الحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله، وعلى آله وصحبه ومن والاه، أما بعد
আজকের মুসলিম সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা হলো — “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।” প্রথমে বিষয়টি শুনতে আকর্ষণীয় মনে হলেও, শরীয়াহর দৃষ্টিতে এবং বাস্তবতার আলোকে এটি একটি ভয়াবহ ভ্রান্তি। কেননা, এটি ইসলামের মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক, এবং ইসলামী পদ্ধতির পরিবর্তে কাফিরদের পদ্ধতি গ্রহণের নামান্তর।
গণতন্ত্র কী এবং কেন এটি ইসলামের পরিপন্থী?
সংক্ষেপে, গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে। সংসদে বসে মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত অনুযায়ী আইন তৈরি হয়। এক কথায়, মানুষ যা চাইবে, তাই হবে — এমনকি তা আল্লাহর বিধানের বিরোধী হলেও।
অন্যদিকে ইসলাম ঘোষণা করে:
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
“হুকুম তো কেবল আল্লাহরই।”
(সূরা ইউসুফ: ৪০)
এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শাসন ও আইন প্রণয়নের পূর্ণ অধিকার একমাত্র আল্লাহর। সুতরাং গণতন্ত্রের মূল দর্শন — মানবসৃষ্ট আইন — সরাসরি কুরআনের এই মৌলিক নীতির বিরোধিতা করে।
হারাম পথে হালাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টার ভ্রান্তি
অনেকে যুক্তি দেন, “উদ্দেশ্য যদি ভালো হয় — ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা — তাহলে গণতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করাতে দোষ কী?”
কিন্তু শরীয়াহর একটি মৌলিক নীতি হলো:
إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি শুধুমাত্র পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন।”
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১০১৫)
অতএব, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মতো পবিত্র কাজ হারাম পদ্ধতিতে করা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। উদ্দেশ্য পবিত্র হলেও যদি মাধ্যম হারাম হয়, তা ইসলামে বৈধ নয়।
কুরআনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা
১. যালিমদের সাথে আপস করার পরিণাম
আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
وَلَا تَرْكَنُوا إِلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ
“আর তোমরা যালিমদের দিকে ঝুঁকো না, তা না হলে তোমাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে। আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই। তারপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।”
(সূরা হুদ: ১১:১১৩)
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করা মানে কুফরী আইনপ্রণেতাদের সাথে আপস করা, যা আল্লাহ স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।
২. কুফরী ব্যবস্থার অংশীদার হওয়ার নিষেধাজ্ঞা
আল্লাহ বলেনঃ
وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ آيَاتِ اللَّهِ يُكْفَرُ بِهَا وَيُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلَا تَقْعُدُوا مَعَهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ۚ إِنَّكُمْ إِذًا مِّثْلُهُمْ
“তোমাদের প্রতি কিতাবে নাযিল করা হয়েছে যে, যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং উপহাস করা হচ্ছে, তখন তাদের সাথে বসো না যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবেশ করে। নিশ্চয়ই তোমরা যদি (তাদের সাথে বসো) তবে তোমরা তাদের মতই হবে।” (সূরা আন-নিসা: ৪:১৪০)
অতএব, কুফরী ব্যবস্থার অংশীদার হওয়া মানে সেই অপরাধে শরিক হওয়া।
৩. আল্লাহর বিধানকে অগ্রাহ্য করা কুফরী
আল্লাহ বলেনঃ
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ
“আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা হুকুম করে না, তারাই কাফির।”
(সূরা আল-মায়িদাহ: ৫:৪৪)
গণতন্ত্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের হাতে। এটি সরাসরি কুফরীর শামিল।
হাদীসের প্রমাণসমূহ
১. কাফিরদের পদ্ধতি অনুসরণের বিরুদ্ধে সতর্কতা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
“যে কোনো জাতির সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।”
(সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪০৩১)
অতএব, গণতন্ত্রের মতো কাফিরদের জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করা সরাসরি এই হাদীসের আওতায় পড়ে।
২. প্রতারণামূলক সময়ের সতর্কবার্তা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
سَيَأْتِي عَلَى النَّاسِ سَنَوَاتٌ خَدَّاعَاتٌ … وَيَنْطِقُ فِيهَا الرُّوَيْبِضَةُ
“মানুষের উপর প্রতারণামূলক বছর আসবে … তখন তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট লোকেরা নেতৃত্বে কথা বলবে।”
(সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস: ৪০৩৬)
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত নেতৃত্বের পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও অযোগ্য লোকেরা নেতৃত্বের আসনে বসে — যা এই হাদীসের প্রতিফলন।
ইসলামী শূরা ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্র:
অনেকেই গণতন্ত্র (ডেমোক্রেসি) ও শূরা (পরামর্শ) কে এক করে দেখে, অথচ বাস্তবে এ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। শূরা হলো— ইসলামী নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যোগ্য আলেম ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করা। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র হলো— মানুষের খেয়াল-খুশি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা, যা আল্লাহর অবতীর্ণ শরীয়াহর বিপরীত।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা শূরার কথা বলেছেন:
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
“আর তাদের কাজকর্ম নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।”
(সূরা আশ-শূরা: ৩৮)
এখানে স্পষ্টভাবে পরামর্শের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এই পরামর্শ কেবল শরীয়াহর সীমার মধ্যে হবে।
অন্যদিকে গণতন্ত্রে সংসদে পরামর্শ হয় বটে, কিন্তু তা মানব-রচিত আইনের বলয়ের ভেতরে সীমাবদ্ধ। সেখানে কুরআন-সুন্নাহর আইন প্রণয়নের কোনো কর্তৃত্ব নেই। বরং অধিকাংশ মানুষের মতামতকেই আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা আল্লাহ তাআলার ঘোষণার স্পষ্ট বিরোধিতা:
অন্যদিকে গণতন্ত্রে সংসদে পরামর্শ হয় বটে, কিন্তু তা মানব-রচিত আইনের বলয়ের ভেতরে সীমাবদ্ধ। সেখানে কুরআন-সুন্নাহর আইন প্রণয়নের কোনো কর্তৃত্ব নেই। বরং অধিকাংশ মানুষের মতামতকেই আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা আল্লাহ তাআলার ঘোষণার স্পষ্ট বিরোধিতা:
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ
“আর যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের নির্দেশ মানো, তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দেবে। তারা শুধুমাত্র অনুমান অনুসরণ করে এবং শুধুমাত্র বাজে কথা বলে।” (সূরা আল‑আন‘আম : ১১৬)
আয়াতটি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যের মানদণ্ড নয়, বরং অনেকেই শুধুমাত্র অনুমান (ظنّ) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় ও সেই কারণেই তারা বিভ্রান্ত হয়।ইসলামিক চিন্তাভাবনায়, সত্য অনুসন্ধানে কুরআন- সুন্নাহ, বিচার-বিবেচনা ও জ্ঞানের গুরুত্ব অগ্রাধিকার পায়, শুধুমাত্র সংখাধিক্যের ভিত্তিতে নয়।
ইসলামে শূরার পদ্ধতি:
খিলাফাহ শাসনব্যবস্থায় খলিফা “আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ”-এর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। এরা হবেন এমন যোগ্য আলেম ও বিশেষজ্ঞ, যারা উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য। হাদীসে এসেছে:
مَا خَابَ مَنِ اسْتَخَارَ وَلاَ نَدِمَ مَنِ اسْتَشَارَ
“যে ইস্তিখারা করেছে সে ব্যর্থ হয়নি, আর যে পরামর্শ নিয়েছে সে অনুতপ্ত হয়নি।”
(মুসনাদ আহমাদ: ২৮৬)
তবে খলিফা শূরা কমিটির সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য নন; তিনি চাইলে নিজের সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে পারেন। শূরা ইসলামে বাধ্যতামূলক নয় বরং পরামর্শ গ্রহণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
সুতরাং, গণতন্ত্র ও শূরা এক নয়।
- গণতন্ত্রে: মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতই আইন।
- শূরায়: আল্লাহর শরীয়াহর সীমার মধ্যে যোগ্য আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ।
এ কারণে ইসলামী শূরা ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে এক করা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
উপরের কুরআন ও হাদীসের দলীল থেকে স্পষ্ট যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার চিন্তা একটি আত্মপ্রতারণা। হারাম পদ্ধতিতে হালাল প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ইসলামের পথ হলো — রাসূল ﷺ এর দেখানো পদ্ধতিতে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করা: দাওয়াহ, জনমত সৃষ্টি এবং আহলে কুওয়া ও নুসরাহর সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে।
গণতন্ত্রের পথে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা: ইতিহাস থেকে শিক্ষণীয় বাস্তবতা
দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক শাসন ও পশ্চিমা আধিপত্য মুসলিম উম্মাহকে তাদের প্রকৃত শাসনব্যবস্থা খিলাফাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন এক অচলাবস্থায় দাঁড় করিয়েছে যেখানে বহু ইসলামী দল ভেবেছে, “গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।” বাস্তবে দেখা গেছে, এই চিন্তা ইসলামী পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং ব্যর্থতাই এর পরিণতি।
নিচে ইতিহাস থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ বিশ্লেষণ করা হলো—
১. মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন (Muslim Brotherhood)
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলিমীন) দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ২০১২ সালে মুহাম্মদ মুরসি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কি হয়েছিল?
- মুরসি ক্ষমতায় এসেও পূর্ণ ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
- মিশরের বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামো ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
- তিনি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বহু আপস করেন।
ফলাফল
এক বছরের মধ্যেই সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। ইখওয়ান নেতাদের অনেকে গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
শিক্ষণীয় দিক
গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও বাহ্যিক চাপ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
২. তুরস্কের রেফাহ পার্টি এবং এ.কে. পার্টি
১৯৯৬ সালে নাজমুদ্দিন এরবাকানের নেতৃত্বে রেফাহ পার্টি ক্ষমতায় আসে। পরে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নেতৃত্বে এ.কে. পার্টি (AKP) রাজনীতিতে আসে।
কি হয়েছিল?
- রেফাহ পার্টি ইসলাম প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করলেও সামরিক বাহিনী ও পশ্চিমা চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
- এ.কে. পার্টি ক্ষমতায় এসে স্পষ্ট ঘোষণা দেয় যে তারা ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখবে।
- ইসলামী ফৌজদারি আইন, হুদুদ, শরীয়াহ আদালত কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
ফলাফল: তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো অটুট রাখে, বরং ইসলামী শাসনের দাবিগুলোকে পাশ কাটিয়ে গণতান্ত্রিক আধুনিকতাকে শক্তিশালী করে।
৩. তিউনিসিয়ার আন-নাহদাহ (Ennahda)
আরব বসন্তের পর ২০১১ সালে আন-নাহদাহ পার্টি তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আসে।
কি হয়েছিল?
- শুরুতে ইসলামী শাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তীতে তারা ঘোষণা করে যে তারা “মডারেট ইসলাম” ও “গণতান্ত্রিক ইসলাম” প্রতিষ্ঠা করবে।
- শরীয়াহভিত্তিক আইন প্রণয়ন এজেন্ডা থেকে বাদ দেয়।
ফলাফল
আন-নাহদাহ এক প্রকার সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ত্যাগ করে।
৪. পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী
পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
কি হয়েছিল?
- নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও তারা আজও ক্ষমতায় যেতে পারেনি তার মানেইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ।
- সংবিধানের ভেতরে থেকে কাজ করতে গিয়ে বহু ইসলামী এজেন্ডা ত্যাগ করে সমঝোতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
ফলাফল
পাকিস্তান আজও পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে শরীয়াহ কেবল আংশিকভাবে আছে।
৫. ফিলিস্তিনের হামাস (Hamas)
২০০৬ সালে হামাস গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়লাভ করে গাজায় ক্ষমতায় আসে।
কি হয়েছিল?
- আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পূর্ণ ইসলামী শাসন কায়েম সম্ভব হয়নি।
- হামাসও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে যায় এবং ফাতাহ’র সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল
ফলাফল
গাজায় ইসলামী শাসনের পরিবর্তে রাজনৈতিক বেঁচে থাকার কৌশলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
৬. আলজেরিয়ার ইসলামী সালভেশন ফ্রন্ট (FIS)
১৯৯১ সালে আলজেরিয়ার FIS (Islamic Salvation Front) নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।
কি হয়েছিল?
- তারা পূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিল।
- কিন্তু সেনাবাহিনী ও পশ্চিমা শক্তির চাপে নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া হয়।
- FIS এর নেতারা গ্রেফতার হন এবং দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
ফলাফল
গণতান্ত্রিক পথ চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং আলজেরিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়।
বাস্তবতার সারসংক্ষেপ
১. কোনো ইসলামী দলই গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ইসলামী শাসন (খিলাফাহ) প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
২. ক্ষমতায় গেলে তারা গণতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে এবং ইসলামী শরীয়াহর পূর্ণ বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে।
৩. আন্তর্জাতিক চাপ, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ, এবং পশ্চিমা শক্তির প্রভাব ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
কেন এমন হয়?
- গণতন্ত্র ইসলামী শাসনব্যবস্থার বিপরীত দর্শনে দাঁড়ানো। এখানে সার্বভৌমত্ব মানুষের হাতে, ইসলামে তা আল্লাহর হাতে।
- পশ্চিমা শক্তির হস্তক্ষেপ — কোনো ইসলামী দল গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো কঠোর ব্যবস্থা নেয়।
- সমঝোতার রাজনীতি — ইসলামী দলগুলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে থাকতে গিয়ে ইসলামের মূলনীতি ত্যাগ করে কুফরের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করতে বাধ্য হয়।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ:
ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ আমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটি হলো রাসূল ﷺ যে পদ্ধতিতে মক্কা থেকে মদিনায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই নববী পদ্ধতি।
এটি সংক্ষেপে তিনটি ধাপে বোঝা যায়ঃ
১. দাওয়াহ ও চিন্তাগত সংগ্রাম
রাসূল ﷺ প্রথমে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাস পরিবর্তনের দাওয়াহ দেন। মক্কায় তিনি আকীদাহ ভিত্তিক দাওয়াহ চালিয়ে মানুষের মনে ইসলামের চিন্তাধারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এর মূল কাজ হলো মানুষকে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের সঠিক ধারণা দেওয়া, বিদ্যমান ভুল বিশ্বাস ও মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করা।
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ
“তুমি যা আদিষ্ট হয়েছ তা প্রকাশ্যে ঘোষণা কর।”
(সূরা আল-হিজর: ১৫:৯৪)
২. জনমত সৃষ্টি ও উম্মাহকে প্রস্তুত করা
রাসূল ﷺ মক্কায় সমাজের প্রভাবশালী ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটি জনমত তৈরি করেন যে, কেবল ইসলামই ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা।
এর মূল কাজ হলো মিথ্যা শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক প্রথার অন্যায়গুলো প্রকাশ্যে তুলে ধরা, সমাজে বিকল্প হিসেবে ইসলামের নিজস্ব মডেল তুলে ধরা।
৩. আহলে কুওয়া (ক্ষমতাধরদের) নুসরাহ গ্রহণ
রাসূল ﷺ মক্কায় বহু গোত্রের নেতাদের কাছে গিয়েছিলেন শক্তিশালী সমর্থন (নুসরাহ) চাওয়ার জন্য। অবশেষে আনসার সাহাবারা (আওস ও খাজরাজ) তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেন।
এক্ষেত্রে মূল কাজ হলো সমাজের ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে শক্তির সহায়তা (নুসরাহ) গ্রহণ, যাতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়।(সীরাতে ইবনে হিশাম দ্রষ্টব্যঃ)
وَإِنِ اسْتَنصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ
“আর যদি তারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের কাছে সাহায্য চায়, তবে তোমাদের কর্তব্য তাদের সাহায্য করা।”
(সূরা আনফাল: ৮:৭২)
কী ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ নয়?
- গণতন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করা: কারণ এটি কুফরী ব্যবস্থা।
- সশস্ত্র বিদ্রোহ (অব্যবস্থিত জিহাদ): রাসূল ﷺ কখনো মক্কায় জোর করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেননি।
- সংস্কারবাদী আপস: বিদ্যমান শিরকী ও কুফরী ব্যবস্থাকে মানিয়ে নেওয়া ইসলামের পদ্ধতি নয়।
রাসূল ﷺ বলেছেনঃ
وَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ
“তোমরা আমার সুন্নাহ এবং সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধর।”
(সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪৬০৭)
রাসূল ﷺ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন কুফরী কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে নয়, বরং দাওয়াহ, জনমত সৃষ্টি এবং আহলে কুওয়া (ক্ষমতাশালী জনগোষ্ঠীর) নুসরাহ গ্রহণের মাধ্যমে।
তিনি কখনো মক্কার দারুন নাদওয়া (কুফরী রাজনৈতিক পরিষদ) তে অংশ নেননি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি
- গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আশা ইতিহাসে ব্যর্থ হয়েছে এবং যা শরীয়াহ অনুমোদিত ও নয়।
- ইসলামী আন্দোলনের মূল এজেন্ডা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে গিয়েই দুর্বল ও লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ে।
- রাসূল ﷺ এর পদ্ধতিই একমাত্র পথ: দাওয়াহ, জনমত সৃষ্টি এবং নুসরাহর মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর এক দীর্ঘ হাদীসের শেষে বলেনঃ
“ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةً عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ”
“…তারপর আবার আসবে খিলাফত, যা হবে নবুয়্যতের আদলে।”
দোয়া
اللَّهُمَّ أَرِنَا الْحَقَّ حَقًّا وَارْزُقْنَا اتِّبَاعَهُ، وَأَرِنَا الْبَاطِلَ بَاطِلًا وَارْزُقْنَا اجْتِنَابَهُ.
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে সত্যকে সত্যরূপে দেখাও এবং তা অনুসরণ করার তাওফীক দাও; আর মিথ্যাকে মিথ্যারূপে দেখাও এবং তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দাও।”
আল্লাহর ইচ্ছায় সমাপ্ত।