ইসলামে কি কোন সরকারব্যবস্থা নেই?

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

দীর্ঘ প্রায় চৌদ্দশত বছর ধরে এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক ছিল না যে, ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা নেই। ১৯২৪ সালে যখন খিলাফত শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন তখন এ প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছিল। এটা সে সময়ের কথা যখন অনেক ব্যক্তিই পশ্চিমা সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পন করছিল এবং ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা থাকাকে অস্বীকার করছিল। ১৯২৫ সালে খিলাফত ধ্বংসের এক বছর পর আলী আবদুর রাজিক ‘আল ইসলাম ওয়া উসুলুল হুকুম’ বইয়ের মাধ্যমে উল্লেখ করেন, ইসলামে কোন ধরণেরই শাসন বা সরকারব্যবস্থা নেই। স্যার থমাস আরনল্ডের মত ওরিয়েন্টালিস্টও ইসলামী অনেক তথ্য প্রমাণ দ্বারা ব্যাপক সাহিত্য রচনা করে প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন যে, ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা নেই।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে আজকাল অনেক মুসলিমও ইসলামকে আধুনিকীকরণের নামে প্রমাণ করবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যে, ইসলামের নিজস্ব কোন সরকার ব্যবস্থা নেই। তাদের যুক্তি হচ্ছে মুসলমানরা যে কোন সমাজে বসবাস করতে পারে এবং এর মধ্যে সবচেয়ে ভালটি গ্রহণ করতে পারে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডে ২০০৭ সালে “ইসলাম এন্ড মুসলিমস ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড টুডে” শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করে। মিশরের প্রধান মুফতি আলী গোমাসহ অন্যান্য ‘মধ্যমপন্থি’ (মডারেট) মুসলিমের তকমা লাগানো ব্যক্তিবর্গ আলোচনা করেন কীভাবে ইসলামকে পশ্চিমাদের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা উচিত। ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা নেই – এ বিষয়টি প্রমাণের জন্য আলী গোমা বলেন,

‘অনেকে মনে করেন ইসলামী শাসনব্যবস্থা মানেই খিলাফত- যেখানে খলীফা একটি নির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতির মাধ্যমে শাসন করবেন। ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে এর কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। খিলাফত এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা মুসলিমরা একটি বিশেষ সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনে গ্রহণ করেছিল। তার মানে এই নয় যখনই সরকার ব্যবস্থার প্রসঙ্গ আসবে তখনই খিলাফতের কথা ভাবতে হবে। মিশর এ ব্যাপারে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। এ ব্যাপারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন মুহম্মদ আলী পাশা। যার ধারবাহিকতায় খেদিব ইসমাইল একটি আধুনিক মিশর গড়বার প্রয়াস পায়। এর মানে হল ইসলামী আইনের সংস্কার। এ প্রক্রিয়ায় ইসলামিক চিন্তাবিদদের সমর্থন নিয়েই মিশর গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে একটি উদার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়। মুসলমানরা তাদের প্রয়োজনমাফিক ইচ্ছেমত যে কোন ধরণের শাসনব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার রাখে।’

ইতোমধ্যে বিভিন্ন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীবর্গ একটি সম্ভাব্য ইসলামী শাসনব্যবস্থার উত্থানের ব্যাপারে সর্তক করে দিয়েছেন। এর মানে হল ইসলামে একটি শাসনব্যবস্থা রয়েছে এটা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেয়া। মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ট একটি মহল মনে করে যে ইসলামে কোন শাসনব্যবস্থা নেই। তাদের যুক্তি হল ইতিহাসে যে ইসলামী শাসনব্যবস্থা দেখতে পাই তা মূলত: একটি সাময়িক ব্যাপারমাত্র – যা বর্তমান সময়ে একেবারেই অপ্রযোজ্য। পূর্বে ইসলামে যে শাসন আমরা দেখেছি তা বস্তুত কিছু রীতিনীতির অধীন ছিল। এ ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের ইসলামী প্রামাণ্য দলিলসমূহ খুব সুক্ষ্ণভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।

কুর’আন আল্লাহ্‌’র আইন দ্বারা শাসিত হবার ব্যাপারে বিভিন্ন আয়াতে বেশ জোর দিয়েছেন। যেমন:

‘এবং যারা আল্লাহ্‌’র দেয়া বিধান ছাড়া অন্য বিধান দিয়ে বিচার ফয়সালা করে তারাই কাফের (অবিশ্বাসী)..জালেম (অত্যাচারী)..ফাসেক (মিথ্যাবাদী)।’ (সূরা মায়েদা:৪৪-৪৭)

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরও বলেন,

সুতরাং তাদের মধ্যে ফয়সালা করুন আল্লাহ্‌ যা অবতীর্ণ করেছেন ও যে সত্য আপনার কাছে এসেছে তা দিয়ে এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না।’ (সূরা মায়েদা: ৪৮)

তিনি আরও বলেন,

‘আর আপনি আল্লাহ্‌’র নির্দেশ অনুযায়ী ফায়সালা করুন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না, সাবধান থাকুন, যাতে তারা বিভ্রান্ত করতে না পারে।’ (সূরা মায়েদা: ৪৯)

এছাড়াও দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং শারী’আহ্‌ দ্বারা শাসিত হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এর এটা কখনওই সম্ভবপর হবে না যদি একজন শাসক না থাকেন -যিনি এই শারী’আহ্‌ বাস্তবায়ন করবেন। এভাবে অসংখ্য প্রমাণ পেশ করা যাবে যেসবের দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, একজন শাসক নিয়োগ করা ফরয দায়িত্ব।

একজন খলীফা নিয়োগ করবার বাধ্যবাধকতা আমরা রাসূলের সুন্নাহ ও ইজমায়ে সাহাবা থেকে পেয়ে থাকি। নাফিয়া বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (খলীফার) আনুগত্য হতে হাত গুটিয়ে নিল, সে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে এমনভাবে উত্থিত হবে যে, তার পক্ষে কোন প্রমাণ থাকবে না এবং যে তার কাঁধে খলীফার বাই’য়াত না থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল সে যেন জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।’ (মুসলিম)

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা) সব মুসলিমের কাঁধে বাই’য়াত থাকবার প্রয়োজনীয়তা ফরয করে দিয়েছেন। তিনি বাই’য়াতহীন মৃত্যুকে জাহেলিয়াতের সময়ের মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন। ‘কাঁধে বাই’য়াত থাকা’ এর অর্থ হল একজন খলীফা থাকা। খলীফা নির্বাচনের পদ্ধতিও রাসূলুল্লাহ (সা) বিবৃত করেছেন। আবু হাজিম বলেন যে, তিনি আবু হুরাইরার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করাকালীন সময়ে শুনতে পান যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। একজন মারা গেলে অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আমার পরে আর কোন নবী আসবে না। এরপর আসবেন অসংখ্য খলীফা। তখন সাহাবা (রা) প্রশ্ন করলেন এ ব্যাপারে আপনি আমাদের কী করতে উপদেশ দেন? তিনি (সা) বলেন, তোমরা প্রথম একজনের পর অপর প্রথম (খলীফা)-এর প্রতি বাই’য়াত পূর্ণ করবে এবং তাদের জন্য রক্ষিত অধিকার প্রদান করবে। আল্লাহ্‌ অবশ্যই তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন।’

নবী করীম (সা) ইসলামী সরকারের রূপরেখা প্রদান করেন, এর নিয়মকানুন বাতলে দেন এবং বিস্তারিত ব্যাখা দেন। তিনি যখন মদীনাতে সপ্তম শতাব্দীতে খিলাফত রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন তখন সেটা ছিল বিবাদমান বিভিন্ন গোত্র অধ্যুষিত একটি শহরকেন্দ্রিক রাষ্ট্র। কুরাইশরা নতুন গড়া সমাজকে সমূলে উৎপাটন করার অপচেষ্টা চালায়। রাসূল (সা) অতিদ্রুত এমন এক রাষ্ট্র কায়েম করেন যা ছিল প্রতিরক্ষায় সক্ষম এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি কুরাইশদের ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন এবং ব্যবসায়িক পথকে সুগম রাখবার জন্য বাণিজ্য চুক্তি ও বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।

মদীনায় পা ফেলার মুহূর্ত থেকেই মুসলিম ও অমুসলিমদের সমস্যাসমূহ বিবেচনায় নিয়ে তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন শাসক হয়ে উঠেছিলেন। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুহাম্মদ (সা) একটি কল্যাণমূলক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। একজন যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি ইহুদী, বানু দামরাহ ও বানু মাদলাজের সাথে চুক্তি করেন। তিনি তারপর চুক্তি স্বাক্ষর করেন কুরাইশ, আয়লাহ, আল জারবাহ এবং উজরাহের সাথে। সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি অনেক যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন। তিনি প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে ওয়ালী (গভর্ণর) এবং প্রত্যেক অঞ্চলে একজন করে আমীল (মেয়র) নিযুক্ত করেন। যেমন: তিনি উতায়েব ইবনে উসাইদকে মক্কা বিজয়ের পর ওয়ালী এবং বাধান ইবনে সাসানকে ইয়েমেনের ইসলাম গ্রহণের পর ইয়ামেনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। মুয়াজ ইবনে জাবাল আল খাজরাজীকে তিনি আল জানাদের ওয়ালী এবং খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে আল আসকে সানার আমীল নিযুক্ত করেন।

রাসুলুল্লাহ (সা) লোকদের বিবাদ নিরসনের জন্য বিচারক নিয়োগ করেন। তিনি (সা) আলী (রা) কে ইয়েমেনে কাজী নিয়োগ করেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে নওফেলকে মদীনার বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। রাসুল (সা) তাদের জিজ্ঞেস করতেন, “তোমরা কি দিয়ে শাসন করবে?” তখন তারা প্রত্যুত্তরে বলতেন, “কোন রায়ের জন্য সমাধান যদি আমরা কুর’আনে না পাই, তাহলে তা সুন্নাহ্‌’র মধ্যে খুঁজব। যদি সেখানেও না পাই তাহলে আমরা কিয়াসের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব।” তিনি (সা) এ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন। রাসুল (সা) কখনও কখনও বিচারকদের এবং উলাহ্‌’দের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালও গঠন করেছেন। তিনি ট্রাইব্যুনাল আসার পূর্বে বিবাদমান বিষয়সমুহ তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ করা ও বিচারব্যবস্থার ব্যাপারে রশীদ ইবনে আবদুল্লাহকে আমীর নিযুক্ত করেন।

মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা) রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের প্রধান হিসেবে কয়েকজন রেজিস্ট্রার নিয়োগ করেন।

– আলী ইবনে আবু তালিবকে চুক্তিপত্রের লেখক হিসেবে
– মুয়াকেব ইবনে আবু ফাতিমাকে রাজস্ব বিভাগের সচিব হিসেবে
– হুজায়ফা ইবনে আল ইয়ামানকে হিজাজ অঞ্চলের ফসল ও ফলমুলের হিসেবের দায়িত্ব
– জুবায়ের ইবনে আল আওয়ামকে সাদকার সচিব
– আল মুগীরাহ ইবনে শু’বাহকে সকল ঋণ ও চুক্তিনামা লিপিবদ্ধের দায়িত্ব
– শারহাবিল ইবনে হাসানাকে বিভিন্ন বাদশাহের কাছে প্রেরিত চিঠি লিখবার দায়িত্ব

এভাবে মুহম্মদ (সা) বিভিন্ন বিভাগে সচিব অথবা পরিচালকের পদে বিভিন্ন সাহাবীদের নিয়োগ দেন। এ ব্যাপারে তিনি (সা) সাহাবীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন-যারা এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও চিন্তার অধিকারী ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলিম- অমুসলিমদের সম্পদ বিশেষত ভূমি, ফসল ও ফলমুলের উপর কর ধার্য করেন। এগুলোর মধ্যে ছিল যাকাত, ওশর, গণীমতের মাল, খারাজ বা ভূমিকর এবং অমুসলিমদের কাছে প্রাপ্ত জিজিয়া। আনফাল এবং গণীমতের মাল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা থাকত। কুর’আনে বর্ণিত আটটি খাতেই জাকাতের অর্থ বন্টন করা হত।

মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশাতেই এসব ব্যবস্থাদি বাস্তবায়ন করেন। তিনি (সা) রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ছিলেন আর তাঁকে সহায়তা করবার জন্য ছিল বিভিন্ন সহযোগী, গভর্ণর, বিচারক, সেনাবাহিনী, সচিবগণ এবং পরামর্শ সভা। এ ধরণের কাঠামোকে বলা হয় খিলাফত এবং এটাই ইসলামের শাসনব্যবস্থা। ইসলামী রাষ্ট্রের এসব কাঠামো বিস্তারিতভাবে তাওয়াতুর বর্ণনার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনাতে পৌঁছবার দিন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আবু বকর ও ওমর (রা) তাঁর দু’জন সহযোগী ছিলেন। সাহাবীগণ রাসূল (সা) এর মৃত্যুর পর ঐক্যমত্যে (ইজমা) পৌঁছেছিলেন যে, ইসলামী খিলাফতের প্রধান নির্বাহী হিসেবে একজন শাসক অর্থাৎ খলীফা নিয়োগ করা প্রয়োজন। অবশ্যই এই ব্যক্তি কোন নবী বা বার্তাবহনকারী হবেন না, কারণ মুহম্মদ (সা) ছিলেন শেষ নবী। একটি শাসনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা মহানবী (সা.) তার জীবনকালেই প্রদর্শন করে গেছেন। সেকারণে তাঁর প্রদর্শিত শাসনব্যবস্থা আমাদের জন্য এখনও অণুকরণীয়।

সাহাবীগণ এ মর্মে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিলেন যে, রাসুলূল্লাহ (সা) এর মৃত্যুর পর একজন উত্তরসুরী নিয়োগ করা প্রয়োজন। তারা সেকারণে আবু বকর (রা) এর মৃত্যুর পর একই ধারাবাহিকতায় উত্তরসুরী হিসেবে ওমর (রা) কে খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন। এভাবে উসমান ও আলী (রা) খলিফা নিযুক্ত হয়েছিলেন। একজন খলিফা নিযুক্ত করবার আবশ্যকতা আমরা সাহাবী (রা) ঐক্যমত্য থেকে পাই যে, রাসুলুল্লাহ (সা) এর ওফাতের পর শীঘ্রই মৃতদেহ সৎকারের বাধ্যবাধকতার চেয়ে তাঁরা খলীফা নিয়োগ করার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মৃতের দাফন কাফনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য দাফন কাফন শেষ করবার আগে অন্য কোন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করা এক অর্থে হারাম। এরপরও কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসুলুল্লাহ (সা) এর দাফনের চেয়ে খলীফা নিয়োগ করা নিয়ে তখন ব্যস্ত ছিলেন। অন্য সাহাবীরা এই ব্যাপারে নীরব ছিলেন যদিও তাঁরা রাসূল (সা) এর দাফন সম্পূর্ণ করতে দুই রাত অপেক্ষা নাও করতে পারতেন।

অর্থাৎ তাঁর (সা) মৃত্যুর পর উম্মাহর ঐকমত্য নিয়ে সাহাবীগনের মধ্য হতে একজন খলীফা নিয়োগ করা হয়েছিল। যখন ইসলাম বিস্তার লাভ করছিল তখন বিভিন্ন জায়গায় ওয়ালী নিয়োগ করা হয়েছিল এবং এভাবে ইসলাম সুসংহত হয়েছিল। প্রত্যেক সাহাবীই পুরো জীবনভর একজন খলীফা নিয়োগ করবার ব্যাপারে একমত ছিলেন। কে খলীফা হবেন- এ ব্যাপারে মত পার্থক্য থাকলেও খলীফা নিযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারও ভেতর কোনরূপ দ্বিধা ছিল না। এটা রাসূল (সা) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের মৃত্যুর পর উত্তরসুরী খলীফা নিয়োগের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে। একইভাবে সাহাবীদের ঐকমত্য (ইজমায়ে সাহাবা) এই যে, মুসলমানদের একজন খলীফা থাকতেই হবে।

কখনও কখনও অপপ্রয়োগ ঘটলেও রাসূলের সময় থেকে ইস্তাম্বুলে ১৯২৪ সালে ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থা পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা) খিলাফতের যে বিস্তারিত ও বাস্তবসম্মত রূপরেখা প্রদর্শন করে গেছেন তাতে এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই যে, এটা কেবলমাত্র একটি ঐতিহ্যগত বিষয় ছিল। আর এটা সর্বকালের জন্য সত্য কথা যে, অবশ্যই রাজতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। সুতরাং খিলাফত ইসলাম দ্বারা পরিচালিত একটি অনন্য শাসন ব্যবস্থা। খিলাফত ইসলামকে বাস্তবায়ন করে এবং সব অঞ্চলে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়।

ইতিহাসে খিলাফতের শাসনব্যবস্থা ছিল সর্বজনগ্রাহ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

ওরিয়েন্টালিস্ট বার্ণার্ড লুইস তার বই ‘What went wrong?’ এ বলেন:

‘পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ইসলাম..এটা ছিল অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার..অর্জন করেছিল মানব ইতিহাসে বিজ্ঞান ও কলায় সর্বোচ্চ উৎকর্ষমন্ডিত সভ্যতা-যা ছিল বহুজাতিক, আন্তর্জাতিক -অন্যকথায় আন্তমহাদেশীয়।’

পশ্চিমাদের কাছে জীবিত কিংবদন্তীতুল্য বুদ্ধিজীবি ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা-যিনি বিশ্বাস করেন বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদের বিপরীতে ইসলামই একমাত্র চ্যালেঞ্জ-তাঁর মতে, ‘আদর্শের জগতে বর্তমানে গণতন্ত্রের একমাত্র যোগ্যতর প্রতিদ্বন্দ্বী হল রাজনৈতিক ইসলাম। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়াবহ রাষ্ট্র হল ইরান-যা কট্টরপন্থী শিয়া মোল্লাদের দ্বারা পরিচালিত। সুন্নী কট্টরপন্থীরা তার সমর্থকদের কাছে সঠিকভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করতে না পারায় এখনও একটি জাতি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না।’

Leave a Reply