ঔপনিবেশিক শাসকরা কি আফ্রিকায় স্থিতিশীলতা নিয়ে এসেছিল এবং তাদের প্রস্থানই কি বর্তমান অস্থিতিশীলতার কারন

ঔপনিবেশিক দেশগুলো এ ধারণা পোষণ করে যে, তারা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই কল্যাণ নিয়ে এসেছে। ঔপনিবেশিক ধারণাপুষ্ট ঐতিহাসিকরা আফ্রিকার উন্নয়ন বিশেষত শিক্ষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য ঔপনিবেশিকদের আগমনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কিন্তু তারা ঔপনিবেশিকদের দ্বারা সংঘটিত বর্ণবাদ, শোষণ এবং গণহত্যাকে উল্লেখ করেন না। এমনকি এইসব সাম্রাজ্যবাদীদের ধারণা শুধু আফ্রিকা নয়, পৃথিবীর অন্যান্য অংশের মানুষও তাদের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না।

ব্যাপক সম্পদ ও খনিজ সম্পদের লোভে উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকায় এসেছিল। ইউরোপীয়রা এ ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দাস এবং ব্যাপক প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে উপনিবেশ স্থাপনের জন্য আফ্রিকায় ছুটে আসত। গণতন্ত্র ও পশ্চিমা মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা তখন খুব কমই ছিল।

ইউরোপীয়রা তাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পুরো আফ্রিকাকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল। বুরুন্ডির এক অংশ, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া এবং নামিবিয়া জার্মানরা শাসন করত। ইটালী জবর দখল করেছিল ইরিত্রিয়ার কিছু অংশ ও সোমালিয়াকে। স্পেন আধিপত্য বিস্তার করেছিল পশ্চিম আফ্রিকায়। অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক এবং আরও ছোট ছোট অংশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল পর্তুগীজরা। বেলজিয়াম নির্মমভাবে শোষণ করত কঙ্গোকে এবং ব্রিটেন পূর্ব আফ্রিকায় তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে সুদান, ঘানা, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, মালাউই এবং নাইজেরিয়াতে। সেনেগাল, আইভরি কোস্ট চাদ, মাদাগাস্কার এবং কমোরোস প্রভৃতি পশ্চিম আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহের উপর ঔপনিবেশিক শাসন আরোপ করেছিল ফ্রান্স।

দশকের পর দশক ধরে আফ্রিকা পশ্চিমা পণ্যের জন্য মুক্ত বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আফ্রিকাকে বাধ্য করা হয়েছে ইউরোপীয়দের জন্য সস্তায় কাঁচামাল যেমন-তুলা, রাবার, চা, টিন এবং দাসব্যবসার মত সস্তা শ্রম সরবারহ করতে। এসবই সম্ভব হয়েছে খ্রীস্টান মিশনারীর আঁড়ালে উপনিবেশবাদীদের উপস্থিতির মাধ্যমে। মহাদেশটি ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের মধ্যকার লুটপাটের প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। এ কারণে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একনায়কের সৃষ্টি হয়, সামরিক অভ্যুত্থান হয় অহরহ। এসব অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারণে এ মহাদেশের ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে ৩৭০ বিলিয়ন ডলার, যা কিনা মহাদেশটির জাতীয় আয়ের ৬৫ ভাগ। শুধু তাই নয় এই মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এতবেশী পরিমাণ ভূমি মাইন (৩০ মিলিয়নেরও বেশী) বসানো আছে যে – তা কিনা পুরো বিশ্বের ভূমি মাইনের শতকরা ২৫ ভাগ হবে।

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ তাদের স্ব-স্ব শোষণের অঞ্চলসমূহ চিহ্নিত করবার জন্য নিজেদের ইচ্ছেমত মহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃত্রিম সীমানা টেনে দেয়। এভাবে কৃত্রিমভাবে সীমানা টেনে দেয়ায় পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রসমূহের মধ্যে কোন বাফার অঞ্চল না থাকায় তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কৃত্রিম বিভেদরেখা টেনে দেয়ার আগে কঙ্গো নদী ছিল আফ্রিকার প্রাকৃতিক ভৌগলিক সীমানা। নদীর উভয়পাশে বসবাসরত গোত্রসমূহ একই ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করত। বেলজিয়ান এবং ফরাসি দখলদারদের ভূমি বিভাজনের কারণে এই গোত্রসমূহ আলাদা হয়ে পড়ে। যারা সাহারা ও সাব সাহারান অঞ্চলে বসবাস করত এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মহাদেশীয় বাণিজ্য চালু রেখেছিল। তাদেরকে এখন ঐ ইউরোপীয়দের তৈরি করা মানচিত্রের কারণে কৃত্রিম সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়। মিশনারীদের সহায়তা ও ঔপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রাখার মাধ্যমে একটির পর একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে থাকে। যে সব জায়গায় ব্যাপক পরিমাণে ইউরোপীয় স্থাপনা ছিল যেমন রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও শ্বেতাঙ্গদের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইউরোপীয়দের হাতে রাখা হয়েছিল। কঙ্গোতে সেখানাকার আদি অধিবাসীদের উপর চাপানো হয়েছিল বর্বর অত্যাচার এবং তাদেরকে দেয়া হয় দাসের মর্যাদা।

বিভিন্ন জাতিসমূহের মধ্যে বিস্তর বিভেদ তৈরির মাধ্যমে ইউরোপীয়রা আঞ্চলিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে জার্মানরা যখন আসে তখন বর্তমান রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডীতে হুতু ও তুতসী গোত্র এক সংস্কৃতির অন্তর্গত ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পারস্পরিক মিশ্রণ, বিবাহ এবং সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের কারণে কোন লক্ষ্যণীয় পার্থক্য দেখা যেত না। বেলজিয়ানরা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য তাদের মাঝে বর্ণবাদের বীজ বপন করে। আর তখন বর্নবাদের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতিসমূহকে বিভক্ত করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ছিল ইউরোপীয় শাসনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। হুতু বলতে কৃষিনির্ভর বানটু ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীকে বুঝায় যারা পশ্চিম থেকে বর্তমান বুরুন্ডী এবং রুয়ান্ডায় এসেছিল। অপরদিকে তুতসী বলতে উত্তর পূর্বদিকের গবাদি পশুপালন নির্ভর জনগোষ্ঠীকে বুঝায়-যারা পরে এ অঞ্চলে এসেছিল। তুতসী বলতে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণীকে বুঝায়-যাদের প্রত্যেকের দশটিরও বেশী গবাদি পশু আছে। হুতুরা সংখ্যায় ছিল কম। বেলজিয়ানরা সেখানে গিয়ে বর্ণবাদী নিয়মকানুন চালু করল। গায়ের রঙের দিক থেকে কিছুটা ফর্সা, উচ্চতায় অপেক্ষাকৃত লম্বা, উন্নত ও সরু নাক – যারা প্রকৃতই হেমিটিক এবং যারা উত্তরাধিকারসূত্রে তুতসীদের কাছাকাছি-তাদেরকে বেলজিয়ানদের পক্ষ থেকে শাসনক্ষমতা দেয়া হল। যদিও প্রশাসনে কিছু কিছু দেশীয় লোককে উচ্চ পদস্থ চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া হল, কিন্তু ইউরোপীয়ানদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। আফ্রিকান উন্নয়নে ইউরোপীয়দের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভিনসেন্ট খাপোয়া তার বইতে বলেন, ‘বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনের সময় জায়ার (বেলজিয়ান কঙ্গো) থেকে ব্যাপক সম্পদ বেলজিয়ামে স্থানান্তরিত হয়। এসময় আফ্রিকানরা সামান্য শিক্ষা পেত-যা তাদের বাইবেল পড়া, মিশনারীয়দের হুকুম তামিল করা ও তা নির্বাহ করা এবং ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে কেরানীর কাজ করতে কাজে লাগত।

খাপোয়া আফ্রিকার উন্নয়নে ইউরোপের অবদানের মিথ্যা কল্পকাহিনী সম্পর্কে আরও বলেন, ‘সব ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ সেসময়কার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মনোনিবেশ করেছিল। এর মধ্যে আছে ভূমি অধিগ্রহণ, খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসলের চাষ, প্রাক ঔপনিবেশিক সময়কার আন্তআফ্রিকান বাণিজ্য বন্ধ করা, ভারত থেকে শ্রমিক সংগ্রহ ইত্যাদি এবং আফ্রিকাকে ইউরোপীয় শিল্পের কাঁচামালের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা- কাজেই আফ্রিকাতে শিল্প স্থাপনের কোন ইচ্ছাই তাদের ছিল না।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের কারণে এখনও আফ্রিকায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ঊনিশ শতকে বৃটিশরা ছিল এ ব্যাপারে প্রতাপশালী এবং একুশ শতকে মার্কিনীরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ১৯৬০ সাল থেকে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ সরে গেলেও একনায়ক, অস্ত্র্, ঋণ এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে পরোক্ষ উপনিবেশবাদ বজায় আছে। সুতরাং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি চলে যাওয়ার কারণে আফ্রিকা অস্থিতিশীল হয়নি বরং এই অপশক্তিসমূহের আফ্রিকার সম্পদকে কুক্ষিগত করবার হীন বাসনা থেকে এ অঞ্চলে নগ্ন হস্ত ক্ষেপের কারণেই গত ২০০ বছর ধরে সেখানে রক্তপাত হচ্ছে।

Leave a Reply