মুখবন্ধ

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতার অধীনে সম্পাদিত ‘আজহিজাতু দাওলিাতিল খিলাফাহ – ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহ’ বইটির বাংলা অনুবাদ হতে গৃহীত)

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এবং দুরূদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ্ (সা), তাঁর পরিবার, সাহাবীগণ (রা.) এবং পরবর্তীযুগের অনুসারীদের প্রতি।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন:

তোমাদের মধ্য হতে যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে আল্লাহ্ তাদের এ ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদের পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন, যেরূপ তাদের পূর্ববর্তীদের দান করেছিলেন আর তিনি অবশ্যই তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন, সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদের নিরাপত্তা দান করবেন। তারা শুধু আমারই বন্দেগী করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। অতঃপর যারা কুফরী করবে তারাই আসলে ফাসেক।
[সূরা আন-নূর: ৫৫]

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন:

“তোমাদের মধ্যে নবুয়্যত থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, তারপর আল্লাহ্ তার সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত। তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, অতঃপর তিনি তারও সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন, তা থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন। এক সময়”আল্লাহ’র ইচ্ছায় এরও অবসান ঘটবে। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে জুলুমের শাসন এবং তা তোমাদের উপর থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন। তারপর তিনি তা অপসারণ করবেন। তারপর আবার ফিরে আসবে খিলাফত  নবুয়্যতের আদলে।”
(মুসনাদে আহমদ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা-২৭৩, হাদীস নং-১৮৫৯৬)

আমরা, হিযবুত তাহরীর-এর সদস্যগণ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেয়া এ প্রতিশ্রতিতে বিশ্বাস করি এবং সেইসাথে বিশ্বাস করি, রাসূল (সা) আমাদেরকে যে সুসংবাদ দিয়েছেন তার উপর। এ পৃথিবীর বুকে খিলাফত রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারজন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে সাথে নিয়ে এবং এই উম্মাহ্’র   মধ্যে আমরা ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছি। লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত এবং সফলতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে প্রার্থনা করি যেন খিলাফত রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সম্মানিত করেন এবং আমাদেরকে খিলাফত রাষ্ট্রের অকুতোভয় সৈনিকে পরিণত করেন, যেন আমরা খিলাফতের পতাকা গৌরবের সাথে উত্তোলিত করতে পারি এবং এ পতাকাকে একের পর এক বিজয়ের দিকে ধাবিত করতে পারি। নিশ্চয়ই কৃত প্রতিশ্রতিতে সত্যে পরিণত করা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য কোন কঠিন কাজ নয়।

বস্তুতঃ এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা খিলাফত রাষ্ট্রের শাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার বাস্তব রূপরেখা মুসলিম উম্মাহ্’র কাছে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চেয়েছি – যাতে করে এটি মুসলিমদের খিলাফত রাষ্ট্রের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, খিলাফত রাষ্ট্রের ব্যাপারে স্পষ্ট এ ধারণার মাধ্যমে মুসলিমদের হৃদয় যেন এমন পর্যায়ে উন্নীতহয়, যাতে তারা খিলাফত রাষ্ট্রকে অন্তর দিয়ে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।

প্রকৃতপক্ষে, এ বইটি রচনার পেছনে আমাদের মূল প্রেরণা হল, বর্তমান বিশ্বের শাসনব্যবস্থা সমূহ তাদের উৎস, ভিত্তি কিংবা কাঠামো কোনদিক থেকেই ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া, মুসলিম উম্মাহ্’র  কাছে এটি স্পষ্ট যে, বর্তমান শাসনব্যবস্থাসমূহ আল্লাহ্ প্রদত্ত কিতাব, রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্ ও ইসলামী শারী’আহ্ ’র অন্যান্য বৈধ উৎস থেকে উৎসারিত নয়। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই যে বর্তমানে প্রচলিত এসকল ব্যবস্থা ইসলামী আক্বীদাহ্’র সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। মূলতঃ যে বিষয়ে মুসলিমরা বিভ্রান্ত হন তা হল, প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে বর্তমানে বাস্তবায়িত শাসনব্যবস্থা সমূহের গঠন প্রণালী ইসলামী শাসনব্যবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কি না। আর, এ কারণেই তারা মন্ত্রী পরিষদ ও বিভিন্ন মন্ত্রনালয় দিয়ে পরিচালিত ইসলাম বহির্ভূত মানবরচিত ব্যবস্থাগুলোর মতোই বিভিন্ন মন্ত্রী ও মন্ত্রনালয়ের অস্তিত্বকে অবলীলায় স্বীকার করে নেন। এ বইয়ে খিলাফত রাষ্ট্রের কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহ (Structure and Institutions) নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যেন এ পৃথিবীতে খিলাফত রাষ্ট্র পুণরায় আবির্ভূত হবার আগেই মুসলিমদের অন্তরে এ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরী হয়, ইনশা’আল্লাহ্।

এ বইয়ে আমরা খিলাফত রাষ্ট্রের পতাকা ও ব্যানার ব্যবহারের বিষয়টিকেও অন্তর্ভূক্ত করেছি। এছাড়া, অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় রয়েছে যা নিয়ে এ বইয়ে আমরা বিশদভাবে আলোচনা করিনি। ইন্শা’আল্লাহ্, সেগুলো নির্ধারিত সময়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খলীফা নির্বাচন পদ্ধতি, খলীফার  বাই’আত    বা শপথে উচ্চারিত শব্দসমূহ, খলীফা বন্দী হলে অন্তর্বর্তীকালীন আমীরের আবশ্যিক ক্ষমতাসমূহ, উলাই’য়াহ্ বা প্রদেশসমূহের পুলিশ প্রশাসন গঠন ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগে নারীপুলিশ সদস্যের নিয়োগ, উলাই’য়াহ্ প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন করার প্রক্রিয়া, মাজলিস আল উম্মাহ্’র   প্রতিনিধি নির্বাচন করার প্রক্রিয়া, ইসলামী রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছানো (official state anthem) ইত্যাদি। অবশ্য এ বইয়ে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্ধারিত স্থানে আমরা প্রয়োজনানুসারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি।

আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি যেন তিনি অতিসত্ত্বর আমাদের বিজয় দান করেন, আমাদের উপর তাঁর করুণা বর্ষণ করেন এবং সর্বোপরি, তাঁর সাহায্য ও রহমতের দ্বারা আমাদের সম্মানিত করেন – যেন মুসলিম উম্মাহ্ আবারও এ পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ্ হিসেবে পরিগণিত হয়। সেইসাথে, প্রথমবার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের আদলে এ বিশ্বে খিলাফত রাষ্ট্র আবারও প্রতিষ্ঠিত হয় – যেন এ রাষ্ট্র তার অধীকৃত সমগ্র অঞ্চল ও সীমানার সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

বস্তুতঃ সেটাই হবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রদত্ত বিজয়ে মুসলিমদের চিত্ত আনন্দে উদ্ভাসিত হবে এবং এ বিজয়ের মাধ্যমেই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের অন্তর কে প্রশান্ত করবেন।

পরিশেষে, আমরা শুধু সন্তুষ্টচিত্তে ও অকুন্ঠভাবে মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রশংসা করি, যিনি এ সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।

ভূমিকা

Leave a Reply