অক্সফোর্ড ডিকশনারি Ideology (আদর্শ) শব্দটির সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে:
“a system of ideas and ideals, especially one which forms the basis of economic or political theory and policy or a set of beliefs characteristic of a social group or individual.”
অর্থাৎ, একটি ধারণা ও বিশ্বাসের সমষ্টি, যা বিশেষভাবে কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও নীতির ভিত্তি গঠন করে, কিংবা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যমূলক বিশ্বাসব্যবস্থা।
“Ideology” শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি বিপ্লবের সময়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি দার্শনিক Antoine Destutt de Tracy প্রথম এটি ব্যবহার করেন idéologie শব্দ থেকে, যার মূল অর্থ ছিল “science of ideas” বা ধারণার বিজ্ঞান। পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক চিন্তাধারার প্রসারে ব্যবহার হতে থাকে, যার উদ্দেশ্য ছিল মানবসমাজের ভাষা, বর্ণ, ভৌগোলিক পার্থক্য নির্বিশেষে এসব ধারণাকে বাস্তবে কার্যকর করা।
শেখ তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানী রহিমাহুল্লাহ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ نظام الإسلام (System of Islam)-এ Ideology (مبدأ) এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে:
«المبدأ هو عقيدة عقلية ينبثق عنها نظام»
অর্থাৎ, “আদর্শ (মাবদা’) হলো একটি বুদ্ধিভিত্তিক আক্বীদাহ, যার থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা উৎসারিত হয়। আক্বীদাহ হলো মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা—যা এই জীবনের পূর্ববর্তী বাস্তবতা, মৃত্যুর পরবর্তী বাস্তবতা এবং এ জীবনের সাথে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বাস্তবতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে।”
কেউ যদি ইসলাম ও আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনকে বুঝতে চান, তবে সহজেই এই পরিভাষাটি ইসলাম ও নবীর সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, এ শব্দটি ইসলামের ক্ষেত্রে যথার্থভাবে প্রযোজ্য এবং স্পষ্টভাবে ব্যবহার করা যায় আমাদের নবী ﷺ -এর জীবন ও ইসলামের প্রকৃতি (The essence of Islam) বর্ণনা করতে। কেননা ইসলাম নিজেই একটি আদর্শ (Ideology)—যা পূর্ণাঙ্গ ও বিশদ ব্যবস্থাসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা আল-কুরআনে সংজ্ঞায়িত এবং আল্লাহর রাসূল ﷺ -এর জীবনে বাস্তবভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জীবন ছিল এক আদর্শিক সংগ্রাম, যা পৃথিবীতে বাস্তবায়নের জন্য পরিচালিত হয়েছিল—মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে: ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে এবং নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের (public life) পর্যায়ে, যেখানে সমাজের কাঠামো, অর্থনৈতিক নীতি, এমনকি বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সম্পর্ক পর্যন্ত ইসলামের নির্দেশনা দ্বারা পরিচালিত হতো।
ঐতিহাসিকভাবে ইসলামকে আদর্শ (Ideology) ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে বোঝার কোনো দ্ব্যর্থতা বা অস্পষ্টতা ছিল না। আমাদের পূর্বসূরিরা এর স্পষ্ট প্রমাণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন, তারা ইসলামকে শুধুমাত্র ইবাদত বা আধ্যাত্মিকতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে বুঝেছিলেন। তাদের আদর্শিক উপলব্ধিই তাদেরকে দাওয়াহ ও জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে বিশ্বব্যাপী বিস্তার করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।যখন তারা ইসলামকে সর্বত্র প্রচার করেছেন এমন পর্যায়ে যে, খিলাফাহ রাষ্ট্র একটি ক্ষুদ্র চারাগাছের মতো মদিনা থেকে শুরু করে ৪৫০০ মাইল বিস্তৃত এক বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল। এর শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছিল পূর্ব দিকে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত এবং পশ্চিমে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত।
তাদের ইসলামের প্রতি এই আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিই এমন এক প্রজন্মের জন্ম দিয়েছিল, যারা আদর্শ দ্বারা চালিত মুসলিম ছিল। তাদের প্রতিটি কর্ম তাদের আক্বীদাহ’র (عقيدة) সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর এই ইসলামী আক্বীদাহ-ই (عقيدة إسلامية) তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ইসলামকে পৃথিবীব্যাপী বাস্তবায়ন করতে।
অতএব, একজন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য হলো ইসলামকে একই আদর্শিক কাঠামোর ভেতরে বুঝতে পারা। কারণ এই ধারণা থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিও একজন মুসলিমের কর্মকে প্রভাবিত করে এবং তা অবিশ্বাসী ঔপনিবেশিকদের সেই ষড়যন্ত্রকে সফল করতে পারে, যা ইসলামের প্রকৃত বার্তাকে (message) ক্ষীণ ও দুর্বল করে ফেলে। তারা ইসলামের সংগ্রামকে—যা বিশ্বের সব ভ্রান্ত মতবাদ ও আদর্শের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ—তা থেকে সরিয়ে এনে এক বহুত্ববাদী (pluralistic) ইসলাম উপস্থাপন করতে চায়। এমন এক ইসলাম, যেখানে রয়েছে পরস্পর বিরোধিতা, অসামঞ্জস্য, আপোস ও সংশয়বাদ—যা আজকাল আমরা সমাজে বহুলভাবে দেখতে পাই।
ইসলামের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি হারানোর বিপদ ও এর বাস্তব পরিণতি এবং তা আজ উম্মাহ হিসেবে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আমরা এমন মুসলিমদের দেখতে পাচ্ছি যারা ইসলামের বার্তায় (narration) ঈমান রাখে, কিন্তু নিজেদের উপর শাসন করার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। আমরা এমন মুসলিমদেরও দেখি যারা কিছু হারাম থেকে দূরে থাকে—যেমন মদ্যপান থেকে বিরত থাকে, বিবাহ-পূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলে এবং শূকরের মাংস খায় না—কিন্তু ব্যবসায় সুদের সঙ্গে খেলা করে কিংবা সুদভিত্তিক ছাত্রঋণ গ্রহণ করে। আমরা এমন মুসলিমদেরও দেখি যারা নিয়মিত মসজিদে যায় এবং এমনকি ইসলামের দাওয়াত কার্যক্রমেও যুক্ত থাকে; কিন্তু ইসলামের প্রতি আদর্শিক (Ideological) উপলব্ধি অনুপস্থিত থাকার কারণে তারা পশ্চিমা নৈতিকতা ও নীতিশাস্ত্রের ধারণার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত সংস্কার (individual reform) ও দানশীলতার (philanthropy) আহ্বান জানায়। আবার কেউ কেউ জাগতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আহ্বান জানায়—ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালন করে কিন্তু জনসমক্ষে ইসলামের বাস্তবায়নের ব্যাপারে অবহেলা করে।
আরেকটি বিষয় যা একজন মুসলিমের জানা ও বোঝা জরুরি, তা হলো—ইসলামের আদর্শ (Ideology of Islam) ইতিহাসে, বর্তমানে এবং সর্বদা অন্যান্য সকল আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী থাকবে; তা সে আধুনিক ও প্রভাবশালী যেমন পুঁজিবাদ (Capitalism) হোক বা বিলুপ্তপ্রায় যেমন উপজাতীয়তাবাদ (Tribalism), সমাজতন্ত্র (Socialism), বিশৃঙ্খলাবাদ (Anarchism) কিংবা অন্য যে কোনো –বাদ যা বিশ্বে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই আদর্শিক লড়াইয়ের মধ্যে একজন মুসলিম কোনোভাবেই ভীত, উৎকণ্ঠিত, লজ্জিত, ভেঙে পড়া বা কাপুরুষ হতে পারবে না—ইসলামের আদর্শ প্রচার ও বাস্তবায়নের কাজে—মিডিয়া, জনমত বা রাজনীতিবিদদের কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট চাপ যাই থাকুক না কেন।
গত দুই দশকে আমরা ইসলামী শরিয়াহর বিরুদ্ধে অসংখ্য আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেছি, বিশেষত ৯/১১ ঘটনার পর এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন তথাকথিত “সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধ”-এর পর থেকে। এর পর লন্ডন বোমা হামলা, ভারতীয় বোমা হামলা, আত্মঘাতী বোমা হামলা, বোস্টন বোমা হামলা এবং লন্ডনে এক ব্রিটিশ সেনাকে ছুরিকাঘাত করার মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে। এমনকি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, ইসলামের প্রেক্ষাপটে বলা যেকোনো রাজনৈতিক শব্দ, পদ বা অভিব্যক্তি জুড়ে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত রাজনৈতিকভাবে কলুষিত পরিভাষার সঙ্গে—যেমন “সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, র্যাডিকালিজম” ইত্যাদি। এ সকল আদর্শিক আক্রমণ আসলে ইসলামের জন্য নতুন কিছু নয় কিংবা কেলেঙ্কারির বিষয় নয়; কেননা ইসলামি উম্মাহ এ ধরনের বিরোধিতা বহু শতাব্দী ধরে প্রত্যক্ষ করেছে—আদম (আঃ) সৃষ্টির পর থেকেই এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকবে।
নিশ্চয়ই ইসলামের আদর্শ হুমকি—আজকের বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য নয়, অমুসলিমদের জন্যও নয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্রে ধিম্মি (ذِمِّي) হিসেবে বৈধ নাগরিকত্বের মর্যাদা পাবে; নয় বিশ্বের নিরীহ নারী বা শিশুদের জন্য, ধর্ম-বিশ্বাস বা মূল্যবোধ যাই হোক না কেন। বরং এ আদর্শ হুমকি তাদের জন্য—যারা অক্লান্তভাবে ও নিরন্তর চেষ্টা করছে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা খিলাফাহ’র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঠেকাতে, ইসলামী আদর্শের পুনর্জাগরণকে বাধাগ্রস্ত করতে—নিজেদের কামনা-বাসনা পূরণ করার জন্য অথবা ইসলামের প্রতি তাদের ঘৃণাকে লালন করার জন্য।
ইসলাম এক চিরন্তন/ কালজয়ী আদর্শ হিসেবে আগমন করেছে, যা সমগ্র বিশ্বে বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য। ইসলামের একটি অনন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে শাসকদের জবাবদিহিতা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। ইসলামের একটি অনন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও রয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্যতা দূর করা এবং সম্পদ বণ্টনে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা দূর করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কিভাবে ইসলামকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। এটাই সেই আদর্শ, যা তাদের জন্য হুমকি যারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা প্রদত্ত স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করে উল্টো পথে চলে, অহংকারভরে পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং মানুষকে নিপীড়ন করে। এটাই সেই আদর্শ যা পুঁজিবাদের জন্যও হুমকি, কেননা এটি সেই অস্বাভাবিক ও অবিচারমূলক ফলাফলগুলোকে উল্টে দেবে, যেখানে আজকের দিনে বিশ্বের ৮০% সম্পদ পৃথিবীর মাত্র ৫% জনগণের হাতে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এটাই সেই আদর্শ, যা আজকে প্রবলভাবে আক্রমণ ও ধর্মনিরপেক্ষীকরণের (secularized) মাধ্যমে সংকুচিত করা হচ্ছে—যাতে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ থেকে শুধুমাত্র এক অন্ধ বিশ্বাসে (blind faith) পরিণত করা যায়।
একজন মুসলিম যখন ইসলাম গ্রহণ করে, তখন সে মূলত আদর্শিক (ideological) হয়ে যায়। কারণ তার প্রত্যেকটি কর্মের বিধান তাকে ইসলামি ‘আক্বীদাহ’ থেকে গ্রহণ করতে হয়। আর এই আক্বীদাহই নির্ধারণ করে দেয় সে কিভাবে জীবন যাপন করবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে তার ধারণা কিরূপ হবে। ইসলামের সংজ্ঞা অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা নির্ধারিত, যা সংবিধান ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সব সমস্যার সমাধান দেয়। ইসলামে বিশ্বাস করা মানেই এই বিশ্বাস করা যে ইসলামকে বিশ্ব শাসন করতে হবে, কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদেরকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন।
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
“তোমরা মানবজাতির জন্য উদ্ভূত সর্বোত্তম উম্মাহ। তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজ থেকে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে ঈমান রাখ।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১০)
একজন আদর্শিক মুসলিম তার সকল কর্মকাণ্ডে সতর্ক থাকবেন যেন তা ইসলামের শরীয়াহ’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং তিনি সর্বশক্তি ব্যয় করবেন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণের জন্য। আদর্শিক মুসলিম বিশ্বে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব কামনা করবেন, কেননা তিনি বুঝতে পারবেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ -এর দাওয়াহ মিশন ও লক্ষ্য কী ছিল। আদর্শিক মুসলিম বিনয়ী হয়ে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন এবং সব কাজ করবেন একমাত্র তাঁর সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য, অন্য কোনো কামনা বা লালসার জন্য নয়। কেননা তিনি ভালো করেই জানেন তার কর্মকাণ্ডের পরিণতি কী এবং কিয়ামতের দিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে কীভাবে হিসাব দিতে হবে।
যে মুসলিম নবী মুহাম্মদ ﷺ এর জীবনকে অনুকরণ করতে চায় এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে সন্তুষ্ট করতে চায়, তার উচিত নিজের ইসলামের বোধ (understanding) সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা। আপনার ইসলামের ধারণা কি সত্যিকার অর্থে ইসলামকে একটি আদর্শবাদী মতাদর্শ হিসেবে প্রতিফলিত করে? যদি না করে, তবে আপনি কোন ইসলামকে বিশ্বাস করছেন? একজন মুসলিম কখনো কুরআনের সেই আয়াতগুলোকে উপেক্ষা বা অবহেলা করতে পারে না, যেখানে স্পষ্টভাবে শরিয়াহর বিধান, জিহাদ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শুধু এ কারণে যে এগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বা চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত হয়, একজন আদর্শবাদী মুসলিমের উচিত নয় এগুলো থেকে দূরে সরে থাকা। বরং তার উচিত এসব বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা, অধ্যয়ন করা এবং সঠিকভাবে বুঝে দাওয়াহ প্রদান করা, যাতে শরিয়াহ ও ইসলামের পররাষ্ট্রনীতিকে যথাযথভাবে রক্ষা করা যায়, যা আজ কঠোর সমালোচনার শিকার।
রাসূল ﷺ বলেছেন:
«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَى أَمْرِي فَهُوَ رَدٌّ»
“যে কোনো কাজ আমার প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী করা হয়নি, তা প্রত্যাখ্যাত।” (সহীহ বুখারি ৩৪২৫)
একজন আদর্শিক মুসলিম প্রতিটি সমস্যাকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবে। এটি সত্যিই একটি জীবনব্যাপী যাত্রা—একজন মুসলিমকে তার পূর্ববর্তী মনোভাব, পছন্দ-অপছন্দ, এবং ইসলামের বাইরে থাকা অন্যান্য আদর্শ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে মুক্ত হতে হবে এবং তার কর্মকাণ্ডকে ইসলামের বিশুদ্ধ রূপের (pure form) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। বাস্তবতা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের অভাবে, যা উম্মাহকে ইসলামিক সংস্কৃতির মাধ্যমে গড়ে তোলে, প্রত্যেক মুসলিম ভুল ধারণার শিকার হতে পারে, যা ইসলামের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। এই ভুল ধারণা যে কোনো রূপে হতে পারে—সেক্যুলার, আধুনিকতাবাদী, সংস্কারবাদী, সাংস্কৃতিক বা বিদেশী (Secular, Modernist, Reformist, Cultural বা Foreign) ইত্যাদি। এই কারণেই একজন মুসলিমের জন্য ইসলামকে একটি আদর্শ (Ideology) হিসেবে বোঝা দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, যাতে সে তার ইসলামী ব্যক্তিত্ব (Islamic Personality) সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারে এবং জীবনযাপন করতে পারে ইসলামের নির্দেশিত পথ অনুযায়ী।
ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য যত্নসহকারে ও নিরলসভাবে কাজ করার প্রেরণা মূলত ইসলামের আদর্শগত উপলব্ধি (ideological understanding) থেকে উদ্ভূত। একজন মুসলিম যখন কোনো সমস্যার অনুভব করে—তা সে পরিবারের মধ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা হোক, কিংবা বাইরের জগতে দৈনন্দিন লেনদেনের সময় (যেমন বাজার করা, কাজ করা, ভ্রমণ ইত্যাদি) উপলব্ধি করা সমস্যা হোক, অথবা রাজনৈতিক আলোচনা সম্পর্কিত সমস্যা হোক—যেমন মুসলিম বিশ্বের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি, স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কিংবা আমাদের ভূমিতে পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ—তখন সে সমস্যার প্রকৃতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এবং উপলব্ধি করে যে, এই সমস্যাগুলির মূল কারণ হলো দুনিয়ায় ইসলামী বিধানসমূহের অনুপস্থিতি। কারণ মুসলমানদের মাঝে ইসলামের আদর্শগত উপলব্ধির ঘাটতির কারণে তারা তাদের কর্মে ইসলামকে অবহেলা করছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানদণ্ড হিসেবে ইসলামের পরিবর্তে পশ্চিমা ধারণাকে (Western ideas) ব্যবহার করছে। যেমন— মতপ্রকাশের স্বাধীনতা “freedom of speech” বা মালিকানার স্বাধীনতা “freedom of ownership” এর মানদণ্ড দিয়ে নির্ধারণ করছে কোনো কাজ করা যাবে কিনা, অথচ ইসলামের দিকে ফিরে যাচ্ছেনা। আমরা এর উদাহরণ দেখি, যখন কোনো মুসলিম কিশোর বলে বসে: “I can do what I want, it is my choice” (আমি যা খুশি তাই করতে পারি, এটা আমার পছন্দ)। অথবা যখন কোনো মুসলিম দম্পতি সুদভিত্তিক মর্টগেজে তাদের প্রথম বাড়ি কেনার সময় দাবি করে, “এটি আমাদের জন্য বৈধ।” কিংবা কোনো মুসলিম মনে করে যে, মুসলিমদের একটি নির্দিষ্ট এমপি (member of parliament) -কে ভোট দেওয়ার জন্য সংগঠিত করে সে ইসলামকে সাহায্য করছে। কিন্তু যে মুসলিম ইসলামকে তার সঠিক আদর্শিক রূপে (correct ideological narrative) বোঝে, সে এসব সমস্যার উৎসকে ইসলামের অনুপস্থিতি এবং জনজীবন (public life) থেকে ইসলামের বিচ্ছিন্নতার সাথে সম্পর্কিত করে। রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন:
«مَثَلُ الْقَائِمِ عَلَى حُدُودِ اللَّهِ وَالْوَاقِعِ فِيهَا، كَمَثَلِ قَوْمٍ اسْتَهَمُوا عَلَى سَفِينَةٍ، فَأَصَابَ بَعْضُهُمْ أَعْلَاهَا وَبَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا، فَكَانَ الَّذِينَ فِي أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوْا مِنَ الْمَاءِ مَرُّوا عَلَى مَنْ فَوْقَهُمْ، فَقَالُوا: لَوْ أَنَّا خَرَقْنَا فِي نَصِيبِنَا خَرْقًا وَلَمْ نُؤْذِ مَنْ فَوْقَنَا، فَإِنْ يَتْرُكُوهُمْ وَمَا أَرَادُوا هَلَكُوا جَمِيعًا، وَإِنْ أَخَذُوا عَلَى أَيْدِيهِمْ نَجَوْا وَنَجَوْا جَمِيعًا»
অর্থাৎ: “আল্লাহর সীমারেখা (হুদূদ) রক্ষা করার চেষ্টা করা লোকদের দৃষ্টান্ত এবং যারা তা ভঙ্গ করে তাদের দৃষ্টান্ত একটি নৌকায় একসাথে বসবাসকারী লোকদের মতো। তাদের কেউ উপরের তলায় এবং কেউ নিচের তলায় বাস করে। নিচের তলার লোকেরা যখন পানি নিতে চায় তখন তাদের উপরের তলায় যেতে হয়। তখন তারা বলে, ‘যদি আমরা আমাদের অংশে নিচে একটি ছিদ্র করি (যাতে সরাসরি পানি নিতে পারি) এবং উপরতলার লোকদের কষ্ট না দিই, তাহলে কেমন হয়?’ যদি উপরতলার লোকেরা তাদের (নিচের তলার লোকদের) ইচ্ছামতো কাজ করতে দেয় তবে সবাই ধ্বংস হবে। আর যদি তারা তা থেকে বাধা দেয় তবে সবাই রক্ষা পাবে।”(সহীহ বুখারী)
তিনি (আদর্শিক মুসলিম) উপলব্ধি করবেন যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতি এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেখানে একজন মানুষের পক্ষে বাড়ি কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং তাকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। অথচ ইসলাম সুদকে (রিবা) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং ঋণ-ভিত্তিক অর্থনীতির ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তিনি বুঝবেন যে, যৌন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত না থাকা এবং শরীয়াহ্ দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণ না করাই হচ্ছে সে কারণ, যার ফলে একজন মুসলিম তার প্রবৃত্তি হারাম উপায়ে পূরণ করছে। কিংবা একজন মুসলিম নারী ইসলামী পোশাক বিধান পরিত্যাগ করছে, কারণ পশ্চিমা সামাজিক ব্যবস্থা তাকে উন্মুক্তভাবে ও আকর্ষণীয়ভাবে পোশাক পরার স্বাধীনতা দিচ্ছে; অথচ ইসলাম একজন মুসলিম নারীর জন্য নির্দিষ্ট পোশাকের বিধান সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছে। আদর্শিক (Ideological) মুসলিম উপলব্ধি করেন যে, আজকের তরুণ মুসলিমরা ইসলামী শিক্ষাবিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত একটি পরিবেশে বেড়ে উঠছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী সংস্কৃতির অনুপস্থিতিই হলো সেই কারণ, যার জন্য আজকের মুসলিম কিশোর তার খেয়াল-খুশি ও প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করছে, ইসলামের মানদণ্ড অনুসারে নয়। তিনি উপলব্ধি করবেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি মুসলিমদের জন্য তাদের দ্বীন পালন করার প্রাকৃতিক পরিবেশ কেড়ে নিয়েছে এবং এর পরিবর্তে এমন এক আদর্শ চাপিয়ে দিয়েছে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক—যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত ধর্মনিরপেক্ষ (secular) ধারণা অথবা গোত্রবাদ (tribalism)-প্রসূত সাংস্কৃতিক ভ্রান্ত চিন্তাধারা।
অনেক আন্তরিক মুসলিম (sincere Muslims) ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করার জন্য নানা কাজ সম্পাদন করেন। কিন্তু অত্যন্ত জরুরি হলো—এই কাজগুলো যেন ইসলামের সংজ্ঞায়িত আদর্শিক লক্ষ্য (Ideological objectives)-এর সাথে সম্পর্কিত হয়। এ বিষয়ে একজনকে শুধু মহানবী মুহাম্মদ ﷺ-এর মক্কী জীবনের দিকে মনোযোগ দিলেই যথেষ্ট। এমনকি একজন অমুসলিমও উপলব্ধি করবে যে, রাসূল ﷺ-এর মিশন ছিল আজকের ভাষায় যাকে বলা হয় একটি বিপ্লব। তিনি ﷺ আরব সমাজকে গোত্রীয় ও প্রথাগত সামাজিক রীতি থেকে ইসলামি বিধি-বিধানের দিকে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল এবং চলতে থাকে ১৯২৪ সালে ইসলামী খিলাফতের ধ্বংস পর্যন্ত। সুতরাং যে মুসলিম ইসলামের দাওয়াহ বহন করতে চায়, তার উদ্দেশ্যও একই হতে হবে—অর্থাৎ পুরো পৃথিবীতে ইসলামী বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো। আজ একশ বছরেরো অধিক সময় ধরে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামী বিধান ছাড়া জীবনযাপনের পর মুসলিম উম্মাহ আজ আবার শারিয়াহ্র বাস্তবায়নের জন্য তীব্রভাবে আকাঙ্ক্ষিত। অসংখ্য জরিপে দেখা গেছে—মুসলিম বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শারিয়াহ্র অধীনে জীবনযাপন করতে চায়। যদিও এ সত্য প্রমাণে জরিপের প্রয়োজন নেই। শুধু গত দুই দশক ধরে দেখা গেছে মুসলিম বিশ্ব ইসলামকে আঁকড়ে ধরতে জীবন দিতেও প্রস্তুত, যেমন আমরা সিরিয়ার উম্মাহর দৃষ্টান্তে প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব যে মুসলিম ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝেছে, সে উপলব্ধি করবে যে ইসলামী রাষ্ট্রই মুসলিমদের পুনর্জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু এবং তাই সে ইসলামের দাওয়াহ ও রাসূল ﷺ-এর মিশন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাবে।
আদর্শিক মুসলিম, যে ইসলামী পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে, তার জীবন হবে না একঘেয়ে—যেখানে কেবল অফিসে যাওয়া, ঘরে ফেরা, ঘুমানো ও ছুটির দিনে আরাম করা। বরং সে প্রতিদিন হাজারো সমস্যা অনুভব করে এবং উপলব্ধি করে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা কতটা জরুরি। সে জানে তার হাতে কী বিশাল দায়িত্ব রয়েছে এবং সর্বশক্তি দিয়ে সে এই চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। তার মন মেনে নিতে পারে না যে মানবজাতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে অবহেলা করে কুফরের অতল গহ্বরে পতিত হয়েছে, আর এর ফলেই মানবজাতির উপর নির্যাতন নেমে এসেছে—অথচ মুসলিমরা ব্যাপকভাবে এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আল্লাহ تعالى বলেন:
هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُشۡرِكُونَ
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি এটিকে সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।”
(সূরা আত-তাওবাহ: ৩৩)
তার সংবাদ অনুসরণ (following the news) করার অভ্যাস তাকে সপ্তাহান্তে আরামে থাকতে দেয় না। কারণ সে অনুভব করে, ইসলামকে ঘিরে প্রচারণা এবং আক্রমণের নতুন নতুন কৌশল চলছে। সে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের গভীরতা বোঝে এবং উপলব্ধি করে কীভাবে রাষ্ট্রগুলো চতুরভাবে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মুসলিম ভূমিগুলোর উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদ কায়েম রাখছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের উত্থানকে রোধ করছে। ফলে সে অনুভব করে—এটার মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনার মাধ্যমে তার সমাজের মধ্যে। সে চায় মানবজাতি শান্তিতে থাকুক এবং সে বোঝে যে, এটি কেবল তখনই সম্ভব হবে যখন মানবজাতিকে ইসলাম দ্বারা পুনর্জীবিত (revived) করা হবে। অতএব অবসর সময়ে কোনো নির্দিষ্ট আলোচনার বিষয়ে তার বোধ (understanding) বৃদ্ধি করার জন্য তার হাত বই ছাড়া পিছিয়ে থাকে না। জনজীবনে (in public life) তার অংশগ্রহণও এমন আলোচনাহীন হয় না, যেখানে সে নিজের আদর্শ শেয়ার করতে পারে। স্ত্রী, পরিবার বা বন্ধুদের সাথে তার সময় শুধু বিনোদন বা অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং সেই সময়কে সে একটি সুবর্ণ সুযোগে পরিণত করে—যাতে আরো মানুষকে ইসলামের আদর্শের দিকে আকৃষ্ট ও আহ্বান জানাতে পারে। সে একটি পরিকল্পনার সাথে কাজ করে, যেখানে তার সপ্তাহগুলো যতটা সম্ভব ফলপ্রসূ হয় এবং অগ্রাধিকার থাকে ইসলামের পুনর্জাগরণের আহ্বান। এজন্য সে নিজের নফসী আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে—যেমন সিনেমায় নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়া, স্ত্রীকে নিয়ে নতুন রেস্টুরেন্টে ঘন ঘন ভ্রমণ করা, খেলাধুলায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা, কিংবা ঘর, গাড়ি বা ব্যক্তিগত যন্ত্রপাতি নিয়ে নিখুঁত সাজসজ্জায় অতিরিক্ত সময় নষ্ট করা। সে সর্বদা নিম্নোক্ত কুরআন ও হাদীসকে মনে রাখে-
আল্লাহ تعالى বলেন:
قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ
“বলুন: নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু—সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক।” (সূরা আল-আন‘আম: ১৬২)
আর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
«مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ»
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, সে যেন কল্যাণকর কথা বলে অথবা নীরব থাকে।”
(সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
“একজন মতাদর্শপ্রাণ মুসলিম বা আদর্শিকভাবে চালিত মুসলিম (ideologically driven Muslim) হওয়ার অর্থ হলো—এই আদর্শের দাওয়াহ’ই তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, যার চারপাশে তার সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়। যদি এমন না হয়, তবে বুঝতে হবে সে মুসলিম ইসলামকে আদর্শ (Ideology) হিসেবে অনুধাবন করতে পারেনি। অর্থাৎ, ইসলাম এমন একটি চিন্তা-ধারা যা বর্ণ বা ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করে এবং এমন বিধান ধারণ করে যা সকল মানুষের জন্য, সকল সময়ে, সকল পরিস্থিতিতে সমভাবে প্রযোজ্য—ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, তেমনি সমাজ জীবনের ক্ষেত্রেও।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের ইসলামের নেয়ামত দান করেছেন, যাতে আমরা নির্বাচিত উম্মাহ হিসেবে ইসলামের আদর্শকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিই। আজ আমরা সারা বিশ্বে বিস্তৃত—এটি আমাদের পূর্বসূরিদের কর্মফল, যারা ইসলামের পতাকা (راية الإسلام) উঁচিয়ে ধরেছিলেন এবং তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছিলেন ইসলামের বাস্তবায়নের জন্য, ইসলামের সঠিক আদর্শিক বোঝাপড়া (understanding) নিয়ে।
যদি আমরা ইসলামকে একইভাবে না বুঝি, তবে মুসলিমরা কুফরের ছায়ায় থেকেই যাবে এবং আমাদের প্রজন্ম ইসলামের বাস্তব রূপকে (practical manifestation of Islam) খিলাফাহর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। ইসলামী খিলাফাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ কেবলমাত্র আদর্শিক মুসলিমদের দ্বারাই সম্পন্ন হবে, এবং ইসলামের পুনর্জাগরণ (revival) ঘটবে তখনই—যখন উম্মাহ স্পষ্টভাবে ইসলামকে একটি আদর্শ (ideology) হিসেবে বুঝবে।
আল্লাহ تعالى বলেন:
ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗا
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।”
(সূরা আল-মায়েদাহ: ৩)
দু’আ:
“হে আল্লাহ, আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে ইসলামের আদর্শিক বোঝাপড়া দান করুন, যেভাবে আপনি আপনার প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ-কে এবং তাঁর সাহাবীগণকে দান করেছিলেন। আমাদের চিন্তা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, পছন্দ-অপছন্দ ও কর্মসমূহ যেন কেবল আপনার দ্বীন ইসলাম অনুযায়ী হয়।” …আমীন।
আল্লাহর ইচ্ছায় সমাপ্ত
– কায়েস আবু মুহাম্মদ কর্তৃক অনুবাদকৃত ও পরিমার্জিত।