بسم الله الرحمن الرحيم
১) ইয়াকুব আলাইহি সালামেরই অপর নাম ইসরাইল। হিব্রু ইসরাইল শব্দটি আরবী আবদুল্লাহ্’র সমার্থক হলেও; আজ ইসরাইলীরা হচ্ছে আদু’আল্লাহ্ [আল্লাহ্’র শত্রু]। তিনি মৃত্যুশয্যায় তার সন্তানদের জিজ্ঞেস করেছিলেন:
“তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন সে সন্তানদের বলল: আমার পর তোমরা কার এবাদত করবে? তারা বললো, আমরা তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের উপাস্যের এবাদত করব। তিনি একক উপাস্য।” [সুরা বাকারাহ: ১৩৩]
অথচ তাদের সীমালঙ্গন আর বিধিবিধান না মানার কারনে তাদের উপর আরোপিত হয়েছে লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা:
“আর তাদের উপর আরোপ করা হল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে থাকল। এমন হলো এ জন্য যে, তারা আল্লাহর বিধি বিধান মানতো না এবং নবীগনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। তার কারণ, তারা ছিল নাফরমান সীমালংঘকারী।” [সুরা বাকারাহ: ৬১]
আর এই সীমালঙ্গনকারীদের সীমালঙ্গনের বর্তমান শিকার ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনি ভূমিতে তাদের দখলদারিত্ব আর আগ্রাসনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। অথচ যেখানে ইসরাইলের অস্তিত্বের ভিতই *দখলদারিত্ব*; সেখানে আজ তারাই শোর তুলছে ফিলিস্তিনিদের *সন্ত্রাস* বলে। এ যেন বাড়ীতে অতিথিকে থাকতে দেয়া গৃহকর্তা; যাকে তার অতিথি নিজ গৃহ থেকে *বহিষ্কার* করতে চায় জবরদখলকারী বলে। কিংবা পকেটমার ধরা পরার পর ভুক্তভোগীকে চোর সাজানোর মত প্রহসন। ঔপনৈবেশিকদের সহায়তায়, জার্মান ইহুদী নিধন পরবর্তী সময়ে এই প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। আর নিঃসন্দেহে এই প্রহসনকারীদের জন্য অপেক্ষা করছে লাঞ্ছনা।
২) ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে হামাস নেতা খালিদ মিশালের মন্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ:
“আজ ইসরাইল স্নায়ু পরীক্ষা করছে এই জাতির, তারা মিশরকে পরীক্ষা করছে, আরব আর মুসলিমদের পরীক্ষা করছে…যে তারা পূর্বের মত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে পারে কিনা নাকি বর্তমান নেতৃবৃন্দের অন্য কোন লক্ষ্য আছে।”
এই মন্তব্যটিই ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের পরিস্থিতির সারাংশ। তাই, এই আলোচনা টেনে দীর্ঘ করতে চাই না আর মুসলিম দেশসমূহের পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট নেতৃবৃন্দের পরচর্চায় ও লিপ্ত হতে চাই না।
৩) তবে, এই চিত্র খুবই হতাশার যে, যখন দেখি গঁৎবাধা আর একই ধরনের প্রতিক্রিয়া: ফিলিস্তিনে ইসরাইলী হামলার পরিপ্রক্ষিতে। ফেসবুকে ফিলিস্তিনি পতাকার বন্যা বইয়ে দেয়া হচ্ছে। আর অনেক ভাই ফিলিস্তিনকে তালিকাভুক্ত দেশের অন্তর্ভুক্তির পিটিশান সাইন আর শেয়ার করছেন। আর প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় প্রতিবাদ করছে সমাজতন্ত্রীদের সাথে এই ধ্বনিতে: “ফিলিস্তিন মুক্ত করো” আর মুসলিমরা বলছে: “ও ফিলিস্তিন…”।
ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনের বর্ণবাদী-জাতীয়তাবাদী পতাকাকে ভয় করে না। তারা ইসলামের পতাকাকে ভয় করে। আমরা এটা জানার চেষ্টা করি না কেন যে ফিলিস্তিনি পতাকার ভিত্তি কি? এর ডিজাইনটি নেয়া হয়েছে আরব বিদ্রোহের পতাকা [প্রায় অন্যান্য আরব জাতীয় পতাকার মত] যা খিলাফহ্’র বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়ছিলো আর যার হোতা ছিলো ব্রিটিশরা। এটি হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আর “আরব” জাতীয়তাবাদের প্রতীক। আর আমরা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে জানতে পারি, জাতীয়তাবাদের অসারতা আর এর পরিত্যাগের নির্দেশ। এই চিন্তা আমাদের মাথায় আসা উচিত না যে, ফিলিস্তিনি পতাকাতো যেকোনভাবে ইসলামিক; বস্তুতঃ তা হচ্ছে উম্মাহ্’র দুর্বলতা আর বিভাজনের প্রতীক আর যার বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হবে, সমর্থন নয়।
এই পতাকাগুলো ছুড়ে ফেলতে হবে আর তার পরিবর্তে ধারন করতে হবে তাওহীদের পতাকা। কমিউনিস্ট কিংবা সমাজতন্ত্রী কাফিরদের সাথে বিক্ষোভ পরিহার করতে হবে; যারা ইসলামেরই বিরুদ্ধাচরণ করে আর তাদের কোন চেতনা নাই ফিলিস্তিনকে সাহায্য করার আর না তারা চায় কোন মুসলিম ভূমি ইসলামি বিধিবিধান দ্বারা শাসিত হোক।
আমাদেরকে এটাও মাথায় রাখতে হবে প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা, ফিলিস্তিন অনেকগুলো আক্রান্ত মুসলিম ভূমির একটি ভূমি; একমাত্র ভূমি নয়। নিঃসন্দেহে এই ভুমি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্’র জন্য পবিত্র ভূমি। এর সাথে জড়িয়ে আছে মুসলিমদের প্রথম কিবলা আল-আকসা, রাসুলুল্লাহ’র ইসরা আর অসংখ্য আন্বিয়াদের স্মৃতি। তাই কেবল ফিলিস্তিনি মুসলিম ভাইদের নিকট নয় বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্’র ভাইদের কাছে এর তাৎপর্য অপরিসীম। কেননা,মিডিয়ার সবসময়ের প্রচেষ্টা একে ফিলিস্তিনি ইস্যু কিংবা আরব ইস্যু বলে তুলে ধরা। আমাদের দেখতে হবে, আমরা কি মিডিয়ার এই কাজে অজান্তে সাহায্য করছি কিনা? সাথে সাথে আমাদের সামগ্রিক বিশ্ব-পরিস্থিতিও অনুধাবন করতে হবে। এই আক্রান্ত ভূমির তালিকায় রয়েছে মালি, ইয়েমেন, সোমালিয়া, চেচনিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, আরাকান, কাশ্মীর, মিন্ডানো এবং আরো অনেক। তাদের জন্য দু’আ করা আর সত্যিকারের তাগাদা অনুভব করতে হবে সমগ্র উম্মাহ্’র জন্য; আর এটাই প্রকৃত ভালবাসার নিদর্শণ।
আমাদের গৌরবোজ্জল ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে; আর সাথে সাথে এই উপলব্ধি ও শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, গতকালের ঘটনাপ্রবাহ থেকে যার মধ্যে নিহিত রয়েছে আজকের সমস্যার উত্তর। আমাদের বুঝা উচিত, আল-কুদসের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন আদায়, এর জন্য কোন সমাধান নয়। এর সমাধান হচ্ছে, উম্মাহ্’র সমস্ত ভূমিকে একত্রীকরণ আর সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্’র একক নেতৃত্বের অধীনে একক জাতি হিসেবে সম্মলিত বাহিনী প্রেরণ এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে; যেভাবে তা করেছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহিমাহুল্লাহ। আর তা শরীয়াহ্’য় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে; আরব, সমাজতান্ত্রিক, গনতান্ত্রিক আর অন্য যে কোন পন্থায় নয়: যা ইসলাম বহির্ভূত।
৪) ইসরাইল আর হামাস বর্তমানে ইঁদুর-বিড়ালের খেলায় রয়েছে। ইসরাইল এখনো তার প্রকৃত শত্রুর মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়নি। কিন্তু, শীঘ্রই তারা ইসলামের সত্যিকার সিংহের সন্মূখীন হবে, যখন তারা জীবন ভিক্ষা চাইবে আর বৃক্ষ আর পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকোবে। আর পাথর বলে উঠবে আমার পিছনে লুকায়িত ইহুদীকে হত্যা কর, ইনশা’আল্লাহ্।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
“আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাবে পরিষ্কার বলে দিয়েছি যে, তোমরা পৃথিবীর বুকে দুবার অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং অত্যন্ত বড় ধরনের অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে।অতঃপর যখন প্রতিশ্রুতি সেই প্রথম সময়টি এল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলাম আমার কঠোর যোদ্ধা বান্দাদেরকে। অতঃপর তারা প্রতিটি জনপদের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। এ ওয়াদা পূর্ণ হওয়ারই ছিল। অতঃপর আমি তোমাদের জন্যে তাদের বিরুদ্ধে পালা ঘুয়িয়ে দিলাম, তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও পুত্রসন্তান দ্বারা সাহায্য করলাম এবং তোমাদেরকে জনসংখ্যার দিক দিয়ে একটা বিরাট বাহিনীতে পরিণত করলাম।তোমরা যদি ভাল কর, তবে নিজেদেরই ভাল করবে এবং যদি মন্দ কর তবে তাও নিজেদের জন্যেই। এরপর যখন দ্বিতীয় সে সময়টি এল, তখন অন্য বান্দাদেরকে প্রেরণ করলাম, যাতে তোমাদের মুখমন্ডল বিকৃত করে দেয়, আর মসজিদে ঢুকে পড়ে যেমন প্রথমবার ঢুকেছিল এবং যেখানেই জয়ী হয়, সেখানেই পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হয়ত তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। কিন্তু যদি পুনরায় তদ্রূপ কর, আমিও পুনরায় তাই করব। আমি জাহান্নামকে কাফেরদের জন্যে কয়েদখানা করেছি।” [সুরা বনী ইসরাইল:০৪-০৮]
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে। [সুরা আল-ই-ইমরান: ১৩৯]
মুসলিম উম্মাহ সর্বত্র আজ যে নির্যাতন, নিপীড়ন আর হত্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা উম্মাহ্’কে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুতি, জাতীয়তাবাদ, মানব-রচিত বিধান, ঔপনৈবেশিক দাসত্বের মনন, অনৈক্য আর পরাজিত মানসিকতার কলুষতা থেকে মুক্তি দান করুন। আর আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় ফিরে যাওয়ার তাওফীক দিন। আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্বাসীদের বিজয় দান করুন এবং ঐক্য দান করুন। আমাদের বিশ্বাস আর জ্ঞানকে পরিশুদ্ধ করুন আর আমাদের একনিষ্ঠতা দান করুন। আল্লাহ্ তা’আলা ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের ধৈর্য ধারন করার তাওফীক দিন আর দৃঢ়পদ করুন। আমীন।
সায়্যিদ মাহমূদ গজনবী