নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘নিযামুল ইসলাম’ বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে গৃহীত
হুক্ম শর’ঈ হচ্ছে, বান্দা’র (‘ঈবাদ) কার্যাবলী সম্পর্কে আইনপ্রণেতা’র (আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) বক্তব্য। বক্তব্যটি হতে পারে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত (ক্বাত’ঈ ছুবুত) অর্থাৎ কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই যথা কুরআন ও হাদীস মুতাওয়াতির অথবা অমীমাংসিতভাবে প্রমাণিত (জন্নিঈ ছুবুত) অর্থাৎ একাধিক মতের অবকাশ রয়েছে যথা অ-মুতাওয়াতির হাদীস সমূহ। যদি বক্তব্যটি ক্বাত’ঈ ছুবুত হয়, তবে এর অর্থ নির্দিষ্ট (ক্বাত’ঈ দালালাহ) এবং হুকুমটি চূড়ান্ত, অর্থাৎ এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। এরূপ একটি উদাহরণ হচ্ছে ফরজ সালাতের রাকাতের সংখ্যা, কারণ হাদীস মুতাওয়াতিরে এর উল্লেখ রয়েছে। অনুরূপভাবে রিবা নিষিদ্ধকরণ, চোরের হস্তচ্ছেদ, যিনাকারীর (ব্যভিচারকারী) শাস্তি বেত্রাঘাত, ইত্যাদি প্রত্যেকটিই চূড়ান্ত বিধান, এদের সত্যতা নির্দিষ্ট এবং চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত মতামত (দ্বিমত নেই)।
যদি আইনপ্রণেতা’র বক্তব্য ক্বাতঈ সুবুত অথচ একটি মাত্র নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশক না হয় (জন্নিই দালালাহ), তবে হুকম টি অমীমাংসীত (অর্থাৎ এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে)। উদাহরণ স্বরূপ কুরআনে উল্লেখিত জিযিয়া সংক্রান্ত আয়াতটি উল্লেখ্য। আয়াতটি ক্বাত’ঈ ছুবুত কিন্তু তার অর্থ নির্দিষ্ট নয়। হানাফী স্কুলের শর্তানুসারে, একে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক এবং তা আদায়করার সময় প্রদানকারীর অবমাননাকর অবস্থায় থাকা বাধ্যতামূলক। শাফে’ঈ স্কুলের শর্তানুযায়ী এটিকে জিযিয়া বলা বাধ্যতামূলক নয়, এবং একে দ্বৈত যাকাত বলা যায়। এই স্কুলের মতানুসারে এটি প্রদানের সময় প্রদানকারীর অবমাননাকর অবস্থাকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং ইসলামী বিধানের অধীন হওয়াই তাদের জন্য যথেষ্ট অবমাননাকর বলে বিবেচিত হয়।
যদি আইনপ্রণেতার বক্তব্য জন্নিই ছুবুত হয়, যেমন অ-মুতাওয়াতির হাদিস, তখন অর্থ ক্বাত’ঈ দালালাহ হোক বা না হোক, এ সংক্রান্ত হুক্ম চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হবেনা, অর্থাৎ এ বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা (রাখা) কিংবা কৃষিভূমি ইজারা (লীজ) দেয়ার নিষিদ্ধতার বিষয়টি।
আইন প্রণেতার বক্তব্য থেকে সঠিক ইজতিহাদের মাধ্যমে হুক্ম শর’ঈ কে অনুধাবন করা হয়। এভাবে একজন মুসলিম, একজন মুজতাহিদের ইজতিহাদের মাধ্যমে হুক্ম শরঈ সম্পর্কে অবগত হয়। সকল মুজতাহিদের ব্যপারে আল্লাহ’র হুক্ম হচ্ছে, মুজতাহিদ ইজতিহাদের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং যা তার নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় সেটিই তার জন্য হুক্ম। ঊলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, যদি একজন মুকাল্লাফ (শরীয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) কোন এক বা একাধিক প্রশ্নে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং এভাবে কোন একটি বিষয়ে কোন হুক্ম এ উপনীত হন, তখন ঐ বিষয়ে অন্য মুজতাহিদিনদের অনুসরণ করা তার জন্য অনুমোদিত নয়। কারণ সেক্ষেত্রে তার জন্য এটি এমন একটি মতামতের তাকলীদ করা হবে, যা তার নিকট সর্বাপেক্ষা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়নি।
মুকাল্লিদ মুত্তাবী হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যিনি ইজতিহাদ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান অর্জন করেছেন, এবং দলীল অনুধাবন করার পর কোন হুক্ম অনুসরণ করেন। একজন মুত্তাবী’র জন্য তার অনুসৃত মুজতাহিদের মতামতই তার জন্য আল্লাহর হুক্ম। মুকাল্লিদ আম্মি হচ্ছেন এরূপ ব্যক্তি যার ইজতিহাদ সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান নেই, কাজেই তিনি হুক্ম সংক্রান্ত দলীল অনুধাবন করা ছাড়াই একজন মুজতাহিদের মতামত অনুসরণ করেন। আম্মি মুজতাহিদের মতামত অনুসরণ করেন ও তিনি (মুজতাহিদ) যে আহকাম এ উপনীত হয়েছেন তা বাস্তবায়ন করেন। তার জন্য হুক্ম শর’ঈ হচ্ছে তার অনুসৃত মুজতাহিদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও মতামত অনুসরণ করা।
কাজেই হুক্ম শর’ঈ হচ্ছে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ লব্ধ হুক্ম। এটিই তার জন্য আল্লাহর হুক্ম এবং তার এটি ছেড়ে অন্য মতামত গ্রহণ করার অনুমতি নেই। এটি একজন মুজতাহিদের অনুসারীর (মুকাল্লিদ) জন্যও আল্লাহর হুক্ম এবং এটি পরিত্যাগের অনুমতি নেই।
যদি কোন মুকাল্লিদ একটি বিষয়ে (ইস্যুতে) হুকুমের জন্য একজন মুজতাহিদের মতামত পালন করে থাকেন তবে তার পক্ষে সেটি পরিত্যাগ করে উক্ত বিষয়ে অন্য মুজতাহিদের মতামত গ্রহণ করার অনুমতি নেই। অবশ্য একজন মুকাল্লিদের জন্য অন্য কোন বিষয়ে (ইস্যুতে) অন্য মুজতাহিদের মতামত অনুসরণ করার অনুমতি রয়েছে, কারণ ইজমা-আস-সাহাবা একজন মুকাল্লিদকে ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন আলিমের মতামত জানবার অনুমতি দিয়েছে। যদি কোন মুকাল্লিদ একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের যেমন শাফিঈ, এর অন্তর্গত হন এবং সম্পূর্ণ মাযহাব অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন, তবে তার জন্য নিম্নলিখিত বিষয় প্রযোজ্য হবে: ঐ মুকাল্লিদ ইতিমধ্যে তার মাজহাব অনুযায়ী যে বিষয়গুলো পালন করেছেন সে বিষয়গুলোতে অন্য কোন মাযহাবের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না। যে সকল বিষয় তিনি এখনো পালন করেননি, সে বিষয়ে অন্য মুজতাহিদিনদের অনুসরণ করতে পারেন। যদি কোন মুজতাহিদ কোন বিষয়ে ইজতিহাদের মাধ্যমে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে থাকেন, গোটা মুসলিম উম্মাহর সিদ্ধান্তের ঐক্যের স্বার্থে তিনি স্বীয় ইজতিহাদ লব্ধ সিদ্ধান্তকে পরিত্যাগ করে অন্য মতামত অনুসরণ করতে পারেন, যেমনটি ঘটেছিল হযরত উসমান (রা) এর বাইয়াতের সময়।