অর্থনীতিবিষয়ক অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক (Socialist) ধারণার জন্ম হয়েছে বিগত উনিশ শতকে। সমাজতান্ত্রিকরা খুবই কঠোরভাবে পুঁজিবাদী (Capitalist) অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে। সমাজতন্ত্রের এই শক্তিশালী আবির্ভাবের অন্যতম কারণ হল পুঁজিবাদের দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক অসমতা।
সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী হচ্ছে কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব। যার উপর ভিত্তি করে কমিঊনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান যুগেও তার তত্ত্বের অনেক প্রভাব রয়েছে। তার সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থের নাম হল ‘দাস ক্যাপিটাল’ (পুঁজি) যার মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদী চিন্তাবিদদের আক্রমণ করেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তা এড্যাম স্মিথ এর মতে, ”কোন পণ্যের মূল্য নির্ভর করে সে পণ্য উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তার উপর।” অর্থাৎ, যে পণ্য উৎপাদনে দুই ঘন্টা সময় লেগেছে তার মূল্য যা উৎপাদনে এক ঘন্টা সময় লাগে তার চাইতে বেশি। পরবর্তীতে রিকার্ডো এর সাথে সংযোজন করেন, “কোনো পণ্যের মূল্য শুধুমাত্র এটি উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম বা কাজ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে না বরং অতীতে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে এবং উৎপাদনের যন্ত্রপাতি তৈরীতে যে কাজ হয়েছে তার উপরও নির্ভর করে।”
মূল্যের এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মার্ক্স ব্যাক্তি মালিকানা ও পুঁজিবাদকে আক্রমণ করেন। তিনি মূল্য নির্ধারণের একমাত্র উৎস হচ্ছে পণ্য উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয়। সুতরাং, শ্রমিকের উৎপাদিত পণ্য বাজারে যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তার পূর্ণ দাবিদার হল শ্রমিক নিজে। কিন্তু, পুঁজিবাদী সমাজে মালিকপক্ষ শ্রমিককে সামান্য কিছু মজুরী দিচ্ছে এবং লাভের একটি বিরাট অংশ নিজের পকেটে পুড়ে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা শ্রমিককে শোষণ করছে।
যে চিন্তার উপর ভিত্তি করে মার্ক্সীয় দর্শন গড়ে উঠেছে তা হল ঐতিহাসিক বিবর্তনবাদ (Historical Evolution) বা অন্যভাবে বলা যায় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। এ তত্ত্বের সারাংশ নিম্নে উল্লেখ করা হল –
প্রত্যেক যুগে কোন একটি সমাজ ব্যবস্থা তার অর্থনৈতিক অবস্থার ফলাফল স্বরূপ। ব্যবস্থার এই রূপান্তর মূলত বস্তুগত অবস্থা (Material Situation) উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রাম বা দন্দ্বের ফলাফল। ইতিহাস আমাদের বলে, এই সংগ্রামের সমাপ্তি হয় যারা শোষিত এবং সংখ্যায় বেশী তাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। পূর্ব যুগেও এই দন্দ্ব বিদ্যমান ছিলো স্বাধীন মানুষ এবং দাসের মধ্য, এরপর অভিজাত ও প্রজার মধ্যে, তারপর অভিজাত ও কৃষকের মধ্যে, তারপর বিভিন্ন গোত্র প্রধানদের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বে শোষিত শ্রেণী সব সময় শোষক শ্রেণীর উপর জয়ী হবে।
ফরাসী বিপ্লবের সময় এই সংগ্রাম দন্দ্ব সংগঠিত হয় বুর্জোয়া (পুঁজিপতি) শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে যা মূলত দুটি শ্রেণীর স্বার্থের মাঝে দন্দ্ব এবং এর উৎস অর্থনৈতিক কারণ।
বর্তমান যুগে, উৎপাদনের উপায় বা হাতিয়ার পরিবর্তিত হয়েছে। উৎপাদন ব্যবস্থা এককেন্দ্রিক হতে বহুকেন্দ্রিক হলেও মালিকানা ব্যবস্থা বা ব্যাক্তিমালিকানার কোন পরিবর্তন হয় নাই। যার ফলে একজন মালিকের অধীনে শ্রম দানকারী অনেক শ্রমিকের এই মালিকানায় কোন অংশ নেই এবং তারা প্রতিনিয়ত শোষণের শিকার হচ্ছে। বাজারে পণ্যের মুল্য ও শ্রমিকের বেতনের এই পার্থক্য মার্ক্সের ভাষায় হল উদ্বৃত্ত মুল্য যা প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকের অংশ তা মালিক পক্ষ অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে। এই দন্দ্ব চলতে থাকবে যতদিন না মালিকানার ধরণ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে উপযোগী না হয়। অর্থাৎ ব্যাক্তি মালিকানা সামাজিক মালিকানায় পরিণত না হয় ততদিন। সামাজিক বিবর্তনের সুত্র মতে, এ দন্দ্ব অবশ্যই শোষিত শ্রেণী বিজয়ী হবে।
পুঁজির মালিকদের পরাজয়ের বীজ বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত এবং তাদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকবে। যার কারণ একাগ্রতা সূত্র (Law of Concentration) ও মুক্ত প্রতিযোগিতা পদ্ধতি (Process of Free Competition)। একাগ্রতা সূত্র মতে পুঁজিবাদীর সংখ্যা কমতে থাকবে এবং শ্রমিক শ্রেনীর সংখ্যা বাড়বে। মুক্ত প্রতিযোগিতা সূত্র মতে, উৎপাদন সীমা অতিক্রম করবে এবং উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধি পাবে যা স্বল্প বেতনভোগী শ্রমিকশ্রেনীর ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে হবে। এর ফলে মালিকরা তাদের পুঁজি হারাবে এবং ধীরে ধীরে শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। একাগ্রতা সূত্র (Law of Concentration) যদি কেঊ কোন শিল্প যেমন – চকলেট কারখানার নিয়ে গবেষণা করে তবে খেয়াল করবে কারখানার সংখ্যা দিন দিন কমবে অন্যদিকে শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে বড় কারখানাগুলো ছোট কারখানাগুলোকে গ্রাস করে নিবে।
এভাবেই, সংকট তৈরি হবে ও এর পুনরাবৃত্তি হবে যা একসময় পুঁজিবাদের মুল ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিবে। এর মধ্য দিয়ে কমিউনিজমের আবির্ভাব ঘটবে যা ঐতিহাসিক বিবর্তনের সর্বশেষ স্তর কারণ ইহা ব্যাক্তি মালিকানা ধ্বংস করে দিবে এবং এর ফলে কোন শ্রেণী থাকবে না ও দন্দ্ব ও থাকবে না।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজতান্ত্রিকরা সমাজে প্রতিটি ব্যাক্তির মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন – মুনাফার ক্ষেত্রে সাম্যতা, উৎপাদনের ক্ষেত্রে সাম্যতা অর্থাৎ, পরম সাম্যতা প্রতিষ্ঠা। এ ধরনের সাম্যতা অসম্ভব এবং অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই না। কারণ সৃষ্টিগতভাবে মানুষের দৈহিক ও মানসিক সংগঠন ক্ষমতা এক নয় এবং তাদের চাহিদা ও সন্তুষ্টির সীমার মাঝেও পার্থক্য রয়েছে। অন্যদিকে, কেউ যদি তাদের মধ্যে সমানভাবে পণ্য ও সেবা বন্টন করে দেয় এরপরও এসব সম্পদ উৎপাদনে ও কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সমতা বিধান সম্ভব না। তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের যে পরিমাণ তার ক্ষেত্রেও সমতা বিধান সম্ভব নয়।
মালিকানা ও উৎপাদনের উপায়ের মধ্যে পার্থক্য খুবই স্বাভাবিক। ব্যক্তি মালিকানার পুরোপুরি বিলুপ্তি মানুষের প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। মালিকানার ইচ্ছা মানুষের বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি হতে উৎসারিত এবং এই প্রকৃতিটিকে ধ্বংস করা সম্ভব নয় কারণ তা মানুষের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। সুতরাং, ব্যাক্তি মালিকানার বিলুপ্তি যা মানুষের প্রবৃত্তির সাথে সাংঘর্ষিক এবং তাকে অশান্তির দিকে ঠেলে দিবে। সুতরাং, এই প্রবৃত্তিকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করার চাইতে তা সংগঠনের চেষ্টা করা উচিত। যেমন – মানুষ কোন কোন সম্পদের মালিক হবে তা নির্ধারণ করা। অন্যদিকে, মানুষের সকল প্রকার সম্পদ অর্জনে যদি সীমারেখা টানা হয় তবে তারা অলস জাতিতে পরিণত হবে।
তারা বলে, শ্রমিক শ্রেণীর শোষণের সমাধান হল তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যাতে করে মালিক শ্রেণীর সাথে তাদের দন্দ্ব প্রবল হয় কিন্তু যদি মালিক শ্রেণী তাদের চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে সন্তুষ্ট করে তবে তারা শোষণ অনুভব করতে পারবে না এবং বিবর্তনও হবে না। সুতরাং, উৎপাদন ও বিতরণ এর সংগঠনের সমতা বাস্তবায়নের জন্য দ্বন্ধ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিবর্তন ঘটানো কখনো সমাধান হতে পারে না বরং সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করে সঠিক আইনের মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে।
কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বের মধ্যে ভুলগুলোর তিনটি দিক রয়েছে-
প্রথমত: মুল্য সম্বন্ধে তার মতবাদের মধ্যে ভ্রান্তি ও মতভেদ রয়েছে। তার মতে মুল্য হচ্ছে কোন পণ্য উৎপাদনে যে পরিমান কাজ বা শ্রম ব্যয়িত হয় তা কিন্তু বাস্তবে তা ঠিক নয়। কাজের পাশাপাশি পণ্যের কাঁচামাল, চাহিদা ও সরবরাহ ইত্যাদি কারণ মুল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। সুতরাং, মুল্যের একমাত্র উৎস হল ব্যায়িত শ্রম এই ধারণা সঠিক নয় যা পণ্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুপযোগী ধারণা।
দ্বিতীয়ত: তার মতে কোন একটি সময়ে যে সামাজিক কাঠামো তা ঐ সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থার ফলাফল এবং ব্যাবস্থার মধ্যে এই বিবর্তন শুধু একটি কারণে সংগঠিত হয় আর তা হল শ্রেণীগুলোর মধ্যে দন্দ্ব যার লক্ষ হল বস্তগত অবস্থার উন্নয়ন। এই মতবাদ ভ্রান্তিমূলক, ভিত্তিহীন এবং অনুমান নির্ভর। ঐতিহাসিক ঘটনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লষণ করলে তা সহজে অনুধাবন করা যায়। আমরা জানি, রাশিয়ার সমাজতন্ত্রে রূপান্তর কোন বস্তুগত বিবর্তন বা শ্রেণী দন্দ্বের মাধ্যমে সংগঠিত হয় নি। বরং একটি দল রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে, জনগনের উপর তার চিন্তাকে প্রয়োগ করে এবং ব্যবস্থার পরিবর্তন করে। রাশিয়া যে সকল রাষ্ট্র বিজয় করে তাতে তারা জোরপূর্বক সমাজতন্ত্র চালু করে যা কোন প্রাকৃতিক বিবর্তন নয়। অনুরূপভাবে, তৎকালীন রাশিয়া বা চীন ছিল কৃষি নির্ভর অন্যদিকে জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা ছিল শিল্প কারখানা নির্ভর যেখানে পুঁজির মালিকের সংখ্যা কম ও শ্রমিকের সংখ্যা বেশি ছিল। মার্ক্সের তত্ত্ব মতে, শ্রেনী দ্বন্ধের কারনে রাশিয়ার বিবর্তন না হয়ে ইংল্যান্ড বা আমেরিকার বিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু এসকল দেশে এখনো পুঁজিবাদ বাস্তবায়িত রয়েছে।
তৃতীয়ত: একাগ্রতা সূত্র (Law of Concentration) ও মুক্ত প্রতিযোগিতা পদ্ধতি (Process of Free Competition) মতে পুঁজিবাদীদের সংখ্যা কমতে থাকবে এবং শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা বাড়বে। এই তত্ত্বটি সঠিক নয় কারণ উৎপাদন বা কারখানার একাগ্রতা (Concentration) একটি নির্দিষ্ট সীমায় পৌছে বন্ধ হয়ে যাবে এবং তা বিবর্তনের জন্য প্রভাবক হিসাবে আর কাজ করবে না। আরও বলা যায় এর কোন অস্তিত্ব নাই, তা হল কৃষিখাত। তা হলে কিভাবে সমাজে বিবর্তন হবে? যা প্রমাণ করে এই সকল তত্ত্ব ভুল।
সমাজতন্ত্রে, সমাজের সমস্যার কারণ হিসেবে যে তত্ত্বগুলোর অবতারণা করা হয়েছে তা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক নয়। সমাধানগুলো অনুমান নির্ভর যা মানুষের প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করে ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।