খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা) বনু তামিমের এক সন্তান। অন্য এক গোত্রের আক্রমণে তাঁর গোত্রটি পরাজিত হয়। আক্রমণকারীরা পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দাসে পরিণত করে। খাব্বাব (রা) ছিলেন ছোটদের একজন।
হাত বদল হয়ে তিনি পৌঁছেন মক্কার বাজারে। বনু খুজায়া’র উম্মু আন্মার নামের এক মহিলা তাঁকে কিনে নেয়। উম্মু আন্মার তাঁকে কর্মকারের কাজে নিয়োজিত করে। একজন সৎ ও কর্মঠ তরুণ রূপে তিনি গড়ে ওঠেন।
যুবক খাব্বাব (রা) জানতে পারলেন যে, মুহাম্মাদ (সা) নামক এক ব্যক্তি নতুন দীন প্রচার করছেন। খোঁজ করে করে তিনি পৌঁছলেন মুহাম্মাদুর রাসূল (সা)-এর কাছে। তাঁর মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে তিনি মুগ্ধ হন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
খাব্বাব (রা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখলেন না। নিঃসংকোচে অন্যদের কাছে তিনি দীনের কথা বলা শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যে এই খবর পৌঁছলো উম্মু আন্মারের কাছে।
উম্মু আন্মার তার ভাই সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে খাব্বাব (রা.)-এর কর্মস্থলে আসে। সিবা’ বলে, “তোমার সম্পর্কে আমরা কিছু কথা শুনেছি।” তিনি বললেন, “কী কথা?” সিবা’ বলে, “তুমি নাকি ধর্মত্যাগী হয়ে বনু হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ?” তিনি বললেন, “আমি ধর্মত্যাগী হইনি। তবে লা-শারিক আল্লাহ্র ওপর ঈমান এনেছি, মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি মুহাম্মদ আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল।”
তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সিবা’ ও তার সঙ্গীরা নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অনবরত কিল-ঘুষি খেতে খেতে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তারা তাঁকে পা দিয়ে পিষতে থাকে।
অন্য একদিন খাব্বাব (রা) আল্লাহ্র রাসূল (সা)-এর সান্নিধ্য থেকে তাঁর কারখানায় ফিরে আসেন। সেখানে ছিল একদল লোক। তারা যখন জানতে পেল যে খাব্বাব (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট থেকে এসেছেন, তারা তাঁকে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত এবং পোষাক রক্তে-রঞ্জিত।
মক্কার মুশরিক নেতাদের নির্দেশে সিবা’ ইবনু আবদিল উয্যা ও তার সাথীরা খাব্বাব (রা)-কে লোহার পোষাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দিতে থাকে। প্রচণ্ড গরমে তিনি কাতর হয়ে পড়তেন। পিপাসায় ছটফট করতেন।
এই অবস্থায় তাঁকে বলা হতো, “মুহাম্মাদ সম্পর্কে এখন তোমার বক্তব্য কী?” দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলতেন, “তিনি আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নেওয়ার জন্য তিনি আমাদের নিকট এসেছেন।” আবারো শুরু হতো মারপিট।
একবার তারা হাপরে কতকগুলো পাথর টুকরো গরম করে সেইগুলো বিছিয়ে তার ওপর তাঁকে শুইয়ে দেয়। একজন বলবান ব্যক্তি তাঁর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁর পিঠের গোশত খসে পড়ে। মাঝেমধ্যে উম্মু আন্মার দোকানে আসত। হাপরে লোহার পাত গরম করে সে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরত। ব্যথায় তিনি ছটফট করতেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
দিনের পর দিন তিনি নির্যাতিত হতে থাকেন। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করে কুফরে ফিরে যেতে রাজি হননি।
পরবর্তী জীবনে মদীনায় একবার সাহাবীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। উমর (রা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি যখন খাব্বাব (রা) জিজ্ঞেস করেন সে সময়ে তার উপর কী অতিবাহিত হয়েছিল, তখন খাব্বাব কিছু না বলে উমরকে শুধুমাত্র তার কাপড়টি তুলে ধরে তার শরীরের একটি অংশ প্রদর্শন করেন। তার শরীরের দৃশ্য দেখে উমর (রা) হতভম্ব হয়ে যান। তিনি দেখলেন, খাব্বাবের শরীরে বেশ কিছু কালো গভীর গর্ত।
এই ছিল খাব্বাব বিন আল-আরাত এর ঈমানী দৃঢ়তা।
[আসহাবে রাসূলের জীবনধারা বইটি থেকে কিয়দংশ নেয়া]
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১২