ইসলামের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা

ইসলামের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থাকে বর্বরোচিত এবং পশ্চাদপদ হিসাবে আখ্যায়িত করে ইসলামের শত্রুরা ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে আসছে। এই অপবাদ নিরসন করতে আজকের এই প্রবন্ধে ইসলামের বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থার উপর আলোকপাত করা হয়েছে এবং পশ্চিমাদের অপপ্রচার (বিকৃতি) উন্মোচন করা হয়েছে।

ইসলামের বিচার ব্যবস্থা :

যে কোন বিষয়ে ইসলামের সিদ্ধান্ত বা রায় কে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করাকে ইসলামের বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি নিম্নলিখিত দায়িত্বগুলো পালন করবে :

১) জনগণের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি;

২) সামাজিক অধিকারের জন্য ক্ষতিকর সবকিছু প্রতিহত করা;

৩) জনগণ এবং সরকারের (যথা- খলীফা, ওয়ালী’র ইত্যাদির) মধ্যে উদ্ভুত বিরোধ নিষ্পত্তি করা।

ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে যা ইসলামের আইনের মৌলিক উৎস যথা- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াস দ্বারা পরিবেষ্টিত (নিয়ন্ত্রিত)।

একজন প্রধান বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে বিচারিক অঙ্গনের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়, যিনি অন্যান্য সকল বিচারক নিয়োগ এবং স্তর/ কার্য পরিধি নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামের তিন ধরণের বিচারকের অস্তিত্ব বিদ্যমান। খলীফা একজন বিশ্বস্ত, যোগ্য, ও ন্যায়পরায়ন বিচারককে প্রধান বিচারপতি বা কাযী-উল্-কুযাত নিয়োগ করবেন। প্রধান বিচারপতি বিধি মোতাবেক নিন্মলিখিত বিচারকদের নিয়োগ করবেন:

১. কাযী-উল্-খুসুমাত – কাযী উল খুসুমাত পারিবারিক আইন, চুক্তি আইন, ক্রিমিনাল আইন ইত্যাদি ব্যাপারে বিচারকার্য পরিচালনা করেন।

২. কাযী-উল্-মুহতাসিব – কাযী উল মুহতাসিব ব্যবসা পরিদর্শক, অসামাজিক কার্যকলাপ বিরোধী পরিদর্শক, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিদর্শক তথা জনস্বার্থ দেখাশুনাকারী বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাযী মুহতাসিবের রায় প্রদান করার জন্য কোন বিচারালয় প্রয়োজন হয় না। তিনি যেকোন সময়ে যেকোন জায়গায় অপরাধ সনাক্ত করতে পারলে সাথে সাথে সেখানেই রায় প্রদান করে তা পুলিশের সাহায্যে বাস্তবায়ন করতে পারেন।

৩. কাযী-উল্-মাযালিম – কাযী-উল-মাযালিম খলীফা থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠীর যেকোন ব্যক্তির যে কোন ধরণের অন্যায় আচরণের ব্যাপারে আইনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। তিনি বাদি ছাড়াই নিজে উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রের যে কোন দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। খলীফার বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন সময়ে এই আদালতের বিচারককে পদচ্যুত করা যাবেনা।

সকল বিচারককে অবশ্যই মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্পন্ন/ সুস্থ মস্তিস্ক/ প্রকৃতিস্থ, ন্যায়পরায়ণ/ সৎ এবং বিচারিক জ্ঞান সম্পন্ন অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে কোন নীতি কিভাবে প্রয়োগ হবে তা জানতে হবে। সরকারের অন্যায় কাজের বিচারের জন্য নিযুক্ত বিচারকের অতিরিক্ত যোগ্যতা হলো তাঁকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে এবং মুজতাহিদ (যিনি ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখেন) হতে হবে।

যে কোন শাসক, প্রশাসক, কর্মকর্তা এমনকি খলীফাকেও পদচ্যুত করবার কর্তৃত্ব রয়েছে কাজী মাযালমি এবং তা রাসূল (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রাসূল (সা) আব্দুল্লাহ্ ইবনে নাওকেল (রা) কে মদিনার বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন এবং রশিদ ইবনে আবদুল্লাহকে বিচার ব্যবস্থার প্রধান ও অভিযোগ সংক্রান্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেন। ।(ইবনু ইসহাক খণ্ড ৪ ও ইমাম শা’ফীর “সহজ আইন বিজ্ঞান”)। একজন বিচারক দিয়ে একটি আদালত গঠিত হয় এবং তিনিই রায় দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অন্য আরও বিচারক থাকতে পারেন, তবে তাঁরা কেবলমাত্র পরামর্শ দ্বারা সহযোগিতা করতে পারেন। প্রকৃত অর্থে তারা বিচারক নন। কারণ রায় নির্ধারিত হয় ইসলামের মৌলিক উৎস দ্বারা, পশ্চিমাদের মত মানব মস্তিস্ক দ্বারা নয়। যেহেতু কেবলমাত্র শতভাগ প্রমাণিত হলেই ইসলামে শাস্তি কার্যকর করার বিধান বিদ্যমান রয়েছে তাই ইসলামে আপীল আদালত নেই। সাক্ষ্য প্রমাণে কোন প্রকার সন্দেহ থাকলেই ঐ মোকদ্দমা বাতিল হয়ে যায়। যখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে যায়, তখন ঐ বিষয়ে প্রদত্ত রায় স্বয়ং আল্লাহর রায় হিসাবে গণ্য হয় এবং তা ফিরিয়ে নেয়া যায় না।

বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা

ইসলামী রাষ্ট্রে শরিয়াহ্ অনুযায়ী বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা । যেহেতু খিলাফত রাষ্ট্রে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন, সেহেতু বিচার বিভাগ জনগণের উপর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে করে।

খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত। বিচারকের অন্যায়ের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। এজন্য বিচারকগণ শরীয়াহর প্রত্যেকটি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন এবং পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ থেকে কর্তব্য পালন করেন।

খিলাফত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতার কোন অবকাশ নাই। নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট আইন বিদ্যমান থাকায় দ্রুত বিচার কার্যক্রম এই শাসন ব্যবস্থার একটি গতিশীল দিক।

বিচার প্রাপ্তি সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম সরকারী ফি নির্ধারণ ও নিশ্চিতকরণ করা হয়ে থাকে।

বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে খিলাফত রাষ্টের বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া খলিফার দায়িত্ব। তাই জনগণকে বিচার প্রাপ্তির জন্য অযথা হয়রানিমূলকভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট স্বীকার করতে হয় না।

ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা : (নিজাম আল উকুবাত)

ইসলামের শাস্তির ব্যবস্থা তথা দন্ডবিধি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়ার প্রমাণ এবং ইসলামের সৌন্দর্য্য। দন্ডবিধির মূলনীতি সমূহ নিম্নরূপ :

১) একজন মুসলিম (পুরুষ বা নারী) তার প্রত্যেকটি কাজের জন্যই দায়িত্বশীল। শরীয়াহতে যে সকল অপরাধের শাস্তি নির্দিষ্ট করা আছে তা রাষ্ট্র কার্যকর করবে। সমাজকে রক্ষা করে শুধুমাত্র এই কারণেই এই নীতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শরীয়াহ্ আদালতের মাধ্যমে কোন অপরাধের শাস্তি হয়ে গেলে ঐ একই অপরাধের জন্য আখিরাত তথা পরকালের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওযা যায়। কারণ দুনিয়ার তুলনায় আখিরাত বা জাহান্নামের শাস্তি বহুগুণ কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক। রাসূল (সা) এর সময় অনেক মুসলিম তাদের নিজেদের অপরাধ নিজেরাই স্বীকার করতো, কারণ শেষ বিচারের দিন তাদের ঐ অপরাধ আমলনামায় গণ্য হোক তা তারা চাইতো না। আবু দাউদ হতে বর্ণিত, যখন একজন লোক নিজের অবৈধ যৌনাচার নিজে স্বীকার করল এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হলো তখন রাসূল (সা) বললেন “কস্তূরীর সুগন্ধির চেয়ে সে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দীয়”। অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, আবু দাউদে বর্ণিত, “রাসূল (সা) এর নিকট একজন মহিলা আসলো এবং বললো, ‘আমি জেনা করেছি’। রাসূল (সা) বললেন, ‘চলে যাও’। সে ফিরে গেল এবং পরের দিন আবার আসলো এবং বললো “সম্ভবতঃ আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিতে চান যেমনি দিয়েছিলেন মা ইয বিন মালিককে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি গর্ভবতী।” তিনি (সা) বললেন, ‘চলে যাও’, এবং শিশুর জন্মের পর আস, সে শিশুর জন্মের পর আসলো এবং বললো, “এইতো সে। আমিই তাকে জন্ম দিয়েছি।” তিনি (সা) বললেন, ‘চলে যাও এবং তাকে পান করাও যে পর্যন্ত না স্তন না ছাড়াও’। যখন মহিলাটি শিশুটিকে স্তন ছাড়াল তখন সে তাকে নিয়ে রাসূল (সা) এর নিকট আসলো। এই সময় শিশুটির হাতে কিছু ছিল যা সে খাচ্ছিল। তখন শিশুটিকে মুসলিমদের মধ্যে একজনকে দেয়া হল এবং রাসূল (সা) মহিলাটির বিষয়ে নির্দেশ দিলেন- অতঃপর তার জন্য একটি গর্ত খোড়া হল এবং তিনি (সা) তার বিষয়ে নির্দেশ দিলেন এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাথর নিক্ষেপ করা হল। যারা পাথর ছুড়েছিল তাদের মধ্যে একজন খালিদ। সে তাকে একটি পাথর নিক্ষেপ করলো। যখন মহিলাটির এক ফোঁটা রক্ত তার গালে পড়ল, তখন সে মহিলাটিকে গালি দিল। তখন রাসূল (সা) তাকে বললেন, “হে খালিদ, বিনীতভাবে। সেই স্বত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, সে এতবেশি অনুতপ্ত হয়েছে যে, যদি কোন বর জালেম ও এই ধরণের তওবা করত তবে সে ও মাফ পেয়ে যেত। ।” এরপর তার বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হল, তিনি (সা) তার জন্য দোয়া করলেন এবং তাকে কবর দেওয়া হল। (মুসলিম)

২) দন্ডবিধির নীতি হল “শাস্তিকে যথাসম্ভব নিবৃত্ত করা”, যেহেতু শাস্তির কঠোরতা নিবৃত্তির প্রাথমিক কাজ করে। কোন প্রমাণের অংশ বিশেষ ও যদি সন্দেহজনক হয় তা শাস্তি নিবৃত্ত করবে। যখন রাসূল (সাঃ) এর নিকট কোন লোক এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করে তাদের উপর শাস্তি কার্যকর করার আবেদন জানাতো তখন রাসূল (সা) শাস্তি প্রয়োগ করা হতে নিজেকে সরিয়ে রাখতে কিভাবে চেষ্টা করতেন তা সীরাতে বর্ণিত আছে। তিনি (সা) বলেছেন, “একজন নিরপরাধীকে শাস্তি প্রদান করার চেয়ে একজন অপরাধীকে মুক্তি দেয়া উত্তম।” একজন ইমামের জন্য ভুলক্রমে একজনকে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে একজনকে ক্ষমা করা উত্তম।”

এরপরেও কি একজন মুসলিম ইসলামী দন্ডবিধির বিরুদ্ধে পশ্চিমা আক্রমণ কল্পনা করতে পারে। আসলে এই বিষয়ে তাদের মিথ্যা প্রচার এবং বিকৃতিতো রয়েছেই, দায়ী তাদের অজ্ঞতাও।

অধিকন্তু পশ্চিমাদের তুলনায় ইসলামের সৌন্দর্য লক্ষ্য করুন। তাদের মৌলিক দর্শন হচ্ছে কাউকে অভিযুক্ত করা বা সাজা দেয়ার জন্য সামান্য একটুকরা দলীল খোঁজা বা সাক্ষী যোগাড় করে তার মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণ করা। ষষ্ঠ বার্মিংহাম কিংবা ৪র্থ গিলফোর্ডের কথা স্মরণ করুন যারা প্রত্যেকেই জেলখানায় কয়েক বছর সাজা ভোগ করার পর নিরপরাধী প্রমাণ হয়েছিল। ইসলামের পুনরুত্থানের দুশ্চিন্তায় পশ্চিমারা আজ এতটাই বিকাররগ্রস্থ হয়ে পড়েছে যে, একজন মুসলিমকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে সাজা দেয়ার জন্য তার মুখের দাঁড়ি কিংবা পরিধানের হিজাবকেই পশ্চিমারা যথেষ্ট/ পর্যাপ্ত প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করছে!

৩) ইসলাম পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণ করে যা জিম্মিদের (অমুসলিম নাগরিক) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাসুল (সা) বলেছেন, “যে কোন জিম্মির ক্ষতি করলো, সে যেন আমারই ক্ষতি করলো।” তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে সকল নাগরিককে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং এক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য বৈধ নয়। বিষয়গুলো নিম্নরূপ :

ক) বিশ্বাস : পশ্চিমা ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি ধর্মকে ক্রমাগত আক্রমণের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইসলাম নয়, যে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস, এমনকি খৃষ্টাণ ধর্ম এবং আমাদের পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণ যথা ঈসা (আ)-কেও আক্রমণ এবং অসম্মান করার পিছনে তাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা অপরিমিত সময় অপচয় করেছে এবং করে যাচ্ছে। পবিত্র কুরআনে আছে “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই” (২:২৫৬) অর্থাৎ অমুসলিমদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা যাবে না এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস লালন ও পালনের অধিকার সংরক্ষিত। কিন্তু ইসলামী আক্বীদা-ই যেহেতু দ্বীনের ভিত্তি, তাই যে কোন অমূল্য রত্নের মতই দ্বীনকে সংরক্ষণ করা হয়। আর তাই কেউ একবার ইসলাম গ্রহণ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হবার পর ত্যাগ করতে চাইলে তার শাস্তি হচ্ছে ইসলাম বিশ্বাসকে অপমান করার শাস্তির মতই মৃত্যুদন্ড। অদ্ভূত বিষয় হচ্ছে, সালমান রুশদী কিংবা সম্প্রতি বাংলাদেশের তাসলিমা নাসরিনের বিষয়টিকে পশ্চিমারা অগ্রহণযোগ্য দাবী করে, আবার তারাই নিজেদের বিশ্বাসের নামে অন্য মানুষকে হত্যা এবং ধ্বংস করার নীতি অবলম্বন করে।

খ) সম্মান : ইসলামে নারীর সম্ভ্রমকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে দেখা হয় এবং নারীকে যে কোন প্রকার ক্ষতি, অপমান, অপবাদ থেকে কঠোরভাবে নিরাপত্তা দেয়া হয়। এটি রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক। এটি পুরোপুরিই পশ্চিমা নীতির বিপরীত, যারা নারীকে কেবলমাত্র কামনার দৃষ্টিতেই দেখে এবং নারী দেহকে বিপনন যোগ্য পণ্যের মতই ব্যবহার করে। যারা পেছনে/ অসাক্ষাতে কোন নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করে তাদের শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেও ইসলাম নারীকে সুরক্ষা দিয়েছে। অধিকন্তু যারা জনসমক্ষে সঠিকভাবে নিজেদেরকে পর্দা দ্বারা আবৃত করেন না এবং যারা ব্যভিচার বা জিনা করে তাদেরকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেও ইসলাম নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে।

গ) চিন্তা/মন/মস্তিস্ক : মদ পান এবং যে কোন বস্তু যা মস্তিস্ককে নেশাগ্রস্থ করে, তা ইসলামে নিষিদ্ধ। অপরদিকে পশ্চিমারা মদের উপরই জীবন-যাপন করছে, আর এখন তারা নেশাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে। এসব বিষয় যখন তাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতাকে ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে তারা এখন বিকল্প সমাধান সন্ধান করছে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ঘ) সম্পদ : পশ্চিমা সরকারগুলো, তাদের ব্যাংক এবং এই ধরণের সংস্থাগুলো যেভাবে কৌশলে অত্যন্ত সভ্য চেহারা নিয়ে জনগণের সম্পদ প্রতিনিয়ত চুরি করে যাচ্ছে, ইসলাম সেখানে চুরির অপরাধ ঠেকাতে হাত কাটার মত কঠোর শাস্তির বিধান রেখে জনগণের সম্পদ সুরক্ষা করেছে। এই শাস্তিটাকে পশ্চিমারা বর্বরোচিত এবং পশ্চাদপদ আখ্যায়িত করে প্রবলভাব আক্রমণ করে আসছে। অথচ এই আক্রমণ একেবারেই ভিত্তিহীন, বরং তা ইসলামের প্রতি তার শত্রুদের প্রবল ঘৃণা এবং বিকৃতির ষড়যন্ত্র দিবালোকের মত উন্মোচন করতে সাহায্য করে। কারণ চুরির অপরাধে কারো হাত কাটতে হলেও কয়েকটি কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়। যথা : দুজন সাক্ষী থাকতে হবে, সম্পদ নিরাপদ স্থান হতে হস্তগত হতে হবে। এছাড়া যদি এমন কেউ চুরি করে যে নিতান্ত দরিদ্র এবং নিরুপায় ছিল, তাহলে উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ হলেও শাস্তি প্রযোজ্য নয়, যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের (নিসাব) চেয়ে কম সম্পদ চুরি করে তাহলেও হাত কাটা হবে না। এগুলো এবং আরো কিছু শর্ত শাস্তির সম্ভাব্যতা হ্রাস করে অনেকাংশে।

ঙ) জীবন : রাসূল (সা) বলেছেন, “কা’বা” গৃহ এবং এর চতুর্পার্শে যা কিছু আছে তার চেয়ে একজন মুসলিমের রক্ত অধিক মূল্যবান।” আর তাই হত্যার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। অবশ্য নিহতের পরিবার ইচ্ছা করলে দিয়তের বিনিময়ে ক্ষমাও করতে পারে।

প্রত্যেক মানুষই এইসব নিরাপত্তা আকাঙ্খা করে যা শুধুমাত্র ইসলাম নিশ্চিত করে। যে কোন পুরুষ বা নারী জিজ্ঞেস করুন, তারা জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ইত্যাদির নিরাপত্তা চায়। আর ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন সমাজই এসব নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে না বরং পশ্চিমে প্রায়ই এসব নিরাপত্তার লংঘন এবং অপব্যবহার ঘটে থাকে। মাথার উপর ঋণের বোঝা, তার সাথে অপরাধের উচ্চতার, বিশেষত : ধর্ষন, চুরি ইত্যাদি এবং সেই সাথে এই সকল সমস্যার সমাধানহীন জীবন ব্যবস্থায় কোনভাবেই মানসিক প্রশান্তি অর্জন সম্ভব নয়।

ইসলামের দন্ডবিধি চার ভাগে বিভক্ত:

১) হুদুদ : এই শাস্তি হচ্ছে “আল্লাহর (সুবহানাহুতা ওয়া তা’আলা) অধিকার এবং তা কেউ ক্ষমা করতে পারে না।” ছয়টি ক্ষেত্র এর অন্তর্ভূক্ত:

ক) অবিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার : (১০০ দোররা বা চাবুকের আঘাত), বিবাহিত পুরুষ/ নারীর ব্যভিচার : (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা), সমকামিতা : (মৃত্যুদন্ড)।

খ) অপবাদ দেওয়া, সম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা কথা প্রচার করা এবং উড়ো খবর রটানো (৮০ দোররা)।

গ) চুরি (হাত কাটা)

ঘ) মদ পান করা এবং নেশা করা (৮০ দোররা)

ঙ) দুই দল মুসলিম দ্বারা আইন লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন। যথা : খলীফা আবু বকর (রা) এর সময় মুরুতাদদের যাকাত অস্বীকার করার বিষয়।

চ) মুরতাদ, অর্থাৎ কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করা (মৃত্যুদন্ড)।

২) আল-জিনায়াত: “ব্যক্তির অধিকার এবং ক্ষমা করারও অধিকারী”। মূলত : হত্যাকান্ড সংক্রান্ত ঘটনাগুলো হতে পারে তা বেআইনীভাবে কিংবা দূর্ঘটনাবশতঃ, এবং নিহত ব্যক্তির স্বজন বা পরিবারের দিয়তের বিনিময়ে ক্ষমা করার অধিকার এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ স্বরূপ :

ক) যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যমূলকভাবে খুন করে তার ক্ষেত্রে দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ যার মধ্যে ৪০টি হতে হবে গর্ভবতী।

খ) যদি কোন ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে খুন করে সেক্ষেত্রে তার দিয়ত হচ্ছে ১০০ উটের সমপরিমাণ।

ইমাম আন-নাসায়ী তার বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করেন যে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য দিয়ত রয়েছে, যেমন চোখের জন্য রক্ত পণ হচ্ছে ৫০টি উটের সমপরিমাণ।

৩) আল-তা’জির : এটি হচ্ছে “সমাজের অধিকার”। যা কিছু সমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে তা এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত, যেমন- রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেচাঁমেচি করা বা রাস্তায় আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি। রাষ্ট্রই এই ধরণের অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে।

৪) আল-মুখালাফাত : এটি হচ্ছে “রাষ্ট্রের অধিকার”। এই ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত বিষয়ে রাষ্ট্র নিজেই নিয়ম/ আইন তৈরী করে থাকে। যেমন- রাস্তায় গাড়ির গতিসীমা অতিক্রম, যেখানে গাড়ি রাখার নিয়ম নেই সেখানে রাখা ইত্যাদি।

সর্বশেষ বলা যায়, বিচার করা এবং শাস্তি প্রয়োগ করার বাধ্য বাধকতার মধ্যেই বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থার মূল ভিত্তি নিহীত রয়েছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতীত কোন ব্যক্তির জন্য কোন প্রকার শাস্তি কার্যকর করা বৈধ নয়। ইসলামি বিচার ও শাস্তি ব্যবস্তার এই সকল দায়িত্ব কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক, অন্যথায় পুরা উম্মাহ্ এর জন্য দায়ী থাকবে, যদিও তারা সালাত আদায় করে, হজ্ব করে, যাকাত দেয়। এই দায় থেকে অব্যাহতি পেতে রাসুল (সা) এর সুন্নাহর অনুসরণে ইসলামী রাষ্ট্র তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজে যোগ দেয়া সকল মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক তথা ফরয। এই রাষ্ট্রই আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করবে।

“The Judicial And Punishment System” প্রবন্ধ থেকে অনূদিত
এস আহমেদ

Print Friendly, PDF & Email

Leave a Reply