(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
বিগত দুই শতাব্দী ধরে বিশ্ব যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখেছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং এটা কি পুজিঁবাদের আধিপত্যের বহিঃপ্রকাশ?
২০০৭ সাল ছিল ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এ বছর পুরো বিশ্ব ইতিহাসে রেকর্ড ৫৪ ট্রিলিয়ন ডলারের মত সম্পদ উৎপাদন করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতির আকার ছিল ১ ট্রিলিয়ন ডলার। পুঁজিবাদ গ্রহণের পর ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয় এবং এর মধ্য দিয়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অগ্রগতি সুচিত হয়-যা সত্যি ইতিহাসে বিরল।
পুঁজিবাদের নিজস্ব অগ্রগতি বাদ দিলেও এর বিশেষজ্ঞরা সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদ এখনও বলবৎ থাকাকে এ ব্যবস্থার শক্তিশালী দিক মনে করেন। কিছু কিছু পুঁজিবাদী ব্যক্তি বর্ণবাদের দোষে দুষ্ট হয়ে নিজেদেরকে সভ্যতাকেন্দ্রিকভাবেই অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে অগ্রগামী বলে মনে করেন। ৯/১১ এর ঘটনার পর ইটালিয়ান প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকনি অত্যন্ত দাম্ভিকতার সাথে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সচেতন থাকব-যা আমাদের ভালভাবে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিয়েছে, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখিয়েছে-যা ইসলামী দেশগুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়-শিখিয়েছে সম্মান করতে মানুষের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকারকে। এটা এমন এক ব্যবস্থা যা পরমতসহিষ্ণু ও বৈচিত্র্যপূর্ণ..পশ্চিমারা মানুষকে জয় করবে যেমনিভাবে এটা সমাজতন্ত্রকে জয় করেছে-যদিও এর অন্যান্য সভ্যতা-যেমন ইসলামের সাথে বিরোধ রয়েছে-যা ১৪০০ বছর আগের ব্যবস্থায় আটকে আছে।’
বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা ও ধ্বসের সময়েও পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদেরা মোহাচ্ছন্নের মত বলেছেন, ‘অর্থনীতি আয়তনে বেড়ে যাওয়া, ধ্বস নামা এ সবই পশ্চিমা অর্থব্যবস্থার মাধূর্য্য, এবং এর পরেও এটাই যোগ্যতর।’
পশ্চিমাদের জন্য পুঁজিবাদ হল অগ্রগতির অপর নাম। আর এ ধরণের দাম্ভিক উচ্চারণের জন্য ভিত্তি হিসেবে তারা ইতিহাসকে বেছে নিয়েছে যদিও বাকী সবকিছু একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের এবং এগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। আসলে এ ধরণের দর্প সেখান থেকেই শুরু হয় যেখানে সংকট নিহিত রয়েছে।
পুঁজিবাদে উন্নয়নের প্রধান সূচক হল কী পরিমাণ সম্পদ বিশ্ব উৎপাদন বা অর্জন করতে সমর্থ্য হয়েছে – যাকে তারা জি.ডি.পি (জি.ডি.পি: গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বলে থাকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন সবই উৎপাদনের হাতিয়ার এবং সুদক্ষ শিল্পায়ন অতি সামান্য থেকে ব্যাপক উৎপাদন সুনিশ্চিত করবে। যাই হোক, প্রশ্ন হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে চালিত করে কে? এর মাধ্যমে একটি সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। কারণসমূহের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে এ ধরণের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়। বৃটেনকে মনে করা হয় বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত দেশ এবং এটা করা হয়েছিল পুরো বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের মনবাসনা নিয়ে। সমুদ্র ব্যবহারের আলাদা সুবিধা থাকার কারণে সেখানে বিশেষ কর্মপদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। বৃটেন উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের দেশে ব্যাপক সম্পদরাজি গড়ে তোলে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও যুগান্তকারী আবিষ্কারের অধিকাংশই হয়েছে যুদ্ধের সময় বিশেষত বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল ওয়ারের সময় সাবমেরিন আবিষ্কার করা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে জয়ের প্রয়োজনে রেলগাড়ির উন্নয়ন করা হয়। যদিও যুদ্ধের আগে রেলগাড়ি ছিল কিন্তু যুদ্ধের সময় অস্ত্র পরিবহনের জন্য এর উৎকর্ষতা বিধান করা হয়। অপারেশন পেপারক্লিপ-যা ছিল মূলত নাৎসী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি অপহরনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রকেট নিয়ে গবেষণা করার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। রকেটবিজ্ঞানের উন্নয়নের কারণে মহাকাশবিজ্ঞান, ব্যালেস্টিক মিসাইল, কৃত্রিম উপগ্রহ ও প্রাথমিক কম্পিউটার উদ্ভাবন ও উৎকর্ষতা অর্জনের পথ সুগম হয়। এ ধরণের আবিষ্কার থেকে সাধারণ ভোক্তা পণ্য এবং গৃহস্থালীর কাজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের গতি সঞ্চারের জন্য অটোমোবাইল ও উড়োজাহাজে দহন ইজ্ঞিন ব্যবহার করা হয়। ককপিটের স্ক্রীণে বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত দর্শনীয় করবার জন্য এবং জেটপাইলটদের যোগাযোগের সুবিধার জন্য টেলিভিশন, আধুনিক রেডিও প্রভৃতির উন্নয়ন সাধিত হয়। হাতে গোনা সামান্য কিছু আবিষ্কার পাওয়া যাবে যেগুলো যুদ্ধকালীন প্রয়োজনে আবিস্কৃত হয়নি।
ইতিহাসে পুঁজিবাদী পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অগ্রগামী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু সম্পদের সন্ধান, উপনিবেশবাদ এবং যুদ্ধ পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
পুঁজিবাদ সম্পদ উৎপাদনের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশী মরিয়া। কিন্তু তার এখনও আরও অনেক কিছু করার অবকাশ আছে। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত বিশ্ব অনেক সম্পদ উৎপাদন করছে, কিন্তু পৃথিবীর অর্ধেক লোক মাত্র ২ ডলারের চেয়ে কম আয় করে বলে তারা খেতে পায় না এবং ৯৫ ভাগ জনগণ দিনে ১০ ডলারেরও কম আয় করে। পুরো বিশ্বে পুঁজিবাদের কারণে দরিদ্রতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। অতীতে ইউরোপীয়ানরা সম্পদের জন্য পুরো বিশ্ব চষে বেড়াত-যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। উনিশ শতকে যে পরিবর্তন হয়েছে তা হল বন্দুক প্রতিস্থাপিত হয়েছে শিল্প দ্বারা, দাসপ্রথা প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভোগের মনোবৃত্তি দিয়ে, সেনাবাহিনী প্রতিস্থাপিত হয়েছে মিডিয়া দিয়ে, কৃষি প্রতিস্থাপিত হয়েছে শেয়ার মার্কেট দিয়ে।
পুজিঁবাদের পরবর্তী সাফল্য হল বিশ্বের ইতিহাসে সম্পদের পতনের সর্বনিম্ন রেখাকে স্পর্শ করা। যখন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তার ভরণপোষনের জন্য মাত্র কয়েক ডলার উপার্জন করতে পারে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সর্বাধিক সংখ্যক বিলিওনিয়ার। একারণে পৃথিবীর অর্থনীতি ভারসাম্যহীন। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইন্সষ্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিঙ্ রিসার্চ অব দি ইউ.এন পৃথিবীর অর্থনীতি সম্পর্কে সর্বসাম্প্রতিক সমীক্ষা তুলে ধরে। যার প্রাপ্তিগুলো ছিল সত্যিই অদ্ভুত। পৃথিবীর সব দেশের গবেষণা পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে যে, বিশ্বের শতকরা ১ ভাগ জনগণ গোটা দুনিয়ার ৪০ ভাগ সম্পদ ভোগ করে এবং মাত্র শতকরা ১০ ভাগ জনগণ ৮৫ ভাগ সম্পদের মালিক। রিচার্ড রবিন তার পুরষ্কারপ্রাপ্ত বই ‘গ্লোবাল প্রবলেম্স এন্ড দি কালচার অব ক্যাপিটালিসম’-এ উল্লেখ করেন : পুঁজিবাদের উত্থান এমন এক সংস্কৃতির জন্ম দেয় যেখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে একসাথে কিছু ব্যক্তিকে চূড়ান্ত আরাম ও আভিজাত্যের সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সবচাইতে সফল। কিন্তু প্রত্যেকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি মোটেও সফল নয় এবং এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতাই এর একটি বড় সমস্যা।
পুঁজিবাদ স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরিমাণে ঋণগ্রস্ত করেছে- যেখানে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি উভয়েরই আয়ের চেয়ে বেশী দেনা রয়েছে। পৃথিবী উৎপাদন করে ৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার-একথা তখনই অন্তসারশূন্য হয়ে যায় যখন বুঝা যায়- এর অধিকাংশ অংশই আসে ধারদেনা থেকে। পশ্চিমা বিশ্ব ভোগে আসক্ত। তারা সবসময় যা আয় করে তার চেয়ে বেশী ভোগ করে। আর এই ভোগের যোগান আসে ঋণ থেকে। কারণ সত্যিকারের সম্পদ অর্জন করে খুব সামান্য কয়েকজন। বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি – তার পতন ও সাম্প্রতিক মন্দা ঋণনির্ভর অর্থনীতির গর্বকে খর্ব করে এবং পুঁজিবাদের করুণ পরিণতির কথা আমাদের সামনে নিয়ে আসে। ২০০৭ সালে মার্কিনীরা সম্পদ উৎপাদন করে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু তাদের জাতীয়ভাবে ঋণের পরিমাণ- যা কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন জনগণ ও বিশ্বের কাছ থেকে বন্ডের মাধ্যমে ৯.৭ ট্রিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ব্যাপক পরিমাণে আমদানি পণ্য ভোগ করে ও ফ্ল্যাট ক্রয় করে। একারণে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। মার্কিন কোম্পানিগুলোর দেনার পরিমাণ ১৮.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এভাবে মার্কিনীদের দেনার পরিমাণ প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলার – যা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের শতকরা ৭৫ ভাগ। ৩৭ মিলিয়ন মার্কিনী দরিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। পুঁজিবাদের সার্বজনীন অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিন্তা নিতান্তই অসার।
পুঁজিবাদ নামকরণের পেছনে রয়েছে এর প্রধান দিক পুঁজির ব্যাপারটি। এটা বস্তগত সম্পদকে জীবনের একমাত্র চাওয়া পাওয়ার বিষয় হিসেবে দাঁড় করায় যেন এটা ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন। একারণে অভিজাত শ্রেণী এ ব্যবস্থার শাসকদের এমনভাবে প্রভাবিত করে যাতে করে শাসকগোষ্ঠী সর্বদা পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে অভিজাততন্ত্র বড় বড় কোম্পানী ও তাদের প্রধানদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। যেমন তেলক্ষেত্রে জন রকফেলার, অটোমোবাইলে হেনরী ফোর্ড, রেলরোডে জে গোল্ড, জে. পিয়ারপন্ট মরগান ব্যংকিং-এ এবং এন্ড্রু কার্নেগী ইস্পাতশিল্পে। পশ্চিমা সরকারগুলো উপনিবেশের মাধ্যমে যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করতে পারেনি-এসব বড় বড় কোম্পানীগুলো তার চেয়ে বেশী সম্পদ লুট করছে। প্রাথমিকভাবে প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখবার জন্য, সম্পদের বৈষম্যকে কমানোর জন্য ও ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য সম্পদ সংগ্রহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কেননা তাদের জনগনের কাছে ব্যয় করবার জন্য সম্পদ যতসামান্যই ছিল। এ চিন্তা থেকেই ভোগবাদেও উদ্ভব হয়-যেখানে ব্যয়, নতুন আবিষ্কারের স্বাদ আস্বাদন এবং নতুন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং এভাবে অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করা হয়।
পুঁজিবাদ সব সময় সম্পদ সৃষ্টি করবে। এ ধারণার ভিত্তিতেই এ ব্যবস্থা পরিচালিত-যা কখনওই বন্টনের দিকে মনোযোগী নয়। যদি তাদের এ সম্পদ সৃষ্টি করতে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করে পুরো একটি মহাদেশকে দরিদ্র বানাতে হয় তাহলে তারা তাই করবে কিংবা বর্তমানে উপনিবেশবাদের নতুন সংস্করণ মুক্ত বাণিজ্য বা বিশ্বায়ন বাস্তবায়ন করবে। পুঁজিবাদ কখনওই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না বরং এটা একটি দুর্যোগ।