বৃটেনকে লাইসেজ ফেয়ার (laissez-faire) মতবাদ গ্রহণকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং তারাই একমাত্র মুক্তবাণিজ্য চর্চা করে থাকে বলে মনে করা হয় । বৃটেন সরকারী হস্তক্ষেপ ছাড়া অথবা খুব সামান্য হস্তক্ষেপের কারণে উন্নত একটি দেশ। তবে একথা বললে মিথ্যাবলা হবে না যে, এ রাষ্ট্রটিই সর্বপ্রথম নতুন গড়ে উঠা শিল্প সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশীয় শিল্পকে বিদেশী শিল্পের অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষার জন্যই এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
১৯০৭ সালে একজন ইতিহাসবেত্তা অর্থনীতিবিদ ব্রিসকো বাণিজ্য আইনের ১৭২১ সালের সংস্কারের সারমর্ম এভাবে তুলে ধরেন,‘দেশীয় উৎপাদনকারীদেরকে বিদেশী পন্য থেকে রক্ষা করতে হবে, উৎপাদিত পন্যের অবাধ রপ্তানী নিশ্চিত করতে হবে এবং যেখানে সম্ভব আর্থিক সুবিধা ও ভাতা দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে’-এর ফলে কাঁচামালের উপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হয় এবং বিদেশে উৎপাদিত পণ্যের উপর অধিক হারে করারোপ করা হয়। বিশেষত বৃটেন নিজস্ব শিল্পকে রক্ষার জন্য তার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল মানের পণ্য আমদানিকে নিষিদ্ধ করে।
১৮৪৬ সালে শস্য আইন বাতিলের মাধ্যমে বড় ধরণের পরিবর্তন আনা হয়। এই আইনটি ছিল বৃটিশ কৃষক ও ভূ-স্বামীদের রক্ষার জন্য কমদামে বিদেশী শস্য ক্রয় রোধকল্পে করারোপ সর্ম্পকিত। কিন্তু এটা করা হয়েছিল মহাদেশে শিল্পায়নকে ঠেকাবার লক্ষ্যে এবং বৃটিশ কৃষির রপ্তানী বাজারকে সম্প্রসারণ করবার জন্য। বৃটেনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা মুক্ত বাণিজ্যের দ্বারকে উন্মোচিত করে এবং এর বিকাশ লাভ হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদী করারোপের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টি করে। বৃটিশ অর্থনীতির উদারীকরণ একটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সুচিন্তিত পদক্ষেপ ছিল এবং এটি লাইসেজ ফেয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত বিষয় নয়।
শিল্পবান্ধব কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বৃটেন ১৮০০ সালে যখন শিল্পায়নের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায় তখন সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সম্পদের খোঁজে নেমে পড়ে। আগ্রাসী উপনিবেশবাদের এই প্রক্রিয়া বিশ্বে বৃটেনের অবস্থানকে সুসংহত করে এবং ভূমি দখল নয় বরং উপকূলবর্তী বাজার দখলের জন্য যুদ্ধের নতুন ধারণার জন্ম হয়। ঔপনিবেশিক বিস্তৃতির জন্যই বৃটেনে তখন ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবিষ্কার, শ্রমিক সংগ্রহের নতুন ধারণা এবং সামরিক কৌশলের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। পুরো বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের পরই বৃটেন ‘উন্নয়নের জন্য উদার মূল্যবোধ’ নীতি গ্রহণ করে। প্রচন্ড প্রতাপে পুরো বিশ্বে যখন বৃটেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল তখন অন্য দেশের বাজার দখলের জন্য মুক্ত বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করে। উন্নত হবার পরই মূলত মুক্তবাজার ধারণা এসেছে। কিন্তু এটা কখনই বৃটিশ সাম্রাজ্যকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নও এভাবেই হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যকে উদার করেনি। কেম্ব্রিজের ইতিহাসবেত্তা অর্থনীতিবিদ ড. জুন চেঙ এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ যখন শিল্পক্ষেত্রে প্রাধান্যের দিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল তখনই বাণিজ্যকে উদার করল এবং মুক্ত বাণিজ্যকে ছড়িয়ে দিতে লাগল’।
রক্ষণশীল নীতির মাধ্যমে পশ্চিমা দেশসমূহ যখন শিল্পক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সমর্থ হয় তখন মুক্তবাজারের পক্ষে তারা সাফাই গাইতে শুরু করে যাতে অন্যরা এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে না পারে এবং তাদের আধিপত্য বজায় থাকে। ঊনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ে বৃটেনসহ পুরো ইউরোপ এ উদারনীতিমালা গ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার একশত বছর পর ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে।