদের তাদের নিজ নিজ অংশের সাথে অতিরিক্ত আরও ১০০ উট দান করলেন এবং অন্যদেরকে তাদের অংশের সাথে অতিরিক্ত আরও ৫০টি করে উট দিলেন।

যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (সা) অসম্ভব উদারতা ও মহানুবতা প্রদর্শন করেছিলেন। একই সাথে, তিনি (সা) প্রদর্শন করেছিলেন অসাধারন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদশির্তা। কিন্তু, তাঁর এ সুচিন্তিত ও দূরদর্শীতাপূর্ণ পদক্ষেপের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যে অনেক মুসলিমই বুঝতে পারল না। আনসাররা, যারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে কিছুই পেল না, তারা মুহাম্মদ (সা) এর এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করতে শুরু করলো এবং দূর্ভাগ্যবশতঃ বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে তাদের অন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। আনসারদের মধ্য হতে একজনের কথায় তাদের এই ক্ষোভের বিষয়টি শেষপর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে পড়লো। ক্ষোভের সাথে সে বললো, “আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর নিজের লোকজনের স্বার্থ রক্ষা করেছেন।”এ পর্যায়ে, সা’দ ইবন উবাদাহ আল্লাহর রাসুলের কাছে গিয়ে তাঁকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। আল্লাহর রাসূল (সা) সা’দকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ ব্যাপারে তোমার অবস্থান কোথায় সা’দ?” উত্তরে তিনি বললেন, “আমি আমার লোকদের সাথে একমত।” আল্লাহর রাসূল (সা) তাকে বললেন, “তাহলে তুমি তোমার লোকদের সবাইকে এখানে একত্রিত করো।” যখন এ বিষয়ে সচেতন সবাই একসাথে হলো, তখন মুহাম্মদ (সা) তাদেরকে বললেন, “তোমাদের  কাছ  থেকে  আজ  আমি  একি  শুনতে  পাচ্ছি? তোমরা কি আমার ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষন করছো? আমি কি তোমাদের কাছে এমন এক অবস্থায় আসিনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে আমার মাধ্যমে পথ দেখিয়েছেন? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না, অতঃপর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বচ্ছলতা দিয়েছেন? তোমরা কি একে অপরের শত্রু ছিলে না, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের হৃদয়কে ভালোবাসায় পূর্ণ করেছেন?” উত্তরে তারা বললো, “হ্যাঁ, সবই আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের অনুগ্রহ।” তিনি (সা) আবারও বললেন, “তোমরা কেন উত্তর দিচ্ছো না, হে আনসারেরা?” তারা উত্তরে বললো, “কিভাবে আমরা আপনার কথার উত্তর দিবো? যখন সকল অনুগ্রহ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের।” রাসূল (সা) বললেন, “তোমরা চাইলে এ কথা বলতে পারো যে, যখন সবাই আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে, আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি। আপনি যখন অসহায় ছিলেন আমরা তখন আপনাকে সাহায্য করেছি। আপনি যখন ভাসমান ছিলেন, আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। যখন আপনি নিঃস্ব ছিলেন তখন আমরা আপনাকে স্বস্থি দিয়েছি। তাহলে, এর প্রতিটি কথার উত্তরে আমি বলবো তোমরা সত্য কথা বলছো। আজ তোমরা দুনিয়ার সামান্য কিছু ভালো জিনিসের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করছো, অথচ আমি দূর্বল মুসলিমদের এ উদ্দেশ্যে তা দিয়েছি যেন তা দিয়ে তাদের অন্তরকে জয় করতে পারি। আর, তোমাদের উপর আমি দ্বীন ইসলাম এর আমানত অর্পন করেছি। তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও হে আনসাররা যে, অন্য সব লোক ভেড়া আর উটের পাল নিয়ে ফেরৎ যাবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবে? সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, যদি আমাকে হিজরত করতে না হতো তবে আমি তোমাদের মতোই আনসার হতাম। যদি সমস্ত মানুষ একদিকে যায় আর আনসাররা যায় অন্য পথে, তবে আমি তোমাদের পথে যাওয়াই পছন্দ করবো। হে আল্লাহ! তুমি আনসারদের উপর তোমার করুণা বর্ষণ করো, করুণা বর্ষণ করো তাদের সন্তান এবং তারপরে তাদের সন্তানদের উপর।”একথা শুনে আনসাররা তাদের ভুল বুঝতে পেরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। এমনকি কাঁদতে কাঁদতে তাদের দাঁড়ি অশ্রুতে ভিজে গেল। কান্নাজড়িত কন্ঠে তারা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আমাদের অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট আর আপনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট।”

এরপর, আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর দলবল নিয়ে মক্কায় উমরাহ করার উদ্দেশ্যে গমন করলেন। মক্কার শাসনকার্য পরিচালনার জন্য উতবা ইবন উসাইদকে সেখানকার ওয়ালী হিসাবে নিযুক্ত করলেন। আর, সেখানকার জনগণকে ইসলামের শিক্ষা দান করার জন্য মনোনিত করলেন মুয়া’দ ইবন জাবালকে। তারপর, তিনি (সা) আনসার ও মুহাজিরদের সহ মদীনায় ফিরে আসলেন।

Leave a Reply