আল্লাহর রাসূল (সা) হুদাইবিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১৫ দিন মদীনায় অবস্থান করেন। এরপর, তিনি (সা) সাহাবীদের খায়বার আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। সে সাথে তিনি (সা) এটাও বলেন যে, শুধু যারা হুদাইবিয়া প্রান্তরে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিল তারাই যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
বস্তুতঃ হুদাইবিয়া প্রান্তরে যাত্রা করার পূর্বেই রাসূল (সা) কুরাইশদের সাথে খায়বারের ইহুদী গোত্রগুলোর গোপন আঁতাতের খবর পেয়েছিলেন। মুসলিমদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য তারা একত্রিত হয়ে গোপনে মদীনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। গোপন এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হবার পরই তিনি (সা) কুরাইশদের সাথে যুদ্ধবিরতী চুক্তি সম্পাদন করার লক্ষ্যে মক্কায় শান্তিপূর্ণ সফরের পরিকল্পনা করেন। যেন, কুরাইশ গোত্রের সাথে তাঁর অভিষ্ট সন্ধি হওয়া মাত্রই তিনি (সা) খায়বারের বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের শায়েস্তা করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাই, কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধবিরতী চুক্তির মাধ্যমে যখন ইহুদীরা কুরাইশদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি (সা) মুসলিমদের খায়বার আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বললেন।
আল্লাহর রাসূল (সা) ১৬০০ মুসলিম পদাতিক ও ১০০ জন অশ্বারোহী নিয়ে খায়বারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এদের সকলেই ছিল আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে নিশ্চিত। যাত্রা করার তিনদিনের মধ্যে রাসূল (সা) তাঁর দলবল সহ খায়বার পৌঁছে যান এবং ইহুদীরা তাদের উপস্থিতি টের পাবার আগেই তাদের দূর্গ ঘেরাও করে ফেলেন। যদিও মুসলিমরা রাতেই খায়বারে ইহুদীদের বসতিতে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু, তা সত্তেও তারা আক্রমণ না করে শুধু দূর্গের বাইরে বসেই রাত পার করেছিল। সকালবেলায় ইহুদী গোত্রের কৃষকরা একে একে কোদাল-কাস্তে আর ঝুড়ি হাতে দূর্গের বাইরে বের হয়ে এল। হঠাৎ, দূর্গের পাশে মুসলিমদের দেখতে পেয়ে তারা ভয়ে পেছন ফিরে দৌড়ে পালালো আর চিৎকার করে বলতে লাগল, “মুহাম্মদ এসেছে তার বাহিনী নিয়ে।” তাদের চিৎকার শুনে রাসূল (সা) বললেন, “আল্লাহু আকবর (আল্লাহ মহান)! খায়বারের ইহুদীদের ধ্বংস আসন্ন। আমরা যখন কোন এলাকায় আগমন করি তখনই তাদের দূর্ভাগ্য সূচিত হয়; তাদের সকালটা তাদের জন্য মন্দ, যাদের পূর্বে সতর্ক করা হয়েছিল।”
খায়বারের ইহুদীরা হুদায়বিয়া সন্ধির বিষয়ে অবহিত হবার পর থেকেই মুহাম্মদ (সা)-এর কাছ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। ইহুদীদেরকে তাদের মিত্রপক্ষ কুরাইশ থেকে বিচ্ছিন্ন করাই যে এ চুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য, তারা এটা পরিস্কার ভাবে বুঝেছিল। নতুন এ বিপদজনক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ ওয়াদি আল-কুরা’ এবং তায়মা’র ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে নতুন মিত্রতা তৈরী করার প্রস্তাবও দিয়েছিল, যেন তারা একত্রিত হয়ে মদীনা আক্রমণ করতে পারে। তাহলে, তাদের নিজেদের রক্ষা করতে আরবদের থলের আর কোন দরকার হত না। বিশেষ করে, এরকম একটা বিপদজনক সময়ে যখন কুরাইশরা আল্লাহর রাসুলের সাথে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। অন্যান্য ইহুদীরা অবশ্য মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করার সুখস্বপ্নে বিভোর ছিল। তারা আশা করেছিল যে, মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেই হয়তো মুসলিমদের ইহুদী বিদ্বেষ দূর হয়ে যাবে। তারা মাঝে মাঝেই একে অপরকে সম্ভাব্য এ বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিত। তারা এটাও জানতো যে, মুহাম্মদ (সা) কুরাইশদের সাথে তাদের গোপন চক্রান্তের কথা জানতে পেরেছেন এবং তাদের আক্রমণ করতে একরকম প্রস্তুত হয়েই আছেন। কিন্তু, তাদের নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই, মুসলিমদের কাছ থেকে আকষ্মিক এ আক্রমণের জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ফলে, সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তারা ঘাতাফান গোত্রের সাহায্য চাইতে বাধ্য হল। তারা তাদের অবস্থানকে সুরক্ষিত করতে ও মুসলিমদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, মুসলিম সেনাবাহিনীর ত্বড়িৎ আক্রমণের মুখে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
অবশেষে, তারা মরিয়া হয়ে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর সাথে সমঝোতা করার শেষ চেষ্টা করল। তিনি (সা) তাদের জীবন ভিক্ষা দিলেন। শুধু তাই নয়, মুহাম্মদ (সা) তাদের নিজ নিজ গৃহে থাকারও অনুমতি দিলেন। বিজয়ের নীতি অনুসারে সিদ্ধান্ত হল যে, ইহুদীদের জমিজমা ও আঙ্গুরের বাগান মুহাম্মদ (সা)-এর অধিকারে থাকবে। ইহুদীরা তাদের কৃষিক্ষেত ও বাগানে কাজ করতে পারবে তবে, বাৎসরিক উৎপাদিত ফসল ও ফলমূলের অর্ধেক মুসলিমদের দিতে হবে। শেষপর্যন্ত তারা মুহাম্মদ (সা)-এর এ সকল শর্ত মেনে নিয়েই সেখানে বসবাস করতে সম্মত হয়।
এরপর, মুহাম্মদ (সা) সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরবর্তী বছর কাযা উমরাহ্ আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। খায়বারে ইহুদীদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব খর্ব করে ইসলামের শাসন-কর্তৃতের কাছে ইহুদীদের নতি স্বীকার করানোর মাধ্যমে বিপদজনক উত্তরাঞ্চল থেকে আল-শাম পর্যন্ত এলাকাকে রাসূল (সা) নিরাপদ এলাকায় পরিণত করেন। যেভাবে, তিনি (সা) হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের দক্ষিনাঞ্চলকে করেছিলেন বিপদমুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, রাসূল (সা) এই সব কর্মকান্ডই সমস্ত আরব ভূ-খন্ড ও বর্হিবিশ্বে ইসলামের আহবানকে প্রসারিত করার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল।