জলবায়ু পরিবর্তন বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করলে এটা ঠিক বিজ্ঞান নয়। জলবায়ু বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। জলবায়ু পরিবর্তন নতুন কিছু নয়, সবসময় জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। যেমন-বরফ যুগ, যখন বিশ্বের তাপমাত্রা দীর্ঘ সময়ের জন অত্যন্ত কম ছিল।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে বুঝায়। প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণ বিশ্বের গড় তাপমাত্রার এই বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় – আর এটাই এখন বিতর্কের বিষয়। এই উষ্ণায়নের জন্য প্রধানত দায়ী গ্রীনহাউসের বৃদ্ধি অর্থাৎ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এটা হল মুলত বায়ুমন্ডলের কিছু গ্যাস কর্তৃক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মত তাপ নির্গমনকারী গ্যাসসমূহকে আটকে ফেলার প্রক্রিয়া। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এ সময়কাল শিল্প বিপ্লবের সমসাময়িক- যখন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ। এর ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের পরিমাণের সাথে উষ্ণায়নের আনুপাতিক সম্পর্কের দিকে নির্দেশ করে। আরও অনেকের মত আল গোরও বলেন, এই গ্যাসটিই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণকেই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ হিসেবে গন্য করা হয়। যদিও এটিই শেষ কথা নয় এবং এ সিদ্ধান্তে পৌছানোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নমুনাগুলোর বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে।
প্রতি কয়েক বছর পর পর, জাতিসংঘের জলবাযু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেল (আই.পি.সি.সি) এর বিখ্যাত জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণার অগ্রগতি সর্ম্পকিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। উষ্ণায়ন হ্রাসের জন্য নিঃসরণ কমানো উচিত বলে তারা শুরু থেকেই সুপারিশ করে আসছেন। সারা বিশ্বের শত শত বিজ্ঞানীদের নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গঠিত। আই.পি.সি.সি-এর চতুর্থ তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন জানুয়ারী ২০০৭ অনুসারে, “তৃতীয় মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে জলবায়ুর উষ্ণায়ন এবং শীতলীকরণের নৃতাত্বিক প্রভাবকগুলো সম্পর্কিত জ্ঞান যথেষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছে। ফলাফল ̄স্বরূপ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে ১৭৫০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মানুষের কর্মকান্ডের গড় নীট পরিণতি হল উষ্ণায়ন- এই সম্ভাবনাই অতি প্রবল।’ তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী “অতি প্রবল সম্ভাবনা” এবং “খুব সম্ভব” এর ধারণা ৯০ ভাগ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাকে অন্তর্ভূক্ত করে (যদিও ২০০১ এর রিপোর্ট অনুসারে ৬৬ ভাগ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল)।
বিশ্বের দূষণকারী দেশসমূহ (২০০৪)
মানব কর্মকান্ডের মাধ ̈মে কার্বন -ডাই-অক্সাইড নিঃসরনকে
মোট নিঃসরেেনর শতকরা ভাগ হিসেবে গণনা করে
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২২%
২. চীন ১৮%
৩. রাশিয়া ৫%
৪. ভারত ৪.৯%
৫. জাপান ৪.৬%
৬. জার্মানী ৩.১%
৭. কানাডা ২.৩%
৮.যুক্তরাজ্য ২.২%
৯. দক্ষিন কোরিয়া ১.৭%
১০. ইতালী ১.৬%
ইতিহাস বলে যে, আজ পর্যন্ত শতকরা ৮০ ভাগ নিঃসরণের জন শিল্পোন্নত বিশ্ব দায়ী। ১৯৫০ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বসাকুল্যে এ পর্যন্ত ৫০.৭ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করেছে। একই সময়ে চীন করেছে ১৫.৭ বিলিয়ন টন (যেখানে আমেরিকার তুলনায় চীনের জনসংখ্যা ৪.৬ গুন বেশী) এবং ভারত করেছে ৪.২ বিলিয়ন টন (যেখানে আমেরিকার তুলনায় ভারতের জনসংখ্যা ৩.৫ গুন বেশী)। শিল্পোন্নত বিশ্বে যেখানে পৃথিবীর ২০ ভাগ লোক বসবাস করে সেখানে ৬০% ভাগ কার্বন নিঃসরণ হয়।
শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিক থেকেই শিল্পোন্নত বিশ্ব ব্যপক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনীতি নিয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দূষণকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে কোন ধরণের নিঃসরণ হ্রাসকারী চুক্তির ব্যাপারে বাধাদানকারী দেশ হিসেবেও এ দেশটির ভূমিকা রয়েছে। নিঃসরণ কমানোর অর্থ হচ্ছে পশ্চিমাদের উৎপাদন কমাতে হবে-যা তাদের অর্থনীতি-পুঁজিবাদকে সংকুচিত করবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার কার্বন নিঃসরণের আরও একটি প্রধান কারণ। মার্কিনীদের মাত্রাতিরিক্ত ভোগের কারণেই পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বৈশ্বিক গড় ব্যবহারের প্রায় পাঁচ গুন।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পশ্চিমাদের ব্যপক শিল্পায়নের মাধ্যমে অধিক মুনাফা করার হীন প্রবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হচ্ছে। নিঃসরণ কমানোর উন্নত প্রযুক্তি থাকলেও এর সাথে প্রচুর ব্যয় যুক্ত থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে রাজী নয়। কেননা এতে করে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজারে মার্কিন পণ্য কম মূল্যে বিক্রি হবে না । মাত্র ২০ বছর আগে চীন এবং ভারত উন্নয়নের ব্য়পক ধারায় সংযুক্ত হয়। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যাটি আরও পুরনো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিসেবে ভারত ও চীনের উন্নয়নের গতিতে পরশ্রীকাতর হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন তাদেরকে দোষারোপ করে আসছে।