প্রতিটি জিনিসের পেছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন – এ সিদ্ধান্ত পৌঁছানোর কারণ হচ্ছে আমাদের অনুধাবনযোগ্য প্রতিটি বিষয়, যেমন: মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব ইত্যাদি সীমাবদ্ধ, দুর্বল, অসম্পূর্ণ এবং তাদের অস্তিত্বের জন্য তারা অপরের উপর নির্ভরশীল। মানুষ সীমাবদ্ধ, কারণ সকল ক্ষেত্রেই সে একটি সীমার মধ্যে বেড়ে ওঠে এবং কখনোই এ সীমাবদ্ধতার বাইরে যেতে পারে না। জীবন সীমাবদ্ধ, কারণ আমরা অনুভব করতে পারি যে এটি স্বতন্ত্র প্রাণীসত্তার মধ্যেই প্রকাশিত হয় এবং তার মধ্যেই বিলুপ্ত হয়। কাজেই এটিও সীমাবদ্ধ।
মহাবিশ্বও সীমাবদ্ধ, কারণ এটি কতগুলো মহাজাগতিক বস্তুর সমষ্টিমাত্র। প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তু সীমাবদ্ধ এবং দৃশ্যতই অনেকগুলো সীমাবদ্ধ বস্তুর সমষ্টিও সীমাবদ্ধ। কাজেই নিশ্চিতভাবেই মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সীমাবদ্ধ। যখন আমরা সীমাবদ্ধ বস্তুগুলো নিয়ে চিন্তা করি, তখন আমরা দেখতে পাই, এগুলো কোনোটিই আজালী (চিরন্তন- আদি, অন্তহীন ও অসীম) নয়। নইলে এগুলোর কোনোটিই সীমাবদ্ধ হত না। আর একারণেই অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন যিনি মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্বসহ সকল কিছুকে সীমা প্রদান করেছেন, এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন।
এই সৃষ্টিকর্তাকে হয় কেউ সৃষ্টি করেছে, অথবা তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, অথবা তিনি চিরন্তন, আদি অন্তহীন (আজালী) এবং যার অস্তিত্ব অপরিহার্য। তাকে কেউ সৃষ্টি করেছে এ ধারণাটি চরম মিথ্যা, কারণ তাহলে তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে যান। আর কেউ যদি বলেন, তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, তবে এ যুক্তিটিও সম্পূর্ণ অসার, কারণ স্বাভাবিক যুক্তির বিচারে তখন তাকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এধরনের যুক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, তিনি সৃষ্টি হবার সময় নিজেকেই সৃষ্টি করছিলেন! এরূপ ধারণা অসম্ভব ও অলীক কল্পনামাত্র। কাজেই সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আজালী (চিরন্তন- আদি, অন্তহীন ও অসীম)। তিনিই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা।
ন্যূনতম চিন্তা-ভাবনার অধিকারী যে কেউ তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনুধাবন করতে পারেন যে, সবকিছুর পিছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। কারণ সবকিছু থেকে যে সত্যটি বের হয়ে আসে তা হচ্ছে এগুলোর প্রত্যেকটিই অসম্পূর্ণ, দুর্বল ও নির্ভরশীল। কাজেই তারা অবশ্যই সৃষ্ট। বস্তুত মানুষ, জীবন বা মহাবিশ্বের যে কোনো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিলেই কোনো ব্যক্তি সহজে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, এগুলোর পিছনে একজন সৃষ্টিকর্তা ও একজন সংগঠক রয়েছেন। মহাবিশ্বের যে কোনো বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করলে, জীবনের যে কোনো দিকের প্রতি গভীর মনোযোগ দিলে, কিংবা মানুষের যে কোনো বিষয় অনুধাবন করলে প্রতিটি বিষয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার অস্তিত্ব সম্পর্কে সুনিশ্চিত নিদর্শন বহন করে। মহাগ্রন্থ কুরআনে এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে এবং মানুষকে তার পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বলা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় মানুষ লক্ষ্য করে কীভাবে একটি বস্তু অপর বস্তুর উপর নির্ভরশীল এবং সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, নিশ্চয়ই আল্লাহর অস্তিত্ব সত্য – যিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। কুরআনে বহু আয়াতে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। সুরা আলি ইমরানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবা-রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য।” (সুরা আলি ইমরান: ১৯০)
এবং তিনি সুরা আর-রুম-এ বলেছেন,
“এবং তার নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি, এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এ সমস্ত কিছুর মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা আর-রুম, আয়াত ২২)
তিনি সুরা আল-গাশিয়াহতে বলেছেন,
“তবে কি তারা উটের প্রতি লক্ষ করে না যে, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের প্রতি যে, কীভাবে তাকে ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং পর্বতমালার প্রতি যে কীভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে? এবং ভূ-পৃষ্ঠের প্রতি, কীভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে? (সুরা আল-গাশিয়াহ, আয়াত ১৭-২০)
এবং সুরা আত-ত্বরিকে বলেছেন,
“সুতরাং মানুষ লক্ষ্য করুক তাকে কি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে যা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও পাঁজরের মধ্য থেকে।” (সুরা আত-ত্বরিক, আয়াত ৫-৭)
এবং সুরা আল-বাকারাহতে বলেছেন,
“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, যা মানুষের কল্যাণ করে তা-সহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে বারিবর্ষণে ধরিত্রীকে পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীবজন্তুর বিস্তারণে, বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকশে ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত ১৬৪)
এরূপ আরও অসংখ্য আয়াত রয়েছে যেখানে মানুষকে তার পারিপার্শ্বিকতার বিভিন্ন বস্তু ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার আহবান জানানো হয়েছে এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই সুনির্দিষ্ট বিচার-বিবেচনা ও স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে আল্লাহর উপর সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়।