উত্তর আধুনিকতাবাদে ইসলামী উম্মাহ

পোস্টমডার্নিজম (তথা উত্তরাধুনিকতাবাদ)-এর আবির্ভাব ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের পটভূমিতে ঘটে। আধুনিকতার ব্যর্থতা—যেমন দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের উত্থান, উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতা (যেমন আলজেরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ), এবং শ্রেণী বৈষম্য—এই সকল বিষয়ে হতাশা থেকেই পোস্টমডার্ন সমালোচনার উদ্ভব ঘটে। মিশেল ফুকো ও জ্যাক দেরিদার মতো চিন্তাবিদগণ আধুনিকতার রৈখিক অগ্রগতির দাবি ও যুক্তির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং এর পরিবর্তে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার আপেক্ষিকতার উপর জোর দেন।

পোস্টমডার্নিজম প্রথমে পশ্চিমা বিশ্বের সার্বজনীন দাবিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠলেও, পরবর্তী সময়ে কিছু চিন্তাধারার পক্ষ থেকে তা ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনকে খাটো করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচয় ও ঐতিহ্যকে “গঠিত” বা “আবিষ্কৃত” বলে দাবী করার মাধ্যমে, পোস্টমডার্ন চিন্তা ইসলাম ও তার চর্চাকে অবৈধ ও মনগড়া হিসেবে উপস্থাপন করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

সালমান সাইয়্যিদ তার বই Recalling the Caliphate-এ উল্লেখ করেন, একটি সাধারণ পোস্টমডার্ন কৌশল হচ্ছে ইসলামিজম (এখানে ইসলামি রাজনীতির ধারণা বোঝানো হয়েছে)-কে একটি “কল্পিত আসল ইসলাম”-এর মনগড়া নির্মাণ হিসেবে চিত্রায়িত করা:

“Islamism is presented as being a discourse ‘conjured’ around a fantasy of an authentic essence (al-Azmeh, 1993:7) … cultural forms such as ‘Islamic dress’ or ‘Islamic way of life’ are recent inventions and not the recovery of sacral traditions (1993:21) … The effect of arguments like this is to try and discredit Islamist claims for being legitimate expressions of a Muslim desire for autonomy and deep decolonisation of the world.”

“অর্থাত, ইসলামিজমকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন এটি একটি কল্পিত ‘প্রকৃত সত্তা’ বা ‘আসল ইসলাম’ ধারণার চারপাশে গঠিত একটি কৃত্রিম বর্ণনা (আল-আযমি, ১৯৯৩: ৭)। অর্থাৎ, ইসলামপন্থীরা যে ইসলামকে ‘প্রকৃত’ বলে দাবি করেন, তা মূলত একটি গঠিত ও রূপান্তরিত ঐতিহ্য, যা ইসলামের প্রকৃত বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। একইভাবে, ‘ইসলামি পোশাক’ বা ‘ইসলামি জীবনধারা’-র মতো সাংস্কৃতিক রূপগুলোকে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ না বলে বরং আধুনিক সময়ে গঠিত নতুন উদ্ভাবন হিসেবে দেখানো হয় (১৯৯৩: ২১)। এই ধরনের ধারণার উদ্দেশ্য হলো ইসলামপন্থীদের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করা—যাতে তাদের দাবি মুসলিমদের স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বজুড়ে গভীর উপনিবেশমুক্তির একটি ন্যায্য ও বৈধ প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য না হয়।“

এই ধরনের পোস্টমডার্ন আক্রমণ মূলত ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে সেক্যুলার পথে অগ্রসর না হওয়ার কারণে করা হয়েছে। সালমান সাইয়্যিদ লিখেছেন:

“As late as the last quarter of the twentieth century… Not only has Islam failed to follow the trajectory pursued by variants of Christianity… but it has, in contrast, forcefully reasserted its public presence in the world.”

অর্থ্যাৎ, বিংশ শতকের শেষ চতুর্থাংশ পর্যন্তও… ইসলাম কেবল খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন ধারার অনুসৃত পথ অনুসরণে ব্যর্থই হয়নি… বরং তার বিপরীতে, বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রকাশ্য উপস্থিতিকে দৃঢ়ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।“

এই “মনগড়া ঐতিহ্য” হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামের চিত্রায়ন আরও গভীরে গিয়ে এমনকি “ইসলাম” শব্দেরই বৈধতা এবং “উম্মাহ’র মতো ধর্মীয় ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। সালমান সাইয়্যিদের ভাষায়, এটি একটি “metaphysics of suspicion মানে, সন্দেহের অধিবিদ্যা”—যার মাধ্যমে ইসলামকে এতটাই বৈচিত্র্যময় ও খণ্ডিত বলা হয় যে, একে আর ঐক্যবদ্ধ কোনো সত্তা হিসেবে রাখা যায় না। ফলে মুসলিম উম্মাহ ধারণাটিও খণ্ডিত জাতীয়তা ও মতবাদে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই প্রচেষ্টাগুলো আসলে কিসের জন্য? প্রফেসর জোসেফ জে. কামিনস্কি তার বই Islam, Liberalism, and Ontology-তে বলেন:

“The rendering of Islam as an incoherent category ultimately subjects its meaning to the whims of hostile hegemonic actors and brute force… Approaches such as El Zein’s ultimately remove agency from Muslims—they are robbed of their ability to control how their own religious discourse is defined… this is imperialism par excellence.”

অর্থাৎ, ”ইসলামকে যদি বিভ্রান্তিকর ও অস্পষ্ট একটি ধারণা হিসেবে দেখানো হয়, তাহলে এর অর্থ কী হবে—তা ঠিক করে দেয় শত্রুভাবাপন্ন ক্ষমতাধর গোষ্ঠী ও জবরদস্তি করে চলা শক্তিগুলো। এল জেইনের মতো চিন্তাধারা এমনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করে যে, এতে মুসলিমদের নিজেদের ধর্ম নিয়ে কথা বলার ও তা ব্যাখ্যা করার অধিকারটাই যেন কেড়ে নেওয়া হয়। তারা আর ঠিক করতে পারে না, তাদের ধর্মের কথা কীভাবে উপস্থাপিত হবে। এটিই হচ্ছে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ।“

ইসলামকে অস্পষ্ট করে উপস্থাপন করার ফলে পশ্চিমা শক্তি বা সেক্যুলার চিন্তাবিদরা ইসলামের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিতে পারে। তারা নির্ধারণ করতে পারে কোন ইসলামি চর্চা গ্রহণযোগ্য আর কোনটি চরমপন্থা।

উম্মাহ ধারণাটিকে কেবল একটি ভাষাগত নির্মাণ বলে চিহ্নিত করে, মুসলিম সংহতিকে দুর্বল করা হয়। এতে মুসলিমরা বিভক্ত হয় জাতীয়তাবাদী বা মতবাদভিত্তিক গোষ্ঠীতে, এবং খিলাফাহর মতো ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নে অক্ষম হয়ে পড়ে।

মুসলমানদের করণীয় হচ্ছে, তাদের ধর্মকে অন্যের দ্বারা সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ না দিয়ে, নিজেদের ঐতিহ্যের সাথে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়া। অধ্যাপক তালাল আসাদ তার প্রবন্ধ The Idea of an Anthropology of Islam-এ লেখেন:

“…one should begin, as Muslims do, from the concept of a discursive tradition that includes and relates itself to the founding texts of the Qur’an and the Hadith.”

“…একজনের উচিত মুসলমানদের মতো করে শুরু করা—একটি বাগ্মীয় ধারার (discursive tradition) ধারণা থেকে, যা কুরআন ও হাদীসের প্রাথমিক পাঠসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।”

ইসলাম, নিঃসন্দেহে, আল্লাহ্‌ ﷻ প্রদত্ত দ্বীন এবং এটি পূর্ণতা লাভ করেছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মাধ্যমে প্রেরিত চূড়ান্ত রিসালাহর মধ্য দিয়ে।

আল্লাহ্‌ ﷻ বলেন,

ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَـٰمَ دِينٗا

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, আমার অনুগ্রহ তোমাদের ওপর সম্পন্ন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়েদাহ ৩]

যারা আল্লাহ্‌ ﷻ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এ ঈমান এনেছে, তারাই মুসলিম এবং একক উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ্‌ ﷻ বলেন,

إِنَّ هَـٰذِهِۦٓ أُمَّتُكُمۡ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ وَأَنَا۠ رَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُونِ

“নিশ্চয়ই তোমাদের এই উম্মাহ একক উম্মাহ, আর আমি তোমাদের প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা আমারই এবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া ৯২]

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

«بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ ﷺ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ مِنْ قُرَيْشٍ وَيَثْرِبَ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ، وَلَحِقَ بِهِمْ، وَجَاهَدَ مَعَهُمْ، أَنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُونِ النَّاسِ»

রহমান ও রহিম আল্লাহ্‌র নামে। এ দলিল মুহাম্মদ ﷺ-এর পক্ষ থেকে কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুসলিম ও মুমিনদের মাঝে, এবং যাঁরা তাঁদের অনুসরণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে একত্রিত হয়েছেন ও তাঁদের সঙ্গে জিহাদ করেছেন—তাঁরা একক উম্মাহ, অন্য সকল মানুষের থেকে পৃথক।” (আল-বাইহাকি, আস-সুনান আল-কুবরা)

একক উম্মাহর স্বীকৃতি ও ইসলামের সত্যতার উপর ভিত্তি করে, মু’মিনগণ তাদের সম্মিলিত ফর্‌যে কিফায়াহ আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালাতে পারে—একক ইমারাহ, ইমামাহ ও খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার জন্য, যা আল্লাহ্‌ ﷻ অবতীর্ণ সকল বিষয় অনুযায়ী শাসন করবে।

তামিম আদ-দারি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন উমর (রা.)-এর সময় লোকে উঁচু ভবন নির্মাণে প্রতিযোগিতা শুরু করে, তখন দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) বলেছিলেন:

«يا معشر العرب، تمسكوا بالأرض، فإنه لا إسلام إلا بجماعة، ولا جماعة إلا بإمارة، ولا إمارة إلا بطاعة، فمن ولي من أمر الناس شيئاً على فقه كان له ولهم، ومن ولي على غير فقه كان عليه وعليهم»

“হে আরবগণ, জমিনে দৃঢ় থাকো! কারণ, কোনো জামাআত ছাড়া ইসলাম নেই, কোনো ইমারত ছাড়া জামাআত নেই, কোনো আনুগত্য ছাড়া ইমারত নেই। যে ফিকহ (তথা পোড় খাওয়া অর্থাৎ ইসলামের অভিজ্ঞতায়) সমৃদ্ধ, তাকে নেতা বানানো হলে তা তার ও তাদের (জনগণের) জন্য কল্যাণকর; আর যে ফিকহ (তথা পোড় খাওয়া অর্থাৎ ইসলামের অভিজ্ঞতায়) সমৃদ্ধ না, তাকে দায়িত্ব দিলে তা তার ও তাদের জন্য ধ্বংসকারী।” (আল-দারিমি)


Leave a Reply