এভাবে, আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় হিজরতের পর একে একে ছয়টি বছর পার হয়ে যায়। ইতিমধ্যে, রাসূল (সা) মদীনায় ইসলামী সমাজের সার্বিক সুসংহত অবস্থা এবং শত্রু মুকাবিলায় তাঁর সৈন্যবাহিনীর শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান। আর, ইসলামী রাষ্ট্রও সমস্ত আরব ভূ-খন্ডে অন্যতম শক্তি হিসাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কিন্তু, তা সত্তেও, রাসূল (সা) তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম বিস্তারে নতুন নতুন পদক্ষেপের কথা চিন্তা করতে থাকেন, যাতে একই সাথে ইসলামের আহবানও হয় প্রতিনিয়ত শক্তিশালী, আর শত্রুপক্ষ হয় আরও দূর্বল।
এরমধ্যে, রাসূল (সা) এর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে, খায়বার ও মক্কার লোকেরা একত্রিত হয়ে আবারও মুসলিমদের আক্রমণ করার ফন্দি আঁটছে। এ খবর শোনার পর, মক্কার লোকদের নিবৃত করার জন্য তিনি (সা) একটি চমৎকার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল খায়বারের ইহুদীদেরকে তাদের মিত্র কুরাইশ গোত্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং একই সাথে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে সমস্ত আরব ভূ-খন্ডে রাসূল (সা) এর দাওয়াতী কার্যক্রমের পথ মসৃণ হয়ে যায়। এ লক্ষ্যে, তিনি (সা) তাঁর সাহাবীদের সহ পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করার উদ্দেশ্যে মক্কা যাবার পরিকল্পনা করেন। তিনি (সা) জানতেন যে, যেহেতু আরব গোত্রগুলো পবিত্র মাসে যুদ্ধ করে না, সেহেতু তাঁর জন্য এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। এছাড়া, তিনি (সা) এটাও জানতেন যে, ইতিমধ্যে কুরাইশদের ঐক্যে ফাটল ধরেছে এবং মুসলিমদের সম্পর্কে তাদের মনে যথেষ্ট পরিমাণ ভীতিও জন্মেছে। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে, মুসলিমদের ত্বড়িৎ বেগে আক্রমণ করার আগে তারা অবশ্যই দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। এ সমস্ত কিছু চিন্তা-ভাবনা করেই তিনি (সা) হজ্জ্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, যদি কুরাইশরা তাঁকে উমরাহ করতে বাঁধা দেয়, তাহলে তিনি (সা) এটাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। আর, এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের আহবানকেও জনসাধারনের কাছে অনেক গ্রহনযোগ্য করতে পারবেন।
এ সমস্ত সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে, আল্লাহর রাসূল (সা) যুল কা’দার পবিত্র মাসে হজ্জ্ব করার ঘোষনা দেন এবং আরবের অন্যান্য গোত্রগুলোকেও তাঁর সাথে শান্তিপুর্ণ এ সফরে অংশ নিতে আহবান করেন। বস্তুতঃ তিনি (সা) যে এবার শুধু হজ্জের উদ্দেশ্যেই মক্কা যাচ্ছেন, আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে নয়, এ বার্তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্যই তিনি (সা) আরব গোত্রগুলোকে তাঁর সাথে এ পবিত্র কাজে শরীক হতে আহবান করেন। এমনকি, যারা তাঁর দ্বীনের অর্ন্তভূক্ত নয় অর্থাৎ অমুসলিম গোত্রগুলোকেও তিনি (সা) তাঁর সঙ্গী হতে আহবান জানান। যাতে সকলেই পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারে যে, তাঁর যুদ্ধ করার কোন অভিপ্রায় নেই।
এ সফরে রাসূল (সা) নিজে তাঁর মাদী উট কুসউয়া’র পিঠে চড়ে নেতৃত্ব দেন এবং ১৪০০ সাহাবী ও ৭০ টি উট সহ মদীনা ত্যাগ করেন। আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবা সফরের এই শান্তিপূর্ণ মনোভাব সকলকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে তিনি (সা) ইহরাম বাঁধা অবস্থায় যাত্রা শুরু করেন। মদীনা থেকে ছয় বা সাত মাইল দূরত্বে যুল হালিফাহ্ নামক জায়গায় পৌঁছালে অন্যান্য সাহাবীরাও ইহরাম বাঁধেন এবং ইহরামের কাপড় পড়েন। তারপর, তারা আবার মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কুরাইশরা পূর্বেই শুনেছিল যে, মুহাম্মদ (সা) হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা দিকে আসছেন। কিন্তু, তারা এটা ভেবে ভীত হয় যে, হয়তো মক্কায় প্রবেশের জন্য এটা মুহাম্মদদের নতুন কোন চাল। এ সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে না পেরে তারা শেষ পর্যন্ত মক্কা প্রবেশকালে মুহাম্মদ (সা)-কে বাঁধা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ কাজে কুরাইশরা খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ ও ইকরামাহ্ ইবন আবি জাহল এর নেতৃত্বে দুইশত দুর্দান্ত অশ্বারোহীর একটি দলকে নিযুক্ত করে। মুশরিকদের এ দলটি মদীনা থেকে আগত হজ্জ্বযাত্রীদের বাঁধা প্রদানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। ধি তুহা নামক স্থানে পৌঁছে তারা যাত্রা বিরতী করে এবং হজ্জ্বযাত্রীদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এদিকে, রাসূল (সা) উসফান গ্রামে প্রবেশ করলে কুরাইশদের প্রেরিত এ বাহিনী সম্পর্কে খবর পান। এ গ্রামের কা’ব নামের এক ব্যক্তিকে রাসূল (সা) কুরাইশদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় যে, “কুরাইশরা আপনার আগমনের সংবাদ পেয়ে, বাঘের চামড়া পরিধান করে দুগ্ধবতী উটের পিঠে আপনাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। তারা ধি তুহায় যাত্রা বিরতী করে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে এবং প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তাদের সাথে মুকাবিলার আগপর্যন্ত তারা আপনাকে কোনভাবেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। তাদের অশ্বারোহী দলের সাথে রয়েছে খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ, যাকে তারা আগে থেকেই কুরা’আল ঘামিম এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছে।”উসফান থেকে কুরা’আল ঘামিম এর অবস্থান ছিল আট মাইল দূরত্বে।
একথা শোনার পর রাসূল (সা) বললেন, “ধ্বংস হোক কুরাইশরা! যুদ্ধ তাদেরকে আসলে গ্রাস করেছে। কি তাদের এমন ক্ষতি হত যদি তারা আমাদের ও অন্য গোত্রগুলোকে আমাদের হালে ছেড়ে দিত? তাদের অন্তরের অভিলাষ হল, যদি তারা আমাকে হত্যা করতে পারত! যদি আল্লাহতায়ালা আমাকে বিজয়ী করেন তাহলে তারা ইসলামে দলে দলে প্রবেশ করবে। যদি তারা তা না করে তবে শক্তি অর্জন করার পর তারা আমার সাথে যুদ্ধ করতো। সুতরাং, তারা আসলে চায় কি? আল্লাহর কসম, আল্লাহতায়ালা যে কাজের জন্য আমাকে নিযুক্ত করেছেন তার জন্য আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতেও পিছ পা হব না। হয় আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন অথবা আমি ধ্বংস হয়ে যাব।”
এরপর, আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর পরিকল্পনার উপরই অটল থাকলেন এবং গভীর ভাবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। কারণ, এবারে তাঁর কৌশল ছিল শান্তিপূর্ণ এবং যুদ্ধের কোন প্রস্তুতি নিয়েও তিনি (সা) আসেননি। কিন্তু, তাঁর যুদ্ধ করার ইচ্ছা না থাকলেও কুরাইশদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করা এবং এ উদ্দেশ্যেই তারা দলবল পাঠিয়েছে। সুতরাং, তিনি (সা) ভাবতে লাগলেন, তাঁর কি মদীনায় ফিরে যাওয়া উচিত, নাকি পূর্বপরিকল্পনা বাতিল করে যুদ্ধ করা উচিত? তিনি (সা) মুসলিমদের ঈমান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন। তিনি (সা) এটাও জানতেন যে, যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন পথ যদি তাঁদের জন্য খোলা না থাকে তাহলে মুসলিমরা নির্দেশ পাওয়া মাত্র যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে এতটুকু পিছ পা হবে না।
যাই হোক, অনেক চিন্তা ভাবনার পর রাসূল (সা) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁর আশঙ্কা অনুযায়ী যদি তাঁকে হজ্জ্ব করতে বাঁধা দেওয়াও হয় তবুও তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়েই সমস্ত ব্যাপারটি ফয়সালা করবেন। এ ব্যাপারে তিনি (সা) কুরাইশদের সাথে কোনরকম সংঘর্ষে যাবেন না বা বিরূপ পরিস্থিতিতে জোরপূর্বক হজ্জ্বও করবেন না। কারণ, এবার তিনি (সা) কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বেরও হননি বা আক্রমণ করার কথা চিন্তাও করেননি। এছাড়া, এবার তাঁর শান্তিপূর্ণ এই পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামের আহবানের মহানুভবতা ও সৌন্দর্যকে কুরাইশদের কাছে তুলে ধরা এবং ইসলামের পক্ষে মক্কায় জনমত তৈরী করা। আর, কুরাইশদের নির্বোধ গোর্য়াতুমি, পথভ্রষ্টতা ও ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক মনোভাব থেকে ইসলাম যে কতো উপরে সেটাও মক্কার সমাজের মানুষের কাছে তুলে ধরা। কারণ, ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রমকে সঠিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু তাই নয়, সমাজে ইসলামের পক্ষে জনমত তৈরীর মাধ্যমেই ইসলামী দাওয়াতের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে, ফলে ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসাবে আর্বিভূত হয়। তিনি (সা) ভেবে দেখলেন যে, তিনি (সা) যদি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে মক্কায় ইসলামের পক্ষে জনমত তৈরীর পরিকল্পনাটা ভেস্তে যেতে পারে। সুতরাং, তিনি (সা) সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কোন অবস্থাতেই তিনি (সা) কোনরকম সংঘর্ষে যাবেন না এবং তাঁর শান্তিপূর্ণ পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করবেন।
এ পর্যায়ে, আল্লাহর রাসূল (সা) গভীর ভাবে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে রাসূল (সা) এর দক্ষতা ও বিচক্ষনতা ছিল অতুলনীয়। এ বিচক্ষনতা ও দূরদর্শিতা থেকেই তিনি (সা) তাঁর শান্তিপূর্ণ পুর্বপরিকল্পনায় অটল থাকতে চাচ্ছিলেন। তিনি (সা) কোনভাবেই চাচ্ছিলেন না তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাক কিংবা জনমত তৈরী করার চমৎকার এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাক। কারণ, তাঁকে যদি কোন কারণে যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে তাঁর পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে তাঁর কাছেই ফিরে আসবে। তখন কুরাইশরা এ চমৎকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত আরবে ভয়ঙ্কর প্রচারনা চালাবে। পরিণতিতে জনমত চলে যাবে তাঁর বিপক্ষে। তিনি (সা) মুসলিমদের ডাকলেন এবং বললেন, “কেউ কি আছে যে আমাদের এমন এক রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সে রাস্তায় কুরাইশ বাহিনীর সাথে মুকাবিলা হবে না?” মুসলিমদের মধ্য হতে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে এগিয়ে এল এবং তাদেরকে পাহাড়ের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ন পাথুরে গিরিপথের ভেতর দিয়ে নিয়ে চললো যে পর্যন্ত না তারা হুদাইবিয়া নামে মক্কার নিম্নবর্তী এক উপত্যকায় পৌঁছাল। এখানেই রাসূল (সা) তাঁর দলবল সহ অবস্থান নিলেন। খালিদ ও ’ইকরামাহ্ সৈন্যদল মুহাম্মদ (সা) এর দলবলকে হুদাইবিয়া প্রান্তরে দেখে আতঙ্কিত হয়ে মক্কা রক্ষায় দ্রুত সেখানে ফিরে গেল। মুসলিম বাহিনীর এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ দেখে পৌত্তলিকদের মেরুদন্ডে যেন আতঙ্কের স্রোত প্রবাহিত হয়ে গেল। তারা নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না, কিভাবে মুসলিমরা এতো দক্ষতা ও চতুরতার সাথে তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাদের অরক্ষিত সীমান্তে এসে উপস্থিত হল। এই পুরিস্থিতিতে, কুরাইশরা মক্কার ভেতর সূদৃড় অবস্থান নিল আর রাসূল (সা) তাঁর বাহিনী নিয়ে অবস্থান নিলেন হুদাইবিয়ার প্রান্তরে। দুইপক্ষ এভাবে মুখোমুখি অবস্থায় দিন পার করতে থাকল এবং প্রত্যেকেই ভাবতে লাগলো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপের কথা। মুসলিমদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবল যে, কুরাইশরা তাদের কোন অবস্থাতেই হজ্জ্ব পালন করতে দেবে না। বরং, তাদের সাথে যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুতি নেবে। তারা ভেবে দেখল যে, এ অবস্থায় তাদের আসলে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ ব্যতীত কোন পথ খোলা নেই। তাই, তাদের উচিত শত্রুপক্ষের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া, তারপর হজ্জ্ব পালন করা। এর ফলে, কুরাইশদেরকে চরম একটা শিক্ষা দেয়া যাবে।
ইতিমধ্যে, কুরাইশরাও মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করার স্বপ্ন বিভোর হল। এমনকি, যদি তারা যুদ্ধ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় তবুও। কিন্তু, খুব শীঘই্র তাদের এ সব সুখ স্বপ্ন বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেল। কারণ, তারা জানত মুখোমুখি হবার জন্য মুসলিমরা হচ্ছে সবচাইতে ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ। তাই, তারা শেষ পর্যন্ত মুসলিমদের পক্ষ থেকেই প্রথম পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল।
প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, আল্লাহর রাসূল (সা) ইহরাম বাঁধা অবস্থায় পূর্ব পরিকল্পনার উপরই অটল থাকলেন। হুদাইবিয়ার প্রান্তরে তিনি (সা) শুধু দৃঢ়তার সাথে অবস্থান গ্রহন করলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন কুরাইশদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। তিনি (সা) এটা খুব ভাল করেই জানতেন যে, কুরাইশরা তাঁর ভয়ে অত্যন্ত ভীত এবং খুব শীঘ্রই তারা তাঁর সাথে হজ্জ্ব পালন বিষয়ে দেনদরবার করার জন্য প্রতিনিধি পাঠাবে। সুতরাং, তিনি (সা) ধৈর্য্য সহকারে কুরাইশদের প্রতিনিধি দলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর, কুরাইশরা প্রথমে খুযায়া গোত্রের কিছু লোক সহ বুদাইল ইবন ওরাকা কে রাসূল (সা) এর কাছে পাঠায়। প্রতিনিধি দল এসে জানতে চায় যে, রাসূল (সা) আসলে কি জন্য মক্কায় আগমন করেছেন। কিছুক্ষন কথাবার্তার পরই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে. মুসলিমদের মক্কা আক্রমণ করার আসলে কোন উদ্দেশ্য নেই। বরং, তারা পবিত্র কাবাঘরের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্যই মদীনা থেকে যাত্রা করেছে।
প্রতিনিধি দল কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করে এবং পুরো ব্যাপারটি তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, কুরাইশরা তাদের কথা অবিশ্বাস করে এবং বলে যে, তারা মুহাম্মদ (সা) এর কথায় প্রভাবিত হয়ে গেছে। কুরাইশরা এরপর আরেকটি প্রতিনিধি দল পাঠায়, তারাও তাদের কাছে এসে একই কথাই বলে। এরপর, কুরাইশরা আল-আহবাস (আবিসিনিয়ার অধিবাসী) গোত্রের প্রধান আল-হুলাইসকে রাসূল (সা) এর সাথে দেনদরবার করার জন্য পাঠায়। কুরাইশরা একরকম নিশ্চিত ছিল যে, আল-হুলাইসের মুহাম্মদ (সা) কে নিবৃত করতে পারবে। আসলে, রাসূল (সা) এর বিরুদ্ধে হুলাইসকে ক্ষেপিয়ে তোলাই ছিল তাদের হুলাইসকে পাঠানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য। তারা ভেবেছিল, হুলাইস যখন রাসূলুল্লাহর সাথে কোন মীমাংসায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হবে, তখন মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি তার ঘৃণা আরও বেড়ে যাবে। ফলে, সে মুহাম্মদ (সা) এর আক্রমণ থেকে মক্কা রক্ষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব আরও দৃঢ় হবে। যা হোক, মুহাম্মদ (সা) যখন হুলাইসের আসার কথা শুনলেন তিনি (সা) তাদের কুরবানীর পশুগুলোকে মুক্ত করে দিতে বললেন যেন সে বলতে পারে মুসলিমরা হজ্জ্বের জন্যই এসেছে, যুদ্ধের জন্য নয়।
আল-হুলাইস উপত্যকার পাশ থেকে আগত কুরবানীর পশুগুলোকে তার পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখল। সে আরও দেখল উমরাহ করার জন্য মুসলিমদের প্রস্তুত করা তাঁবুগুলো হজ্জ্বের মতো পবিত্র ইবাদতের আমেজে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তাদেরকে দেখে মনেও হচ্ছে না যে, তারা যুদ্ধ করতে এসেছে। এ সব কিছু দেখে সে এতো অভিভূত হল যে, সে নিশ্চিত হয়ে গেল যে, মুসলিমরা যুদ্ধ করতে নয় বরং হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যেই এসেছে। এমনকি সে মুহাম্মদ (সা) এর সাথে সাক্ষাৎ না করেই কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল এবং তাদেরকে সবকিছু বিস্তারিত বর্ণনা করল। শুধু তাই নয়, ফিরে এসে সে কুরাইশদের ধমক দিয়ে বলল, যেন তারা মুহাম্মদ (সা) এবং কাবার মাঝে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। আর, মুসলিমদের নির্বিঘ্নে হজ্জ্ব পালন করতে দেয়া হয়। এর ব্যতিক্রম হলে, সে তাঁর সৈন্যদল প্রত্যাহার করে নেবে। কুরাইশরা তাদের উদ্যত স্বরকে নমনীয় করে হুলাইসকে শান্ত করল। তারা হুলাইসের কাছে আরও ভাল কোন প্রস্তাবের জন্য কিছুটা সময় চেয়ে নিল। হুলাইস এতে সম্মতি দিলে তারা ’উরওয়া ইবন মাস’উদ আল-ছাকাফিকে পরবর্তী প্রতিনিধি হিসাবে পাঠাল এবং তারা ছাকাফিকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করল যে, তারা তার দেয়া সিদ্ধান্তকেই মেনে নেবে। ’উরওয়া ইবন মাস’উদ রাসূল (সা) এর কাছে গিয়ে তাকে হজ্জ্ব না করে মদীনার ফেরত যাবার অনুরোধ করল। কিন্তু, তার সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল।
একই সাথে, এটাও স্বীকার করল যে, মুহাম্মদ (সা) এর অবস্থানই সঠিক। তারপর সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “হে কুরাইশরা! আমি খসরুর দরবারে গিয়েছি, কায়সারের দরবারেও গিয়েছি, গিয়েছি নাজ্জাশীর দরবারেও। কিন্তু, পৃথিবীর কোথাও আমি এমন কোন বাদশাহ্ দেখিনি যিনি মুহাম্মদের চাইতে বেশী তাঁর সঙ্গীদের ভালোবাসা পেয়েছেন। যখন তিনি ওজু করেন তখন তাঁর সাহাবারাও সাথে সাথে তা করার জন্য দৌড়ে যায়। যদি তাঁর একটা চুলও পড়ে যায় তবে তারা তা কুড়াবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছুটে যায়। আমার ধারণা, তারা কোন অবস্থাতেই মুহাম্মদকে পরিত্যাগ করবে না। সুতরাং, তোমরা কি করবে তা তোমরা নিজেরাই ঠিক কর।”
কিন্তু, উরওয়া ইবন মাস’উদের এ দ্বিধাহীন বক্তব্য শুধু মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি কুরাইশদের বিদ্বেষ, ঘৃণা আর প্রতিহিংসাই বৃদ্ধি করল। তাদের অন্ধ গোঁর্য়াতুমি ও মিথ্যা অহঙ্কার পরবর্তী মধ্যস্থতার সকল পথকে রুদ্ধ করে দিল। তাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার আর কোন মূল্যই থাকল না। এরপর, রাসূল (সা) তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি (সা) ভাবলেন, হয়ত কুরাইশ প্রতিনিধিরা তাঁর সাথে আলোচনা করার ব্যাপারে আতঙ্ক বোধ করছে। তাই তিনি (সা) তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠালেন এবং আশা করলেন হয়ত সে কুরাইশদের সাথে মধ্যস্থতা করতে সমর্থ হবে। কিন্তু, কুরাইশরা রাসূল (সা) এর প্রতিনিধিকে বহনকারী উটের পায়ের রগ কেটে ফেলল এবং দূতকে হত্যা করতে উদ্যত হল। সৌভাগ্যবশতঃ আল-আহবাসের সেনাদল তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসল। মুসলিমদের প্রতি কুরাইশদের বিদ্বেষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং তারা এক পর্যায়ে মুসলিমদের তাঁবুতে পাথর নিক্ষেপ করার জন্য তাদের বখাটে ছেলেদের লেলিয়ে দেয়। কুরাইশদের এ হীন আচরনে মুসলিমরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু রাসূল (সা) তাদেরকে শান্ত করেন। পরদিন, কুরাইশরা মুসলিমদের ছাউনী ঘেরাও করে তাদের প্রহার করার জন্য ৫০ জনের একটি দল পাঠায়। কিন্তু, মুসলিমরা তাদের বন্দী করে রাসূল (সা)এর কাছে নিয়ে যায়। রাসূল (সা) তাদের ক্ষমা করে দেন এবং তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেন।
মুহাম্মদ (সা) এ মহানুভব আচরন মক্কাবাসীদের প্রচন্ড ভাবে নাড়া দেয় এবং এরপর তাদের মুহাম্মদ (সা) এর দাবীর ব্যাপারে আর কোনই সন্দেহ থাকে না। তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, মুহাম্মদ (সা) আসলে প্রথম থেকে সত্য কথাই বলে আসছেন। এ ঘটনা তাদের পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিল যে, মুহাম্মদ (সা) আসলে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যেই এসেছেন, যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নয়। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে, মুহাম্মদ (সা) মূলতঃ মক্কার জনসাধারনের জনমত তাঁর নিজের পক্ষে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। এরফলে, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, তিনি (সা) যদি তাঁর দলবল নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে চান আর কুরাইশরা যদি তাদের মক্কা প্রবেশ কালে বাঁধা দিতে চায়, তবে মক্কার জনগণ ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলোই মুহাম্মদ (সা) এর সাহায্যে এগিয়ে আসবে এবং মুসলিমদের সমর্থন করবে। সুতরাং, এ পর্যায়ে কুরাইশরা তাদের উদ্দেশ্যমূলক প্ররোচনা থেকে নিজেদের বিরত করল এবং খুব গুরুত্বের সাথে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে মনোযোগ দিল। রাসূল (সা) এরপর আরেকজন দূতকে তাঁর পক্ষ থেকে কুরাইশদের নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তিনি (সা) ওমর ইবন খাত্তাবকে মক্কার যাবার নিদের্শ দিলেন। কিন্তু ওমর (রা) তাঁকে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি কুরাইশদের কাছে আমার জীবননাশের আশঙ্কা করছি। কারণ, এখন আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য বনু আদি ইবন কা’ব আর মক্কায় নেই। আর আপনি কুরাইশদের সাথে আমার শত্রুতা এবং তাদের প্রতি আমার রূঢ় ব্যবহার সম্পর্কেও জানেন। আমি এক্ষেত্রে, আমার পরিবর্তে উসমান ইবন আফফানের নাম প্রস্তাব করতে চাই, যাকে পাঠানো আমার থেকেও বেশী ফলপ্রসু হবে।”
ওমর (রা) এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে রাসূল (সা) উসমান ইবন আফফানকে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠিয়ে দেন। উসমান (রা) মক্কায় গিয়ে আল্লাহর রাসুলের বার্তা কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেন। তারা তাঁকে কাবাঘর তাওয়াফ করার প্রস্তাব দিয়ে বলে, “তুমি যদি কাবাঘর প্রদক্ষিন করতে চাও তবে তা করতে পার।”উত্তরে উসমান (রা) বলেন, “আমি ততক্ষন পর্যন্ত তা করব না যতক্ষন পর্যন্ত না আল্লাহর রাসূল (সা) তা করেন।”উসমান (রা) এরপর কুরাইশদের সাথে শান্তিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন, কিন্তু প্রথম পর্যায়ে কুরাইশরা তা পুরোপুরি প্রত্যাখান করে। শান্তিুচুক্তির বিষয়ে এই আলোচনার ক্ষেত্র ছিল ব্যাপক এবং সে সময়ে তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কুরাইশরা শান্তি চুক্তিকে পুরোপুরি প্রত্যাখানের অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকে এবং এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়ায় যাতে উভয়পক্ষের কাছেই তা গ্রহনযোগ্য হয়। একসময় তারা ’উসমান (রা) এর সাথে আলোচনা করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকে এবং তাঁর সাথে একত্রে বসেই অনেক বাকবিতন্ডার পর অবশেষে জটিল এ সমস্যা থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে বের করে। যার ফলশ্রুতিতে, মুহাম্মদ (সা) এর সাথে তাদের যুদ্ধাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে।
এদিকে উসমান (রা) যখন মক্কায় তাঁর অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করেন এবং মক্কার রাস্তাঘাটের কোথাও তাকে দেখা যায়না, তখন মুসলিম শিবিরে রটে যায় যে, কুরাইশরা তাঁকে হত্যা করেছে। এ সংবাদ শোনার পর, মুসলিমরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে যায় এবং কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে, রাসূল (সা) আবার নতুন করে তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর কাছে মনে হয়, দূত হিসাবে মক্কায় গমনের পরও পবিত্র মাসে উসমানকে হত্যা করে কুরাইশরা তাঁর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এ কারণে, তিনি (সা) ঘোষনা দেন, “শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত আমরা এ স্থান ত্যাগ করব না।”তিনি (সা) সাহাবীদের সকলকে নিয়ে একটি গাছের নীচে দাঁড়ান এবং এ স্থানেই তাদের সকলের কাছ থেকে বাই’য়াত গ্রহন করেন। আমৃত্যু লড়ার শপথ করে তারা রাসূল (সা) এর নিকট বাই’য়াত করেন। বাই’য়াত গ্রহন সম্পন্ন হলে, রাসূল (সা) তাঁর এক হাত দিয়ে আরেক হাত শক্ত করে ধরে উসমান (রা) এর পক্ষে এমন ভাবে বাই’য়াত করেন যে, মনে হয় যেন উসমান (রা) তাঁদের সাথেই আছেন। এ বাই’য়াত পরবর্তীতে বাই’য়াত আল-রিদওয়ান নামে পরিচিত হয়। এসম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন,
“নিশ্চয়ই, আল্লাহ ঈমানদারদের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন যখন তারা গাছের নীচে তোমার নিকট বাই’য়াত করেছিল। তিনি জানতেন তাদের হৃদয়ে কি আছে এবং তিনি তাদের জন্য (তাদের অন্তরে) সাকীনাহ (প্রশান্তি ও স্বস্তি) দান করলেন। এবং বিজয়কে নিকটবর্তী করে তিনি তাদের পুরস্কৃত করলেন।” [সুরা ফাতহ্ঃ ১৮]
যখন বাই’য়াত গ্রহন সম্পন্ন হল এবং মুসলিমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল, এ সময়ে মুসলিম শিবিরে খবর পৌঁছাল যে, উসমান (রা) কে হত্যা করা হয়নি। এর পরপরই উসমান (রা) ছাউনীতে ফিরে আসেন এবং কুরাইশদের প্রস্তাব সম্পর্কে রাসূল (সা) কে অবহিত করেন। এরপর, আবারও মুহাম্মদ (সা) এবং কুরাইশদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা শুরু হয়। এরপর, কুরাইশরা সুহাইল ইবন আমরকে দুই শিবিরের মধ্যে যুদ্ধবিরতী চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য রাসূল (সা) এর নিকট দূত হিসাবে প্রেরণ করে। কুরাইশদের দূত সেইসাথে মুসলিমদের হজ্জ্ব এবং উমরাহ্ পালন বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করে। আলোচিত দ্বিতীয় বিষয়টিতে তাদের শর্ত ছিল যে, মুসলিমদের এবার হজ্জ্ব না করেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু, পরবর্তী বছরে তাদের হজ্জের অনমুতি দেয়া হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের এ সমস্ত চুক্তি মেনে নিয়েই তাদের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। কারণ, তিনি (সা) বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি (সা) যে উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন ইতিমধ্যে তা অজির্ত হয়ে গেছে। সুতরাং, তিনি (সা) এবার পবিত্র ঘর তাওয়াফ করেন বা না করেন তাতে আর কিছুই আসে যায় না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রমের পথকে মসৃণ ও বাধামুক্ত করতে এবং ইসলামের সুমহান বাণী আরবের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে তিনি (সা) চেয়েছিলেন খায়বারের বিশ্বাসঘাতক ইহুদী গোত্রগুলোকে পুরোপুরি কুরাইশদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। কারণ, ইহুদী আর কুরাইশদের এই মৈত্রীই প্রকৃত অর্থে তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম বিস্তারের পথে বিরাট বাঁধা সৃষ্টি করেছিল আর ইসলাম প্রচার-প্রসারের পথকে করেছিল রুদ্ধ। এ লক্ষ্যেই তিনি (সা) কুরাইশদের সাথে একটি যুদ্ধবিরতী চুক্তি স্বাক্ষর করতে উদগ্রীব ছিলেন যেন কুরাইশদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আক্রমণের আশঙ্কা না থাকে। আর, হজ্জ্ব কিংবা উমরাহ্ পালন করা আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কারণ, সেটা তিনি (সা) পরবর্তী বছরই করতে পারতেন।
যুদ্ধবিরতী চুক্তি এবং এর শর্তাবলীর ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সা) সুহাইল ইবন ’আমরের সাথে দীর্ঘ সময় যাবত সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আসলে, এই আলোচনা ছিল খুবই ব্যাপক এবং একটা সমঝোতার জায়গায় এসে দুইপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার বিষয়টি ছিল খুবই কঠিন কাজ। একেক সময় মনে হচ্ছিল আলোচনা ফলপ্রসু হবে না এবং পুরো ব্যাপারটিই ভেস্তে যাবে। আল্লাহর রাসুলের প্রচন্ড পরিমান রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা না থাকলে হয়তো পুরো ব্যাপারটি ভেস্তেও যেত। মুসলিমরা খুব কাছ থেকেই পুরো ব্যাপারটি পর্যবেক্ষন করে এবং তারাও ভাবে যে, রাসূল (সা) উমরাহ্ করার বিষয়েই দেনদরবার করছেন। কিন্তু, রাসূল (সা) এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের সাথে যুদ্ধবিরতী চুক্তি সম্পাদন করা। যে জন্য, চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে মুসলিমরা বিরক্ত হলেও আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে এটাকেই আল্লাহর রহমত মনে করেন। ফলে, তিনি (সা) চুক্তির প্রতিটি শর্ত ও স্বল্পমেয়াদী সুযোগসুবিধার দিকে লক্ষ্য না করে, সুহাইলের ইচ্ছা অনুযায়ীই আলোচনা চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত, কিছু নির্দিষ্ট শর্তাবলীর ভিত্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধবিরতী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির শর্তাবলী মুসলিমদের অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত করে। তারা অপমানজনক এ চুক্তি প্রত্যাখান করে কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করাকেই শ্রেয় মনে করে এবং এ জন্য রাসূল (সা) কে বারবার অনুরোধও করে। চুক্তির শর্ত দেখে ওমর (রা) লাফিয়ে উঠে যায় এবং আবু বকর (রা) এর কাছে গিয়ে বলেন, “কেন আমরা এমন সব শর্ত মেনে নিচ্ছি যা আমাদের দ্বীনকে হেয় প্রতিপন্ন করছে?” ওমর (রা) তাঁর সঙ্গে রাসূল (সা) এর কাছে গিয়ে এ চুক্তি বাতিলের দাবীতে আবেদন করার জন্য আবু বকর (রা) কে জোর করতে থাকেন। আবু বকর (রা) তাঁকে এ ধরণের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখার নিষ্ফল চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ওমর (রা) একাই রাসূল (সা) এর কাছে যান এবং চুক্তির ব্যাপারে তাঁর ক্রোধ ও উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু, এ সব কোন কিছুই রাসূল (সা) এর সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং, তিনি (সা) ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও প্রচন্ড মানসিক দৃঢ়তার সাথে তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি (সা) ওমর (রা) কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “আমি আল্লাহর রাসূল ও তাঁর অনুগত দাস। আমি অবশ্যই তাঁর আদেশ লঙ্ঘন করে কোন কাজ করব না এবং অবশ্যই তিনি আমাকে অপমানিত ও ক্ষতিগ্রস্থ করবেন না।”
চুক্তিপত্র তৈরী করার জন্য রাসূল (সা) আলী ইবন আবু তালিবকে নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে লিখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “লিখ, শুরু করছি আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও পরম দয়ালু।”এ সময় সুহাইল বাঁধা দিয়ে বলে, “থামো! আমি পরম করুণাময় ও পরম দয়ালু একথা মানতে রাজী নই। বরং, তুমি লিখ, তোমার নামে, হে প্রভু”। রাসূল (সা) আলী (রা) কে তাই লিখার নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি (সা) বললেন, “লিখ, এটা হচ্ছে সেই চুক্তি যা স্বাক্ষরিত হয়েছে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ ও সুহাইল ইবন আমরের মধ্যে”। এ পর্যায়ে সুহাইল আবারও বাঁধা দিয়ে বললো, “থামো! যদি আমি স্বীকারই করে নিতাম তুমি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তোমাদের আমাদের মধ্যে কোন বিরোধই থাকত না। বরং, তুমি তোমার নাম ও তোমার বাবার নাম লিখ।” রাসূল (সা) আলী (রা) কে বললেন, “লিখ, এটা হচ্ছে সেই চুক্তিপত্র, যা মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ, সুহাইল ইবন আমরের সাথে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে।” শুরুতে এ বাক্যগুলি লিখার পর নিম্নোক্ত শর্তাবলীর ভিত্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধিপত্র লিখা হয়ঃ
১. যুদ্ধবিরতী সময়কালে উভয়পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা কোনরকম আক্রমণাত্মক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকবে।
২. যদি কুরাইশদের মধ্য হতে কেউ ইসলাম গ্রহন করে এবং গোত্র প্রধানের অনুমতি ব্যতীত মুহাম্মদ (সা) এর নিকট পালিয়ে যায় তবে, তিনি (সা) তাকে কুরাইশদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু, মুহাম্মদ (সা) এর নিকট থেকে যদি কেউ কুরাইশদের কাছে গমন করে তবে তারা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে না।
৩. আরব গোত্রসমূহের মধ্য থেকে যে কেউ যদি স্বাক্ষরিত এ চুক্তির পক্ষে মুহাম্মদ (সা) এর মিত্র হতে চায় তবে, তা তারা পারবে। আবার, যদি কেউ কুরাইশদের মিত্র হতে চায় তবে তাও তারা পারবে।
৪. মুহাম্মদ (সা) ও মুসলিমদের এবার হজ্জ্ব না করেই মদীনায় ফিরে যেতে হবে। সামনের বছর তাদের মক্কায় প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন বাঁধা থাকবে না। তবে, তখন তারা মাত্র তিনদিন মক্কায় অবস্থান করতে পারবে। এ সময় তারা কোষবদ্ধ তলোয়ার ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধাস্ত্র বহন করতে পারবে না।
৫. এই চুক্তি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং এ সময়কাল হচ্ছে স্বাক্ষরিত হবার সময় থেকে পরবর্তী দশবছর।
ইতিমধ্যে, এ চুক্তির ব্যাপারে মুসলিমদের মাঝে প্রচন্ড অসন্তোষ ও অস্থিরতা তৈরী হয়। তাদের এ ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের ভেতর দিয়েই আল্লাহর রাসূল (সা) সুহাইল ইবন আমরের সাথে এ চুক্তি সম্পাদন করেন। মুসলিম শিবিরে দানা বেঁধে উঠা এ প্রচন্ড উত্তেজনা ও ভয়ানক অসন্তোষের মধ্যে আল্লাহর রাসূলকে রেখে সুহাইল মক্কায় ফিরে যায়। যুদ্ধ করার জন্য মুসলিমদের এতো ব্যাকুলতা ও চুক্তি স্বাক্ষরের পর তাদের চরম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করে আল্লাহর রাসূল (সা) ভেতরে ভেতরে খুবই মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড অসহায় বোধ করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত, তিনি (সা) তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামাহ্ (রা) এর কাছে তাঁর অন্তরের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ও হতাশার কথা খুলে বলেন। উম্মে সালামাহ্ (রা) তাঁকে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! মুসলিমরা কখনোই আপনার অবাধ্য হবে না। তারা তো শুধু তাদের দ্বীন, আল্লাহর উপর তাদের অবিচল ঈমান ও আপনার আনীত বাণীর ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। আপনি আপনার মাথা কামিয়ে ফেলুন এবং হাদীর পশুগুলোকে জবাই করে ফেলুন। দেখবেন, মুসলিমরাও সাথে সাথে আপনাকে অনুসরণ করবে। তারপর, তাদের নিয়ে আপনি মদীনায় ফিরে যান।”
উম্মে সালামাহ্ (রা) এর পরামর্শ অনুযায়ী রাসূল (সা) তাঁবু থেকে বেরিয়ে তাঁর মাথা মুড়িয়ে ফেলেন এবং উমরাহ্ আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত করে মানসিক ভাবে প্রশান্তি ও তৃপ্তি বোধ করেন। আল্লাহর রাসূল (সা) কে এ অবস্থায় দেখে মুসলিমরাও শেষপর্যন্ত নিজ নিজ পশু জবাই করার জন্য ছুটে যায় এবং মাথা মুড়িয়ে ফেলে। এরপর, রাসূল (সা) মুসলিমদেরসহ মদীনার পথে যাত্রা করেন। প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর আল্লাহতায়ালা সুরা ফাতহ্ নাযিল করেন। আল্লাহর রাসূল সদ্য নাযিলকৃত এ সুরার পুরোটাই সাহাবীদেরকে তিলওয়াত করে শোনান। শুধুমাত্র তখনই মুসলিমরা সত্যিকার ভাবে বলতে পারে যে, হুদাইবিয়া সন্ধির মাধ্যমে আসলে মুসলিমদেরই চুড়ান্ত বিজয় অজির্ত হয়েছে।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার পরপরই রাসূল (সা) এবার খায়বারের ইহুদীদের সাথে চুড়ান্ত বোঝাপড়া করে আরব ভূ-খন্ডের বাইরে ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেন। এর মাধ্যমে তিনি (সা) ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রমকেও শক্তিশালী করার চিন্তা করেন। হুদাইবিয়া সন্ধিকে কার্যকরী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে তিনি (সা) একদিকে বর্হিবিশ্বের সাথে সম্পর্ক তৈরীর চেষ্টা করেন। আবার, অন্যদিকে, এ সন্ধির মাধ্যমেই তিনি (সা) আরব ভূ-খন্ডে দাওয়াতী কার্যক্রমের পথে বাধা হয়ে দাড়ানো কিছু ক্ষুদ্র প্রতিরোধ বলয়কে ভেঙ্গে দেন। অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদশির্তা থেকে হজ্জ্ব পালন করার উছিলায় আল্লাহর রাসূল (সা) যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেছিলেন, এ চুক্তির মাধ্যমে তাঁর সে পুরো পরিকল্পনাই তিনি (সা) শেষপর্যন্ত বাস্তবায়ন করেন। লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেক বাঁধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্তেও, এ চুক্তির সুবাদেই তিনি (সা) পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর প্রতিটি উদ্দেশ্য হাসিল করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর এ সমস্ত সাফল্য পরবর্তীতে সন্দেহাতীত প্রমাণ করে দেয় যে, হুদাইবিয়া সন্ধি প্রকৃত অর্থেই মুসলিমদের জন্য বিজয়ের বার্তা বহন করে এনেছে। রাসূল (সা) এর অর্জিত কিছু সাফল্য হলঃ
১. হুদাইবিয়া প্রান্তরে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) সাধারণ ভাবে সমস্ত আরবের মধ্যে এবং বিশেষ করে কুরাইশদের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে জনমত তৈরী করতে পেরেছিলেন। যা প্রকৃত অর্থে আরবদের দৃষ্টিতে মুসলিমদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করেছিল এবং কুরাইশদের মর্যাদাকে করেছিল ক্ষুন্ন ।
২. এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদের ঈমানের দৃঢ়তা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলেন। বস্তুতঃ হুদাইবিয়া সন্ধি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছিল যে, মুসলিমদের ঈমান ইস্পাত কঠিন ও অনমনীয়। এছাড়া, দ্বীন রক্ষার খাতিরে তাদের দুঃসাহসী পদক্ষেপ ও স্বতঃস্ফুর্ত আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তও বিরল।
৩. এ ঘটনা থেকে মুসলিমরা এ শিক্ষাও লাভ করেছিল যে, ইসলাম প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে দক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক চাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।
৪. এর ফলে, মক্কায় অবস্থানকারী মুসলিমরা আসলে শত্রুবুহ্যের ভেতরে থেকেই ইসলামী দাওয়াতের ছোট ছোট কেন্দ্র তৈরী করেছিল।
৫. এছাড়া, এ চুক্তির মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গৃহীত সকল পদ্ধতিই একই উৎস, সত্যবাদীতা ও ন্যায়পরায়নতার ভিত্তিতে হতে হবে। তবে, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ও প্রজ্ঞার মাধ্যমেই লক্ষ্য অর্জনের পথ নির্ধারন করতে হবে। এক্ষেত্রে, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কৌশল হিসাবে, শত্রুপক্ষের কাছে লক্ষ্য অর্জনের উপায় ও প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন রাখা যাবে।