আবারও আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আমাদেরকে এই বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ কুর‘আন আল-কারীম-এর মাসে ইবাদত করার সুযোগ দান করেছেন। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
“নিশ্চয়ই আমি নাযিল করেছি এই কুর‘আন মহিমান্বিত রাত্রিতে।” (সূরা ক্বদর: ১)
আল্লাহ্’র (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) পক্ষ থেকে এই উম্মাহ্’র জন্য রহমত হিসেবে বহু কিছু প্রদান করা হয়েছে, যেগুলোর কারনে আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত; বিশেষভাবে কুর‘আনের মাধ্যমে আমাদের প্রতি রহমত বর্ষনের জন্য আমরা আল্লাহ্’র (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) অশেষ শুকরিয়া আদায় করি। কুর‘আন কেবল হৃদয় ও মনকে প্রশান্তি দেয় না, বরং এটি আমাদের জীবনের জন্য দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। পৃথিবীতে আল্লাহ্’র (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নবীদের (আ.) মহাকাব্যিক কাহিনী এবং তাদের সংগ্রাম সকল মুসলিমের জন্য আদর্শ। যেহেতু এই মাসে আমাদের কুর‘আন শোনা ও পড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, সেহেতু এই কিতাবের অন্তর্গত শক্তিশালী বক্তব্য সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এটি এমন একটি গ্রন্থ যেটি নাযিল হওয়ার পর মক্কার কাফির কুরাইশ শাসকদের সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার অনুসারীদের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়। অবাধ্যতার শাস্তি সম্পর্কে মানবজাতিকে অবহিত করে আল্লাহ্ আজ্জা ওয়া জাল আমাদের প্রতি যে সতর্কবাণী প্রেরণ করেছেন তা প্রতিবার কুর‘আন তেলাওয়াতের সময় স্মরণ করা উচিত। সত্যিকার অর্থেই আমাদের জীবন শূণ্য ও অর্থহীন, যদি না আমরা কুর‘আনকে আমাদের নিকটবর্তী রাখি এবং কুর‘আনের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করি। এমনকি সমগ্র সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে যদি না আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কুর‘আন বাস্তবায়ন করতে পারি। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে কিভাবে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) আল-কুর‘আনে সমাজ পরিচালনা বিষয়টি উল্লেখ করেছেন:
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
“আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।” (সূরা মায়িদাহ্: ৪৪)
অতএব, কুর‘আন হলো এমন একটি কিতাব যা আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) রমযান মাসে মানবজাতির জন্য সামগ্রিক পথ-নির্দেশ হিসেবে প্রেরণ করেছেন, যাতে এর মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারি এবং কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করতে পারি। তাই আমাদের জীবনে একটি সক্রিয় সহচর হিসেবে কুর‘আনের ভূমিকা থাকা উচিত। এই রমযান শেষে পুনরায় পরের বছর খোলার উদ্দেশ্যে কুর‘আন তুলে রাখা উচিত নয়, বরং ঘরে নিয়মিতভাবে আমাদের এটি পড়া উচিত। কুর‘আনের প্রত্যেকটি আয়াতে কি ব্যাখ্যা রয়েছে তা বোঝার জন্য আমাদের সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করা উচিত এবং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কুর‘আনের শিক্ষা প্রয়োগের সংকল্প করা উচিত। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তবে কি তারা কুর‘আন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে না, নাকি তাদের অন্তরের উপর তালা লাগানো রয়েছে।” (সূরা মুহাম্মাদ: ২৪)
কুর‘আন মানবজাতির জন্য একটি পথ-নির্দেশ যা মিথ্যা থেকে সত্যকে পৃথক করে। এটি মানবজাতির জন্য শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, সামাজিক বিষয় হতে শুরু করে ব্যক্তিগত ইবাদত পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই রমযান মাসে যখন আমরা প্রতিদিন কুর‘আন তেলাওয়াত করি এবং তারাবীতে দীর্ঘ সময় ধরে সূরা পড়ি তখন কি আমরা সত্যিই এই কুর‘আনকে বুঝি এবং অনুশীলন করার বিষয়ে চিন্তা করি? আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ্‘র (সা.) চরিত্রকে চলন্ত কুর‘আন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমাদের চরিত্রে কি কুর‘আনের বার্তা প্রতিফলিত হয়? আমরা কি আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন করি? নাকি আমরা অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের সাথে সম্পর্কিত অধিকাংশ হুকুম উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদতের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করি? আমরা কি সত্যিই আমাদের কাঁধে কুর‘আনের গুরুভার অনুভব করি? আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:
لَوْ أَنزَلْنَا هَذَا الْقُرْآنَ عَلَى جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
“আমি যদি এ কুর’আন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি তাকে দেখতে আল্লাহ্’র ভয়ে বিনীত ও ভীত হয়ে গেছে। মানুষের জন্য আমি এসব দৃষ্টান্ত এজন্য বর্ণনা করি যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা হাশর: ২১)
অতএব, আমাদের কাঁধে এই কুর‘আনের যে গুরুভার রয়েছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুন, এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে – মসজিদে বা স্কুলে, বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে যেখানেই থাকুন না কেন, কিংবা একটি বাড়ি কিনুন বা একটি গাড়ি বিক্রি করুন না কেন, অথবা ব্যক্তিগত ইবাদতে মশগুল হন বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন না কেন – কোনরূপ ব্যতিক্রম ছাড়াই সবসময় আল্লাহ্র আনুগত্য করার জন্য কুর‘আনকে ব্যবহার করুন। সংক্ষেপে বলা যায় যে ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবন, তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের কেবল ইসলামকে অনুসরণ করা উচিত।
আসুন আমরা কুর‘আন-এর মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর এই সুবর্ণ সুযোগটিকে কাজে লাগাই। ইসলাম সম্পর্কে আমরা যত বেশি সচেতন হব ততই এর ভিত্তিতে আমাদের জীবন পরিচালনা করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেন:
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاء
“আল্লাহ্‘র বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির: ২৮)
আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রত্যেক রাতে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর সাথে কুর‘আন অধ্যয়ন করতেন। আল-বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রমযানে সবচেয়ে বেশি উদার ছিলেন, যখন তিনি ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং তাঁর সাথে কুর‘আন পড়তেন। ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) রমযানে প্রতি রাতে কুর‘আন শিক্ষা দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন”।
আসুন আমরা এই মহিমান্বিত মাসে কুর‘আনের আয়াতের অর্থ অধ্যয়ন করে জ্ঞান অর্জন করি। আসুন আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এবং তার সাহাবীদের (রা.) জীবন সম্পর্কে পড়ি: কিভাবে তারা জীবন কাটিয়েছিলেন? কিভাবে তারা এই পৃথিবীতে আল্লাহ্’র বাণী সুউচ্চে তুলে ধরার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন? আসুন আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থ, কৃষি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে পড়াশোনা করি। আসুন আমরা দেখি যে ইসলাম পুরুষ ও নারী, পরিবার ও শিশুদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কি বলে? আসুন আমরা সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে ইসলামের হুকুমসমূহ খুঁজে বের করি। মনে রাখবেন, ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা এবং এই পবিত্র মাসে আসুন আমরা আমাদের অজানা ইসলামের কিছু অংশ হলেও জানার আন্তরিক চেষ্টা করি।