ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ২৪ (প্রতিবেশী দেশে দূত প্রেরণ)

যেহেতু, ইসলাম একটি সার্বজনীন দ্বীন এবং এ দ্বীন প্রেরণ করাই হয়েছে মানব জাতির সার্বিক কল্যাণে, তাই হেযাযে ইসলামী দাওয়াত একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছানোর সাথে সাথেই মুহাম্মদ (সা) হেযাযের বাইরে ইসলামের আহবান ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। কারণ, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

 “এবং আমি তোমাকে সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত হিসাবে পাঠিয়েছি।” [সুরা আম্বিয়াঃ ১০৭]

আল্লাহতায়ালা সুরা সাবা-তে আরও বলেছেন,

“এবং আমি তোমাকে সমস্ত মানবজাতির প্রতি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসাবে প্রেরণ করেছি।” [সুরা সাবাঃ ২৮]

এছাড়া, আল্লাাহতায়ালা সুরা তওবাতে বলেছেন,

“নিশ্চয়ই তিনি রাসূল পাঠিয়েছেন হেদায়েত ও সত্যদ্বীন সহকারে যেন এই দ্বীন সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়, যদিও মুশরিকরা তা ঘৃণা করে।” [সুরা তওবাঃ ৩৩]

নিজ দেশে ইসলামী দাওয়াতকে শক্তিশালী করা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা রক্ষায় সামর্থ্য অজর্ন করার পরই আল্লাহর রাসূল (সা) বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ আরম্ভ করেন। তিনি (সা) একে একে বিভিন্ন স্থানে তাঁর দূত পাঠাতে আরম্ভ করলেন। তাঁর শাসন-কর্তৃতের বাইরের সমস্ত আরব ভূ-খন্ডকে তিনি (সা) ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আওতায় নিয়ে এসেছিলেন। তারপর, যখন, সমস্ত হেযায অঞ্চলে তাঁর কতর্ত্বৃ প্রতিষ্ঠিত হল, তখন আরবের সীমানার বাইরের যে কোন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগকে পররাষ্টনীতি হিসাবে বিবেচনা করা হত। যেমনঃ পারস্য বা রোমান সাম্রাজ্য। ইতিমধ্যে, হুদাইবিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এবং খায়বারে ইহুদীদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হবার পর পুরো হেযায অঞ্চলেই মুহাম্মদ (সা)-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ, কুরাইশদেরও আসলে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোন শক্তি ছিল না। এ রকম অবস্থাতেই তিনি (সা) বহির্বিশ্বে তাঁর প্রতিনিধি দল পাঠান। যা হোক, ইতিহাস বলে, ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন দেবার জন্য নিজভূমিতে রাসূল (সা)-এর শাসন-কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হবার পরই তিনি (সা) বহির্বিশ্বে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন।

খায়বার থেকে প্রত্যাবর্তনের একদিন পর রাসূল (সা) সাহাবীদের ডেকে বললেন, “হে আমার লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা আমাকে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং, ঈসা ইবন মারিয়মের হাওয়ারীদের মতো তোমরা আমার বিরুদ্ধাচারন করো না।” তখন সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিভাবে হাওয়ারীগণ তার বিরুদ্ধাচারণ করেছিল হে আল্লাহর রাসূল?” তিনি (সা) বললেন, “তিনি তাদের আহবান করেছিলেন, যার দিকে আমি তোমাদের আহবান করছি। কিন্তু, কাউকে নিকটবর্তী কোন স্থানে প্রেরণ করা হলে সে তা মেনে নিত। অথচ, দূরবর্তী স্থানে প্রেরণ করা হলে সে তা অপছন্দ করতো এবং পিছে পড়ে থাকত।”

এরপর তিনি (সা) তাঁর সাহাবীদের বললেন যে তিনি (সা) হিরাক্লিয়াস (রোমান অধিপতি), খসরু (পারস্যের অধিপতি), আল-মাওকিস (মিশরের অধিপতি), আল-হারিছাহ আল-গাচ্ছানী (হীরার অধিপতি), আল-হারিছাহ আল-হিমইয়ারী (ইয়েমেনের অধিপতি) এবং আল-নাজ্জাশী (আবিসিনিয়ার অধিপতি)-কে ইসলামে আহবান জানিয়ে দূত প্রেরণ করতে চান। সাহাবারা এ কথায় সম্মত হলেন এবং রাসূল (সা) এর জন্য ”মুহাম্মদ, আল্লাহর রাসূল”কথাটি খোদাই করা একটি রুপার সীলমোহর তৈরী করলেন। এরপর, তিনি (সা) এ সমস্ত শাসকবর্গকে ইসলামের দিকে আহবান জানিয়ে তাদের কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। হিরাক্লিয়াসের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছানোর জন্য দাহিয়াহ ইবন খালিফাহ আল-কালবী, খসরুর কাছে আব্দুল্লাহ ইবন হুযাইফা আল-সাহমী, নাজ্জাশীর কাছে উমর ইবন উমাইয়া আল-দামরী, মুকাওকিসের কাছে হাতিব ইবন আবি বালতা, ওমানের বাদশাহর কাছে ’আমর ইবন আল ’আস আল-সাহমী, আল ইয়ামামাহর বাদশাহর কাছে সুলাইত ইবন ’আমর, বাহরাইনের বাদশাহর কাছে আল-’আলা ইবন আল-হাদারামী, আল-হারিছাহ আল-গাচ্ছানী, তুকহাম আল-শামের বাদশাহর কাছে সুজা ইবন ওয়াহাব আল-আসাদী এবং আল-হারিছাহ আল-হিমইয়ারীর কাছে আল-মুহাজির ইবন উমাইয়া আল-মাখযুমী কে দূত হিসাবে প্রেরণ করলেন।

প্রেরিত দূতেরা একই সাথে যাত্রা শুরু করেন এবং আল্লাহর রাসূল (সা) এর নির্দেশ অনুযায়ী নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছান। প্রেরিত দূতেরা এসব শাসকবর্গের কাছে রাসূল (সা) এর বার্তা পৌঁছে দেন। আল্লাহর রাসুলের আহবানে বেশীর ভাগই শাসকই মোটামুটি ইতিবাচক সাড়া দেয়। আর এদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত রূঢ় ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। আরবের শাসকদের মধ্যে, ইয়েমেন ও ওমানের বাদশাহ্ রূঢ় প্রতিক্রিয়া জানায়। বাহরাইনের বাদশাহ ইতিবাচক সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহন করে। আর, ইয়ামামার বাদশাহ বলে, সে ইসলাম গ্রহন করতে প্রস্তুত যদি তাকে শাসক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। আল্লাহর রাসূল (সা) তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। আর, অনারব শাসকদের মধ্যে, আল্লাহর রাসুলের চিঠি পাঠ করার পর পারস্যের অধিপতি খসরু অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে সে চিঠি টুকরা টুকরা করে ফেলে। শুধু তাই নয়, হেযাযের নেতার কর্তিত মস্তক তার কাছে হাজির করার জন্য সে তার ইয়েমেনের গর্ভনর বুদহানকে নির্দেশ দেয়।

আল্লাহর রাসূল (সা)-একথা শোনার পর বলেন, “আল্লাহ যেন খসরুর রাজত্ব টুকরা টুকরা করে দেন।” এদিকে, খসরুর নির্দেশ পাবার পর ইয়েমেনের গভর্নর বুদহান ইসলামের ব্যাপারে খোজঁ খবর নেন এবং খুব দ্রুতই ইসলাম গ্রহনের ঘোষনা দেন। তাকে মুহাম্মদ (সা) ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। যদিও তিনি প্রকৃত অর্থে আল-হারিছাহ আল-হিমইয়ারী অর্থাৎ, ইয়েমেনের বাদশাহ ছিলেন না। আর, মিশরের অধিপতি মুকাওকিস দাওয়াতের উত্তরে ইতিবাচক মনোভাব জানিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর জন্য উপহার পাঠান। নাজ্জাশীর মনোভাবও ছিল ইতিবাচক, বলা হয়ে থাকে যে, নাজ্জাশী আসলে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন। আর, হিরাক্লিয়াস আসলে রাসূল (সা) এর এ আহবানকে এত গুরুত্ব দেয়নি। না সে কোন সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে মনযোগী ছিল, আর না এ ব্যাপারে কিছু বলেছিল। আল-হারিছাহ আল-গাচ্ছানী যখন আরবের এ ধর্ম প্রচারককে শাস্তি দেবার জন্য সৈন্যদল পাঠানোর অনমুতি চায়,  তখন সে এর উত্তরে কিছুই বলেনি বরং, গাচ্ছানীকে আল-কুদসে (জেরুজালেম) যাবার নির্দেশ দিয়েছিল।

বহির্বিশ্বে এই দাওয়াতী কার্যক্রমের ফলে, আরবের লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। তারা দলবদ্ধ হয়ে রাসূল (সা)-এর কাছে ছুটে আসে এবং ইসলাম গ্রহনের ঘোষনা দেয়। আর, অনারবদের সাথে রাসূল (সা) জিহাদ করার ঘোষনা দেন এবং এজন্য তাঁর সৈন্যবাাহিনী প্রস্তুত করতে থাকেন।

আপনার ধান্দা কী?

Leave a Reply