ইসলামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম

১. সূচনা

খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle) করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের (Cultural stage) কাজের স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্যায়। যেহেতু বাংলাদেশে আমাদের এই সংগ্রামের পর্ব শুরু হয়েছে, তাই আমাদেরকে এই বিষয় সম্পর্কে সুগভীর ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই নিবন্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিবে এবং পরবর্তীতে আমরা ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যান্য দিক নিয়ে আরো আলোচনা করবো। সবার সুবিধার্থে আমার আলোচনাকে আমি চারটি ভাগে ভাগ করেছি:

১. রাজনৈতিক সংগ্রাম কি? (Definition of  Political Struggle)
২. রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিক (Aspects of  Political Struggle)
৩. ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রাম (Political Struggle in Islam)

৪. রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Those who Struggle for Islam)

২. রাজনৈতিক সংগ্রাম কী?

রাজনৈতিক সংগ্রামের মানে হচ্ছে শাসক বা যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাদের বিরোধিতা করা তথা সরকারের সাথে বিরোধে লিপ্ত হওয়া। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরির্বতনের লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন বিরোধিতার নামই রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রাম প্রাণঘাতী বা সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বিভিন্ন কর্মকান্ড বা কথার মাধ্যমে পরিচলনা করা হয়। একটি দেশের নাগরিকদের একটি অংশ সরকারের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে।

মানব সভ্যতা যত পুরনো, রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসও তত পুরনো। মানুষ যখনই সমাজবদ্ধ বা গোত্রবদ্ধ বা একটি দেশের মধ্যে বসবাস করা শুরু করেছে, তখন থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রামের উৎপত্তি। পরিপূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন কামনাকারী মানুষ একটি সমাজে সব সময়ই থাকে। সমাজের একটি অংশ হয়তো পুরনো রীতিনীতি বা সামাজিক প্রথার মুলোৎপাটন চায়। অন্যরা হয়তো অবিচার, জুলুম ও নিপীড়নের অবসান চায়। আরও কোন গোষ্ঠী হয়তো ক্ষমতায় আরোহণ করতে চায়। এদের মধ্যে কেউ হয়তো সশস্ত্র পন্থার আশ্রয় নেয়, কেউ হয়তো অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে বিশ্বাস করে। আবার কেউ হয়তো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে।

যেকোন রাজনৈতিক সংগ্রামের দুটি পক্ষ থাকে। একটি পক্ষে থাকে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান তথা সরকার, যার হাতে থাকে ক্ষমতা, সশস্ত্র বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল যন্ত্র, যারা রাষ্ট্রীয় নীতি ও অবকাঠামোর রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। আর অন্য পক্ষে থাকে নবীন ও দুর্বলেরা, যারা সরকার বিরোধী পক্ষ। এরা জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করে। এই পক্ষ একটি আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার মাধ্যমে একটি কাংখিত পরিবর্তেনের স্বপ্ন দেখে।

৩. রাজনৈতিক সংগ্রামের বিভিন্ন দিক

রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করার তিনটি দিক রয়েছে:-

১. রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা
২. সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা
৩. গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যে তথা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা

৩.১ রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা

রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রথম ধাপ হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার মাধ্যমেই ‘খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ রাজনীতির ময়দানে নিজের জন্য অবস্থান তৈরী করে নেয় এবং ধীরে ধীরে একটি দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী সব সময় রাজনৈতিক ক্রিয়া কর্মকে তার ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে। লেখক, কলামিস্ট ও বু্দ্ধিজীবিদের লেখালেখি ও সমালোচনায় একটি সরকার তেমন উদ্বিগ্ন হয়না।

রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হলে রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে সার্বক্ষণিক সচেতনতা থাকতে হবে এবং রাজনীতির ময়দানের আলোচিত ইস্যু সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। একটি দেশে প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে এবং অসংখ্য ইস্যু জন্ম নেয়। এইসব ঘটনা আর ইস্যুই একজন রাজনীতিবিদের লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। তাই রাজনীতিবিদকে সার্বক্ষনিকভাবে নিচের কাজগুলো করতে হয়-

১. নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে।
২. গভীর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে হয়, যাতে রাজনৈতিক সংগ্রামের উপযোগী ইস্যু নির্বাচন করা যায় অথবা সংগ্রামের জন্য ইস্যু তৈরী করা যায়।

নিয়মিত ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনায় ব্যর্থ হলে সঠিক ইস্যু নির্ধারণে আমরা ব্যর্থ হবো। এর ফলে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হবে এবং আন্দোলনের অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়বে। আন্দোলন যদি বারে বারে সঠিক ইস্যু নির্ধারণে ব্যর্থ হয়, তবে সে তার উদ্দেশ্য হাসিলেও ব্যর্থ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতির ময়দানে বিদ্যমান ইস্যুর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা একজন রাজনীতিবিদদের আসল কাজ নয়। বরং প্রকৃত রাজনীতিবিদ রাজনীতির মাঠে নতুন ইস্যু তৈরী করে এবং ইস্যুকে সংগ্রামের জন্য উপযোগী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করে। ইস্যু নির্ধারণের পর রাজনীতিবিদের কাজ দু’টি:

১. ইস্যু সম্পর্কে নিজস্ব আঙ্গিকে বক্তব্য তুলে ধরা

২. ক্ষমতাসীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রদানের মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলন করা। সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা যায় দু’ভাবে – প্রত্যক্ষভাবে (direct) অথবা পরোক্ষভাবে (indirect).

পরোক্ষ আন্দোলন হচ্ছে সরকারের সহযোগী শক্তি বা শাসক গোষ্ঠীর একাংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় (কয়েক বছর আগে ইসলামবিরোধী কার্টুন ছাপার প্রতিবাদে) প্রথম আলো বিরোধী আন্দোলনে সকল কর্মসূচী শুধুমাত্র পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল। এটি সরকারের বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ আন্দোলন। এটা প্রত্যক্ষ আন্দোলন হতো যদি দাবি আদায়ের জন্য মনোযোগ সরকারের প্রতি নিবদ্ধ করা হতো।

আমাদের সবারই জন্য খুবই জরুরী বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ড (Political Action) আর কর্মপদ্ধতির (Method) মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করা। কর্মপদ্ধতি একটি স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় বাধ্যতামূলক (ফরজ) দায়িত্ব। কর্মপদ্ধতি সুনিদিষ্ট কিছু স্তরে বিন্যস্ত। কর্মপদ্ধতির প্রতিটি পর্যায় বা স্তরের নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারিত আছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচীর সমন্বিত রূপ। এর উদ্দেশ্য সরকারকে চ্যলেঞ্জ করা এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। রাজনৈতিক কর্মকান্ড বাস্তবতার নিরীখে পরিবর্তনীয়। তাই সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার দিকে গভীর মনোনিবেশ করে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হয়। উক্ত বাস্তবতার ঘটনা পরম্পরা ও কার্যকারণ পর্যালোচনায় কোন যৌক্তিক অনুমান, তুলনা বা সাধারনিকীরণের (সাধারণশ্রেণী ভুক্তিকরণ) আশ্রয় নেয়া যাবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঘটনা বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে শুধু অতীত ধারণা, বা যৌক্তিক অনুমানের উপর নির্ভর করা যাবে না। এছাড়া রাজনৈতিক ইস্যুকে গড়পড়তা (Generalization) হিসাবের মধ্যেও ফেলা যাবে না। প্রত্যেকটি ঘটনা সুনির্দিষ্ট এবং এদের আঙ্গিকগুলোও ভিন্ন ভিন্ন। সব কিছুকে বর্তমান বাস্তবতার নিরীখে পর্যালোচনা করেই কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে এবং ময়দানে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

৩.২ সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করা

জনগণের মধ্যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করা একান্ত জরুরী। সব রাজনৈতিক কর্মসূচী সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ লাভ করবে না। আন্দোলন রাজনীতির ময়দানে যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হবে, তত বেশী এর কর্মসূচীকে সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করবে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও সরকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার জনবিচ্ছিন্ন থাকে, যার ফলে সামান্য সমালোচনাও সরকার হুমকি হিসেবে গণ্য করে। এর বিপরীতে উম্মুক্ত সমাজে (যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়) সরকারের কিছুটা জনসমর্থন বা গণভিত্তি থাকে। এ ধরণের সমাজে সরকারকে নানা জন নানা ভাবে সমালোচনা ও সমর্থন করে থাকে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মতো অবস্থান তৈরী করতে আন্দোলনমুখী দলটিকে অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে অধিক সংখ্যক জনগণের কাছে পৌছে অধিকতর জনসমর্থন এবং ব্যাপক ও গভীরতর গণভিত্তি তৈরীর প্রয়োজন হয়। এভাবে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ বা উদ্বিগ্ন করার মাধ্যমে আন্দোলনটিকে সরকারের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরতে হয়।

সমাজ পরিবর্তনের জন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠাকামী দলটিকে বারে বারে তীব্র ভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে – তা উম্মুক্ত বা অবরুদ্ধ সমাজ, যাই হোক না কেন। সরকার বিরোধী আন্দোলনের স্বরূপ অবশ্যই তীব্র ও প্রায় যুদ্ধংদেহী (Fierce and Combative in Style) হতে হবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পাঁজর ক্ষতবিক্ষত হবে, সরকারের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি ধুলোর সাথে মিশে যাবে এবং গণমানুষ এমনভাবে জাগ্রত হবে যেন দিনের পর দিন বিক্ষুদ্ধ মানুষের হাত ও আঙ্গুলের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, যারা সরকারের গলা টিপে ধরবে এবং সরকারকে চিরতরে ধরাশয়ী করবে। এই সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীকে অবশ্যই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুধা, ভয়ভীতি, জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনের জন্য এবং নিজের সময়, শ্রম, সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংগ্রামে দলের গভীর আন্তরিকতা, স্থির সংকল্প ও অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে জনগণ খিলাফত প্রতিষ্ঠার দলটিকে নিজের পক্ষের শক্তি হিসেবে চি‎হ্নিত করবে এবং তা জনগণের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হবে।

সরকার বিরোধী আন্দোলনে দু’ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়োজন-

১. জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী
২. সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম

৩.২.১ জনগণের স্বার্থ রক্ষার কর্মসূচী

জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার মানে হচ্ছে সরকারের প্রজা প্রতিপালনকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এই বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে কর্মসূচী দেয়া। যখনই সরকার জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করবে অথবা সরকার জনগণের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে অথবা কোন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উদাসীন থাকবে, তখনই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং সরকারের গণবিরোধী চেহারা জনগণের সামনে উম্মোচিত করতে হবে। জনস্বার্থের বিষয়টি দু’রকম হতে পারে-

১. স্বল্প মেয়াদী সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ (যেমন – দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি)
২. স্বল্প মেয়াদী রাজনীতি বিষয়ক স্বার্থ (যেমন- ড. ইউনুসের রাজনীতিতে নামার প্রচেষ্টা)

স্বল্প মেয়াদী জনগণের সুযোগ সুবিধা বিষয়ক স্বার্থ লংঘিত ও অবহেলিত হলে বাস্তবতার বর্ণনা করে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তাহলো-

– জুলুমের বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং শরীয়াহ্‌ হুকুমের বর্ণনা না দিয়ে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা
– বিদ্যমান সমাধানের মন্দ দিক তুলে ধরা, জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং শরীয়াহ হুকুম ব্যাখ্যা করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়া।

আর স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রে যে ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করা যায় তা হলো-

– চলমান বা প্রস্তাবিত সরকার গঠন পদ্ধতিকে সমালোচনার ইস্যু বানানো
– সংসদের কার্যকরিতাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা
– সরকারের উপর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী কোম্পানীর প্রভাবকে জনসমক্ষে তুলে ধরা
– দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী দূতাবাসসমূহের হস্তক্ষেপের বিষয়টি জনগণকে জানানো ইত্যাদি।

৩.২.২ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম

রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে স্বতন্ত্রভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই সাম্রাজ্যবাদীরাই জনগণের আসল শত্রু।

সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থ হচ্ছে তাদের আগ্রাসণের প্রতিবাদ করা, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করা, তাদের ষড়যন্ত্র ও কূটচালের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরা যাতে করে উম্মাহ্‌কে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যায় এবং দেশে তাদের প্রভাবের মুলোৎপাটন করা যায়। এই সংগ্রামের জন্য আমাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

– সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের সকল দালালদের গতিবিধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে।
– তাদের দালালদের মুখোশ উম্মোচিত করতে হবে।
– তাদের তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র আগে থেকেই বিশ্লেষণ ও অনুমান করে তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
– তাদেরকে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিহত করতে হবে।
– তাদের সকল অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত বা সামরিক অনুদান বর্জন করতে হবে।
– তাদের অনুগত সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ইত্যাদি।

৩.৩ গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যে তথা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা

সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা। আর জনগণকে সংগঠিত করে গণআন্দোলন পরিচালনা করার মাধ্যমেই এই উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব। শাসকগোষ্ঠীর শক্তি বা সমর্থনের ভিত্তি হয় স্বাভাবিক সমর্থন (Natural support) বা অস্বাভাবিক সমর্থন (Unnatural support)।

স্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে জনগণের সমর্থন আর অস্বাভাবিক সমর্থন হচ্ছে বিদেশী শক্তির সমর্থন। এছাড়াও একজন শাসকের শাসনকার্জে সহায়তা করার জন্য থাকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। যদি শাসকের ক্ষমতার ভিত্তি হয় জনগণের সমর্থন, তবে আমাদের কাজ হবে শাসককে গণবিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ক্ষমতার ভিত্তির সাথে শাসকের সম্পর্ক কেটে ফেলা। আর শাসক অস্বাভাবিক সমর্থন তথা বিদেশী শক্তির সমর্থনে ক্ষমতায় থাকলে জনগণই শাসকের বিরুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এছাড়া সরকার যেসব উপায়কে অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকে সেগুলোকে দূর্বল করে ফেলার জন্যও জনগণের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার অর্থ হচ্ছে একটি গণআন্দোলন পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে খিলাফত প্রতিষ্ঠাকামী দলটির কাজ হচ্ছে দলের সাথে সরকারের বিরোধিতাকে জনগণের সাথে সরকার বিরোধিতায় পরিণত করা।

গণআন্দোলনের অর্থ হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করা। জনগণকে শাসকদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক করা, শাসকের অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলা এবং শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কর্মসূচী প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে দলটি জনগণের নেতৃত্বের আসন অর্জন করবে। গণআন্দোলন তৈরীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতিয়ার হচ্ছে –

১. হালাকার (পাঠচক্র) মাধ্যমে জনগণকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দীক্ষা দিতে হবে।
২. উম্মুক্ত জায়গায় সরাসরি, পরিস্কার ভাষায়, খোলামেলাভাবে ও সাহসিকতার সাথে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। একজনের সাথে হলেও এভাবেই কথা বলতে হবে এবং একাজ কোন গোপন স্থানে করলে হবে না।
৩. জনগণের সাথে গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে এবং মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক থাকতে হবে। লিফলেট, পোষ্টার ইত্যাদির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব বেশী। খিলাফত প্রতিষ্ঠা আন্দোলন-এর সকল সদস্য ও কর্মীকে জনগণের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপন ও তা বজায় রাখতে হবে। মসজিদ, দোকানপাট, চায়ের ষ্টল এবং জনসমাগম হয় এরকম যেকোন স্থানই জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপযুক্ত স্থান।

গণআন্দোলন পরিচালনা করার আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা স্বতন্ত্রভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হলো জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের (Strong Personality) প্রয়োজনীয়তা। গণআন্দোলনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে জনগণ রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিবে। জনগণ শুধু উন্নততর চিন্তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নেয় না। জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হলে বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। সুতরাং দলের সদস্য ও কর্মীবৃন্দকে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করার জন্য গভীর মনোযোগ দিতে হবে এবং যত্নশীল হতে হবে। দলের সদস্যদেরকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইতিমধ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তথা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে দলের চিন্তা চেতনার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে; সম্ভব হলে তাদেরকে দলের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এটা সামগ্রিকভাবে দলের ব্যাক্তিত্বকেও শানিত করবে এবং দলটিকে একটি ব্যাপক প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবে। এমন একটি দলের নেতৃত্বেই জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এগিয়ে আসবে। রাসূল (সাঃ) দুই ওমরের এক ওমরকে (ওমর ইবনে খাত্তাব বা ওমর ইবনে হাকাম অর্থাৎ আবু জাহেল) ইসলামের সমর্থক হিসেবে চেয়ে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট দোয়া করেছিলেন। এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের দৃষ্টিতে ইসলামের দাওয়াতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।

শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব মানে হচ্ছে জনগণকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা। একজন ব্যক্তি তখনই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় যখন সে জনগণের সমস্যা সমাধানে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে। এধরণের কাজ একজন ব্যক্তির মধ্যে তীব্র দায়িত্ববোধের জন্ম দেয় এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে সব ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যোগ্যতা তৈরী হয়। আর এইসব কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে সংগঠিত করার ও নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী অর্জিত হয়। জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে সমাজে বন্ধুর পাশাপাশি শত্রু ও প্রতিযোগী তৈরী হয়। এই বন্ধুত্ব, শত্রুতা বা প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হয়। সুতরাং দলের কর্মীদেরকে এধরণের কাজ দিতে হবে যাতে করে গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও ধারাবাহিকভাবে জনগণের জন্য কাজ করার মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হতে পারে। সমাজে বিদ্যমান এধরনের ব্যক্তিত্বকে দলের সাথে জড়িয়ে ফেলার বিষয়টিও গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের সংগঠনে এই ধরনের ব্যক্তিত্বদের ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মানানসই করে সাজিয়ে নিতে হবে।

৪. ইসলামে রাজনৈতিক সংগ্রাম

ইসলামের সুচনালগ্ন থেকেই মুসলিমরা রাজনৈতিক সংগ্রাম করে আসছে। এটি ইসলামের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ দায়িত্ব যে প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। খিলাফত পূণঃপ্রতিষ্ঠা বা খলীফার প্রকাশ্য কুফরীর বিরোধিতার মতো বিষয়ে এ ধরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

ইসলামি আকীদার দিকে গভীর মনোযোগ দিলে যে কারো কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ইসলাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগই নেই। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মধ্যেই ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম নিহিত। একজন মুসলিমের বিশ্বাস তাকে একজন সংগ্রামী মানুষ হিসেবে তৈরী করে। পৃথিবীতে মাত্র একজন মুসলিমও যদি বেঁচে থাকে তবে স্থান-কাল নির্বিশেষে তার উপর ফরজ দায়িত্ব হবে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সংগ্রাম করা।

পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং রাসূল (সা) এর বাণীসমূহ রাজনৈতিক সংগ্রামকে গৌরবদীপ্ত ও সম্মানিত কাজ হিসেবে মহিমান্বিত করেছে। এই সমস্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ একজন মুসলিমকে তার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে এবং শাসককে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। ইসলামে শাসকের জবাবদিহিতার বিষয়টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এমনভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে এ কাজ করার ফল উচ্চ মর্যাদা ও পুরস্কার আর একাজ করতে ব্যর্থ হলে বা অবহেলা করলে ফলাফল গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনবে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ।” রাসুল (সাঃ) শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের মহত্ত্ব ও উচ্চতর মর্যাদাকে তুলে ধরেননি। সংগ্রামরত রাজনৈতিক কর্মী যে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)’র পথে জীবন বিলিয়ে দেয় তার মর্যাদার ও পুরস্কার সম্পর্কেও রাসুল (সাঃ) নিশ্চিত করেছেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন “শহীদদের সর্দার হামযা (রাঃ) আর ঐ ব্যক্তি যে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে তার কর্মের জবাবদিহি করতে বাধ্য করে এবং একারণে তাকে হত্যা করা হয়।” এই দুইটি হাদীস রাজনৈতিক সংগ্রামের উচ্চমর্যাদা শুধু নিশ্চিতই করেনা বরং বলিষ্ঠভাবে অত্যাচারী শাসককে মোকাবেলা করতে উদ্বুদ্ধ করে। হাদীসে উল্লেখিত ‘অত্যাচারী শাসক’ বলতে তার মুখের উপর এবং তার শক্তিশালী অবস্থানে গিয়ে বিরোধিতার কথা বলা হয়েছে। আর ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে’ বলতে মুখোমুখি দাড়িয়ে তাকে সাবধান করা, পরামর্শ দেয়া এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছে।

৫. রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্য

এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যারা ইসলামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম করবে তাদেরকে ইস্পাত কঠিন মনোবলের অধিকারী হতে হবে। এর কারণ হচ্ছে সংগ্রামরত কর্মীকে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। অথচ শাসক ও তার অনুগত চক্রের হাতে রয়েছে সার্বিক রাষ্ট্রযন্ত্র এবং স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র শাসকচক্রের ক্ষোভ গিয়ে সংগ্রামরত মানুষের উপরই নিপতিত হবে। সত্যিকথা হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইচ্ছাশক্তির সংগ্রাম। আর ইচ্ছাশক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নত চিন্তাশক্তির মানুষ দুর্বল চিত্ত হলে এর কোনো ফলাফল নেই। একই ভাবে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও যদি উন্নত ধ্যান-ধারণা না থাকে এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য সঠিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো না থাকে তবে সেই ইচ্ছাশক্তি থাকাটা হবে অর্থহীন। প্রবল ইচ্ছাশক্তির মানে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খার দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠ মনোভাব এবং ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে সংগ্রামের ময়দানে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া। এটা খুবই স্বাভাবিক যে শাসক তার সমস্ত শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে চাইবে বা আন্দোলনের শিকড় উপড়ে ফেলতে চাইবে। শাসক ঘুষ দিবে, লোভ দেখাবে, ভয় দেখাবে, অত্যাচার নির্যাতন করবে, ক্ষুধার্ত রাখবে; এমনকি এসব বিষয়ে শাসক রীতিমত দক্ষ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং সংগঠনের কর্মীদেরকে এই অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করতে হবে এবং নিজেদের ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষা দিতে হবে। যদি তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে আন্দোলন স্তিমিত ও নিঃশেষ হয়ে যাবে আর যদি তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, তবে তারা লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে। যারা এই সংগ্রামে দৃঢ় পদে দাড়িয়ে থাকতে ব্যর্থ হবে, তারাই আন্দোলনের প্রকৃত হতাহত।

সুতরাং, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

১. উদ্দেশ্যের প্রতি শক্ত ও অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস
২. প্রবল ইচ্ছা শক্তির অধিকারী হওয়া
৩. উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সর্বাবস্থায় স্থিরসংস্কল্প ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা থাকা
৪. সাহসিকতা ও দৃঢ়তা
৫. গৃহীত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলনীতির প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং সার্বিকভাবে তা অনুসরণ বা মেনে চলা
৬. রাজনৈতিক সংগ্রামে কোন ধরণের নমনীয়তা, আপসকামিতা, প্রতারণা, আত্মপ্রসাদ লাভ বা অবহেলার সুযোগ নেই

এভাবেই একটি ইসলামি সংগঠনের সদস্যদেরকে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যসমূহ শুধুমাত্র দল-এর বৈশিষ্ট্য নয় বরং দলের সকল সদস্যের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। একটি জাতিকে শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেতৃত্ব দেয়া যায়না কারণ উম্মাহ দলের উন্নত চিন্তা বা তত্ত্ব দ্বারা সন্তুষ্ট নয়। উম্মাহ দলকে তার নেতাদের ব্যক্তিত্বকে দিয়ে পরিমাপ বা বিচার করে। জাতি সংগ্রাম ও সাহসিকতার আকাঙ্ক্ষী। দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ণ কাজ গল্পের মতো এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় তা চোর ডাকাত যারই হোকনা কেন। সুতরাং দল এবং এর নেতৃত্বকে জনগণ সূক্ষাতিসূক্ষ পরীক্ষার পরই সমগ্র জাতির নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করবে। জাতি কখনোই কাপুরুষ, দুর্বল, প্রতারক বা আত্মতুষ্টিতে নিমগ্ন কাউকে নেতৃত্ব দেয়না।

যেহেতু ইসলামের দাওয়াকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপরোক্ত গুণাবলী অপরিহার্য এবং এই গুণাবলীগুলো অর্জনের স্বাভাবিক অনুসঙ্গ হচ্ছে হয় মৃত্যু, নয় নির্যাতন নতুবা ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষ্ট। আর এর জন্য আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তার পবিত্র কিতাবে এবং রাসূল (সাঃ) তার বর্ণনায় এ দায়িত্ব পালনে অপারগ ব্যক্তিদের তীব্র শাস্তির কথা ঠিক তেমনিভাবেই বলেছেন যেমনিভাবে মুমিন ও দৃঢ় ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করেছেন সেই জান্নাতের ব্যাপারে যা এই বিশ্বজগতের মতই বিশাল কুর’আনের এই আয়াতগুলো জাহান্নাম এবং তার ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই বিস্তারিত যেমনিভাবে বিস্তারিত জান্নাত ও তার ঐশ্বর্যের ব্যাপারে। আর এভাবেই আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা) মুমিন বান্দাদের আশ্বস্ত করেন উত্তম প্রতিদানের।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

আলিফ-লাম-মীম, মানুষ কি মনে করে যে তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদের কে পরীক্ষা করা হবে না ? আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে। [সূরা- আনকাবূত ১-৩]

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সেই লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনিভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পূর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহ্‌র সাহায্য ! তোমরা জেনে নাও, আল্লাহ্‌র সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী। [ সূরা- আল বাকারা ২১৪]

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন:

তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ্‌ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈয্যশীল? [সূরা আল ইমরান-১৪২]

মুসলমান হোক বা না হোক যে কারও জন্যই সমাজের জীবনধারাকে বদলে দেয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবর্তীণ হয়ে তাতে জয়লাভ করে নিজেরা ক্ষমতায় আসীন হওয়া। তবে কম্যুনিষ্ট পার্টির কর্মীরা জারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিল কিংবা ‘স্বাধীনতা’ ‘সাম্য’ এবং ‘মুক্তচিন্তা’র প্রচারকরা ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে বাস্তিল দূর্গে কিভাবে লাঞ্ছনা ভোগ করেছিল অথবা যারা ইউরোপের রাজাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে রুখে দাঁড়িযেছিল বা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তার গৌরব গাঁথা বর্ণনা করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। বরং আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষ সেইসব সংগ্রামী বীর মুসলিমদের কথা, যারা এই ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, সম্মানহানি ও দারিদ্র্য- দুর্দশার শিকার হয়েছিলেন।

আবু জুবাইদা
অক্টোবর, ২০০৭

Leave a Reply