আল্লাহ বলেন,
“তোমরাই (মুসলিমগণ) সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের জন্য উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।” (সূরা আল ইমরান: ১১০)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় কেউই মুসলিম উম্মাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বলতে পারবে না। মুসলিমগণ এখন অধপতিত। এটি সবাই বুঝতে পারছে। বিশ্ব নেতৃত্বে মুসলিম উম্মাহ নেই। ইউরোপ আমেরিকার হাতে আজকে বিশ্ব নেতৃত্ব। মুসলিম উম্মাহ নির্যাতিত, নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী, নৈতিকভাবে অধপতিত, জ্ঞান বিজ্ঞানে পশ্চাদপদ, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত যদিও মুসলিম ভূমিসমূহ তেল, গ্যাস, কয়লাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ।
কিন্তু কেন মুসলিম উম্মাহ আজকে অধপতিত?
এ ব্যাপারে নানা মুনীর রয়েছে নানা মত। মুসলিম চিন্তক, ইসলামিক বিশেষজ্ঞগনের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ মনে করছেন মুসলিম উম্মাহ অধপতিত কেননা তাদের নৈতিক পদস্খলন ব্যাপক। কেউ মনে করছেন মুসলিম উম্মাহ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে পশ্চাদপদ, ইংরেজীতে দূর্বল, শিক্ষার হার কম, জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত, প্রবল জাতিগত বিভেদ, ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচারাদিতে অনুৎসাহ, ইউরোপ আমেরিকার মত সঠিক অর্থনৈতিক নীতির অভাব ইত্যাদি। সব প্রস্তাবনাগুলো একটু খতিয়ে দেখা দরকার। যদি জনসংখ্যার আধিক্য কোন সমস্যা হত তাহলে সবচেয়ে বড় জনসংখ্যা নিয়ে চীন কী করে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হল, ভারত কী করে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হল? ইংরেজী শিক্ষায় চীন, জাপান ও কোরিয়ানদের অনাগ্রহের কথা সবাই জানে। তথাপিও এ তিনটি দেশ শিল্পক্ষেত্রে ও অর্থনীতিতে প্রথম সারিতে। শ্রীলংকার স্বাক্ষরতার হার প্রায় একশভাগ হওয়া সত্ত্বেও এটি ইউরোপ, আমেরিকার মত নেতৃত্বশীল জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। মদীনার লোকেরা এখনও নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ ও কোমল প্রকৃতির। কিন্তু তারপরেও তারা খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়ের মত বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আসনে নেই। যে কোন দেশের জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার উপর নির্ভরশীল। এই প্রগতিশীল নীতিমালা আসে একটি ভিশনারী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে। আর ভিশন আসে আদর্শ থেকে। মুসলিম দেশসমূহ কি আজকে কোন আদর্শ অনুসরণ করছে? উত্তর হল না। সেকারণে সেসব দেশ জ্ঞান বিজ্ঞানে পশ্চাপদ ও অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র। মধ্যযুগের ইউরোপ, আমেরিকা ছিল দরিদ্র, জাতিগত হানাহানিতে পরিপূর্ণ, পশ্চাপদ। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ইউরোপের পূর্ণজাগরণ বা রেনেসা ইউরোপের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে উদ্ভুত পুজিবাদী অর্থনীতির ভিশনের ফলে তাদের শিল্পবিপ্লব ঘটল। শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্যের বাজারের জন্য তারা একের পর এক উপনিবেশ স্থাপন করল এবং বিশ্ব নের্তৃত্ব কায়েম করল। অর্থাৎ আগে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রেনেসা হয়েছিল এবং তার পর জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। একই কথা ইসলামিক সভ্যতার ক্ষেত্রেও সত্য। মুসলিমগণ কখন এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিল যখন আফ্রিকা হয়ে উঠেছিল রুটির ঝুড়ি এবং যাকাত দেয়ার জন্য লোক খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না? কখন মুসলিমগণ ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডে দূর্ভিক্ষের সময় ত্রাণ পাঠিয়েছিল অথচ এখন মুসলিমরা নিজেরাই শরণার্থী। অবশ্যই এরকমটি ঘটেছিল ইসলামী খিলাফতের সময়ে। কখন মুসলিমগণ জ্ঞান বিজ্ঞানে বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিল? কখন তারা গড়ে তুলেছিল বাগদাদের বায়তুল হিকমাহ, মরক্কোর কারাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয়, মিশরের আল আজাহার, স্পেন বা আন্দালুসিয়ার কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জগত বিখ্যাত প্রাচীন বিদ্যাপীঠ? কখন তৈরি হয়েছিল বীজগণিত ও অ্যালগরিদমের জনক আবু মুসা আল খোয়ারিজিমি, শল্য চিকিৎসাবিদ্যার জনক ইবনে সিনা, আল কেমিগন যেখান থেকে রসায়নশাস্ত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল? উত্তর অবশ্যই ইসলামি খিলাফতের সময়ে। আজকে মুসলিমদের নৈতিক অধপতনের কথা বলি অথচ কখন নৈতিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ নজির স্থাপন করার কারণে গোয়ালিনীর মেয়ে হয়ে গিয়েছিল প্রতাপশালী খলিফার পুত্রবধূ? কখন জীনা করার পর মুসলিম নারী এসে রাসূলুল্লাহ’র কাছে রজমের শাস্তি প্রার্থনা করেছে? এসবই ঘটেছে ইসলামী খিলাফতের সময়ে। উপরের আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, আজকে যদি আবার ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা পূণরায় ফেরত আসে তবেই মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ছড়িয়ে দেয়ার ভিশন থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হবে, এর জন্য স্থাপিত হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠসমূহ। আর রাষ্ট্র ছাড়া ব্যক্তিবিশেষকে সম্ভব হলেও উম্মাহকে সামগ্রিকভাবে কালচার করা যাবে না যাতে তার নৈতিক উৎকর্ষতা ঘটে এবং ধর্মীয় আচার পালনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। কারণ রাষ্ট্রের রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, মিডিয়া এবং অন্যান্য ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোসমূহ। একারণে পূর্ণজাগরণের জন্য মুসলিম উম্মাহ’র অন্য কোন ক্ষেত্রে প্রচেষ্ঠা বিনিয়োগ না করে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশী মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত।
তবে অনেকে এ যুক্তি দেখান যে, খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই নৈতিকভাবে উন্নত, ইসলামিক আচারাদিতে অভ্যস্ত মুসলিম বেশী করে তৈরি করা উচিত। প্রথমত: যারা এরকম কথা বলেন তারা ব্যক্তিমানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করেন। কিন্তু মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের রীতি নীতি ব্যক্তি মানুষকে প্রভাবিত করে এবং সহজ বলে ব্যক্তিমাত্রই সমাজের প্রচলিত নিয়ম কানুনের অনুগামী হয়। সেকারণে অধপতিত ও দূর্নীতিগ্রস্ত সমাজের প্রচলিত রীতি নীতি, চিন্তা, ধারণার বিপরীতে এসে অধিকাংশ মানুষকে নৈতিকভাবে উন্নত করা বাস্তবসম্মত কোন চিন্তা নয় এবং এটি পৃথিবীর কোন সমাজে কোনকালেই সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত: উন্নত নৈতিক চরিত্র দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা)। তাঁর নীতি নৈতিকতার বিষয়ে সর্বাধিক জানা ছিল মক্কার লোকদের। একারণে তারা তাকে ‘আল আমীন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। নিজেদের আমানত পর্যন্ত গচ্ছিত রাখলেও নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা ও পূর্ব পুরুষের ধ্যান ধারণার মূলে আঘাত করার অপরাধে মুহাম্মদ (সা) কে হত্যা করার মত ন্যাক্কারজনক কাজ করতে তারা পিছপা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সা) এর সম্মানিত সাহাবীগনও নৈতিকতার দিক দিয়ে মক্কার লোকদের কাছে অনুকরণীয় ছিল। কিন্তু তাদের কাউকে কাউকে তারা হত্যা করেছে, কারও সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, কারও উপর চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ও সাহাবী (রা) কে ইসলাম পালন ও নিরাপত্তার জন্য মক্কা পরিত্যাগ করে মদীনার হিজরত করতে হয়েছে। উন্নত নৈতিকতার মাধ্যমে মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে মক্কাকে খিলাফতের অধীনে আনতে হয়েছে।
রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সেকারণে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটি রাজনৈতিক। রাসূলুল্লাহ (সা) বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে মদীনাতে ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত কায়েম করেছিলেন। এক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার বিকাশ বা ইসলামী ব্যক্তিগত আচারাদি কোন ভূমিকা পালন করেনি। একজন মুসলিম যখন ইসলামকে সামগ্রিকভাবে তার জীবনে গ্রহণ করবে তখন সে এমনিতেই নৈতিকভাবে উন্নত ও ব্যক্তিগত ইসলামিক আচারাদিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খিলাফত উম্মাহ’র জন্য সামগ্রিকভাবে ইসলাম পালনকে সহজতর করে বা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। সেকারণে মুসলিমগনকে আজকে রাসূলুল্লাহ (সা) কে অনুসরণ করে উম্মাহ’র নীত নৈতিকতা বা আমল বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা না করে ইসলামিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করা উচিত।
মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যে যেসব সমস্যা আমরা আজকে দেখতে পাই সেগুলো হয় কোন প্রধান সমস্যার শাখা সমস্যা অথবা উপসর্গ মাত্র। মুসলিম উম্মাহ’র প্রধান সমস্যা হল খিলাফত রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি। সেকারণে মুসলিমগণ আজকে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী, তার বিশাল প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ এবং জনবল থাকা সত্তে¡ও সে দরিদ্র, ১৫০ কোটির মত বিশাল মুসলিম জনসংখ্যা এবং পৌনে এক কোটির মত মুসলিম সেনাবাহিনী থাকা সত্তে¡ও তারা হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাটের শিকার। খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা মুসলিম ভূমিসমূহকে একত্রিত করবে, মুসলিমদের সম্পদগুলোকে একত্রিত করে এগুলোকে তাদের কল্যাণে ব্যয় করবে, সামরিক বাহিনী সমূহকে একত্রিত করে উপনিবেশিক কাফের দখলদার শক্তিসমূহকে সমুচিত জবাব দেবে ও মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং সর্বোপরি বিশে^র বুকে একটি নেৃতত্বশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে ইনশাআল্লাহ।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন:
“নিশ্চয় ইমাম/খলিফা হচ্ছেন ঢালস্বরূপ,যার পেছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়এবং আত্মরক্ষা করা হয় “…।