একটি আদর্শ শাসনব্যবস্থা: গণতন্ত্র না খিলাফাহ — প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, ও কুরআন ও রাসূলের (সা.) মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দিয়েছেন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি, যাঁর মাধ্যমে মানবজাতি এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম পেয়েছে।

বর্তমান দুনিয়ায় মুসলিম উম্মাহর একটি বড় অংশ ইসলামি শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফাহ এবং পশ্চিমা শাসনব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতন্ত্রের পার্থক্য বোঝে না। অনেকে এই দুটি ব্যবস্থাকে মিলিয়ে দেখে, কেউ আবার খিলাফাহকে মধ্যযুগীয় বা অগণতান্ত্রিক ভাবে অপপ্রচার করে। অথচ খিলাফাহ একটি স্বতন্ত্র এবং আল্লাহ-নির্ধারিত শাসনব্যবস্থা, যেখানে সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। বিপরীতে, গণতন্ত্র মানুষের তৈরি একটি পদ্ধতি—যেখানে আইন প্রণয়ন ও শাসনের অধিকার জনগণের হাতে।

এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা কী, এর মূল বৈশিষ্ট্য কীভাবে এটি গণতন্ত্রসহ অন্যান্য শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথক, এবং কেন ইসলাম অনুযায়ী গণতন্ত্র একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা।

গণতন্ত্র কেন একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা

গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা (Democracy & Secularism): আধুনিক গণতন্ত্রের উৎস ইউরোপীয় রেনেসাঁ, তারপরে ১৭শ এবং ১৮শ শতকের আমেরিকান-ব্রিটিশ রাজনৈতিক আন্দোলনে নিহিত। এই কাঠামো ধর্ম ও রাজ্যের পৃথকীকরণ (secularism) থেকে উদ্ভূত, যেখানে শাসন ও আইনের উৎস জনগণ ও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব ধর্ম পুরোটাই ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, রাষ্ট্র ধর্মীয় সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। আইন ও নীতি সম্পূর্ণভাবে মানব তৈরি নিয়মে গঠিত, যা ধর্মীয় বিধির নয় বরং মানব ইচ্ছায় নির্ধারিত।

কিন্তু ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই, কারণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই জীবনের কোনো অংশকে ধর্ম থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ  
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র ধর্ম হলো ইসলাম।”
(সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯)

গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ (Democracy & Nationalism): বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদ বজায় রাখা ও লালন করা হয়। জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রতিটি জাতি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সঙ্গে আবদ্ধ থাকে, যাকে সীমানা বলা হয়। প্রত্যেক জাতি নিজেদের অন্য জাতির তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং এই শ্রেষ্ঠত্ববোধ থেকে তারা অন্য জাতিকে দমন করার চেষ্টা করে। এর ফলস্বরূপ সংঘটিত হয় যুদ্ধ। ফলে গণতান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো পরোক্ষভাবে বিশ্বে ঘৃণা ছড়ায় এবং আধিপত্য বিস্তার করে বেড়ায়। বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে, ইসলামি রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত, কারণ জাতীয়তাবাদ হারাম। রাসূল (সা.) জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন এবং উম্মাহকে তা বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদের বিষয়ে রাসূল (সা.) একটি হাদীসে বলেন:
যে ব্যক্তি জাতীয়তাবাদের আহ্বান জানায়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
(- মুসনাদে আহমদ/আবু দাউদ থেকে বর্ণিত হাদীস)

  1. আইন প্রণয়নের উৎস (Source of Law) এবং সার্বভৌমত্বের (sovereignty) ধারণা:
  • গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’, যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার আধার ও আইনের উৎস।আধুনিক গণতন্ত্রে আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের হাতে, অর্থাৎ মানুষই আইন গঠন করে ।

এর বিপরীতে, ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন। তাঁর এ ক্ষমতায় কোনো অংশীদার বা প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ইসলামী রাষ্ট্রে তিনিই হচ্ছেন মৌলিক আইনের উৎস এবং সকল ক্ষমতার আধার।আল্লাহ বলেন:

“أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ۗ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ”
“إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ…”

“তোমরা জেনে রাখবে, সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র (সেই) আল্লাহরই, আর তিনিই হচ্ছেন সর্বাধিক দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” (সূরা আরাফ ৭:৫৪)”

গণতন্ত্রে জনগণই আইনি অধিকারে অংশ রাখে, যা ইসলামি দৃষ্টিতে “সুবৎ শরীক” ধরা হয়, কেননা শুধু আল্লাহরই আইন প্রণয়নের অধিকার আছে।

ইসলামে আইন প্রণয়নের অধিকার কেবল আল্লাহর। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন:

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ
“যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের আলোকে বিচার করে না, তারা কাফের।” (সূরা মায়েদা: ৪৪)

إِنِ ٱلْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوٓا۟ إِلَّآ إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

নিশ্চয় আইন প্রণয়নের মালিক একমাত্র আল্লাহ্। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ব্যতীত আর কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না। [সূরা ইউসুফ: ৪০]

গণতন্ত্র এই মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখানে মানুষ নিজেই আইন তৈরি করে, হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল বানায়। এই স্বেচ্ছাচারিতা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

  • সেন্স অফ প্লুরালিজম (Pluralism):

এটি হলো এমন এক মানসিকতা যেখানে সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শ, ধর্ম, রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী এক সঙ্গে টিকে থাকতে পারে এবং আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বহুত্ববাদের চেতনা (sense of pluralism) বজায় রাখা হচ্ছে না; বরং বিশ্ব গণতন্ত্রে ইসলাম, মুসলিম এবং তাদের আদর্শিক মানসিকতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করা, মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে নির্যাতন করা, রাসূল (সা.)-এর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি।

এখন প্রশ্ন হল এটি (সেন্স অফ প্লুরালিজম) কি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক?

এখানে দুই দিক থেকে দেখা যায়:

  • ইসলামে ভিন্ন মতের অস্তিত্ব:
    ইসলাম মুসলিম সমাজে আলাদা মত, মাজহাব এবং এমনকি অমুসলিমদের ও (যেমন আহলে কিতাব) নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে—

لَاإِكْرَاهَفِيالدِّينِ
দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” (সূরাবাকারা: ২৫৬)

অতএব, মানুষের নিজস্ব ধর্ম ও মত অনুসরণ করার স্বাধীনতা ইসলামে স্বীকৃত।

  • কিন্তু ইসলামে সীমারেখা আছে:
    ইসলামী রাষ্ট্রে ভিন্ন ধর্ম বা মতের অস্তিত্ব সহ্য করা হয়, কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিধান অস্বীকার বা ইসলাম বিরোধী আইন চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়না। অর্থাৎ, ইসলামে অসীম স্বাধীনতা বা ধর্মনিরপেক্ষ প্লুরালিজম (Pluralism) নেই।

সুতরাং গণতান্ত্রিক প্লুরালিজম (সেটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ ) যেখানে সব মতবাদকে সমানভাবে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, সেটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু অমুসলিমদের নিরাপদে বসবাস, নিজ ধর্ম পালন ও ন্যায্য অধিকার দেওয়া—এ অংশ ইসলামে স্বীকৃত।

নিম্নে কিছু বাস্তব উদাহরনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও ইসলামের সংঘর্ষিকতাকে তুলে ধরা হলো:

১. সমকামীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার সংরক্ষণ

গণতন্ত্রে: LGBTQ+ সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা, তাদের বিয়ে, দত্তক নেওয়ার অধিকার এবং এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের কোটা বা প্রতীক স্থাপন এখন অনেক দেশে বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে।

ইসলামে: সমকামীতা (লাওতী আমল) স্পষ্টত হারাম এবং নূহ (আ.) এর জাতি এ কাজের কারণে ধ্বংস হয়েছিল।

আল্লাহ বলেন:

أَتَأْتُونَ ٱلذُّكْرَانَ مِنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ ﴿١٦٥﴾ وَتَذَرُونَ مَا خَلَقَ لَكُمْ رَبُّكُم مِّنْ أَزْوَٰجِكُم ۚ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ عَادُونَ
তোমরা কি পুরুষের কাছে কামনা পূরণ করো নারীদের ছেড়ে? (সূরা আশ-শু‘আরা: ১৬৫-১৬৬)

২. সুদ (ব্যাংকিং ব্যবস্থা)

গণতন্ত্রে: আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে সুদ (interest) ভিত্তিক ব্যাংকিং বৈধ এবং এটি একটি রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতি। সুদের হার নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং এর ভিত্তিতে ঋণ ও সঞ্চয়ের ব্যবস্থা চলে।

ইসলামে: সুদ (রিবা) কুরআন ও সুন্নাহতে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

আল্লাহ বলেন:

يَمْحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰا۟ وَيُرْبِى ٱلصَّدَقَٰتِ ۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ
আর আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি দেন। [সূরা আল-বাকারা: ২৭৬]

আল্লাহ বলেন:

فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا۟ فَأْذَنُوا۟ بِحَرْبٍۢ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ۖ
“যদি তোমরা তা (সুদ) না ছাড়ো, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৯)

. অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি

গণতন্ত্রে: বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে পর্নোগ্রাফি, নগ্নতা ও অশ্লীলতা প্রকাশকে ‘মতপ্রকাশের অধিকার’ হিসেবে বিবেচনা করে বৈধতা দেওয়া হয়। অনেক দেশেই এগুলোর জন্য বৈধ ও নিয়ন্ত্রিত ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে।

ইসলামে: পর্দা লঙ্ঘন, অশ্লীলতা, ও জিনা সংক্রান্ত যেকোনো কিছু কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَقْرَبُوا۟ ٱلْفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ
তোমরা নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, তা প্রকাশ্য হোক বা গোপন। [সূরা আল-আন’আম: ১৫১]

৪. ধর্মত্যাগ বা ধর্ম পরিবর্তনের স্বাধীনতা

গণতন্ত্রে: অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম পরিবর্তন, এমনকি ইসলাম ত্যাগ করাকেও “ব্যক্তিগত অধিকার” বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেউ ইসলাম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সেটি আইনত বৈধ এবং শাস্তিযোগ্য নয়।

ইসলামে: ইসলাম পরিত্যাগ (রিদ্দা) মারাত্মক অপরাধ। শরীয়াহ অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ত্যাগকারীকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে (যদি সে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয় বা বিদ্রোহ করে)।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

‘مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ
“যে ব্যক্তি তার দ্বীন পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা করো।” (সহীহ বুখারী: ৩০১৭)

৫. অশ্লীল নারীদের “মডেল” বা “বডি পারেড” আইনি স্বীকৃতি

গণতন্ত্রে: অনেক দেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অর্ধনগ্ন ফ্যাশন শো, বিউটি কনটেস্ট, এবং খোলামেলা পোশাককে আইনি অধিকার ও শিল্পের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ইসলামে: নারীদের খোলামেলা পোশাক, বেপর্দা চলাফেরা এবং তাদের দেহকে বাণিজ্যিকভাবে উপস্থাপন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا: … نِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ
“দুই ধরনের জাহান্নামী মানুষ আমি (আমার জীবনে)দেখিনি … এমন কিছু নারী থাকবে যারা পোশাক পরিধান করেও নগ্ন থাকবে…” (সহীহ মুসলিম: ২১২৮)

৬. মাতৃগর্ভে শিশু হত্যা (Abortion)

গণতন্ত্রে: অনেক দেশে গর্ভপাতকে নারীর “স্বাস্থ্যগত অধিকার” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানদেরও হত্যার অনুমতি দেওয়া হয়।

ইসলামে: গর্ভপাত (নিষেধ না থাকলে) শুধুমাত্র নির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণে করা যায় এবং ৪ মাস পর এটা স্পষ্টতই হারাম।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না দারিদ্র্যের আশঙ্কায়… (সূরা আল-আন’আম: ১৫১)

৭. যৌন স্বাধীনতা (Sexual Freedom)

গণতন্ত্রে: প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিতে যেকোনো ধরনের যৌন সম্পর্ক, এমনকি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও আইনত বৈধ (যদি তা জোরপূর্বক না হয়)। “Live-in relationship”, casual dating ইত্যাদি সামাজিকভাবে স্বীকৃত।

ইসলামে: বিবাহ ছাড়া যেকোনো ধরনের যৌন সম্পর্ক জিনা হিসেবে পরিগণিত এবং শরীয়াহ অনুযায়ী তার জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَىٰ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
আর জিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।” (সূরা আল-ইসরা: ৩২)

৮. ইসলাম ও নবীকে অবমাননা “মতপ্রকাশের অধিকার” বলে মনে করা

গণতন্ত্রে: অনেক দেশে নবী মুহাম্মদ ﷺ, কুরআন ও ইসলামী চিহ্ন অবমাননা করাকেও মতপ্রকাশের অধিকার বলে মনে করা হয় এবং সেসব আইনত দণ্ডনীয় নয়।

ইসলামে: নবী অবমাননার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সাহাবাগণ এমন দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছনা রয়েছে।
(সূরা আহযাব: ৫৭)

১০. শরীয়া আইনকে “Radicalবা সন্ত্রাসীঘোষণা করা

গণতন্ত্রে: অনেক দেশে শরীয়া আইনের প্রচার, বিশেষ করে শরীয়াহ অনুযায়ী শাস্তির কথা বলা (যেমন: চোরের হাত কাটা, ব্যভিচারীর শাস্তি) সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থা (extremism) হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইসলামে: এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত বিধান, যা মানবজাতির শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রণীত।

আল্লাহ বলেন:

وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“চোর, পুরুষ ও চোর, নারী—তাদের হাত কেটে দাও; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি…

(সূরা আল-মায়িদা: ৩৮)

১১. নারীদের পুরুষের সমতুল্যঘোষণা করে সমস্ত যৌন পার্থক্য বিলোপ

গণতন্ত্রে: “Gender equality” এর নামে অনেক দেশে নারীদেরকে জোরপূর্বক পুরুষের মতো সব কাজ করতে বাধ্য করা হয়, এমনকি পুরুষদের সেনাবাহিনীতে, খনি বা যুদ্ধক্ষেত্রেও পাঠানো হয়।

ইসলামে: নারী ও পুরুষের নিজ নিজ ভূমিকাকে সম্মান করা হয়। ইসলাম নারীর মর্যাদা রক্ষা করে তার জন্য আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা বিধান দিয়েছে।

আল্লাহ বলেন:

ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَآ أَنفَقُوا۟ مِنْ أَمْوَٰلِهِمْ
“পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক, কারণ আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন…”
(সূরা আন-নিসা: ৩৪)

১২. বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানের বৈধতা ও উত্তরাধিকার অধিকার

গণতন্ত্রে: “Illegitimate children” বা বিবাহ বহির্ভূত সন্তানের আইনি বৈধতা ও উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। সন্তান পিতা-মাতার বিবাহ ছাড়া জন্ম নিলেও তাকে সমান অধিকার দেওয়া হচ্ছে।

ইসলামে: এ ধরনের সন্তান শরীয়তের দৃষ্টিতে পিতার নাম বা সম্পত্তিতে অধিকার পায় না। সমাজে জিনার দৃষ্টান্ত বন্ধ করতে ইসলাম এ বিধান দিয়েছে।

রাসূল ﷺ বলেন:

الْوَلَدُ لِلْفِرَاشِ وَلِلْعَاهِرِ الْحَجَرُ
“শয্যা (বিবাহিত সম্পর্ক) সন্তানের জন্য, আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর (শাস্তি)।” (সহীহ বুখারী: ৬৭৭২)

১৩. প্রাইড মান্থLGBTQ+ শিক্ষাকে স্কুলে বাধ্যতামূলক করা

গণতন্ত্রে: যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপসহ বহু দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের “gender identity”, “same-sex family” বা “drag queen story hour” ইত্যাদি শেখানো হয়। মুসলিম পরিবারের শিশুরাও এসব পাঠে বাধ্য।

ইসলামে: এ ধরনের শিক্ষা বেহায়াপনায় উৎসাহ দেয় এবং শিশুদের ফিতরাহ নষ্ট করে।

রাসূল ﷺ বলেন:

كُلُّ وَلَدٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ
“প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাহ (প্রাকৃতিক স্বভাব) অনুযায়ী জন্ম নেয়…” (সহীহ মুসলিম: ২৬৫৮)

১৪. ধর্মীয় (Islamic) অনুভূতিকে আইনগতভাবে অপরাধ না ধরা

গণতন্ত্রে: যেকোনো ধর্মের উপাস্য, ধর্মীয় প্রতীক বা নবীকে ব্যঙ্গ করে কেউ “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” দাবি করলে তা অনেক রাষ্ট্রে বৈধ। যেমন: ফ্রান্সে মুহাম্মদ ﷺ এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ।

ইসলামে: এটি স্পষ্ট কুফরি এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

আল্লাহ বলেন:

وَإِذَا سَمِعُوا۟ مَا أُنزِلَ ٱللَّهُ يَسْتَہْزِئُونَ بِہِۦ فَلَا تَقْعُدْ مَعَهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا۟ فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِۦ ۚ إِنَّكَ إِذًا مِّثْلُهُمْ
“তারা যখন শুনে যে আল্লাহর আয়াত নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে, তখন তাদের সঙ্গে বসো না…”
(সূরা আন-নিসা: ১৪০)

১৫. পর্দাহীনতা ও পোশাকের স্বাধীনতা আইন

গণতন্ত্রে: অনেক দেশে “freedom of dress” বা “bodily autonomy” নামক ধারণার আওতায় নারীরা যেকোনো ধরনের পোশাক পরতে পারে—even নগ্ন হওয়ার স্বাধীনতা দাবি করে। অনেক দেশে হিজাব নিষিদ্ধও করা হয়েছে (যেমন: ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি)।

ইসলামে: নারীদের জন্য নির্ধারিত পোশাকের নিয়ম রয়েছে। পর্দা করা ফরজ এবং বেহায়াপনা হারাম।

আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ…
“হে নবী! মুমিন নারীদের বলো যেন তারা তাদের জামার ওপর অতিরিক্ত চাদর (জিলবাব) পরিধান করে…” (সূরা আহযাব: ৫৯)

১৬. পতিতাবৃত্তি (Prostitution) বৈধতা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ

গণতন্ত্রে: নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, থাইল্যান্ড, কানাডা প্রভৃতি দেশে যৌনকর্ম (sex work) আইনি ও করযোগ্য পেশা হিসেবে বিবেচিত।বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশেও আইন দ্বারা যৌনকর্ম বৈধ করা হয়েছে এবং সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে যে যৌনকর্মীদের সাধারণ শ্রমিকের মতোই ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

ইসলামে: এটি জঘন্য হারাম। পতিতাবৃত্তির ব্যবসা করা, পরিচালনা করা কিংবা অনুমোদন দেওয়া সবই কবিরা গুনাহ।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تُكْرِهُوا۟ فَتَيَٰتِكُمْ عَلَى ٱلْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَزْكِيَّهَاۥ وَٱلَّٰهُ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًۭا
“আর তোমরা তোমাদের দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করো না, যদি তারা পবিত্র থাকতে চায়…”
(সূরা নূর: ৩৩)

১৭. কুকুর ও শূকরের মাংস খাওয়ার আইনগত বৈধতা

গণতন্ত্রে: পশ্চিমা অনেক দেশে কুকুর, শূকর বা যেকোনো প্রাণীর মাংস খাওয়া বৈধ এবং তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় করা হয়।

ইসলামে: শূকর ও মৃত পশুর মাংস হারাম। কুকুর ও অপবিত্র বলে বিবেচিত।

আল্লাহ বলেন:

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ …
“তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের মাংস…” (সূরা আল-মায়িদা: ৩)

১৮. পিতৃ-মাতৃ পরিচয় নির্ধারণে মায়ের নামকিংবা নিরপেক্ষ পরিচয়ব্যবহারের প্রচলন

গণতন্ত্রে: কিছু রাষ্ট্রে (যেমন: সুইডেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া) শিশুদের শুধু “guardian” হিসেবে মা বা অন্য কেউ নির্বাচন করতে পারে, এবং সন্তানের “father” পরিচয় আইনি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় না।

ইসলামে: সন্তান পিতার নামেই পরিচিত হবে; মিথ্যা পরিচয় কিয়ামতের দিনে গোনাহর কারণ হবে।

রাসূল ﷺ বলেন:

عَرَّفُوا أَنفُسَكُمْ بِأَبَوَاتِكُمْ فَإِنَّهُ أَحَقُّ بِأَنْ يَعْرِفَكُمْ اللَّهُ
“তোমরা নিজেদেরকে নিজেদের পিতার নামে পরিচিত করো, কেননা এটি আল্লাহর কাছে অধিক ন্যায়সঙ্গত।” (সহীহ বুখারী: ৩৫১০)

১৯. সমকামিতাকে উৎসাহ দেওয়া ও গর্ভধারণে সক্ষম পুরুষতত্ত্ব

গণতন্ত্রে: পশ্চিমা অনেক দেশে এমন শিক্ষা চালু হয়েছে যে, পুরুষ ও সন্তান ধারণ করতে পারে (যদি সে নিজেকে নারী হিসেবে দাবি করে)। এছাড়া “pregnant man emoji” ও “trans men birthing” কে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।

ইসলামে: এগুলো ফিতরাহ বিরোধী এবং জাহিলিয়াত যুগের চেয়েও নিচু স্তরের কুফরি।

রাসূল ﷺ বলেন:

مَنْ جَامَعَ ذَكَرًا فِي نَفْسِ الذَّكَرِ نَزَلَ عَلَيْهِ غَضَبُ اللَّهِ
“পুরুষরা যখন পুরুষের সঙ্গে এবং নারীরা নারীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে, তখন আল্লাহর গজব নেমে আসে।” — (মুসনাদে আহমদ)

২০. ইসলাম বিদ্বেষমূলক কার্টুন বা চিত্র প্রদর্শনের স্বাধীনতা (Blasphemy Laws Exemption)

গণতন্ত্রে: ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স ও সুইডেনে ইসলামবিদ্বেষী ব্যঙ্গচিত্র আঁকা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” হিসেবে বৈধ। এমনকি এই কার্টুনগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে।

ইসলামে: এটি মহানবী ﷺ এর অবমাননা এবং স্পষ্ট কুফরি। মুসলিমদের জন্য তা সহ্য করা বা এই ব্যাপারে উদাসীন থাকা হারাম।

আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের উপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর লা’নত আছে।”
(সূরা আহযাব: ৫৭)

নির্বাচন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র নামে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্রান্ত করা:

আজকের মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রকে ইসলামের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। ভোট, নির্বাচন, গণমত—এইসব শব্দকে ইসলামী মূল্যবোধ বলে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিজে গণতন্ত্র নয়; বরং এটি গণতন্ত্রে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম মাত্র। যে কোনো শাসন ব্যবস্থাই তাদের নেতা বা শাসক বাছাইয়ের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। গণতন্ত্র,  সাম্যবাদ এমনকি ইসলামী শাসন ব্যবস্থাতে ও নির্বাচন একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই ‘নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র’—এমন বলা চরম অজ্ঞতার পরিচায়ক। বাস্তবে, গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যা মানুষকে আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে নিজেদের তৈরি আইনের অধীনে পরিচালিত করে। এটি কেবল অজ্ঞতা নয়, বরং এক বিপজ্জনক বিপথগামিতা।

পরিশেষে একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র একটি কুফরী শাসনব্যবস্থা। এটি এ কারণে নয় যে, এটি মানুষকে শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। কারণ এটি প্রকৃত অর্থে মূল আলোচ্য বিষয়ও নয়। বরং, এটি এ কারণে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তিই হলো মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, স্বাধীনতা (Freedom) এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব।

খিলাফাহ একটি আদর্শ শাসনব্যবস্থা

খিলাফাহ: সংজ্ঞা ও ভিত্তি

খিলাফাহ বলতে বোঝায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার নেতৃত্ব দেয় একজন খলীফা। এই খলীফা নিযুক্ত হন মুসলিম উম্মাহর বাই‘আত বা আনুগত্যের মাধ্যমে। খলীফা নিজে আইনপ্রণেতা নন; বরং তিনি আল্লাহর আইন—কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস—অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করেন।

আল্লাহ তা’আলা রাসূল (সা.)-কে মানুষের মাঝে তাঁর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করার নির্দেশ দিয়েছেন:

فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ…

“অতএব, তাদের মধ্যে বিচার করো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা এবং তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না, যা তোমার কাছে সত্য এসেছে তা থেকে বিচ্যুত হয়ে…” [সূরা মায়েদাহ: ৪৮]। “আর তাদের মধ্যে বিচার করো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা এবং তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না, আর তাদের থেকে সতর্ক থাকো যেন তারা তোমাকে আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো কিছু থেকে বিচ্যুত করতে না পারে।” [সূরা মায়েদাহ: ৪৯]।

যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের আলোকে বিচার করে না, তারা কাফের। (সূরা মায়েদা: ৪৪)

এই নির্দেশগুলো উম্মতের জন্যও প্রযোজ্য, যা শরিয়া বাস্তবায়নের জন্য খলিফার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে, কারণ শরিয়া বাস্তবায়ন একজন ক্ষমতাসীন শাসক ছাড়া সম্ভব নয়।

(من مات وليس في عنقه بيعة مات ميتة جاهلية)
“যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যায়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যু বরণ করে”

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার জন্য কোনো যুক্তি থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইয়াত ছাড়া মারা যায়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যু বরণ করে।” [সহীহ মুসলিম ১৮৫১, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৬৭৪, সহীহাহ ৯৮৪, সহীহ আল জামি’ ৬২২৯]।

এই হাদিসটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একজন স্বীকৃত ইমাম বা খলিফার বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) এর আবশ্যকতা নির্দেশ করে। জাহিলিয়াতের মৃত্যু বলতে ইসলামী নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় মৃত্যুকে বোঝায়, যা অত্যন্ত গুরুতর। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মুসলিমদের জন্য একটি সুসংগঠিত ও স্বীকৃত নেতৃত্বের অধীনে থাকা অপরিহার্য, যা তাদের বিশৃঙ্খলা ও অনৈসলামিক জীবনযাত্রা থেকে রক্ষা করে । বাইয়াত ছাড়া মৃত্যুবরণকে জাহিলিয়াতের মৃত্যুর সাথে তুলনা করা একটি গুরুতর সতর্কবাণী। জাহিলিয়াত হলো বিশৃঙ্খলা, আইনহীনতা এবং ঐশী নির্দেশনার অনুপস্থিতির একটি অবস্থা। যদি বাইয়াত ছাড়া মৃত্যুবরণ এই অবস্থার সমতুল্য হয়, তবে এর অর্থ হলো একজন মুসলিমের জন্য ইসলামী অবস্থায়, সঠিক নির্দেশনা ও শৃঙ্খলার অধীনে মৃত্যুবরণ করতে হলে বাইয়াত (এবং যার কাছে বাইয়াত করা হয়, সেই ইমাম/খলিফা) অপরিহার্য। এটি খিলাফতের আবশ্যকতাকে একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার স্তরে উন্নীত করে, যা প্রতিটি মুসলিমের আধ্যাত্মিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে।

ইমাম ঢালস্বরূপ” (إنما الإمام جنة)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “ইমাম তো ঢালস্বরূপ, যার পিছনে যুদ্ধ করা হয় এবং যার দ্বারা আত্মরক্ষা করা হয়। যদি তিনি আল্লাহর তাকওয়া অনুযায়ী আদেশ করেন এবং ন্যায়বিচার করেন, তবে এর জন্য তিনি পুরস্কার পাবেন। আর যদি এর বিপরীত করেন, তবে তার উপর এর দায়ভার বর্তাবে।” [সহীহ মুসলিম ১৮৫৯, সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী) ৪৬৮৭ [১৮৫১], সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ]।

এই হাদিসটি ইমাম বা খলিফার অপরিহার্য ভূমিকা তুলে ধরে। তিনি মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এবং শরিয়া বাস্তবায়নের জন্য ঢালস্বরূপ। ঢাল যুদ্ধের সময় সুরক্ষা এবং সংহতি বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। এর অনুপস্থিতি দুর্বলতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, খিলাফত কেবল একটি কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা নয়, বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার জন্য একটি অত্যাবশ্যক, অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, যা ছাড়া তারা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকার হুমকির মুখে পড়ে। এটি খিলাফতের বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকে ধর্মীয় আবশ্যকতায় রূপান্তরিত করে ।

আমার পরে বহু খলিফা হবে” (وسيكون خلفاء فيكثرون)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “বনী ইসরাঈলকে নবীরা শাসন করতেন। যখন একজন নবী মারা যেতেন, আরেকজন তার স্থলাভিষিক্ত হতেন। আমার পরে কোনো নবী নেই, তবে খলিফা হবে এবং তারা অনেক হবে।” সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন: “আপনি আমাদেরকে কী নির্দেশ দেন?” তিনি বললেন: “প্রথমজনের পর প্রথমজনের বাইয়াত পূর্ণ করবে, তাদের অধিকার দেবে। কেননা আল্লাহ তাদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।” [সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, অধ্যায়: বনী ইসরাঈল, হাদিস ৩২৬৮]।

এই হাদিসটি রাসূল (সা.)-এর পরে খিলাফতের ধারাবাহিকতা এবং বহু খলিফার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে খিলাফত একটি চলমান প্রতিষ্ঠান যা খোলাফায়ে রাশেদীনের পরেও টিকে থাকবে। “বহু খলিফা হবে” এবং “প্রথমজনের পর প্রথমজনের বাইয়াত পূর্ণ করবে” এই নির্দেশনাবলী নেতৃত্বের একটি ধারাবাহিক শৃঙ্খলার ধারণাটিকে আরও শক্তিশালী করে। এটি এই ধারণাকে খণ্ডন করে যে খিলাফত একটি অস্থায়ী ঘটনা ছিল যা কেবল প্রাথমিক ইসলামী সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি উম্মাহর মধ্যে নেতৃত্বের একটি চিরন্তন প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে, এমনকি যদি সেই শাসনের প্রকৃতি নবুয়তি পদ্ধতির মতো আদর্শ নাও হয়।

কোনটি আদর্শ শাসনব্যবস্থা?

উপরের দীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খিলাফাহ একটি শাসন ব্যবস্থা হিসেবে কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটি কেবল আদর্শ শাসন ব্যবস্থাই নয়, বরং প্রতিটি মুসলিমের জন্য খিলাফাহর অধীনে জীবন যাপন করা ফরজ বা আবশ্যিক।

খিলাফাহ এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, অমুসলিমদের জন্যও ন্যায়, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। অপরদিকে, গণতন্ত্র অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করে। তদুপরি, এর ভিত্তিই মানুষের ইচ্ছা—যা পরিবর্তনশীল, সীমাহীন এবং কখনো কখনো চরম অবিচারপ্রবণ।

সিদ্ধান্ত:

গণতন্ত্র মানুষকে আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়, ফলে মানবীয় সীমাবদ্ধতা ও খেয়াল-খুশির ভিত্তিতে বহু আইন শরীয়াহর বিরুদ্ধে গঠিত হয়।গণতন্ত্র একটি কুফরী ভিত্তিক, মানবসৃষ্ট ও পরিবর্তনশীল শাসনব্যবস্থা যা শরীয়াহর মৌলিক ধারণার বিপরীত।
বিপরীতে, খিলাফাহ শাসনব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর বিধানকে চূড়ান্ত আইন হিসেবে গ্রহণ করে, যা মানুষ ও সমাজ উভয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

খিলাফাহ একটি স্বতন্ত্র, আল্লাহ-নির্ধারিত শাসনব্যবস্থা যা ন্যায়, হেদায়াত এবং মানবকল্যাণের প্রকৃত মানদণ্ড।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّـَٰٔتِهِمْ وَأَجْرَهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ ۚ وَكَانَ رَبُّهُمْ غَفُورًا رَّحِيمًا
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং তাদের জন্য তার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান প্রস্তুত আছে; কারণ তিনি দয়ালু ও করুণাময়।” (সূরা নূর: ৫৫)

وَعْدَ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مِنكُمْ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُم فِي ٱلْأَرْضِ كَمَا ٱسْتَخْلَفَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ ٱلَّذِي ٱرْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِى لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْـًٔا
“আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তাদের প্রতি যারা তোমাদের মধ্যে ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, যে তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন, যেমন তিনি পূর্ববর্তী জাতিগুলোকেও দান করেছিলেন। তিনি তাদের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন, যা তিনি মুমিনদের জন্য পছন্দ করেছেন, এবং তাদের ভয়কে পরিবর্তে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না।” (সূরা নূর: ৫৬)

গণতন্ত্র ইসলামি শরিয়াহ আইনকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এবং এর অবস্থান ইসলামের বিরুদ্ধে। সুতরাং একজন মুসলিম গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে পারে না; বরং তাদের উচিত শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা।

হে আল্লাহ, আমাদেরকে সত্য বুঝার তৌফিক দান করো এবং ইসলামকে পরিপূর্ন দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করবার দৃঢ় ঈমান দান করো, আমীন।

আল্লাহ’র ইচ্ছায় সমাপ্ত

Leave a Reply