ধ্বংসাত্মক টিকফা চুক্তি!

বাংলাদেশ কি অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল? তাহলে কেন এই ধ্বংসাত্মক টিকফা চুক্তি!


কথিত আছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল। কিছু লোকের ধারণা যেহেতু তৈরী পোশাক রপ্তানি খাতের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎসগুলির মধ্যে একটি এবং যার অধিকাংশ রপ্তানি হয় আমেরিকায় এছাড়া আমেরিকায় ১ লক্ষেরও বেশী প্রবাসী রয়েছে যারা দেশে রেমিটেন্সে অনেক অবদান রাখছে এতে বিশ্বের পরাশক্তি আমেরিকার প্রতি কোন চ্যালেঞ্জ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব এমনকি আত্মঘাতিও বটে। যদি বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে অর্থনৈতিভাবে অনেক দূরবস্থায় পরতে হবে এমন চিন্তাও বিদ্যমান। মুসলিম হিসাবে আমরা আল্লাহর কাছে বাধ্য এই সাম্রাজ্যবাদী ক্রুসেডারকে প্রতিরোধ করা। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-

“….এবং আল্লাহ তায়ালা কখনোই মুমিনদের উপর কাফেরদের কোন পথ (বিজয়) রাখেননা” [সূরা নিসা: ১৪১]


আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের দু’টি প্রধান অর্থনৈতিক সম্পর্ক হল পণ্য বিনিময় ও রেমিটেন্স। আমাদের দেশের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক কতটুকু বাস্তব সম্মত, আদৌ কী আমরা তাদের উপর নির্ভরশীল কিনা সে বিষয়ে একটু ভাবার দরকার। পাশাপাশি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে বিধিবিধান পাঠিয়েছেন সে বিষয়ে সজাগ হওয়া আবশ্যক।

নির্ভরতার সূচক হিসাবে সারণী থেকে দেখতে পাই মোট GDP-র এক পঞ্চামাংশ আসে রপ্তানী থেকে কিন্তু মোট রপ্তানীর এক পঞ্চামাংশ USA’র জন্য নির্ধারিত। মোট USA’তে রপ্তানী GDP-তে অবদান রাখে ৪%। আমরা দেখি পোষাক খাতে ৫০% যে মূল্য সংযোজন যুক্ত করা হয় তা বিবেচেনা করলে এ অবদান দড়ায় মাত্র ২%। সুতরাং সামষ্টিক দৃষ্টিতে এটাই স্পষ্ট যে USA যদি বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি বন্ধ করে তাতে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে পড়বে তা অনেকটা কাল্পনিক।

একই চিত্র USA থেকে পাঠানো রেমিটেন্স এর ক্ষেত্রে দেখতে পাই। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতিতে ভাল অবদান রাখে। দেখা যায় মোট রেমিটেন্স GDP-র ১০% এর চেয়ে বেশী অবদান রাখে। কিন্তু মোট রেমিটেন্স – ১৪% আসে USA থেকে যা মোট GDP-র ১.৫%। যে কোন বিবেচনায় এটি স্পষ্ট USA থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স নূন্যতম গুরুত্ব বহন করে। এছাড়াও তথাকথিত সহায়তার নামে যে ঋণ দেয় তা গণনা করারও গুরুত্ব বহন করে না, যেমন ২০১০ সালে মোট GDP–তে ০.১২% যোগ করে।

বছরমোট রপ্তানীর মধ্যে USA তে রপ্তানী %GDP-তে রপ্তানী %GDP-তে USA-এ রপ্তানীর অবদান %USA থেকে আসা মোট রেমিটেন্স %GDP-তে রেমিটেন্সের অবদানGDP-তে  USA থেকে আসা রেমিটেন্সের অবদান %
২০০৬২৭.৯১৯.০৫.৩১৫.১৮.৯১.৩
২০০৭২৫.৪১৯.৮৫.০১৬.৬৯.৬১.৬
২০০৮২৩.২২০.৩৪.৭১৭.৬১১.৩২.০
২০০৯২১.৩১৯.৪৪.১১৪.২১২.০১.৭
২০১০২৩.২১৮.৪৪.৩১৪.৪১১.০১.৬
২০১১১৯.৪২২.৭৪.৪১৪.১১১.০১.৫

মরনঘাতি টিকফা

যুক্তরাষ্ট্র নাছোড়বান্দা। বাংলাদেশকে সে এবার ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার কাঠামোগত চুক্তি’ বা Trade and Investment Cooperation Framework Agreement (TICFA) স্বাক্ষর না করিয়ে ছাড়বে না বলেই মনে হচ্ছে। বিষয়টি গুরুতর! কারণ, এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিশ্ব পরিসরে অনুন্নত দেশগুলোর আপেক্ষিক দরকষাকষির ক্ষমতায় এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ও এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাবে। ফলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বহুলাংশে হাতছাড়া হয়ে যাবে। মেলার মানুষকে ভালুক নাচের খেলায় ব্যস্ত রেখে তাদের পকেট কেটে নেয়ার সাজানো জোচ্চুরির মতো রাজনৈতিক সহিংসতা, নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তার প্রতি মানুষের মনোযোগ আটকে রেখে আমেরিকা এই ‘টিকফা’ চুক্তি আদায় করার কায়দা করে নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা-বিতর্ক পাশ কাটিয়ে, চুক্তির বিষয়সমূহ বহুলাংশে গোপনীয়তার চাদরে ঢেকে চুক্তিটি সম্পাদন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এক যুগ আগে আমেরিকার উদ্যোগে ২০০১ সালে ‘টিকফা’ ধরনের একটি চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা ও চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছিল। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত এই চুক্তির প্রথম খসড়াটি তৈরি হয়ে যায় ২০০২ সালেই। ২০০৪ সালে ও তারও পরে ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। সে সময় ধারার সংখ্যা কমিয়ে ও প্রস্তাবনার সংখ্যা বাড়িয়ে (মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি আধিপত্যবাদী উদ্দেশ্যগুলোকে প্রস্তাবনার অংশে ঢুকিয়ে সেগুলোকে আড়াল করার জন্য) চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। চুক্তিটি স্বাক্ষর হয় হয় অবস্থায় দেশের আদর্শিক রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একটি অংশের প্রবল প্রতিবাদের মুখে চুক্তিটি তখন সই করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এরপর থেকে এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে এসেছে। প্রথমে চুক্তিটির নাম ছিল ‘টিফা’। সেখানে ‘Cooperation’ শব্দটি ছিল না। সমালোচনা এড়িয়ে চুক্তিটি সম্পর্কে ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য তারা ‘সহযোগিতা’ (Cooperation) শব্দটি যোগ করে ‘টিফা’কে ‘টিকফা’ নামকরণ করেছে। শোনা যাচ্ছে, Investment শব্দটি বাদ দিয়ে সেখানে ‘Economic’ শব্দটি ব্যবহার করে চুক্তিটির নাম করা হবে ‘TECA’। এদিকে চাপ প্রয়োগের জন্য তারা বাংলাদেশকে ক্রমাগত হুমকিও দিচ্ছে। ব্ল্যাকমেইলিং-এর ভাষায় এমনও বলেছে যে, এই চুক্তি না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই ‘টিকফা’ চুক্তির বিষয়বস্তু আসলে কী? তার আসল উদ্দেশ্যই বা কী? ‘টিকফা’ চুক্তির সর্বশেষ খসড়া বয়ানটি যেহেতু গোপন রাখা হয়েছে (স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে সবক দেয়া সত্ত্বেও) তাই এক্ষেত্রে ২০০৫ সালে ‘টিফা’র জন্য প্রণীত খসড়ার বিষয়বস্তু যতোটা জানা গিয়েছিল সেই ভিত্তিতে কথিত ‘টিকফা’ সম্পর্কে পর্যালোচনা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু তার আগে যুক্তরাষ্ট্র GSP সুবিদা বহাল ও বাতিল নিয়ে টিকফা চুক্তি করিয়ে নেয়ার জন্য যে কূটকৌশল করছে তা বিশ্লেষন করা চাই।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে বাজার-সুবিধা দেয়া হয়, তাকে জিএসপি বলা হয়।

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই সুবিধা পেয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত এই সুবিধার আওতায় নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য বিষয়ক অফিসের ওয়েবসাইটে তাদের জিএসপি-সুবিধা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: ‘১২৭টি সুবিধাভোগী দেশের থেকে আমদানি করা প্রায় পাঁচ হাজারটি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য এই জিএসপি। এর অন্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি করা পণ্যে মার্কিন সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করে মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।…জিএসপির অধীনে যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, তার মধ্যে আছে: বহু রকম রসায়ন দ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, বিল্ডিং স্টোন, জুয়েলারি, বহু রকমের কার্পেট, এবং কিছু কৃষি ও মৎস্যজাত দ্রব্য। যেসব পণ্য জিএসপি শুল্কমুক্ত সুবিধাবহির্ভূত সেগুলোর মধ্যে আছে: বেশির ভাগ বস্ত্র ও পোশাকসামগ্রী, বেশির ভাগ জুতা, হাতব্যাগ ও ব্যাগ।’

বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধার বাইরে। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির প্রায় শতকরা ২৩ ভাগ গেছে, সেই হিসাবে এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে, তার ছয় গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রতিবছর! এবং যুক্তরাষ্ট্রই মুক্তবাজার নীতিমালা ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে! অর্থাৎ প্রচারণা বা বিশ্বাস যা-ই থাকুক, তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে কোনো বিশেষ সুবিধা পায় না, বরং অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে সেখানকার বাজারে প্রবেশ করতে হয়।

গ্লোবাল ওয়ার্কার্স ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাণিজ্যবিষয়ক বিশ্লেষক এড গ্রেসার জানান, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তাঁবু, গলফ খেলার সরঞ্জাম, প্লেটসহ প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে। এর ওপর জিএসপি-সুবিধা অনুযায়ী ২০ লাখ ডলার শুল্ক ছাড় পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ৪৯০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার শুল্ক দিয়েছে, যা ২০১২ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে প্রাপ্ত শুল্কের প্রায় দ্বিগুণ। ফ্রান্স ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে শুল্ক দিয়েছে মাত্র ৩৮.৩ কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, শ্রমঘন পণ্য যেগুলো গরিব দেশ থেকে আসে, তার অনেকগুলোর ওপরই মার্কিন শুল্কহার অস্বাভাবিক রকম বেশি, গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনো কখনো ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আমদানি শুল্ক শতকরা ১১ থেকে ৪৮ ভাগ। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনা করে আইএমএফই স্বীকার করছে যে, যে বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য আমদানি বাবদ ৩৩ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক আয় করল, সেই বছরেই সমপরিমাণ শুল্ক তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে আয় করল ১২ গুণ বেশি। অর্থাৎ তিন হাজার কোটি ডলার পণ্য আমদানির জন্য।

অর্থাৎ ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এটাই বিশেষ সুবিধা!

অর্থাৎ GSP সুবিধা বাতিল বা বহাল দ্বারা TICFA চুক্তি প্রভাবিত নয় বরং জনগনের মধ্যে ধূম্রজাল ছড়ানো হচ্ছে ।

চুক্তিটির ১৫, ১৬ ও ১৭ নং প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার (Intellectual Property Rights)-TRIPS, আন্তর্জাতিক শ্রমমান সংরক্ষণ, পরিবেশ ও বাণিজ্য স্বার্থকে সমান গুরুত্ব দেয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই চুক্তির ফলে মেধাস্বত্ব অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলে তা আমাদের দেশকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করবে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতেই দেশকে সফটওয়্যার লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি (৬০ কোটি ডলার) ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। ওষুধ শিল্পকে পেটেন্ট আইনের অধীনে মাশুল দিতে হবে এবং তার ফলে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এ দেশের তৈরি এক্সেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে নজরানা দিতে হবে। বাসমতি চাল, চিরতার রস, নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়েলটি প্রদানে বাংলাদেশকে বাধ্য করার জন্য ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষর করতে এভাবে চাপাচাপি করছে।

বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এতো তত্পর হয়েছে কেন? সরাসরি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া ছাড়াও এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের আরো একটি গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে। চুক্তির ১৮ নং প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একত্রে ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ সফল বাস্তবায়নে সহযোগিতামূলক প্রয়াস শক্তিশালী করবে।

দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলো হলো—অকৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারীকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিন স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে। অথচ এই চুক্তির সুবাদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। এ কথা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থসংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু ‘টিকফা’র মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তা করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থরক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগও বহুলাংশে হারাবে। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয়, বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

চুক্তিতে এ কথা আছে যে, দুই পক্ষের মধ্যে কারো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যদি কোনো এক পক্ষ ব্যর্থ হয় তাহলে অপরপক্ষ তাকে ‘সহযোগিতা’ দিবে। স্পষ্টতই চুক্তির এই ধারাতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ‘বিনিয়োগের সুরক্ষার’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিনিয়োগ ও তার সুরক্ষার বিষয়টি প্রায় সর্বাংশে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করার শক্তি বা ক্ষমতা বাংলাদেশের তেমন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ও সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রধান বিনিয়োগকারী দেশ। চুক্তির বিধান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিনিয়োগ সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের। বাংলাদেশ যদি সে কাজে অপারগতা প্রদর্শন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ সুরক্ষার কাজে ‘সহযোগিতা’ দিবে। এই ‘সহযোগিতার’ স্বরূপ কি হতে পারে? ধরা যাক, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানির পিএসসি’র মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে সেই বিনিয়োগের সুরক্ষা করা বাংলাদেশের কর্তব্য হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সামরিক নিরাপত্তার প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তার সক্ষমতা বাড়ানোর কাজে ‘সহযোগিতা’ দেয়ার ‘সুযোগ’ খুলে দিবে। চুক্তির এই বিষয়ের সাথে আমরা যদি বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌ উপস্থিতি, নৌঘাঁটি স্থাপন, বাংলাদেশের অরক্ষিত সমুদ্রসীমা রক্ষার কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ সম্পর্কে একদিকে জোরালো মার্কিনী বক্তৃতা-বিবৃতি এবং অন্যদিকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো কর্তৃক পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্লক ইজারা নিয়ে নেয়ার কথা একসাথে হিসেবে নেই তাহলে কারো পক্ষেই মার্কিন উদ্দেশ্য সম্পর্কে দুয়ে দুয়ে চারের অঙ্ক মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রাজনৈতিক-সামরিক স্ট্র্যাটেজির প্রধান দিক নির্দেশ হলো- ‘চীনকে নিয়ন্ত্রনে রেখে তাকে নিবৃত করা’ (containing the influence of china)। এজন্য এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে সে তার আন্তর্জাতিক তত্পরতার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং এখানেই তার বিদেশে অবস্থানরত নৌসেনার বেশিরভাগ মোতায়েন করেছে। বাংলাদেশকে এই স্ট্র্যাটেজিতে আরো শক্ত করে আটকে ফেলাটা যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গ্লোবাল যুদ্ধের’ আঞ্চলিক সহযোগী করাটাও তার আরেকটি উদ্দেশ্য। এসব ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে নিজেদের পরিকল্পনায় আরো নিবিড় ও কাঠামোগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যই ‘টিকফা’ স্বাক্ষরে যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ মরিয়া প্রয়াস। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক গোপন সামরিক চুক্তি রয়েছে। এসবের সাথে ‘টিকফা’ স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও সাথে সাথে তার নিরাপত্তা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ হচ্ছে একটি ঘুমন্ত বাঘ। উন্নত দেশের সঙ্গে অনুন্নত দেশের মধ্যে চুক্তিগুলো মূলত করা হয় গরিব দেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তবে ভাগ্যের বদল হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে এবং বিশ্বের অন্যান্য ৭২টি দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ চুক্তি করেছে। তাতে তারা খুব বেশি লাভবান হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। ‘টিকফা’ বা ‘টিফা’ সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যে আপাতদৃষ্টিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রনীতিসহ অনেক বিষয় জড়িত। এ ধরনের চুক্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলের অংশ হওয়া যে কোনো বিচারেই ক্ষতিকর। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে মার্কিনিদের স্বার্থরক্ষার জন্যই কাজ করতে হবে।

সবশেষ হাসিনার কেবিনেটে পাশ হওয়া টিকফা চুক্তির মূল কথাগুলো এরকম:

[১] চুক্তির শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণ করতে হবে ।

[২] যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং বিদ্যমান শুল্ক ও অশুল্ক বাধাসমূহ দূর করতে বাংলাদেশ বাধ্য থাকবে ।

[৩] বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, (মানে সরকারকে জিরো করে আনার বুদ্ধি)।

[৪] দুই দেশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে ।

[৫] যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে শুধু সেবা খাতেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে / তারা কোনো পণ্য এদেশে উৎপাদন করবে না / সোজা কথা সার্ভিস দিয়ে পয়সা নেয়া ।

[৬] বাংলাদেশের দেশীয় শিল্প বা প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ নীতি বাতিল করতে হবে অর্থাৎ শিল্পখাত চরম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে ।

[৭] যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোনো কর আরোপ করা যাবে না ।

[৮] বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ।

[৯] দেশের জ্বালানি গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর টেলিযোগাযোগ শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবহন ইত্যাদি খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে ।

[১০] কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্ত করতে হবে এবং কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে ।

[১১] চুক্তি অনুযায়ী মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ ।

এই সকল উদ্বেগের বিষয় যেমন আমাদের চিন্তিত করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঠিক একইভাবে এটাও মনে রাখা দরকার USA চাইলেই কোন দেশের সাথে বাণিজ্য বন্ধ রাখতে পারবে না কারণ তার প্রয়োজন বাংলাদেশের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠির ভোক্তা শ্রেণী, সস্তা শ্রম ও খনিজ সম্পদের উত্তোলনে বিনিয়োগ এছাড়াও তাদের দেশে বাংলাদেশী যে প্রবাসীরা থাকে তারা তাদের ভোট ব্যাংক যেমন সম্প্রতি বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করা হবে। অর্থাৎ বর্তমান প্রেক্ষাপটেই তা অসম্ভব খিলাফাহ্ রাষ্ট্রে তো প্রশ্নই আসে না। আসুন খিলাফাহ্ রাষ্ট্র কিভাবে বেকারত্ব ও বৈদেশিক বিনিময়কে পররাষ্ট্র চুক্তি সমাধান করবে তার সংক্ষিপ্ত নমুনা দেখা যাক:

খিলাফত রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে:

ধারা ১৮৪

অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামীর রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ভর করবে চারটি নীতির উপর। এগুলো হচ্ছে:

১. ইসলামী বিশ্বে বর্তমান রাষ্টগুলোকে এমনভাবে দেখা হবে যেন তারা একটি অভিন্ন রাষ্ট্র আর তাই তারা পররাষ্ট্র নীতির অধীনে পড়বে না। তাদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র নীতির বাস্তবতা বিবেচনা করা হবে না। বরং, এ রাষ্টগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি একক রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

২. যে সকল রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক অথবা বন্ধুত্বের চূক্তিতে চূক্তিবদ্ধহবে তাদের প্রতি চূক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চূক্তিতে উল্লেখিত থাকলে ঐ সকল রাষ্ট্রের নাগরিকদের শুধুমাত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে আমাদের দেশে প্রবেশের অধিকার প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের পাসপোর্টের প্রয়োজন হবে না। তবে, চূক্তিতে এটি উল্লেখিত থাকতে হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণও ঐ রাষ্ট্রে অনুরূপ প্রবেশের অধিকার রাখবে। ঐ রাষ্ট্রগুলোর সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট পণ্য সামগ্রীর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে; এই শর্তে যে, ঐ পণ্য সামগ্রী আমাদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় এবং এ (অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক) সম্পর্ক ঐ সকল রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবে না।

৩. যে সকল রাষ্ট্রের সাথে আমাদের কোন চূক্তি নেই, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র যেমন বৃটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্স, এবং ঐ সকল রাষ্ট্র যাদের আমাদের রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা আছে, যেমন রাশিয়া, ঐ সকল রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক সম্ভাব্য যুদ্ধ রাষ্ট্র’ হিসাবে বিবেচিত হবে। তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সকল সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের সাথে আমাদের কোনরূপ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি নেই। যতক্ষণ না তাদের সাথে প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধের সূচনা হয়ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নাগরিকগণ আমাদের রাষ্ট্রে পাসপোর্ট ও ভিসার মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারবে যা প্রতিটি ব্যক্তির প্রতিটি ভ্রমণের জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে।

৪. যে সকল রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই আমাদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় আছে, যেমন, ইসরাইল, তাদের সাথে যুদ্ধাবস্থার ভিত্তিতেই সকল সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যেন তারা আমাদের সাথে প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধরত অবস্থায় আছে, সেটি যুদ্ধবিরতিই হোক কিংবা অন্য কোন অবস্থাই হোক না কেন। ঐ সকল রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের আমাদের রাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

ধারা ১৮৫

সকল সামরিক চূক্তি এবং সন্ধি সম্পর্ণূ রূপে নিষিদ্ধ। এর মধ্যে রাজনৈতিক চূক্তি ও সমঝোতা যেখানে সেনাঘাঁটি ও বিমানঘাঁটি লিজ দেয়ার বিষয়গুলোও অর্ন্তভূক্ত। তবে, বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, অর্থব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক এবং যুদ্ধবিরতি চূক্তির অনুমতি রয়েছে।

  • খিলাফাহ্ ব্যবস্থায়, রাষ্ট্র শুধু GDP বৃদ্ধিকে বিবেচনা না করে বরং প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক চাহিদার কথা চিন্তা করে।
  • শিক্ষা ব্যবস্তায় এমন নীতি প্রণয়ন করা হবে যা উৎপাদনমুখী।
  • রাষ্ট্রের খাস জমি ভূমিহীনদের বন্টন করা হবে এক্ষত্রে খলীফা সেচ ব্যবস্থা, সার, উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা হবে।
  • শক্তিশালী উৎপাদন ব্যবস্থায় জাতিকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভর করতে পারে আর খিলাফাহ্ রাষ্ট্র বিশ্বের পরাশক্তি হিসাবে রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক ও জনসম্পদকে ব্যবহার করে শ্রম ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়নের দিকে নিয়ে যাবে।
  • রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করবে যার জন্য প্রচুর যুদ্ধ উপকরন প্রয়োজন এতে শিল্প বিভাগ থাকবে সামরিক বাহিনীর অধীনে যেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প, বিমান প্রস্তুতকারী শিল্প ও অন্যান্য ভারী শিল্প কারখানা যেখানে প্রাইভেট সেক্টরকেও বিনিয়োগে উৎসাহী করা হবে।
  • যদি কেউ নিজ উদ্যোগে ব্যবসায় শুরু করতে চায় তাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হবে। এছাড়া লুটপাঠ, দুর্নীতি, রাহাজানি, টোল সংগ্রহের বিরুদ্ধে শরীয়াহ্ প্রদত্ত শাস্তির ব্যবস্তা নিবে।
  • বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে US তার কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ডলারকে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে এতে সে অন্য রাষ্ট্রকে বাধ্য করে ডলার সঞ্চয় করতে এবং যার বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা মুদ্রণ করে। খিলাফাহ্ রাষ্ট্র নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন করবে যা মুদ্রিত হবে মূল্যবান ধাতু তথা স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিপরীতে এতে মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ উভয়ই সহজ হবে।
  • একবার এটিই প্রতিষ্ঠিত হযে গেলে অন্যান্য দেশগুলোও ইসলামি রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য করতে এগিয়ে আসবে যেমনটি অতীতে হয়েছিল।


টিকফা চুক্তির মাধ্যমে এদেশের অর্থনীতির উপরই শুধু নয়, দেশের শ্রম, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, গাছ-গাছড়া হতে শুরু করে ছোট ছোট জীব-অনুজীব পরযন্ত সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তার করবে আমেরিকা।

দেশের সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও শ্রমবাজারের উপর মার্কিন পুজিবাদী কোম্পানিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি বিকল করে এদেশের ইসলাম ও মুসলিমদের এক হাতে শায়েস্তা করে সম্ভাব্য ইসলামী খিলাফতের উত্থান ঠেকানোর নতুন বীজ বপন করবে ক্রুসেডার আমেরিকা।

“তারা যদি তোমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হবে, তাদের হস্ত ও রসনাসমুহ প্রসাড়িত করে তোমাদের ক্ষতি সাধন করবে, তারা চায় যাতে তোমরা কাফিরদের কাতারে শামিল হও” [সুরা মুমতাহিনা: ২]।


উপরোক্ত বিশ্লেষনের আলোকে এটাই প্রমাণিত যে, বাংলাদেশ USA’র উপর নির্ভরশীল নয় এবং খিলাফা্ত শাসন ব্যবস্থায় পারে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্বয়ংসম্পূর্ন ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। বর্তমান কুফর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমেরিকা বা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের বলয় থেকে বের হয়ে আসা বা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আর এর জন্য প্রয়োজন মুসলিম উম্মাহ্’কে সাথে নিয়ে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্তা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সামগ্রিকভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক নীতিমালা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নেয়া হবে যেখানে হালাল এবং হারামের নিরিখে শান্তিপূর্ণভাবে ও আনন্দে জীবন ধারণ সম্ভব হবে। এগুলো রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা করবে এবং মানুষকে সম্পদের দাস বানানো ব্যতিরেকে সম্পদকে মানুষের ভৃত্য বানাবে।

হে মুসলিমগণ!!!!

টিকফা চুক্তির ছদ্বাবরণে ক্রুসেডার আমেরিকার দেশের অর্থনীতি ও শ্রমবাজারের উপর একচ্ছত্র থাবা বিস্তারের মাধ্যমে এদেশের ইসলাম ও মুসলিমদের উপর সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তারের পায়তারা রুখে দাড়ান। শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি ও ভারী শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশকে একটি নেতৃত্বশীল জাতিতে পরিণত করার লক্ষে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলুন।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-

“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) সহকারে, যেন এই দ্বীন অন্যান্য সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন…” [সূরা আত-তাওবা: ৩৩]



আতিক রহমান

Leave a Reply