ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ১৩ (ইসলামী সমাজ গঠন)

আল্লাহ তা’য়ালা প্রতিটি মানুষকে দিয়েছেন বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই মানুষ সবসময় একত্রিত হয়ে দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করতে চায়। আর দলবদ্ধ মানুষের পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা এবং একে অন্যের সাথে মেলামেশা একটি স্বাভাবিক প্রকৃতিগত ব্যাপার। কিন্তু, শুধুমাত্র কিছু মানুষের দলবদ্ধ ভাবে বসবাসের ব্যাপারটি একটি সমাজ তৈরী করে না। মূলতঃ ততক্ষন পর্যন্ত এই দলবদ্ধ মানুষগুলো একটি সমাজ তৈরী করতে পারে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা সকলের মাঝে বিদ্যমান একই ধরনের কিছু চিন্তা-ভাবনা দ্বারা পরস্পর আবদ্ধ হয়। একই ধরনের কিছু কারণকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিপদজনক বা হুমকি মনে করে থাকে এবং তা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চায়। দলবদ্ধ কিছু মানুষের মধ্যে যদি এ ধরনের একটি সম্পর্ক তৈরী হয়, শুধুমাত্র তখনই সত্যিকার অর্থে একটি সমাজ তৈরী হয়। আবার, নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ না হলে সত্যিকারের একটি সুষম সমাজও তৈরী হয় না।

বস্তুতঃ সুষম সমাজ তৈরীতে সমাজের মানুষের মধ্যে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন:

১.        সমাজের মানুষের মধ্যে চিন্তার একতা।

২.        মানুষে মানুষে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে সর্বসম্মত ভাবে গ্রহন করা না করার জন্য প্রয়োজন আবেগ-অনুভূতির মধ্যে একতা।

৩.        সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে সমাধান করার জন্যও প্রয়োজন একটি নির্ধারিত সমাজ-ব্যবস্থা।

তাই, কোন সমাজ সম্পর্কে কোন মতামত বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে প্রয়োজন সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারনা, বিদ্যমান আবেগ-অনুভূতি এবং সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষনা করে সমাজের প্রকৃত চরিত্র অনুধাবনের চেষ্টা করা। মূলতঃ উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোই নির্ধারন করে দেয় একটি সমাজ থেকে আরেকটি সমাজের পার্থক্য। ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমরা রাসূল (সা) হিজরত করার পর মদীনার তৎকালীন সমাজব্যবস্থার উপর আলোকপাত করবো।

সে সময়ে মদীনার সমাজ তিনটি দলে বিভক্ত ছিলো। একটি হলো আনসার ও মুহাজির নিয়ে গঠিত মুসলিমদের দল, যেটি ছিলো সর্ববৃহৎ। আরেকটি দলে ছিলো আউস ও খাযরাজ গোত্রের মূর্তিপুজারীরা (যারা ইসলাম গ্রহন করেনি) এবং তৃতীয় দলটি ছিলো ইহুদীদের, যারা আবার চারটি উপদলে বিভক্ত ছিলো। এদের মধ্যে একটি দল মদীনায় বসবাস করতো, যারা বনু কায়নুকা গোত্র নামে পরিচিত ছিলো। আর মদীনার বাইরের ইহুদীদের দলগুলো বনু নাদির, খায়বার এবং বনু কুরাইজা নামে পরিচিত ছিলো। প্রকৃতপক্ষে, মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার আগেও সেখানে ইহুদীদের আলাদা সমাজ ছিলো, যা মদীনার তৎকালীন সমাজ থেকে ছিলো একেবারেই ভিন্ন। জীবন সম্পর্কে মদীনার মুশরিক গোত্রগুলো থেকে ইহুদীদের সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারনাই ছিলো এর মূল কারণ। মূলতঃ তারা তাদের নিজস্ব এসব ধ্যান-ধারনার ভিত্তিতেই পরিচালনা করতো তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড। ফলে, ইহুদীরা মদীনার ভেতরে ও এর চারপাশে বসবাস করা সত্বেও কখনই মদীনার সমাজের অংশ হতে পারেনি। আর মুশরিকরা ছিলো সংখ্যালঘু এবং তারা মদীনার প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া ইসলামের আদর্শ দিয়ে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত ছিলো। এজন্য, ইসলাম গ্রহন না করলেও ইসলামী ধ্যান-ধারনা, আদর্শ এবং ইসলামের শাসন-কর্তৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করা ছিলো তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ঐক্য। ইসলামই তাদের কর্মকান্ডকে একসুরে বেঁধেছিলো এবং ইসলামের আলোকিত আদর্শই তৈরী করেছিলো তাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে একই ধরনের ধ্যান-ধারনা ও আবেগ-অনুভূতি। তাই এ আদর্শের ভিত্তিতেই তাদের জীবনের প্রতিটি কাজ পরিচালিত হওয়া ও তাদের মধ্যকার সম্পর্কগুলো তৈরী হওয়াও ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার।

আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরী করতে শুরু করলেন। তিনি মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে আহবান করলেন, যাতে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, ব্যবসায়িক লেনদেন এবং জীবনের অন্যান্য কর্মকান্ডের উপরও এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিদ্যমান থাকে। এ চিন্তা মাথায় রেখেই তিনি (সা) ’আলী ইবন আবি তালিব, তাঁর চাচা হামযা (রা) এবং তাঁর ক্রীতদাস যায়িদ (রা) এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করলেন। একই ভাবে আবু বকর (রা) এবং খারিযাহ ইবন যায়েদও পরস্পরের ভাই হলেন। তারপর তিনি (সা) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যেও একই ভাবে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করলেন। এভাবে, ’উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা) ও ’উতবাহ ইবন মালিক আল-খাযরাজি পরস্পরের ভাই হলেন। আবার, তালহাহ ইবন ’উবাইদুল্লাহ ও আবু আইয়ুব আল আনসারী এবং ’আবদ আল-রাহমান ইবন ’আওফ ও সা’দ ইবন আল-রাবি’য়াও পরস্পরের ভাই হয়ে গেলেন।

মদীনার সমাজে এই ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার ফলাফল বাস্তবিক ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিলো। এই ভ্রাতৃত্ববোধের কারণেই মদীনার আনসাররা তাদের মুসলিম  মুহাজির ভাইদের প্রতি প্রদর্শন করেছিলো  অকল্পনীয় উদারতা, যা  আনসার ও মুহাজিরদের সম্পর্ককে করেছিলো সুদৃঢ় ও মজবুত।

ভ্রাতৃত্বের দাবী অনুযায়ী তারা মুহাজিরদের অর্থ-সম্পদ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুতে অংশীদার করেছিলো। এমনকি তারা একসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৃষিকাজও করতো। মুহাজিরদের মধ্যে যাদের ব্যবসা করার মতো মনমানষিকতা ছিলো তারা আস্তে আস্তে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহন করতে লাগলো। যেমনঃ ’আবদ আর রহমান ইবন ’আউফ বাজারে মাখন বিক্রি করতেন। আর যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে গেল না, তারা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলো। যেমনঃ আবু বকর ও ’আলী (রা) আনসারদের জমিতে চাষাবাদ করতেন। রাসূল (সা) বললেন, “যার একখন্ড জমি আছে সে যেন তা চাষ করে, অথবা তার ভাইকে চাষ করার জন্য দেয়।”এভাবেই মুসলিমরা জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে লাগলো। কিন্তু, তারপরেও মুসলিমদের মধ্যে ছোট একটি দল রয়ে গেলো, যাদের না ছিলো কোন অর্থ, না পেল তারা কোন কাজ আর না ছিলো তাদের কোন থাকার জায়গা। তারা ছিলো খুবই অভাবী, তারা মুহাজির-আনসার কোন দলেরই অর্ন্তভূক্ত ছিলো না। এরা ছিলো মূলতঃ বেদুইন যারা ইসলাম গ্রহন করার পর মদিনায় এসেছিলো। রাসূল (সা) নিজে এদের দায়িত্ব নিলেন, মসজিদের এক অংশে তাদের থাকার  বন্দোবস্ত  করে  দিলেন  এবং  ক্রমে  এরা  আহল  আস  সুফ্ফাহ  নামে  পরিচিতি  লাভ  করলো।  মুসলিমদের  মধ্যে  যাদেরকে  আল্লাহতায়ালা স্বচ্ছলতা দিয়েছিলেন সে সব মহানুভব হৃদয়ের মানুষেরাই এদের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করতো। এভাবেই আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনার মুসলিমদের জীবনযাত্রাকে স্থিতিশীল করেছিলেন এবং তাদের পরস্পরের সাথে পরস্পরের সম্পর্ককে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। চারিদিকে কুফর পরিবেষ্টিত অবস্থায় মদীনার ইসলামী সমাজ এরকম একটি মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো বলেই তা মুনাফিক ও ইহুদীদের সকল হীন চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে সমর্থ হয়েছিলো। মদীনার ইসলামী সমাজ সবসময়ই ঐকবদ্ধ ছিলো এবং রাসূল (সা) মুসলিমদের মধ্যকার এই একতাকে নিশ্চিত করেছিলেন।

মদীনায় ইসলামী সমাজ গঠনে সেখানকার মুশরিকরা কখনোই কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রথমদিকে, তারা ইসলামী হুকুম- আহকামের কাছে সম্পূর্ন ভাবে নতি স্বীকার করেছিলো, তারপর আস্তে আস্তে সমাজে তাদের প্রভাব কমতে কমতে একসময় তা সম্পূর্ন ভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।

আর, ইহুদীদের সমাজ সবসময়ই মদীনার সমাজ থেকে সম্পূর্ন আলাদা ছিলো, এমনকি ইসলাম আসার পূর্বেও। তারপর মদীনায় যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলো, ইহুদীদের সাথে মদীনার সমাজের এই পার্থক্য আরও ঘনীভূত হলো। তাই, কিছু নির্ধারিত ভিত্তির উপর ইহুদী ও মুসলিমদের মধ্যে একটি পারস্পারিক সম্পর্ক নির্ধারন করা জরুরী হয়ে পড়লো। সুতরাং, সমাজের অন্যান্য সদস্যদের ব্যাপারে মুসলিমদের অবস্থান কি হবে তা রাসূল (সা) নির্ধারন করলেন। এই প্রেক্ষাপটে, রাসূল (সা) মুহাজির ও আনসারদের ব্যাপারে একটি সনদ তৈরী করলেন, যাতে তিনি (সা) ইহুদীদেরকে ধর্মীয় ও সম্পদে অধিকার দিয়ে তাদের সাথে একটি চুক্তি করলেন এবং বিনিময়ে ইহুদী সম্প্রদায়ের জন্য কিছু দায়িত্ব নির্ধারন করে দিলেন। তিনি (সা) চুক্তিপত্রটি এভাবে শুরু করেছিলেন,“এটি হচ্ছে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে সনদ, যিনি কুরাইশ ও ইয়াসরিবের(মদীনা)  বিশ্বাসী  মুসলিমদের  উপর  কর্তৃত্বশীল  এবং  তাদের  উপরও  যারা  তাদেরকে  অনুসরন  করবে,  তাদের  সাথে  যোগ  দেবে  এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের বিপরীতে তারা হবে একটি জাতি”। তারপর, তিনি (সা) বিশ্বাসীদের মধ্যে কিভাবে সম্পর্ক গঠিত হবে তা উল্লেখ করেন। এছাড়া, তিনি (সা) উক্ত সনদে ইহুদীদের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক কেমন হবে তাও উল্লেখ করে বলেন,“একজন মুসলিম কখনোই কোন অমুসলিমের খাতিরে কোন মুসলিমকে হত্যা করবে না। এমনকি, একজন অবিশ্বাসীকে কোন মুসলিম একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে কখনো সাহায্যও করবে না। আল্লাহর সাথে তাদের কৃত চুক্তি এক এবং চুক্তি ভঙ্গকারী দায়ভার গ্রহন করবে। মু’মিনরা হচ্ছে সমস্ত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে একে অপরের সাহায্যকারী। ইহুদীদের মধ্য হতে যারা আমাদের অনুসরন করবে তারা সাহায্য ও সমান অধিকার প্রাপ্ত হবে। তাদের ব্যাপারে কোন অন্যায় করা হবে না, না তাদের শত্রুকে কোনরকম সাহায্য করা হবে। মু’মিনদের মধ্যকার শান্তি থাকবে অবিচ্ছেদ্য।  মু’মিনরা যখন  আল্লাহর  রাস্তায়  যুদ্ধ  করবে তখন  কোনরকম  পৃথক  শান্তিচুক্তি  করা  যাবে  না। চুক্তির  শর্ত  অবশ্যই  সবার  জন্য  সমান ভাবে যুক্তিযুক্ত হতে হবে”। এ চুক্তিতে যে সকল ইহুদী গোত্র মদীনার সীমানার বাইরে বাস করতো তাদের কথা বলা হয়নি, বরং যে সব ইহুদী ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হতে চেয়েছিলো শুধু তাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রদত্ত চুক্তি অনুযায়ী, মদীনায় বসবাসকারী যে কোন ইহুদী ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে মুসলিমদের সমান অধিকার পেয়েছিলো এবং তাদের সাথে মুসলিমদের মতোই ব্যবহার করা হতো। ইসলামী রাষ্ট্রে তাদেরকে জিম্মি (শর্তসাপেক্ষে নাগরিক) হিসাবে বিবেচনা করা হতো। চুক্তিপত্রের পরের দিকে যে সব ইহুদী গোত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ছিলো বনু ’আউফ এবং বনু নাজ্জার এবং আরও অনেকে।

উল্লেখিত ইহুদী গোত্রগুলোর সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে তা এ সনদে উল্লেখ করা ছিলো। এখানে পরিষ্কার ভাবে লিখিত ছিলো যে, ইহুদী ও মুসলিমদের মধ্যকার এ সম্পর্ক হবে শুধুমাত্র ইসলামী হুকুম-আহকাম, ইসলামের শাসন-কর্তৃত্ব এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার উপর ভিত্তি করে। চুক্তির কিছু কিছু শর্ত ছিলো নিম্নরূপঃ

       ১. The close friends of the Jews are as themselves. মুহাম্মদ (সা) এর অনুমতি ছাড়া কেউ মদীনার বাইরে যেতে পারবে না।

       ২. চুক্তিপত্রে উল্লেখিত সকলের জন্য ইয়াসরিব পূণ্যভূমি হিসাবে বিবেচিত হবে।

       ৩. যদি কোন ব্যাপারে কোন মতভেদ বা বিবাদের সৃষ্টি হয়, যা কিনা সমাজে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, তবে তা অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

       ৪. কুরাইশ এবং তাদের সাহায্যকারীদের কোনরকম নিরাপত্তা দেয়া হবে না।

আল্লাহর রাসুলের তৈরী এ সনদ মদীনার প্রান্তসীমায় বসবাসরত ইহুদী গোত্রগুলোর অবস্থান নির্ধারন করেছিলো। এ সনদ তাদের উপর এ শর্তও আরোপ করেছিলো যে, আল্লাহর রাসূল (সা) অর্থাৎ, ইসলামী রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত তারা মদীনার বাইরে যেতে পারবে না। এ চুক্তির মাধ্যমে ইহুদী গোত্রগুলোকে যুদ্ধ বা অন্য কোন গোত্রকে যুদ্ধে সহযোগিতার মাধ্যমে মদীনার পবিত্রতা বা শান্তি নষ্ট করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এছাড়া, ইহুদী গোত্রগুলোর উপর কুরাইশ গোত্র বা কুরাইশদের মিত্রদেরকেও কোনরকম সাহায্য করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। চুক্তি অনুযায়ী, সনদের কোন ব্যাপারে বিবাদের সৃষ্টি হলে তারা তা আল্লাহর রাসূল (সা) এর দিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য ছিলো। ইহুদীরা এ চুক্তির সকল শর্ত মেনে নিয়েছিলো এবং উল্লেখিত গোত্রগুলোও শর্ত মেনে নিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলো। এ গোত্রগুলোর মধ্যে ছিলো বুনু ’আউফ, বন আল-নাজ্জার, বনু আল-হারিছাহ, বনু সায়ি’দাহ, বনু জুশাম, বনু আল-আউস এবং বনু ছালাবাহ। বনু কুরাইজা, বনু আল-নাজির এবং বন কাইনুকা এ সময় এ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করলেও পরবর্তীতে তারা স্বেচ্ছায় চুক্তির সকল শর্ত মেনে নিয়েই এতে স্বাক্ষর করেছিলো।

এ চুক্তির মাধ্যমে রাসূল (সা) নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্কগুলো শক্ত ভাবে নিরুপণ করেছিলেন। এছাড়া, ইসলামী রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী ইহুদী গোত্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্কও দৃঢ় ও সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত শর্তের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিলো। উভয় ক্ষেত্রেই ইসলামী হুকুম আহকামকেই সব বিচার-ফায়সালার মাপকাঠি হিসাবে ধরা হতো। মূলতঃ এ পর্যায়ে আল্লাহর রাসূল (সা) মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ইসলামী রাষ্ট্র একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ইহুদীদের অতর্কিত আক্রমণ ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নবগঠিত এ রাষ্ট্র কিছুটা নিরাপত্তা লাভ করেছে। সতরাং, এরপর তিনি (সা) ইসলামী দাওয়াতের পথে অবস্থিত বস্তুগত বাঁধা অপসারনে মনোনিবেশ করলেন এবং জিহাদের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।

Leave a Reply