গত বুধবার, ২১ আগষ্ট, সিরিয় সরকার দামেস্কের পাশেই আল-ঘুটায় জনসাধারনের উপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমন চালিয়ে প্রায় ১৭২৯ জনকে হত্যা করে। এর একদিন পরেই ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফেবিয়াস বলেন, এধরনের আক্রমন প্রমানিত হলে ‘পাল্টা আক্রমন’ (reaction with force)-এর প্রয়োজন হতে পারে। গত শুক্রবার ২৩শে আগষ্টে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব চাক হেজেল বলেন, ক্রুজ মিসাইল দ্বারা সম্ভাব্য আক্রমনের প্রস্তুতির জন্য নৌবাহিনীর কিছু এসেট সিরিয়ার কাছে পৌছানোর আদেশ দিয়েছে পেন্টাগন। এছাড়া বৃটেনও খুব শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে কথা বলেন এবং ঐক্যমতে পৌছান যে এধরনের অস্ত্র ব্যবহারের বিপক্ষে একটি ‘শক্তিশালী জবাব’ (serious response) দিতে হবে। গত রবিবার, ওয়াশিংটনের বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতাগণ মতামত পোষন করেন যে তারা মার্কিন ও এর মিত্রশক্তি কর্তৃক সীমাবদ্ধ সামরিক আক্রমন প্রত্যাশা করেন। সুতরাং, এসবের মধ্যে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন উঠে আসে: আমেরিকা কি সিরিয়া আক্রমন করবে?
এখানে একটি মূল বিষয় হচ্ছে, এটি খুবই অনাকাঙ্খিত যে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে এটা না উপলব্ধি করেই আসাদ সরকার ব্যপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। প্রথমতঃ আসাদ সরকার ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের আক্রমনের মুখে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দ্বিতীয়তঃ তারা মিডিয়া উত্তেজনা এড়িয়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার না করেই বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। আসাদ সরকার ইতিপূর্বেও সল্প আকারে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে; কিন্তু আমেরিকা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এ থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় যে আসাদ সরকার তখনই এধরনের (রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের মতো) গর্হিত কাজে লিপ্ত হবে যখন সে মার্কিন সবুজ সংকেত পাবে যাতে মার্কিন স্বার্থ জড়িত।
সুতরাং কেন ওয়াশিংটন এধরনের সবুজ সংকেত দেবে যাতে বিশ্ব জনমত উত্তেজিত হবে এবং এ ঘটনায় নিস্ক্রিয়তার দরুন মার্কিন ভাবমূর্তি বিশ্বব্যাপি ক্ষুন্ন হবে? আসাদ সরকার গত ৪৩ বছর মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করে আসছে। আমেরিকার এখনো আসাদ সরকারকে প্রয়োজন যেহেতু সিরিয় বিদ্রোহীদের মাঝে তার স্বার্থ রক্ষাকারী মিত্র খুঁজে বের করা অত্যন্ত দুরূহ বলেই প্রমানিত হয়েছে। এ বিষয়টি পরিস্কারভাবে উচ্চারিত হয়েছে মার্কিন জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ-এর চেয়ারম্যান জেনারেল ডেম্পসের বক্তব্যে যখন তিনি বলেন, আমি মনে করি যে [বিদ্রোহী] অংশই আমরা পছন্দ করি তাদের অবশ্যই তাদের স্বার্থ ও আমাদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকতে হবে যখন ক্ষমতা তাদের দিকে মোড় নেবে। বর্তমানে, তারা সে অবস্থানে নেই। সুতরাং, আমেরিকা এ ধরনের (রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের) সবুজ সংকেত তখনই দেবে যখন তারা এর ওজর দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে সিরিয়া আক্রমন করতে চাইবে।
আমেরিকা আসাদ সরকারের প্রতি ইরানি সমর্থন ও সিরিয়ার ভুমিতে হিজবুল্লাহর হস্তক্ষেপের দিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়া সরকারকে ঠেকিয়ে রাখা যতক্ষন না আমেরিকা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহী দল তৈরি করা যা আসাদ সরকারকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে। এ সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে আসছে। হিজবুল্লাহ আসাদকে হোমসে কিছুটা শক্তি যুগিয়েছে, কুসাইর শহর দখল করে দিয়েছে ও দামেস্কে সহায়তা করেছে। এসব কিছুই ছিল সীমিত আকারে আর লেবাননে আভ্যন্তরিন বিষয়াদি ও যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক ক্ষতির দরুন তারা ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং, আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপ করবে যদি বিদ্রোহীদের চাপে আসাদ সরকার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছায়।
বিগত কয়েক সপ্তাহে বিদ্রোহীদের ফিরতি উত্থান হয়েছে। যদিও গত দুবছরে যুদ্ধে এটি প্রথমবরের মতো নয়, কিন্তু এবারের বিশেষত্ব হল সামরিক ঘাটি ও চেকপয়েন্ট হতে বিদ্রোহীদের প্রাপ্ত অস্ত্র। আলেপ্পোর মেনেগ বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রন নিতে গিয়ে বিদ্রোহীরা অসংখ্য অস্ত্র প্রাপ্ত হয়। এর মধ্যে রয়েছে, টি-৭২ ট্যাংক, এন্টি ট্যাংক গান, হেভি মেশিন গানস, ৫৭মিমি এন্টি এয়ারক্রাফ্ট গানস, প্রচুর গ্রেনেড ও গোলাবারুদ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন প্রাপ্তি হল দামেস্কের শহরতলীর অস্ত্র ভান্ডার যেখানে বিদ্রোহীরা শত-শত আধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র খুঁজে পেয়েছে যা আসাদের যেকোনো ট্যাংকই ধ্বংস করতে সক্ষম। এসব ক্ষেপনাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, ফরাসী মিলান টাইপ, রাশিয়ান করনেট, কনকার্স ও ফ্যাজোট টাইপ। এরমধ্যে করনেট সর্বাধুনিক এবং আসাদের যেকোনো আধুনিক ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহারের দিক দিয়ে আসাদের শুধুমাত্র দুটি সুবিধা রয়েছে। ভারী সামরিক অস্ত্রাদি ও বিমান। ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা ভারী অস্ত্রাদির ভান্ডার ও বিমান উড্ডয়নের জন্য ব্যবহৃত এয়ারবেইসগুলো দখল করে নিতে পারবে। তাই, আগামী দিনগুলোতে সিরিয়ার সামরিক-কৌশলগত ভারসাম্য পাল্টে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে – যা মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে। এধরনের মার্কিন হস্তক্ষেপের পেছনে যে উদ্দেশ্যগুলো থাকতে পারে তা নিম্নরূপ:
১) যেকোনো বড়মাপের মরনঘাতি অস্ত্রাদি যা বিদ্রোহী হাতে চলে আসতে পারে তা বিনষ্ট করা।
২) ভবিষ্যতে জাবহাত আল-নুসরাহ ও একই ধরনের জঙ্গী গ্রুপের বিরুদ্ধে ড্রোন হামলার সদ্ব্যবহার করা।
৩) ভবিষ্যতের কোনো তীব্র অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নেয়া বিশেষ করে যদি বর্তমান সরকার যদি পরাভূত হয় এবং বিদ্রোহীরা বর্তমান বিশ্ব অবস্থার প্রভাববলয় থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে বিশেষ করে যদি তা হয় একটি ইসলামী রাষ্ট্র।
আমেরিকা প্রাথমিকভাবে কোনো সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং, জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল ঐক্যমতে পৌছাতে না পারলে, ন্যাটোর সহায়তায় সীমাবদ্ধ কোনো আক্রমন আসতে পারে সিরিয়ায়।