ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ২৫ (মু’তার যুদ্ধ)

প্রতিনিধি দল বহির্বিশ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পরপরই আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন এবং আরব ভূ-খন্ডের বাইরে জিহাদ করার ঘোষনা দেন। এ লক্ষ্যে, তিনি (সা) রোমান ও পারস্যের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে আরম্ভ করেন। আর, রোমান সাম্রাজ্যের সাথে তাঁর সীমান্ত যুক্ত থাকায় তিনি (সা) তাদের গতিবিধির উপর বিশেষ ভাবে নজর দেন এবং গুপ্তচরের মাধ্যমে ধারাবাহিক ভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। রাসূল (সা) তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার কারণে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি একবার আরব ভূ-খন্ডের বাইরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো যায়, তবে ইসলামের আহবানকে বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। তাই তিনি (সা) এ লক্ষ্যে, আল-শাম (বৃহত্তর সিরিয়া) থেকেই জিহাদের সূচনা করবেন বলে স্থির করেন। কারণ, খসরুর ইয়েমেনের গর্ভনর বরহান ইসলাম গ্রহন করার পর তিনি (সা) সেখান থেকে কোনরকম আক্রমণের আশঙ্কা মুক্ত ছিলেন। এজন্য, তিনি (সা) রোমানদের মুকাবিলা করার জন্য আল-শামেই সৈন্য পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। এরপর, হিজরী ৭ম সালের জুমাদিউল ’উলা মাসে, হুদাইবিয়া সন্ধির কয়েকমাস পরেই তিনি (সা) তিন হাজার যোদ্ধার এক দক্ষ বাহিনী তৈরী করেন। যায়েদ ইবন হারিছাহকে এ বাহিনীর নেতা নিযুক্ত করে নির্দেশ দেন যে, “যদি যায়েদ নিহত হয় তবে, জা’ফর নেতৃত্বে থাকবে, আর জা’ফর নিহত হলে ’আব্দুল্লাহ ইবন রুওয়াহাহ্ নেতৃত্ব দেবেন।”

নির্দেশ পাবার পর সৈন্যবাহিনী নিদিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা শুরু করে, আর নও মুসলিম হিসাবে খালিদ ইবন ওয়ালিদ (তিনি হুদাইবিয়া সন্ধির পরপরই ইসলাম গ্রহন করেছিলেন) তাদের সঙ্গী হন। রাসূল (সা) সৈন্যদলের সাথে মদীনার প্রান্তবর্তী সীমানা পর্যন্ত যান। মুসলিম যোদ্ধাদের তিনি (সা) নারী, পঙ্গু বা অচল ব্যক্তি ও শিশুদেরকে আক্রমণ না করার নির্দেশ দেন এবং সেইসাথে, গাছপালা বা বাড়ীঘরও ধ্বংস করতে নিষেধ করেন। তারপর, রাসূল (সা) এবং মদীনার বাকী মুসলিমরা সৈন্যদলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলেন, “এ যাত্রায় আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন, তোমাদের রক্ষা করুন আর নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন ।”

এরপর, সৈন্যবাহিনী রনাঙ্গনের দিকে এগিয়ে যায়। এর মধ্যেই নেতৃস্থানীয়রা যুদ্ধের কৌশল নির্ধারন করে। তারা ঠিক করে যে, শত্রুকে ত্বড়িৎগতিতে আচম্কা আক্রমণ করে তাদের বিজয়কে সুনিশ্চিত করবে, ঠিক যেভাবে রাসূল (সা) আক্রমণ পরিচালনা করে থাকেন। সৈন্যদলের নেতৃস্থানীয় যোদ্ধারা এতে সম্মতি দিলে তারা উদ্দেশ্য সাধনে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু, মু’য়ান (আরবের উত্তরাঞ্চল) এলাকায় পৌঁছানোর পর তারা শুনতে পায় যে, হিরাক্লিয়াসের আল-শাম অঞ্চলের গভর্নর শারহাবিল আল-গাচ্ছানী তাদের মুকাবিলার উদ্দেশ্যে ১,০০,০০০ সৈন্য সমাবেশ করেছে। আকস্মিক এ সংবাদে তারা হতবিহবল হয়ে দুই রাত সেখানেই যাত্রা বিরতী করে এবং ভয়ঙ্কর এ বাহিনীকে কিভাবে মুকাবিলা করবে সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। এ অবস্থায় তারা চিন্তা করে দেখে যে, তাদের জন্য সবচাইতে নিরাপদ পদক্ষেপ হচ্ছে রাসূল (সা)-কে পত্র মারফত অবস্থা বণর্না করা। তিনি (সা) যদি তাদের সাহায্য করার জন্য আরও সৈন্য পাঠান তো ভাল, আর তা না হলে, পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য তারা তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে।

এ অবস্থায় ’আব্দুল্লাহ ইবন রুওয়াহাহ্ সৈন্যদলকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বলেন, “আল্লাহর কসম! তোমরা শাহাদতের পেয়ালা পান করার জন্যই এখানে এসেছো, যদিও তোমরা মৃত্যুকে অপছন্দ করো। জেনে রাখো, শত্রুর সাথে আমরা আমাদের সংখ্যা কিংবা শক্তিসামর্থ্য দিয়ে যুদ্ধ করি না, আমরা যুদ্ধ করি আমাদের দ্বীন ইসলামের শক্তি দিয়ে যা দিয়ে আল্লাহতায়ালা আমাদের সম্মানিত করেছেন। সুতরাং, তোমরা নির্ভয়ে এগিয়ে যাও। শাহাদত কিংবা বিজয়, দুটোর যে কোনটাই আমাদের জন্য পছন্দনীয়।” একথা শোনার পর, মুসলিম বাহিনী ঈমানী শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠে এবং দৃঢ় চিত্তে শত্রুপক্ষের মুকাবিলায় এগিয়ে যায়, যে পর্যন্ত না তারা মাশরিফ নামের এক গ্রামে পৌঁছে। শত্রুপক্ষ যখন মুসলিম বাহিনীর দিকে এগিয়ে আসে ততক্ষনে মুসলিমরা মু’তাহ গ্রামে প্রবেশ করেছে। এখানেই, দুইপক্ষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়। শুরু হয় যুদ্ধ।

মু’তার প্রাঙ্গনে এ যুদ্ধ ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহ। যুদ্ধের ময়দানের সর্বত্র ছিল মৃত্যুর বিভীষিকা, আর চারিদিকে বইছিলো রক্তের বন্যা। শাহাদতের অমিয় স্বাদ পান করার তীব্র আকাঙ্খায় মাত্র ৩০০০ মুসলিম সৈন্য জীবন বাজি রেখে লড়েছিল ২,০০,০০০ রোমান যোদ্ধার সাথে (রোমানরা তাদের বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য আরও ১,০০,০০০ অতিরিক্ত সৈন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল)। ভয়ঙ্কর ও অসম এ যুদ্ধে যায়িদ ইবন হারিছাহ্ ইসলামের পতাকা হাতে লড়াই করছিলেন। এক পর্যায়ে, পরিণামের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে তিনি শত্রুব্যুহ ভেদ করে অরক্ষিত অবস্থায় রোমান সৈন্যদের ভেতরে ঢুকে যান। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তিনি প্রচন্ড সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার সাহসিকতা ছিল দুর্দান্ত আর নায়কচিত বীরত্ব ছিল অতুলনীয়। শেষ পর্যন্ত শত্রুর বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এরপর জা’ফর ইবন আবি তালিব ইসলামের পতাকা তুলে নেন। জা’ফর ছিলেন ৩৩ বছরের সুদশর্ন এক টগবগে যুবক। মৃত্যুর ভয়ঙ্কর বিভীষিকাকে উপেক্ষা করে তিনিও বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। একপর্যায়ে, শত্রুপক্ষ তার সওয়ারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিনি ক্ষিপ্র গতিতে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তলোয়ারের এক আঘাতে ঘোড়ার পায়ের রগ কেটে দেন। তারপর, দ্রুততার সাথে শত্রুকে আঘাত করতে করতে পায়ে হেঁটেই শত্রুবুহ্যের একেবারে ভেতরে ঢুকে যান। এ সময়ে এক রোমান সৈন্য তাকে তলোয়ারের আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে হত্যা করে ফেলে। এরপর, আব্দুললাহ্ ইবন রুওয়াহাহ্ পতাকা তুলে নেন এবং ঘোড়ার পিঠে চড়ে শত্রুর মুকাবিলায় অগ্রসর হন। প্রথম দিকে সামনে এগুতে একটু দ্বিধাগ্রস্থ হলেও একরকম জোর করেই তিনি নিজেকে ভয়ঙ্কর রণক্ষেত্রে ঠেলে দেন, তারপর যুদ্ধ করতে করতে একসময় তিনিও শহীদ হয়ে যান। এ সময়ে, ছাবিত ইবন আকরাম পতাকা হাতে বলেন, “মুসলিমরা! তোমরা একজনের পেছনে সারিবদ্ধ হও।”এরপর, মুসলিমরা খালিদ ইবন আল- ওয়ালিদের পেছনে সমবেত হয়। খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ তার সৈন্যদলকে এমন দক্ষতার সাথে সজ্জিত করেন, যাতে শত্রুপক্ষ বেশ চাপের মুখে পড়ে যায়। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত তিনি শত্রুপক্ষকে ছোট ছোট আক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য করেন।

বস্তুতঃ এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, কারণ শত্রুপক্ষের বিপুল সংখ্যার তুলনায় মুসলিম বাহিনী ছিল অত্যন্ত নগন্য। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে, রাতের বেলায় খালিদ চাতুর্যপূর্ণ এক যুদ্ধকৌশলের পরিকল্পনা করেন। খালিদ তার বাহিনীর একটি অংশকে শোরগোল তৈরী করার জন্য পেছনে রেখে দেন, যাতে  রোমানরা মনে করে মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য আরও সৈন্যদল এসে পৌঁছেছে। হট্টগোল শুনে রোমানরা ভীত হয়ে একপর্যায়ে আক্রমণ বন্ধ করে দেয়। এমনকি এ অবস্থায় খালিদ (রা) আক্রমণ বন্ধ করলে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে যায়। এরপর, খালিদ (রা) যুদ্ধের ময়দান থেকে তার সৈন্যদল প্রত্যাহার করে নেন এবং দলবল নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। যদিও এ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী বা পরাজিত কোনটাই হয়নি, কিন্তু তাদের অর্জন ছিল উল্ল্যেখযোগ্য।

এ যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুসলিমদের প্রত্যেকেই জানত যে, প্রতিটি মূহুর্তে মৃত্যু তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, কিন্তু তারপরেও তারা বীরের মতো যুদ্ধ করেছে এবং মৃত্যুকে নির্ভয়ে আলিঙ্গন করেছে। কারণ, আল্লাহর জন্য হত্যা করতে বা জীবন দিতে মুসলিমরা আদিষ্ট। আর, আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করা হচ্ছে বিনিয়োগের সবচাইতে লাভবান ক্ষেত্র। এটাই হচ্ছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

“নিশ্চয়ই, আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মু’মিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, যাতে তারা [কখনো] হত্যা করে এবং [কখনো] নিহত হয়। এ সত্য অঙ্গীকার করা হয়েছে তাওরাত, ইঞ্জিল এবং কুরআনে। আর, কে আছে যে আল্লাহ অপেক্ষা অঙ্গীকার পালনে অধিক সত্যবাদী? অতএব, তোমরা আনন্দ করতে থাকো তোমাদের এই ক্রয়-বিক্রয়ের উপর যা তোমরা সম্পাদন করেছ, আর এটাই হচ্ছে চুড়ান্ত সফলতা।” [সুরা তওবাঃ ১১১]

আর, এ কারণেই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এ যুদ্ধের নায়করা বীরের মতো যুদ্ধ করেছে। তারা এটাও প্রমাণ করেছে যে, যুদ্ধ ছাড়া মুসলিমদের জন্য যদি অন্য কোন পথ খোলা না থাকে, তাহলে তাদের অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে, নিশ্চিত মৃত্যুর বিভীষিকা কখনোই বিবেচ্য বিষয় হবে না। আর, জিহাদের ক্ষেত্রেও শত্রুপক্ষের সংখ্যা, শক্তিসামর্থ্য, অস্ত্রসস্ত্র এগুলো বিবেচ্য বিষয় হবে না, বরং লক্ষ্য অর্জনই হবে মূল বিষয়, তার জন্য যতো বড় ত্যাগেরই প্রয়োজন হোক না কেন কিংবা তার ফলাফল যাই হোক না কেন।

মুসলিমদের সাথে রোমানদের এই যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে জন্য মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মুসলিম সেনানায়কদের যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে মুকাবিলা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। বস্তুতঃ মুসলিমদের মৃত্যুর ভয়ে কখনোই ভীত হওয়া উচিত না। আর, না তাদের আল্লাহর পথে জিহাদ করা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন বিষয় চিন্তা করা উচিত। এ যুদ্ধের শুরু থেকেই আল্লাহর রাসূল (সা) জানতেন রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তে তাদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ানো কতোটা বিপদজনক। কিন্তু, শত্রুপক্ষের অন্তরে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এটা খুবই কার্যকরী উপায় ছিল। আর সমস্ত বিশ্ববাসীকে এটা দেখানোও প্রয়োজন ছিল যে, সংখ্যায় নগন্য হওয়া সত্তেও বিশ্বাসীরা কিভাবে শুধু তাদের অতুলনীয় ঈমানী শক্তিকে পুঁজি করে, তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য দুর্দান্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুকে মুকাবিলা করতে পারে। প্রকৃত অর্থে, জিহাদই হচ্ছে একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে মুসলিমরা নতুন নতুন ভূ-খন্ড জয় করে সেখানে ইসলামের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করতে পারে, ছড়িয়ে দিতে পারে ইসলামের আলোকিত আহবান বিশ্বব্যাপী। আর, এ যুদ্ধ মূলতঃ মুসলিমদের অপরিহার্য সেই জিহাদের জন্যই প্রস্তুত করেছিল, সাফল্যের সাথে ক্ষেত্র তৈরী করেছিল পরবর্তীতে রোমানদের সাথে সংঘটিত তাবুক যুদ্ধের। মু’তার যুদ্ধ রোমানদের এত বেশী নাড়া দিয়েছিল যে, পরবর্তীতে মুসলিমরা আল-শাম জয় করা না পর্যন্ত দুঃসাহসী এ বাহিনীর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনাই ছিল রোমানদের আতঙ্কের ব্যাপার।

Leave a Reply