বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, ডেভিড ক্যামেরন গত ২৯শে আগষ্ট মানবিকতার দোহাই দিয়ে আবেগপ্রবন আবেদন করা সত্ত্বেও সিরিয়ায় সামরিক সংশ্লিষ্টতার জন্য সংসদীয় অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বৈশ্বিক বিষয়াদি, বিশেষ করে সিরিয়ার জন্য যখন আমেরিকা একটি জোট গঠন করতে সচেষ্ট তখন ইউরোপীয় অবস্থান (বিশেষ করে বৃটেন ও ফ্রান্স) অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যখন আরব বসন্তের বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী ক্রমাগতভাবে বিশ্বকে কাঁপিয়ে চলছে, তখন ইউরোপ ও আমেরিকার বিভাজন ও মতানৈক্য আরো প্রকটভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
বৃটেন ও ফ্রান্স উভয়েরই বিশ্ব ময়দানে বিভিন্ন উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে। কিন্তু উভয়েই বিশ্বশক্তি আমেরিকা কর্তৃক পর্যদুস্ত হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশক্তি হিসেবে উভয়কে প্রতিস্থাপন করে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উভয় জাতিই আমেরিকার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতার চেষ্টায় রত। এক্ষেত্রে বৃটেন সবসময়ই আমেরিকার সাথে কাজ করার নীতি অবলম্বন করেছে। কখনো আমেরিকার সহযোগী শক্তি হিসেবে, পাশাপাশি কখনো আমেরিকার প্রচেষ্টাকে জটিল, পরিবর্তন কিংবা বিচ্যুত করে দেবার নিমিত্তে। যেখানেই বৃটিশ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সেখানেই তারা আমেরিকার পাশে এসে দাড়িয়েছে। আবার যেখানে তাদের স্বার্থের বিপরীত দেখতে পেয়েছে সেখানেও তারা আমেরিকার সাথে থেকেছে যাতে করে আমেরিকার পরিকল্পনা দূর্বল করে দেয়া যায়। সুতরাং, আপাত দৃষ্টিতে আমেরিকা ও বৃটেনের সম্পর্কে কোনো উত্তেজনা দেখা যায়নি। কিন্তু অভ্যন্তরে তারা সবসময়ই আমেরিকার পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জ করতে চেষ্টা করেছে। দো গলের আমলে ফ্রান্স আমেরিকাকে একটি হুমকি হিসেবে দেখতো যা প্যারিসকে বিশ্বে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে। সুতরাং, সেসময় তারা প্রকাশ্যে আমেরিকার বিরোধিতা করে। তবে, নিকোলাস সারকোজি ২০০৭ এ ক্ষমতায় এসে বৃটিশ পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করে। উদাহরনসরূপ, ফ্রান্স, বৃটেন ও আমেরিকা সকলেই উত্তর কোরিয়া, ইরান ও ফিলিস্তিনের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের মতো বিভিন্ন বিষয়ের পক্ষে একসাথে কাজ করেছে। আবার, লেবানন, সুদান ও নাইজেরিয়াতে তারা একে অপরের সাথে বিরোধিতা ও প্রতিযোগিতা করেছে।
আমেরিকা, ফ্রান্স ও বৃটেনের জন্য সিরিয়া নতুন আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। শুরুর দিকে আমেরিকা যখন বাশারকে সংস্কারের কথা বলছিল, তখন ইউরোপিয়ানরা তার উচ্ছেদের কথা বলছিল। ২০১১তে হিলারি ক্লিনটন বলেন, “যা আমি বুঝি তা হচ্ছে যে তাদের এখনো সংস্কারের কার্যক্রম নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। কেউ বিশ্বাস করেনি গাদ্দাফী তা করবে। (তবে) মানুষ আসলেই বিশ্বাস করে যে সিরিয়ার সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাব্য সুযোগ রয়েছে। সুতরাং, আমরা আমাদের মিত্রদের সাথে এক হয়ে ক্রমাগতভাবে এ বিষয়ে জোরালো চাপ প্রয়োগ করে যেতে থাকবো।” অপরদিকে জি-৮ সম্মেলনে ডেভিড ক্যামেরন বলেন, “আসাদের হাত রক্তে রঞ্জিত। এটি অচিন্তনীয় যে এ স্বৈরাচারী এ জাতির ভবিষ্যতে কোনো ভুমিকা নিতে পারবে।” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স সিরিয়াকে তার জন্য কেটে নেয় ও আলাওয়ীদের ক্ষমতায় রেখে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে তার গুরুত্ব হারাতে থাকে এবং সিরিয়া আমেরিকার প্রভাববলয়ে প্রবেশ করে।
বাশার আল-আসাদের গণহত্যার চিত্র যখন সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়, তখন আমেরিকা অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থান নিতে শুরু করে এবং বিরোধী পক্ষের সাথে আলোচনা শুরু করে। তবে, ২০১২তে লিওন প্যানেট্টা মার্কিন অবস্থান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেন, “আমি মনে করি যখন আসাদ প্রস্থান করবে – এবং সে প্রস্থান করবে – সে দেশের স্থিতিশীলিতা সংরক্ষন করার চেষ্টা করে। এবং সেধরনের স্থিতিশীলিতা সংরক্ষনের জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো সিকিউরিটি ফোর্সসহ সেনাবাহিনী ও পুলিশকে রক্ষনাবেক্ষন করা যাতে করে তারা নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ (That’s a key)।” সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল (যা পরে সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়েলিশনে পরিবর্তিত হয়) সবসময়ই সরকারের সাথে আলাপ চালাতে চেয়েছে যা বরাবরই মার্কিন অবস্থান ছিল। তবে, বৃটেন ও ফ্রান্স উভয়ই আমেরিকা হতে ভিন্ন ধারায় অগ্রসর হয়েছে, যেমন, ‘সিরিয়ার মিত্র’ (Friends of Syria) গ্রুপটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ইউরোপের তত্ত্বাবধানে গাস্সান হিট্টোকে প্রধান করে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় যা নির্দেশনা দেয় যে আসাদ সরকারের সাথে কোনো বোঝাপড়া হবে না। এটিই সবসময় ইউরোপের অবস্থান ছিল। তবে, এই মধ্যবর্তী সরকার সিরিয়া হতে নির্বাসিত এবং সিরিয়ার অভ্যন্তরে সাংগঠনিকভাবে দূর্বল।
বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে আমেরিকা সিরিয়ায় ফ্রান্স ও বৃটেনের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাসমূহকে দূর্বল করে দেয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ, আসাদের কিছু সহচর রেখে নতুন চেহারা সম্বলিত একটি মধ্যবর্তী সরকার গঠন, ইয়েমেনি মডেল প্রয়োগ, জাতিসংঘের ব্যবহার ইত্যাদি। এসকল প্রচেষ্টার পরও সরকার এখনো টিকে আছে। (আমেরিকার বিপরীতে) ইউরোপ ক্রমাগতভাবে আসাদ সরকারের উচ্ছেদের কথা বলে আসলেও, সম্প্রতি গত ২১ আগষ্ট, আল-ঘুটায় আসাদ সরকার কর্তৃক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে আমেরিকা তার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে এবং দ্রুত ভুমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনীর চারটি যুদ্ধজাহাজকে সচল করে। এই পরিবর্তিত অবস্থান বৃটেন ও ফ্রান্স কিছুটা অপ্রস্তুত করে যেহেতু আমেরিকা বরাবরই সামরিক হস্তক্ষেপের বিপক্ষে বলে আসছিল। কিন্তু পরিবর্তিত এ অবস্থানের দরুন ফ্রান্স ও বৃটেন আমেরিকার হস্তক্ষেপের এ বাস্তবতা মোকাবেলা করতে বাধ্য হচ্ছে।
যদিও বৃটেন ও ফ্রান্স আপাত দৃষ্টিতে আমেরিকার সাথে এক হয়ে কাজ করে বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে তারা একে অপরের প্রতিযোগী – সিরিয়া যার নতুন এক অধ্যায়। সিরিয়ার অস্থিতিশীলতা বৃটেন ও ফ্রান্সের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের হৃদয়ে অবস্থিত এ জাতির উপর হস্তক্ষেপ করে ফায়দা হাসিলের মূলত নতুন এক সুযোগ নিয়ে এসেছে। অপরদিকে, আমেরিকা ইউরোপীয়দের বিভিন্ন বাধা পাশ কাটিয়ে সিরিয়াকে নিজের প্রভাববলয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো ব্যপারে একমত না হলেও, সিরিয়া যাতে তাদের উভয়ের হাত থেকেই চলে না যায়, সে ব্যাপারেই তারা সকলেই একমত হবে।
প্রবন্ধটি ভু-রাজনৈতিক বিশ্লেষক আদনান খান এর একটি বিশ্লেষন হতে নেয়া এবং কিছুটা পরিমার্জিত