পৃথিবী কি জনসংখ্যার আধিক্যে ভারাক্রান্ত?

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

জিনের গঠন নিয়ে বর্তমান আধুনিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, ১৫০০০ বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ মিলিয়ন (বর্তমান ঢাকা ও দিল্লীর সমান)। যীশু খ্রীস্টের সময় অর্থাৎ আজ থেকে ২০০০ বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ মিলিয়ন (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সমান)। শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৮০০ শতকের দিকে জনসংখ্যা তিনগুন বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ মিলিয়ন (বর্তমান ইউরোপের সমান)। গত দুই শতাব্দীতে বার্ষিক ৬ ভাগ হারে বৃদ্ধিতে ১৯৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫ বিলিয়ন। আর ২১ শতকের শুরুর দিকে বিগত ৫০ বছরে শতকরা ১৮ ভাগ হারে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে গেছে এবং কিছু কিছু এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, তারপরেও ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯ বিলিয়ন। সেপ্টেম্বর ২০০৮ অনুসারে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬.৭২ বিলিয়ন।

বিগত শতাব্দীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এমন মাত্রায় এসে পৌঁছেছে যে, একেই দেখানো হয় পৃথিবী এখন বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হবার মূল কারন হিসেবে। যু্ক্তি দেখানো হয় যে, আমরা এখন এই বিশাল জনসংখ্যাকে যোগান দেয়ার মত খাদ্যেও অপ্রতুলতার সম্মুখীন। এছাড়াও বলা হয় এ ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধি দরিদ্রতা, পরিবেশ বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহের অনুন্নয়নের জন্য দায়ী। এ কারণে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারসমূহ জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধকল্পে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নানাবিধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

তথাকথিত এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে এমন কোন কিছুর সাথে তুলনা করতে হবে যা সীমিত। আর তা হল পৃথিবীর মোট সম্পদের পরিমাণ।

বিশ্বের জনসংখ্যা ২০০৭
১. সমগ্র বিশ্ব৬.৭ বিলিয়ন
২. এশিয়া৩.৯ বিলিয়ন
৩. চীন১.৩ বিলিয়ন
৪. ভারত১.১ বিলিয়ন
৫. আফ্রিকা৮৮৭ মিলিয়ন
৬. ইউরোপ৭৭৪ মিলিয়ন
৭. লাতিন আমেরিকা৫৫৮ মিলিয়ন
৮. উত্তর আমেরিকা৩৩২ মিলিয়ন
৯. যুক্তরাষ্ট্র৩০৪ মিলিয়ন
১০. ইন্দোনেশিয়া২৩১ মিলিয়ন
১১. ব্রাজিল১৮৭ মিলিয়ন
১২. পাকিস্তান১৬৩ মিলিয়ন
১৩. বাংলাদেশ১৫৮ মিলিয়ন
জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয় সংক্রান্ত বিভাগ জনসংখ্যা বিভাগ

কিন্তু খুব সূক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীর অনেক বড় বড় সমস্যা – যেগুলোর দায়ভার জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর চাপানো হয়েছে-তা আদৌ সঠিক নয়। বরং এগুলোর পেছনে রয়েছে স্পষ্ট রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য। মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখবার জন্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিকে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। মূল সমস্যা হল জীবনযাপন প্রণালী, ভোগবাদী মনোবৃত্তির স্ববিনাশী প্রবণতা, দরিদ্রতা এবং নিজেদের স্বাচ্ছন্দের স্বার্থে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করবার হীন মানসিকতা।

উন্নত বিশ্ব বিশেষত: জাপান, রাশিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ আরেকটি বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-যা হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের নিম্নগতি। পশ্চিমের অন্যান্য অংশেও এ নিম্ন হার অব্যাহত রয়েছে। তবে অভিবাসনের মাধ্যমে সেটা কিছুটা ঠেকানো হয়েছে। যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার অব্যাহত থাকে, তাহলে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক হারে বেড়ে যাবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে শক্তিশালী হওয়া জাতিকে পদানত করবার এক হীন প্রক্রিয়া। এ ব্যাপারটি স্পষ্ট ফুটে উঠবে তুরষ্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। প্রায় ৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার অনুপাতে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য রয়েছে তুরষ্কের। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এটা প্রমাণ করে ২০২০ সালের মধ্যে পার্লামেন্টে এ দেশটি জার্মানীকে ছাড়িয়ে যাবে। তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলবে। সে কারণে ফ্রান্সের ভ্যালেরি গিসকার্ড ডি’এস্টাইং তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি তুলেন। ডি’এস্টাইং- এর মতে তুরষ্কের অন্তর্ভুক্তি মরক্কোর অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে।

যদিও এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্য নেই যে, কেন ব্রিটেন পৃথিবীর প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তারপরেও যে আটটি পূর্বশর্তের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করা হয়; তার মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি। ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ডের সাথে সংযুক্তির পর ব্রিটেনের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬.৫ মিলিয়ন। এক শতাব্দী পর সেটি প্রায় দ্বিগুন হয়ে দাঁড়ায় ১৬ মিলিয়ন। ১৭৫০ এর পরে এ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ-যা ব্রিটেনের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি থেকে তৈরি হয় দক্ষ শ্রমিক এবং ভোক্তা।

চীন এবং ভারত ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে সমর্থ্য হয়েছে যে, বিরাট জনসংখ্যা এক বড় আর্শীবাদ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে সংকুচিত করবার অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলেও চীন ও ভারত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে অন্যতম বৃহৎ দু’টি দেশ। এই জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধি হারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের অর্থনীতি। যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফলতার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক।

পৃথিবী কখনই জনসংখ্যা ভারক্রান্ত নয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তুলনায় এখনও অতিরিক্ত সম্পদ রয়ে গেছে। যদিও তার সিংহভাগ পশ্চিমারা একা ভোগ করছে।

Leave a Reply