গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে শীতকাল একটি অল্প সময়ের বিষয় এবং এ সময়কালে যেমন কিছু সহজ বাস্তবতা রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছু কষ্টসাধ্য বাস্তবতা। বিশেষ করে ঈমানদারদের এ সময়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেমন, সালাতের সময়ে পরিবর্তন। রাত গড়াতে শুরু করলে ঈশার সালাত পড়া অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, একইভাবে ঘুম থেকে উঠে ফজর সালাত পড়াও অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য হয়। আবার, জোহর, আসর ও মাগরিবের সালাতের মাঝের ব্যবধান এতই কমে আসে যে একটু দেরি করলেই অনেকের জন্য সালাত কাযা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এর বাইরে শীতের তীব্রতায় ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল কিংবা ওযু করাটিও কষ্টকর কাজ।
তবে লড়াই যত কঠিন, এর পুরস্কারও তেমন ব্যাপক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে—সংকটকালীন দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত তাবরানি: ১৪১৪)। উমর (রা.) তাঁর ছেলের উদ্দেশে বলেন, ‘শীতের দিনে ভালোভাবে অজু করা বড় গুরুত্বপূর্ণ ও সওয়াবের কাজ।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কাজের কথা বলব না! যা দ্বারা গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়?’ সাহাবিরা বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল!’ তিনি বললেন, ‘মন না চাইলেও অজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’ (মুসলিম)।
একইভাবে শীতকালের সকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাত্রিতে একজন ঈমানদার আল্লাহর দ্বীনের জন্য, দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য, ইসলামকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকলক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করার দাবির যে সুমহান দাওয়াত তা পৌঁছিয়ে দেওয়ার স্বার্থে যেকোনো দৌড়ঝাপ তথা যেকোনো কষ্টসাধ্য কাজই করুক না কেন তার পুরস্কারও ঠিক সেরকমই বিশাল হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সকল কাজ পর্যবেক্ষন করেন।
আবার যদি মুদ্রার অপর পিঠে আসি তবে শীতের কিছু সহজ বাস্তবতায়ও রয়েছে। তবে এ বাস্তবতা কি ঈমানদারের প্রয়োজন নাকি প্রয়োজন ছাড়াই বাড়তি প্রাপ্তি?
উমর (রা) বলতেন:
الشتاء غنيمة العابدين
[আশ-শিতা-উ গনীমাতুল ’আ-বিদীন]
“শীতকাল ইবাদতকারীদের জন্য গনীমতসরূপ”
যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে আরবীতে গনীমত বলা হয়। গনীমত একজন ঈমানদার সৈনিকের জন্য অতিরিক্ত প্রাপ্তি। একে আনফালও বলা হয়ে থাকে (যা নফল বা অতিরিক্ত থেকে এসেছে) অর্থাৎ, এটি অতিরিক্ত প্রাপ্তি। ঈমানদার গনীমতের জন্য যুদ্ধ করে না। বরং ঈমানদার লড়াই করে ইসলামের পতাকাকে তুলে ধরার জন্য, আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চ করার জন্য, এবং এর বদলে সে আখিরাতের পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা করে, বৈষয়িক ব্যক্তিগত কোনো প্রাপ্তি সে আশা করে না। সুতরাং, একজন মুমিনের জন্য গনীমত অতিরিক্ত প্রাপ্তি বৈ আর কিছু নয়।
যথার্থই, শীতকালে রাতগুলো দীর্ঘ ও দিনগুলো ছোট এবং রাতে কিয়াম করা খুবই সহজতর। যেহেতু রাত দীর্ঘ, কিছুটা ঘুমিয়েও কিয়াম উল-লাইল করা যায়। আর যারা ঘুমোতে চান না তাদের জন্য কিয়াম করার জন্য রয়েছে রাতের দীর্ঘ সময়।
এছাড়াও, দিনগুলো ছোট, তাই সিয়াম পালন করা সহজতর। অল্প সময়কাল রোজা রেখেও একজন পুরো একটি রোজার আজর বা পুরষ্কার পায়।
একজন খুশূ’প্রাপ্ত ঈমানদারের জন্য গ্রীষ্মকালের রাতে সালাত আদায় করা কঠিন কিছু নয়, যদিওবা রাত্রিগুলোর ব্যপ্তি ছোট এবং ঘুমের সময় অল্প। একজন বিশ্বাসী ঠিকই তার সময় বের করে নেয়। একইভাবে, একজন ঈমানদারের জন্য গ্রীষ্মকালের দীর্ঘ ও উত্তপ্ত দিনগুলোয় রোজা রাখা গুরুতর কিছু নয়। মু’আজ বিন জাবাল (রা) বলতেন: ’হে আল্লাহ আমি এই জন্য বেঁচে থাকতে চাই না যে আমি দুনিয়া চাই। বরং আমি এই জন্য বেচে থাকতে চাই যাতে আমি গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনগুলোতে রোজা রাখতে পারি এবং শীতের দীর্ঘ রাতগুলোতে কিয়াম করতে পারি।’ শীতকাল আগমন করলে উবাঈদ বিন উমাঈর (রা.) বলতেন, ‘হে কুরআনের ধারক! তোমাদের রাতগুলো তিলাওয়াতের জন্য প্রলম্বিত করা হয়েছে, অতএব তা পড়তে থাকো। আর রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনগুলো সংক্ষেপিত করা হয়েছে, তাই বেশি বেশি রোজা রাখো।’
এসবকিছুর পাশাপাশি, শীতকাল একজন আল্লাহর পথে দায়ীর জন্য দাওয়া করার জন্য একটি সুবর্ণ সময়। যদিও শীত-গ্রীষ্ম সকল ঋতুতেই একজন দায়ী ইসলামী আদর্শের দাওয়াত নিয়ে সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে আহ্বানে ব্যস্ত থাকে। তবে, শীতকালে আবহাওয়া শীতল ও রাত দীর্ঘ হবার কারণে মানুষ দীর্ঘ সময় বাইরে থাকে, বিভিন্ন লোক-সমাগমের স্থান, যেমন, মাঠ-ময়দান, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকানগুলো সরগরম থাকে, মানুষ আড্ডা দেয়, বন্ধু-বান্ধব পরিচিতদের সাথে সময় কাটায়। তাই যেকোনো বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা করার অবকাশ থাকে। তাই একজন দা’ঈ শীতের অল্প কয়েক মাসে অনেক মানুষকে দাওয়া করার সুযোগ পায় এবং এভাবে অল্প সময়ে অনেক বেশি পুরষ্কার অর্জন করতে পারে।
সুতরাং, যদিও শীতকালের সহজতর অংশটুকু প্রকৃত ঈমানদারের জন্য কোনো চাহিদাপূরণ নয়, এরপরও একজন ঈমানদারের জন্য শীতকাল এক প্রকারের বোনাস যেখানে অল্প পরিশ্রমে বেশি পুরস্কার অর্জন করা যায়। এবং একজন প্রকৃত ঈমানদার এ সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করবে না, হেলায় হারাবে না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
কিন্তু যে কেউ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভালো কাজ করে, সেটি তার জন্য ভালো। [বাকারাহ: ১৮৪]
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ ، وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
তারা রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটায়, আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকে। [সুরা জারিয়াত: ১৭-১৮]
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ
ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। নিশ্চয় তা যথেষ্ট কঠিন কেবলমাত্র তাদের ছাড়া যারা বিনয়ী (খুশু’প্রাপ্ত) [বাকারাহ: ৪৫]
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
আর যারা রাত্রি কাটিয়ে দেয় তাদের পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত ও দন্ডায়মান হয়ে [ফুরকান: ৬৪]
وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
আর যদি রোজা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার [বাকারাহ: ১৮৪]