তথ্য বিভাগ (আল ই’লাম)

রাষ্ট্র এবং এর দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ আছে, তথ্যবিভাগ তাদের মধ্যে একটি। এটি জনস্বার্থের (মাসালিহ্) সাথে সম্পর্কিত নয় যে, এটি জনকল্যাণ বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে; বরং, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সমূহের মতোই একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি সরাসরি খলীফার তত্ত্বাবধানের অধীন থাকবে। 

একটি সুনির্দিষ্ট তথ্যনীতি যা বিশ্বের দরবারে ইসলামকে শক্তিশালী ও কার্যকরভাবে উপস্থাপন করবে, স্বাভাবিকভাবেই তা ইসলামের প্রতি গণমানুষের মনকে আকৃষ্ট করবে; সেইসাথে, তাদের আগ্রহী করবে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও চিন্তাভাবনা করতে। এছাড়া, মুসলিম ভূমিসমূহকে খিলাফত রাষ্ট্রের সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া, তথ্য-উপাত্তের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে, যা রাষ্ট্রের (ভাল-মন্দের) সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত; এজন্য খলীফার অনুমতি বা নির্দেশ ব্যতীত এ তথ্যগুলো প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষতঃ এটা প্রযোজ্য সামরিক বাহিনী এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো, যেমন: সেনাবাহিনীর গতিবিধি; কিংবা, জয় বা পরাজয়ের সংবাদ, কিংবা, সামরিক শিল্পবিষয়ক তথ্য ইত্যাদি। এই জাতীয় তথ্যগুলো সরাসরি ইমাম বা খলীফার সাথে যুক্ত থাকতে হবে, যেন কোন কোন খবর গোপন রাখতে হবে এবং কোন কোন সংবাদ ঘোষণা এবং প্রচার করতে হবে সে বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। 

এ বিষয়ে শারী’আহ্ দলিল হল আল্লাহ্’র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ্।

আল্লাহ্’র কিতাবের ক্ষেত্রে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, 

“আর যখন তাদের নিকট কোন শাস্তি সংক্রান্ত বা ভীতিজনক কোন বিষয় উপস্থিত হয়, তখন তারা সেটা রটনা করতে থাকে। যদি তারা ওগুলোকে (সংবাদ) রাসূল ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীলদের কাছে পৌঁছে দিত তবে অবশ্যই তথ্যঅনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গ তা উপলব্ধি করতো।”
[সূরা নিসা: ৮৩]

এ আয়াতের বিষয়বস্তু সরাসরি তথ্য-উপাত্ত সংক্রান্ত। 

আর, রাসূলের সুন্নাহ্’র দলিল হিসাবে মক্কা বিজয়ের উপর ইবন আব্বাসের হাদীসটি উল্লেখ করা যায়, যে হাদীসটি আলহাকিম তার আল-মুসতাদরাক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী এটি সহীহ্ হাদীসের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং আল-জাহাবী এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন: “কুরাইশদের নিকট হতে তথ্য গোপন করা হয়েছিল; যেন আল্লাহ্’র রাসূল (সা) এর সংবাদ তাদের কাছে না পৌঁছায়; এবং তারা যেন তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতে না পারে।” 

আবু সালামাহ্’র একটি মুরসাল হাদীস (যে হাদীস সরাসরি রাসূলুল্লাহ্’র সাথে যুক্ত নয়; বরং এখানে বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি) আছে যা ইবনে আবু শায়বাহ্ বর্ণনা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে:  

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আয়েশাকে বললেন: আমাকে সবকিছু প্রস্তুত করে দাও এবং এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলো না। তারপর তিনি রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দিলেন, যেন মক্কার লোকেরা চলাচল করতে না পারে এবং তাদের কাছে কোন সংবাদ না পৌঁছে।’

এছাড়া, গাজওয়া ’উসরাহ্ (তাবুকের অভিযান) সম্পর্কে কা’ব বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে, যে হাদীসের ব্যাপারে ঐক্যমত আছে, এ হাদীসে বলা হয়েছে:  

রাসূল (সা) কখনও কোন অভিযানে তাঁর সঠিক গন্তব্যের ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রকাশ করতেন না, একমাত্র সে অভিযানটি ছাড়া যেটির জন্য তিনি ভয়াবহ উত্তপ্ত আবহাওয়ায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন; যেটি ছিল একটি দূরবর্তী স্থানে, মরুভূমিতে এবং বিশাল সংখ্যক শত্রুর বিরুদ্ধে। সুতরাং, তিনি মুসলিমদের পুরো ব্যাপারটি বর্ণনা করলেন যাতে তারা অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকে এবং তিনি তাদেরকে তাঁর গন্তব্যও জানিয়ে দিলেন।”

এ ব্যাপারে আনাসের একটি হাদীস রয়েছে যা আল-বুখারী বর্ণনা করেন,

“রাসূলুল্লাহ্ (সা) যায়িদ, জাফর ও ইবনে রুওয়াহার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর আগেই এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘যায়িদ প্রথমে পতাকা হাতে নিল ও শহীদ হল; অতঃপর জাফর হাতে নিল এবং সেও শহীদ হল; তারপর, ইবনে রুওয়াহা পতাকা হাতে নিল এবং সেও শহীদ হল; একথা বলতে বলতে তিনি কাঁদছিলেন। অতঃপর, আল্লাহ্’র তরবারীর মধ্য হতে একটি তরবারী তা তুলে নিল এবং আল্লাহ্ তাদের জন্য বিজয় নির্ধারণ করলেন।”
(সহীহ্ বুখারী, হাদীস নং-৩৭৫৭)

তথ্য সম্পর্কিত এই সমস্ত নীতির কিছু কিছু খোলাফায়ে রাশেদীনদের সময়েও প্রয়োগ করা হয়; যা কিনা ইবন আল-মুবারক এর জিহাদ সম্পর্কিত এক বর্ণনায় এসেছে; আল-হাকিম এটি তার আল-মুসতাদরাক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম মুসলিমের (সহীহ্ হাদীসের) শর্তানুযায়ী তিনি এটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন, যে ব্যাপারে আল-জাহাবী একমত পোষণ করেছেন। উক্ত হাদীসটি যায়িদ ইবন আসলাম থেকে ইবন আল-মুবারক, ইবন আসলাম আবার তার পিতা হতে, তার পিতা আবার উমর ইবনুল খাত্তাব থেকে বর্ণনা করেছেন: তিনি (’উমর) এ ব্যাপারে অবগত হলেন যে, আবু উবাইদাহ শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে এবং তারা তাদের দিকে সমবেতভাবে এগিয়ে আসছে। শোনার পর উমর তাঁকে লিখলেন, ‘তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক! ঈমানদারদের উপর এমন কোন বিপদ আপতিত হয় না, যেখান থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা তাকে পথ করে দেন না; এবং (জেনে রাখ) একটি কঠিন সময় কখনও দু’টি সুসময়ের কাছে পরাজিত হয় না।’ 

হে ঈমানদানগণ! ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার।’
[সূরা আল ইমরান : ২০০] 

তিনি বলেন: তারপর, আবু উবায়দা তাঁকে লিখেন, ‘আপনার উপরেও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আল্লাহ্ বলেন, 

‘তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারষ্পরিক অহমিকা এবং ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়।’
[সূরা হাদীদ : ২০]  

তারপর তিনি বলেন: অতঃপর ’উমর তাঁর হাতের বইখানা নিয়ে মিম্বারে উঠে দাঁড়ালেন এবং মদীনার লোকদের এটা পাঠ করে শোনালেন এবং বললেন, ‘হে মদিনাবাসী! আবু উবাইদা পরোক্ষভাবে তোমাদের জিহাদের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে, যেন তোমরা এ ব্যাপারে আগ্রহী হও।”

যে বিষয়গুলো সমরবিষয়ক তথ্যের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো হল, সমঝোতা, শান্তিচুক্তি এবং বিতর্ক বিষয়ক তথ্য যা কিনা খলীফা কিংবা তার সহকারীবৃন্দ এবং কুফর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে। সমঝোতার উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, হুদাইবিয়া’র প্রান্তরে আল্লাহ্’র রাসূল (সা) এবং কুরাইশদের প্রতিনিধির সাথে প্রদত্ত শর্তের ভিত্তিতে শান্তিচুক্তি সংঘটিত হবার পূর্বপর্যন্ত যে সংলাপ সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়া, সরাসরি বিতর্কের উদাহরণ হিসাবে রাসূল (সা) এর সাথে জাজরান থেকে আগত প্রতিনিধিদের বিতর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়, যেখানে তিনি (সা) তাদেরকে নিজেদের উপর আল্লাহ্’র অভিশম্পাত নাযিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন যদি তারা (তাদের দাবির ব্যাপারে) সত্যবাদী না হয়ে থাকে। এছাড়া, রাসূল (সা)এর নির্দেশক্রমে তামিমের প্রতিনিধিদের সাথে ছাবিত ইবন কায়েস ও হাস্সান এর বিতর্কের ঘটনাও উল্লেখ করা যায়।   

বস্তুতঃ উপরোল্লিখিত ঘটনাগুলোর কোনটির ক্ষেত্রেই কোন প্রকার গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়নি।

এছাড়া, আরও অনেক ধরনের সংবাদ বা তথ্য আছে যেগুলোর রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে খলীফার সরাসরি অনুমোদন বা নির্দেশ অপরিহার্য নয়; যেমন: প্রতিদিনকার খবর, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বিজ্ঞান বিষয়ক কিংবা, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদি। বস্তুতঃ এ ধরনের সংবাদ বা তথ্যসমূহে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী কিংবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এজন্য, এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার বিষয়ে রাষ্ট্রের তদারকী ও পর্যবেক্ষণ প্রথমোক্ত তথ্যসমূহের থেকে ভিন্নতর হবে।  এজন্য, রাষ্ট্রের তথ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই দু’টি প্রধান বিভাগ থাকতে হবে:

প্রথমত: এ বিভাগের কাজ রাষ্ট্রের সাথে সরাসরিযুক্ত এমন তথ্যের সাথে সম্পর্কিত, যেমন: সামরিক বিষয়সমূহ, সামরিক শিল্প বিষয়ক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক, ইত্যাদি। এ বিভাগের কাজ হল এ সম্পর্কিত তথ্যগুলো সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা; যেন এ ধরনের সংবাদসমূহ এ বিভাগে উপস্থাপনের পূর্বে রাষ্ট্রের কোন সংবাদ মাধ্যম বা অন্যকোন বিশেষ সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত না হয়। 

দ্বিতীয়ত: এ বিভাগটি অন্যান্য খবরের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য নয়। রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম কিংবা, অন্যকোন বিশেষ সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রচারের জন্য কোন পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই।  

প্রচারমাধ্যম সমূহের অনুমোদন প্রাপ্তি

ইসলামী রাষ্ট্রে প্রচারমাধ্যমসমূহের কাজ করার জন্য কোনপ্রকার অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। বরং, রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিক যে কোন ধরনের প্রচারযন্ত্র স্থাপন করতে পারবে, সেটা প্রকাশনার মাধ্যমে হোক কিংবা, অডিও বা ভিজ্যুয়াল যাই হোক না কেন। তবে, তিনি কোন ধরনের প্রচারযন্ত্র স্থাপন করতে চান তা অবশ্যই তাকে তথ্যবিভাগে অবহিত করতে হবে।    

এবং, তাকে অবশ্যই উপরোল্লিখিত নীতি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সাথে সরাসরিযুক্ত এমন তথ্য প্রচারের পূর্বে তথ্যবিভাগের অনুমতি নিতে হবে; আর অন্যান্য খবরের ক্ষেত্রে তথ্যবিভাগের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই।   

সকল ক্ষেত্রে, প্রচারমাধ্যমের মালিককেই তার প্রচারিত সংবাদের দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে এবং অন্যান্য নাগরিকের মত তাকেও জবাবাদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে, যদি তিনি তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে শারী’আহ্ আইন লঙ্ঘন করেন।  

রাষ্ট্রের তথ্য নীতি 

তথ্য সংক্রান্ত একটি আইন প্রকাশ করা হবে, যেখানে শারী’আহ্ আইনের আলোকে গঠিত রাষ্ট্রের তথ্যনীতির ব্যাপারে কিছু সাধারণ দিকনির্দেশনা থাকবে। ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে রাষ্ট্র এ নীতিকে অনুসরণ করবে, যেন এমন একটি পরস্পর নিবিড় সম্পর্কযুক্ত ও শক্তিশালী ইসলামী সমাজ গঠিত হয়, যা আল্লাহ্’র রজ্জুকে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং যা থেকে ক্রমাগত উন্নত আদর্শের আলোকময় শিখা বিচ্ছুরিত হবে; যেখানে অনৈতিক, দুষ্ট ও ক্ষতিকর ধ্যান-ধারণার কোন স্থান থাকবে না; থাকবে না ভ্রান্ত পথনির্দেশনাপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন কোন সংস্কৃতি। এটি হবে এমন একটি ইসলামী সমাজ যা নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সকল দুষ্ট চিন্তাধারাকে নস্যাৎ করবে এবং বিচ্ছুরিত করবে ন্যায় ও সত্যাদর্শের আলোকময় শিখা এবং সকল সময়, সকল ক্ষেত্রে বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রভু, মহান আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা জ্ঞাপন করবে।

বাইতুল মাল

মাজলিস আল উম্মাহ্

Leave a Reply