১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি আমেরিকান বড় বড় কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে বুঝানোর জন্য সর্বপ্রথম বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র একধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচ হওয়ায় উচ্চ উৎপাদন খরচের কারণে মার্কিন পণ্য রপ্তানি করা দুরূহ হয়ে পড়ে। নিজ গৃহে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেসব পণ্য মার্কিনীরা বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রি করতে পারছিল না।
সেকারণে সস্তা বিদেশী বাজার দরকার হয়ে পড়েছিল। সস্তা শ্রম, শ্রম আইনের যথেচ্ছ অবমাননা এবং শোষণের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে উৎপাদন সুবিধার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার নামই হল বিশ্বায়ন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বিশ্বায়নের শিক্ষা যে রাষ্ট্রটিকে প্রথম দেয়া হয়, সেটি হল রাশিয়া। ১৯৯০ সালে সমাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর এককেন্দ্রিক বাজারনির্ভর অর্থনীতির অনুপস্থিতিতে পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো রাশিয়ায় ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন ডলার নিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য রাশিয়ার অর্থনীতিকে মুক্ত করে দেয়া হয়। শিল্পকারখানাগুলোকে বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় এবং অর্থনীতিকে বৈশ্বিক দরের উঠানামার কাছে স্পর্শকাতর করে তোলা হয়। ১৯৯৭ সালে বিনিয়োগকারীরা রাশিয়ার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলায় সেখান থেকে অর্থ উঠিয়ে নিতে থাকে। আর উদারনীতি গ্রহণের কারণে রাশিয়ার তখন অসহায়ের মত পরিস্থিতি অবলোকন করা ছাড়া কিছুই করবার ছিল না। দরিদ্রতা ৩০০০ ভাগ বেড়ে ২মিলিয়ন থেকে ৬০ মিলিয়নের পৌঁছায়। ইউনিসেফ পর্যবেক্ষণ করে যে এর কারণে প্রতিবছর ৫০০০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু হয়। রাশিয়া হল বিশ্বায়নের কারণে সর্বনাশের চূড়ান্ত প্রতিচ্ছবি।
বিশ্বায়ন প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে পরাশক্তিসমূহ বিভিন্ন নীতিমালা চাপিয়ে দেয়ার অপর নাম-যা ইতিহাসে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার একটি অংশমাত্র। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র বৃটেন থেকে আলাদা হলেও মার্কিনীরা উত্তরাধিকার সূত্রে উপনিবেশিক বৃটিশ নোংরামী ও অসততা বহন করে। সেকারণে বৃটিশরা একসময় অন্যদের সাথে যা করত মার্কিনীরা এখন তাই করে। ১৮১২ সালে বৃটিশ বাণিজ্য পদ্ধতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের অল্পকিছুদিন পর মার্কিন রাজনীতিজ্ঞ হেনরী ক্লে একজন বৃটিশ নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমাদের মত বিভিন্ন জাতিসমূহ জানে ‘মুক্ত বাণিজ্য’ এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমরা ব্যাপক সুবিধা ভোগ করি এবং তাদের বাজারে আমাদের উৎপাদনকারীরা মনোপলি ব্যবসা করে এবং তাদের উৎপাদনকারী জাতিতে পরিণত হবার স্বপ্নকে এভাবে চিরতরে বিনষ্ট করা হয়।
রিগান এবং থেচারের সময় বিশেষভাবে দেখা যায়, বিশ্বায়নের নামে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে মুক্ত বাণিজ্যের অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত যে কোন কিছুই ধ্বসিয়ে দিয়ে গণখাতের সব কিছুকে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে ঢালাওভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা হয়। ধনী দেশের বড় বড় কোম্পানীগুলো যাতে সস্তায় দরিদ্র দেশের বিভিন্ন সম্পদের মালিক বনে যেতে পারে সে কারণে অবকাঠামোগত সমন্বয় নীতি গ্রহণ করা হয়।
বিশ্বায়নের ব্যর্থতার অনেক উদাহরণ আছে। এ পর্যন্ত দরিদ্রতা নিয়ে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা স্কোরকার্ড অন গ্লোবালাইজেশন ১৯৮০-২০০০ এ দি সেন্টার ফর ইকোনোমিক এন্ড পলিসি রিসার্চ এর গবেষক মার্ক ওয়েসব্রট, ডীন বেকার সহ প্রমুখ গবেষকগণ উল্লেখ করেন যে, ১৯৬০-১৯৮০ তুলনায় ১৯৮০-২০০০ এর বিশ্বায়নের সময়ে গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুহার, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতার হার অনেক কমে গেছে। ১৯৬০-১৯৮০ সাল সময়ের মধ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাদের দেশীয় শিল্পকারখানাকে পুষ্ট ও প্রতিযোগিতামূলক করবার জন্য এবং অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক বাজারের হাত থেকে রক্ষার জন্য রক্ষণশীল নীতিমালা গ্রহণ করত। এই ঠিক একই প্রক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বেড়ে উঠে।