(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটেন ও জার্মানীর বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখার দ্বন্দ্ব তাদেরকে তাদের কয়লাভিত্তিক বৃহদাকার যুদ্ধযানগুলোর জন্য বিকল্প জ্বালানী উৎসের অনুসন্ধানের দিকে ঠেলে দেয়। আর ঐ সমসাময়িক সময়েই মধ্যপ্রাচ্যে তেলক্ষেত্রগুলোর আবিষ্কার ও নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন নতুন ধারার ভোগের সমাজব্যবস্থা ও বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করে।
স্বাভাবিকভাবেই জীবাশ্ম জ্বালানি অপ্রতুল এবং এটা একসময় শেষ হয়ে যাবে। বিংশ শতাব্দী জুড়ে অধিকাংশ তেলক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশ অনাবিষ্কৃত থাকায় তেলের বিষয়টি খুব একটা আলোচনায় আসেনি। পরবর্তিতে জঙ্গি বিমান, ট্যাঙ্ক, অটোমোবাইল ইত্যাদির আবিষ্কার এ জ্বালানীর উপর সবার নির্ভরশীলতা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যদি একসময় তেল শেষ হয়ে যায় তাহলে এসব যন্ত্রপাতি ও প্রযু্ক্তি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
১৯৭০ সালে প্রথম ‘পিক অয়েল’ থিওরী আবির্ভূত হয়। এর মাধ্যমে দেখানো হয় তেলের সেই পরিমান যে পরিমান উত্তোলন হলে পৃথিবীর মোট তেলের অর্ধেক উত্তোলন করা হবে।
বিশ্বের তেল মজুদের পরিমান (২০০৬)
==============================
বিশ্ব ১.১৩ ট্রিলিয়ন
সৌদি আরব ২৬০ বিলিয়ন
কানাডা ১৭৯ বিলিয়ন
ইরান ১৩৬ বিলিয়ন
ইরাক ১১৫ বিলিয়ন
কুয়েত ৯৯ বিলিয়ন
সংযুক্ত আরব আমিরাত ৯৭ বিলিয়ন
ভেনিজুয়েলা ৮০ বিলিয়ন
রাশিয়া ৬০ বিলিয়ন
লিবিয়া ৪১ বিলিয়ন
নাইজেরিয়া ৩৬ বিলিয়ন
ইউ.এস.এ ২১ বিলিয়ন
বিপি বিশ্বের জ্বালানীর পরিসংখ্যাগত পর্যালোচনা ২০০৭
===============================
ভবিষ্যতে কতটুকু তেল উৎপাদন করা যাবে তা নিরূপনের জন্য তিনটি উপাত্ত খুব দরকার। প্রথমে দরকার হল, এ পর্যন্ত সর্বমোট কত ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়েছে- যাকে সর্বমোট উৎপাদন বলা হয়। দ্বিতীয়ত দরকার হল, বিভিন্ন কোম্পানীগুলো একটি তেলক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করবার আগে কতটুকু তেল উত্তোলন করতে সমর্থ্য হবে। সবশেষে দরকার হল, একটি বিশেষজ্ঞ দল অনাবিষ্কৃত ও উত্তোলনযোগ্য তেলের পরিমাণ সম্পর্কে গবেষণা ভিত্তিক তথ্য প্রদান করবে। এই তিনটি উপাত্ত থেকে পরিষ্কার বুঝা যাবে কয়েক দশক পর থেকে এই খনিটি পরিত্যক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত ঠিক কতটুকু তেল উত্তোলন করা সম্ভবপর হবে- একে সর্বমোট উত্তোলন বলে।
সর্বোচ্চ কি পরিমাণ তেল উৎপাদিত হবে তা বুঝার জন্য এ পর্যন্ত উৎপাদিত তেল আবিষ্কৃত তেলের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেল কিনা সেদিকে তাকাতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হল এ পর্যন্ত তেলক্ষেত্র আবিষ্কারের দিক থেকে ১৯৬০ এর দশক ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ের সর্ববৃহৎ তেলক্ষেত্রটি ১৯৮৫ সালে মেক্সিকোতে আবিষ্কৃত হয় আর ১৯৫০ এর দশকে আবিষ্কৃত তেলক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন প্রায় শেষের দিকে। অথচ পৃথিবীতে এখন যে পরিমান তেল উৎপাদন হচ্ছে তার প্রায় চারগুন ব্যবহার হয়। ফলে তেল কোম্পানিগুলো নতুন তেলক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু যাই মিলছে তা আবার ছোট ছোট এবং উৎপাদনও খুবই যৎসামান্য। নতুন নতুন তেল ক্ষেত্রর আবিষ্কার নিম্নগামী হওয়ায় এবং তেলের উত্তোলন অব্যাহত থাকায় কালোসোনার বর্তমান মজুদও নিঃশেষ হবার দিকেই এগুচ্ছে।
কোন কোন অতি উৎসাহী ভবিষ্যতদ্রষ্টা বলেন যে, ২০৬০ সাল পর্যন্ত তেলের সর্বোচ্চ (পিক) উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হল, বর্তমান সময় থেকে ২০১২ সালের মধ্যেই তেলের উৎপাদন সর্বোচ্চ (পিক) পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে।
আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাতে পারি যারা ইতোমধ্যে তেল উৎপাদনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে অথবা অতি শীঘ্রই যাবে। তেল উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম সাতটি দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে হয় তাদের উৎপাদন নিম্নমুখী অথবা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে, নরওয়ে ২০০১ সালে এবং ব্রিটেন ১৯৯৮ সালে সর্বোচ্চ উৎপাদনে পৌঁছে গেছে। রাশিয়া, মেক্সিকো ও চায়না ২০০৮ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। সৌদি আরব ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানই কেবল এ উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে।
বৈশ্বিক তেল ব্যবহারের পরিমান (ব্যারেল প্রতিদিন ২০০৭)
========================================
বিশ্ব ৮৫ মিলিয়ন
ইউ.এস.এ ২০.৬ মিলিয়ন ২৪%
চীন ৭.৮ মিলিয়ন ৯.৩%
রাশিয়া ২.৬ মিলিয়ন ৩.২%
জার্মানী ২.৩ মিলিয়ন ২.৮%
ফ্রান্স ১.৯ মিলিয়ন ২.৩%
ইউকে ১.৬ মিলিয়ন ২%
স্পেন ১.৬ মিলিয়ন ২%
বিপি বিশ্বের জ্বালানীর পরিসংখ্যাগত পর্যালোচনা ২০০৭
=======================================
এছাড়াও আরও অনেক কারণ থাকতে পারে যেগুলো দ্রুত তেল উৎপাদনের শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর জন্য দায়ী। সেকারণে বড় বড় তেল কোম্পানীগুলোর (যেমন: শেল) জন্য তেলের মজুদ সম্পর্কে করা অতিরঞ্জিত বক্তব্য মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
বর্তমান মজুদকে সামনে নিয়ে এসে তেল উৎপাদনকারী দেশের সংগঠনগুলো তেল ঘাটতিকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। তেল উৎপাদনকারী কোম্পানী যেমন ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম নতুন তেলক্ষেত্র আবিষ্কার নয় বরং পুরনো ক্ষেত্রগুলো থেকে তেল উত্তোলন চুক্তির ভিত্তিতে মজুদ সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। নতুন তেলক্ষেত্র আবিষ্কারের পেছনে বিনিয়োগ বরাবরই কমছে। সৌদি আরবের অধিকাংশ ক্ষেত্রসমূহে চালানো বিশেষজ্ঞ অনুসন্ধানে তেল প্রাপ্তির নিম্নমুখী প্রবণতা প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, ভারত, চীন ও অন্যান্য এশিয়ান দেশসমূহের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে তেল ও গ্যাস ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
এ কারণসমূহ ‘তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে’- এ ধরণের প্রচারণাকে মূল ধারায় নিয়ে এসেছে এবং এটি এখন বিশ্বশক্তিসমূহের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এর আড়ালে আরও কিছু রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি লুকিয়ে আছে।
পশ্চিমাদের অতিরিক্ত তেল খরচার উপযুক্ত অজুহাত হল তেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। সীমিত মজুদের তেল সম্পদের প্রতি অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রসমূহের চাহিদা তৈরি হোক এটা পশ্চিমারা চায় না। পশ্চিমারা মোট তেল উৎপাদনের চার ভাগের এক ভাগ করলেও প্রায় অর্ধেক তারা ভোগ করে। তাদের অতিরিক্ত ব্যয়ই তেল সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ-তেলের প্রাকৃতিক মজুদ নয়।
যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৮ ভাগ তেল উৎপাদন করলেও প্রায় ২৫ ভাগ তেল খরচ করে। তাদের এ বিশাল খরচ বহন করা অসম্ভব। কারণ মাত্র কয়েকটি বিশাল তেলক্ষেত্রের উপরই তাদের তেলের সিংহভাগ চাহিদা পূরণের দায়ভার বর্তায়। পুরো পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার তেলক্ষেত্র থাকলেও মাত্র ১১৬ টি ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ১০০০০০ ব্যারেল উৎপাদিত হয়-যা পুরো বিশ্বের উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ। এদের হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি ছাড়া বাকীগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে সিঁকি শতাব্দীরও আগে। যেগুলো এখন প্রায় ফুরিয়ে যাবার পথে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে সৌদি আরবের ঘাওয়ার, কুয়েতের বারগান, মেক্সিকোর কেণ্টারেল এবং রাশিয়ার সামোতলর-এখন উৎপাদনের দিক থেকে নিম্নমুখী। এসব বৃহৎক্ষেত্রসমূহের নিম্নমুখী উৎপাদন একটি বড় ঘটনা। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য ছোট ছোট ক্ষেত্রসমূহের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হবে। তবে এর মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত। যেহেতু মার্কিন তেল খরচ বেড়েই চলেছে সেহেতু সীমিত মজুদের এ জ্বালানীশক্তিকে ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েই চলবে। একারণে ইরাকের মত মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অংশও এ কালো সোনার জন্য মার্কিনীদের রাহুগ্রাসের শিকার হতে পারে।
তেল সম্পদের স্বল্পতার জন্য নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বের তেলের অতিরঞ্জিত ব্যবহারই তেল ফুরিয়ে যাবার প্রধান কারণ।