বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আমাদের করণীয়

বেশ দীর্ঘ সময় যাবৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। শাহবাগ রাজনীতি থেকে শুরু করে হেফাজতে ইসলামীর লংমার্চ এবং অন্যান্য সকল ইস্যুগুলোর ফলে বাংলাদেশ একরকম গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মত দিচ্ছেন অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।

কিন্তু প্রশ্ন হল আসলেই কি বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে নাকি সাম্রাজ্যবাদীদের ধারাবাহিক চক্রান্তের বেড়াজালে ঘুরেফিরে আটকা পরে আছে??

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, বর্তমানে যেসকল বিষয়সমূহ আমাদের সামনে সুনিপুণভাবে তুলে আনা হচ্ছে, তার প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যবাদীদের সুদীর্ঘ পরিকল্পনার ক্ষুদ্র অংশবিশেষ।

বাংলাদেশে প্রতি নির্বাচন পূর্ববর্তী মৌসুমে এই ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়ে থাকে এবং নির্বাচন পর্যন্ত তা টিকিয়ে রাখা হয়। আর এর মধ্যেই জনগণের নিকট ৫ বছর যাবৎ হয়ে আসা যুলুমের সমাধান হিসেবে অপর যালিমকে পছন্দের ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়; যে/যারা কিনা এর পূর্বে বারবার প্রতারণা করে আসছে। আর এভাবেই মার্কিন-ভারতের স্বার্থসিদ্ধির দ্বার খোলা থাকে পরবর্তী ৫ বছরের জন্যও।

আর এই চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় মূলত এতসকল জাগরণ-আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ; যেখানে সমাধান একেবারেই অনুপস্থিত। আর উম্মাহকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে এসকল নাট্যমঞ্চ দ্বারা।

কিন্তু এবার এই চক্রান্ত পূর্বের তুলনায় অধিক ভয়াবহ; কারণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই অঞ্চলে চীনের উত্থান এবং পুঁজিবাদের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি খিলাফতের প্রখর সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং সেই লক্ষ্যে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি শুরু করেছে।

কিছুদিন আগে (১১ই মার্চ, ২০১৩) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্যে এই উপমহাদেশে বাংলাদেশকে ঘিরে মার্কিন-ভারতের ঐক্যবদ্ধ চক্রান্তের ধারাগুলো স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে।

বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশকে ঘিরে আমেরিকার পরিকল্পনা সুদীর্ঘ এবং বিগত বছরগুলোতে আমরা এর বাস্তবায়নের পাঁয়তারা দেখে আসছি।

দালাল শসক দ্বারা সামরিক মহড়া থেকে শুরু করে মার্কিন স্বার্থপন্থী চুক্তিসমূহ একের পর এক বাস্তবায়ন ঘটিয়ে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে অবিরত। কারণ, নিষ্ঠাবান সেনা অফিসারদের মাঝে তাদের দালাল সৃষ্টি প্রচেষ্টা সফল হলে, তাদের কুকীর্তি সম্পাদনে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বাধা আসবেনা আর তারা তাদের ঘৃণ্য কার্যক্রম চালিয়ে যাবে নিশ্চিন্তে। আর সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ বছর বাংলাদেশেই তারা আয়োজন করতে যাচ্ছে মিলিটারি-মিলিটারি কনফারেন্স।

তাছাড়া, মে মাসের ২২ তারিখ বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে আমেরিকা United States Coast Guard Cutter Jarvis নামক একটি নৌযান উপহারের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের পাঁয়তারা করে যাচ্ছে।আর এরই পরিকল্পনার জের ধরে গত ৭ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছে মার্কিন ৭ম নৌ বহরের প্রধান স্কট এইচ সুইফট, সফরের মেয়াদ কাল ৩ দিন, আলোচনা হবে সমুদ্র সীমা ও ব্যবহার চুক্তি নিয়ে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমনে যৌথ সামরিক একাডেমী স্থাপনের চুক্তি হবে। আর মে ১৩/১৫ তারিখ হবে যৌথ সংলাপ। যার চুক্তি হয় হিলারির সফরের সময়। এর পূর্বে এ সরকারের মেয়াদে জাতিকে অন্ধকারে রেখে মার্কিনীদের সাথে দেশের সাধারণ মুসলিমদের জন্য ধ্বংসাত্মক চুক্তি ও সামরিক মহড়া করে যার কিছু উদাহরণ হল:

– ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ CARAT (Cooperation Afloat Readiness & Training) নামে চট্টগ্রামে মার্কিন মেরিন ফোস ও বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর মধ্যে সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।

– ১৯ এপ্রিল’ ২০১২ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ক মন্ত্রী অ্যন্ড্রু জে শ্যাপিরোর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপে অংশ নেয়।

– ৫ই মে ২০১২ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে।

– ১লা জুন ২০১২ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি নিরাপত্তা সংলাপে ঘোষণা দেয় যে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্য তাদের নৌবাহিনীর ৬০ শতাংশ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে আসবে।

– ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন মেরিন ফোস ENCAP (Engineering Capillitia Exercise) মহড়ায় অংশ নেয়

– এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ড যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়

– ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ মার্কিন ৭ম নৌ বহরের কমান্ডের ভাইস অ্যাডমিরাল Scott swift ঢাকা আসে।

– ১৭-২৪ সেপ্টেম্বর আবার ও CARAT-2 চট্টগ্রামের বনৌজ ঈশা খাঁ ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত হয়

– ২৫-৩০ সেপ্টেম্বর DREE(Disaster RESPONSE Exercise & exchange) নামে ঢাকায় সামরিক মহড়া হয়

– একই মাসে হাওয়াই দ্বীপে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য সামরিক সংলাপও অনুষ্ঠিত হয়।

– ১০ই অক্টোবর ২০১২ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক প্রধান অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল জে লকলিয়ারের বাংলাদেশ সফরে আসে। সফরকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্বার্থ গত প্রবল আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।

– মজিনা বাংলাদেশে F.B.I এর উপস্থিতি সুনিশ্চিতকরণ এবং সেনাবাহিনীর সাথে বিভিন্ন যৌথ মহড়ার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রম বিস্তারণের কথাও বলেছে; যা বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত বৈ আর কিছুই নয়।

আমরা যদি পাকিস্তানের দিকে তাকায়, তবে দেখব দালাল শাসকদের সাহায্যার্থে একইভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সাথেও যৌথ মহড়ার নামে তাদের জাল বুনেছিল সেনাবাহিনীতে আর পাকিস্তানে “রেইমন ডেভিস” বা “ব্ল্যাক ওয়াটারের” উপস্থিতি সুনিশ্চিত করে। ফলশ্রুতিতে আজ পাকিস্তানের বাস্তবতা ভয়াবহ।

বাংলাদেশ থেকেও একইভাবে ফায়দা লুটতে তারা এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে; পাশাপাশি F.B.I এখানে জনগণের মাঝে মার্কিন গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাবে; যা কিনা পরবর্তীতে মার্কিনিদের অবস্থান সুনিশ্চিতকরণের দ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দী চীনকে দমনে সে সাথে করে নিয়েছে ভারতকে। বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তির নামে ইন্দো-প্যাসিফিক করিডোর নির্মানের ব্যবস্থা করছে; যা শুধুমাত্র ভারত-মার্কিন স্বার্থ নিশ্চিত করবে।

যদিও পরবর্তীতে ভারতকেও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত এই সমঝোতা। আর এতসব চক্রান্ত বাস্তবায়নের ইস্যুগুলো বাংলাদেশে আমরা বর্তমান দেখতে পাচ্ছি।

মজিনা তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে পরবর্তী ৫ বছরে বাংলাদশের সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তার কার্যক্রমের ব্যাপারে দৃঢ়তা প্রকাশ করেছে। অর্থ্যাৎ, পরবর্তী ৫ বছরের সরকার সম্পর্কে তারা নিশ্চিত আর জনগণকে তারা লেলিয়ে রেখেছে গত ৪২ বছর ধরে প্রতারক শাসকগোষ্ঠির মত গণতান্ত্রিক শসন ব্যবস্থার উচ্ছিষ্ট নিয়ে কামড়া-কামড়িতে। অথবা, এমন কিছু তথাকথিত আবেগী আন্দোলনের সাথে যেখানে উম্মাহ’র পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা পর্যন্ত নেই; বরং লুকিয়ে আছে কাফিরগোষ্ঠী এবং তার দালাল বাহিনীর ভয়ঙ্কর চক্রান্ত।

অবশ্যই, সমধানের জন্য এসকল সাম্রাজ্যবাদী কুফর শক্তি বা তাদের দালালদের কাছে অথবা এই শাসনব্যবস্থার মাঝে ঘুরপাক খাওয়া আবর্জনার মাঝে ঘুরপাক খাওয়ার সমতুল্য।

শাসক শ্রেণীর ইচ্ছার বাইরে কেউ নয়, চাবি যার তালা তার!! এমন নীতিতে গত ৪২ বছর ধরে নানা পঠপরিক্রমায় আমরা তাদের অত্যাচার নিপীড়ন দেখে আসছি। আমাদের চাওয়া পাওয়া বা দৈনন্দিন যে চাহিদা রয়েছে তার কোন অংশের প্রতি সরকার বা রাজনৈতিক কোন পদক্ষেপ নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে কোথায় নিজের কর্মসংস্তান করবে তার কোন দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ রাষ্ট্রের অবিভাবকের নেই, শিক্ষার নামে বেকুব বানানোর কারখানা বা মানসিক প্রতিবন্ধী করার শিক্ষা ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখছে, রাষ্ট্রকে স্তিতিশীল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করার কোন পদক্ষেপ নেই, পৃথিবীর অন্যতম উর্বর ভূমি থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে কৃষি পণ্য আমদানি করতে হয়, নানা চুক্তির ছায়াতলে বাংলাদেশকে মার্কিন-ইঙ্গ-ভারতের বাফার স্টেটে পরিণত করে তাদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয়, আর রাষ্ট্র যন্ত্রের গুণে ধরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের প্রতারণামূলক শাসন ব্যবস্থা দ্বারা আকড়ে ধরে বাংলাদেশের কথিত রাজনীতিবীদদেরে চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। আর এ কারণেই এক ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলেছে, – “Democracy is the system by which politicians rape the public”

এ সমস্যার উত্তরণে সমাধান একটাই আজকের মুসলিম উম্মাহর সবচাইতে বড় সম্পদ তেল, গ্যাস, সমারস্ত্র কিংবা স্বর্ণ রৌপ্য নয় বরং তার হারানো চিন্তা যা তাকে ফিরে পেতে হবে, সে এতদিন অন্যের সাহায্যে মাগুর মাছের মত মাংশাসী হয়েছিল অথবা ফার্মের মুরগির মত নিস্তেজ হয়েছিল, তাকে যদি আবারও পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাড়াতে হয় তাহলে জালেমকে জালেম বলার সাহসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আর সত্যকে সত্যের মত তুলে ধরতে হবে, করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। কারও ব্যক্তি সমালোচনা বা ছিনেপোটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে কাজের কাজ কিছুই হবে না আমার আপনার আবেগকে কেনার জন্য অনেকেই হাত বাড়িয়ে আছে, নিজের বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে এ মহাবিশ্ব, জীবন ও মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ আজ্জা ওয়া জালের বিধানকে সমাজে মিশ্রণ গঠাতে হবে। আনতে হবে রাসূল (সা)-এর প্রদর্শিত ও আবু বকর, উমর ফারুখ, উসমান ইবনে আফ্ফান, আলী ইবনে আবু তালিব (রা), উমর ইবনুল আবদুল আযীযের খিলাফাহ্ আর রাশীদা। অতএব কাল বিলম্ব না করে আমরা খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে খলীফার প্রতি শরীয়াহ্ প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ করার মাধ্যমে নিজেদের ফরয কাজ সম্পাদন করি।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “যে আনুগত্যের শপথ (বাই’য়াত) থেকে তার হাত ফিরিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার সাথে এমনভাবে সাক্ষাত করবেন যে, ঐ ব্যক্তির পক্ষে কোন দলিল থাকবে না এবং যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, যখন তার কাঁধে কোন আনুগত্যের শপথ নেই, তবে তার মৃত্যু হবে জাহেলি যুগের মৃত্যু।” [সহীহ্ মুসলিম: ১৮৫১]

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে অবশ্যই আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে মার্কিন-ভারতের এইসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং তাদের দালালসমূহ ও দালাল তৈরির কারখানা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা আলিঙ্গনে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা একমাত্র সমাধান।

আল্লাহ আমাদের সত্য উপলব্ধি এবং এর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দিন এবং মুসলিম উম্মাহ’র গৌরব খিলাফাহ রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দিন।

Leave a Reply