নাম উসমান, পিতার নাম তালহা ইবন আবী তালহা এবং মাতার নাম উম্মু সাঈদ সালামা। মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আমর শাখার সন্তান। জাহিলী যুগে পবিত্র কাবার হাজেব বা তত্ত্বাবধায়ক ও চাবির রক্ষক ছিলেন। ইসলামী যুগেও এ দায়িত্ব পালন করেন। (উসুদুল গাবা-৩/৩৭২)।
উসমান ইবন তালহার পিতা তালহা,তিন ভাই মুসাফি, কিলাব ও হারেস এবং তার চাচা উসমান ইবন আবী তালহা উহুদ যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। তার পিতা তালহা হযরত আলীর (রা) সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আলী (রা) তরবারির এক আঘাতে তাকে জাহান্নামে পৌঁছে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম ১ম খন্ড, টীকা নং-৩, পৃ. ৪৭০)।
উসমান ইবন তালহার ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার উতপীড়নে শরীক হতেন কি না সে সম্পর্কেও ইতিহাসে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। একটি ঘটনা জানা যায়, হযরত মুসয়াব ইবন উমাইর (রা) মক্কায় দারুল আরকামে গোপনে ইসলাম গ্রহণের পর চুপে চুপে নামায আদায় করতেন। একদিন উসমান ইবনে তালহা তা দেখে ফেলেন এবং তার মা ও গোত্রের কানে পৌঁছে দেন। ফলে তারা মুসয়াবকে বন্দী করে তার ওপর নির্যাতন চালায়। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩০১)।
হযরত উম্মু সালামার (রা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞরা উসমান ইবন তালহার নামটি বারবার উচ্চারণ করেছেন। ঘটনাটি সংক্ষেপে এই রকম: হযরত উম্মু সালামা সা: যখন মক্কার কুরাইশদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে স্বামী আবু সালামার (রা) সাথে মিলিত হওয়ার জন্য একাকী মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে মক্কার অদূরে তানয়ীমে পৌঁছেন, তখন এই উসমান ইবন তালহা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন: আবু উমাইয়্যার মেয়ে, কোন দিকে যাবে? তিনি বললেন: মদীনায় স্বামীর কাছে। উসমান বললেন: তোমার সাথে আর কেউ নেই? উম্মু সালামা বললেন: আমার এই ছোট্ট শিশু সালামা বললেন, আমার এই ছোট্ট শিশু সালামা ছাড়া আর কেউ নেই। অত:পর উসমান উম্মু সালামার উটের রশি ধরে টেনে চলতে লাগলেন এবং মদীনার উপকন্ঠে কুবার বনী আমর ইবন আউফের পল্লীতে পৌছে উম্মু সালামাকে বললেন: আল্লাহর নামে প্রবেশ কর, তোমার স্বামী এখানে আছে। এ কথা বলে উসমান আবার মক্কার পথ ধরেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৯-৭০)
হযরত উম্মু সালামা (রা) যখন মদীনায় হিজরত করেন, উসমান তখনও অমুসলিম।
উসমান ইবন তালহার ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। কোন মতে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়, কোন মতে হিজরী ৮ম সনে আবার কোন মতে মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বে হিজরী অষ্টম সনে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও হযরত আমর ইবনুল আসের সাথে মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন মনে মনে বললাম: রাসূল সা: এর কাছে যাব কার সাথে? বিষয়টি নিয়ে সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যার সাথে আলোচনা করলাম। সে আমার প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বললো, কেউ আমার সাথে না থাকলেও আমি কক্ষনও তার অনুসারী হবো না। এর আমি ইকরামা ইবন আবী জাহলের নিকট গিয়ে একই কথা বললাম। সেও সাফওয়ানের মত জবাব দিল। তারপর আমি উসমান ইবন তালহার সাথে দেখা করে বললাম: আমাদের অবস্থা তো এখন সেই খেকশিয়ালের মত যে একটি গর্তের মধ্যে আছে, আর সেই গর্তে পানি ঢালা হচ্ছে। এক সময় অবশ্যই তাকে বের হয়ে আসতে হবে। উসমান আমার কথা বুঝতে পেরে সায় দিল এবং আমার মত একই ইচ্ছা প্রকাশ করলো। আমি বললাম: আগামী কাল ভোরেই আমি মদীনার পথে রওয়ানা হচ্ছি। অত:পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল ভোরে আমরা পৃথকভাবে মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে ইয়াজুজ নামক স্থানে পৌঁছবো এবং সেখান থেকে এক সাথে যাত্রা করবো। কেউ আগে পৌঁছলে অন্যের জন্য অপেক্ষা করবো। প্রভাত হওয়ার পূর্বেই আমরা ‘ইয়াজুজ’ পৌঁছে যাত্রা শুরু করলাম। ‘হাদ্দা’ নামক স্থানে পৌঁছে আমর ইবনুল আসের সাথে আমাদের দেখা হলো। আলাপ করে জানা গেল তিনিও একই উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তারপর আমরা তিনজন এক সাথে মদীনায় পৌঁছে রাসূল সা: এর খিদমতে হাজির হই। প্রথমে আমি, তারপর উসমান ও আমর রাসূলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ করি। সে ছিল অষ্টম হিজরীর সফর মাস। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬১-৬২, কবি আবদুল্লাহ ইবন যাবয়ারী তালহার ইসলাম গ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে সে সময় একটি কাসীদা রচনা করেছিলেন। তার কিছু অংশ হিবন হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে সংকলন করেছেন (সীরাত-২/২৭৮)। অন্য একটি বর্ণনামতে, উসমান হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং খালিদ ও আমরের সাথে মদীনায় যান। (আল ইসাবা-৩/৪৬০)। অপর দিকে মক্কা বিজয় সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা: এর নিকট থেকে উসমান কাবার চাবি লাভ করার পর সেই দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। এতে বাহ্যত: প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, মক্কা বিজয়ের পর একজন অমুসলিমের হাতে রাসূল সা: কাবার চাবি তুলে দিতে পারেন কি? চাবি দেওয়ার ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন হচ্ছে, মক্কা বিজয়ের পূর্বেও কাবার চাবি ছিল উসমানের নিকট। মক্কা বিজয়ের পূর্বে একজন মুসলমানের হাতে কাবার চাবি থাকবে, আর কুরাইশরা তা মেনে নেবে, এ কি সম্ভব? এ সব প্রশ্নের সমাধান এ ভাবে হতে পারে, তিনি খালিদ ও আমরের সাথে পূর্বেই মদীনায় গিয়ে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে মক্কায় চলে আসেন? কিন্তু মক্কার লোকেরা তা হয়তো জানতো না। (আসাহহুস সিয়ার-৩০৪-৩০৬)।
জাহিলী যুগ থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত কাবার তত্বাবধান ও চাবি রক্ষকের দায়িত্ব উসমানের ওপর ন্যাস্ত ছিলো। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত রাসূলে কারীম সা: কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য তার নিকট চাবি চাইলেন। তিনি বাড়ীতে গিয়ে তার মায়ের নিকট চাবি চাইলে তিনি দিতে অস্বীকার করেন। সম্ভবত: তখনও উসমানের মা ইসলাম গ্রহণ করেননি। উসমান কোষমুক্ত তরবারি উঁচু করে ধরে মাকে জবরদস্তি চাবি এনে নিয়ে হযরত রাসূলে কারীমের হাতে অর্পণ করেন। রাসূল সা: দরজা খুলে কাবার ভেতরে প্রবেশ করেন। উসমানও সংগে ছিলেন। দরযা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর কাবা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করার পর রাসূল সা: বের হয়ে আসেন। অত:পর রাসূল সা: মসজিদে বসলেন। আলী (রা) কাবার চাবিটি হাতে নিয়ে এসে দাড়িয়ে আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, চাবিটি আমাদের দায়িত্বে অর্পণ করুন। সিকায়াহ ও হিজাবাহ (হাজীদের পানি পান ও কাবার রক্ষণাবেক্ষণ) উভয় দায়িত্ব এখন থেকে বনু হাশিমের হাতে দান করুন।
সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, সে দিন আববাস ইবনুল আব্দুল মুত্তালিব কাবার চাবিটি হস্তগত করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন এবং তাকে সমর্থন করেছিল বনু হাশিমের আরও কিছু লোক। সিকায়াহ বা পানি পান করানোর দায়িত্ব পূর্ব থেকেই আব্বাসের ওপর ন্যস্ত ছিল।
বনু হাশিমের এ দাবীর মুখে হযরত রাসূলে কারীম সা: বললেন: উসমান ইবন তালহা কোথায়? উসমানকে ডাকা হলে রাসূল সা: তার হাতে মতান্তরে উসমান ও তার চাচাতো ভাই শাইবার হাতে চাবিটি দিয়ে বললেন: এই তোমার চাবি। এখন থেকে এই চাবি চিরদিনের জন্য তোমাদের হাতে থাকবে। কেউ তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সে হবে অত্যাচারী। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪১১-১২)
ইবন সাদ লিখেছেন: কাবার চাবি পূর্ব থেকেই উসমান ইবন তালহার দায়িত্বে ছিল। তিনি প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কাবার দরজা খুলতেন। একবার রাসূল সা: তাকে ভিন্ন এক দিন দরযা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত শক্তভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাসূল সা: সেদিন বলেছিলেন, ওহে উসমান এমন একদিন আসবে যখন এ চাবি আমারই আয়ত্বে থাকবে এবং আমি যাকে ইচ্ছা তাকেই অর্পণ করবো। উসমান বলেছিলেন: সম্ভবত: সেদিন গোটা কুরাইশ বংশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। রাসূল সা: তার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেন: না, বরং সেই দিনটি হবে কুরাইশদের প্রকৃত ইযযত ও সম্মানের দিন। তাই মক্কা বিজয়ের দিন উসমান যখন রাসূলুল্লাহর সা: হাত থেকে চাবিটি নিয়ে চলে যাচিছলেন তখন তিনি উসমানকে পুনরায় ডেকে অতীতের সেই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। উসমান তখন বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল।
আজও কাবার চাবি মক্কার শাইবী গোত্রের লোকের হাতে বিদ্যমান। এই শাইবী গোত্র হযরত উসমান ইবন তালহার (রা) চাচাতো ভাই শাইবা ইবন উসমান ইবন আবী তালহার বংশধর। এই শাইবা ইবন উসমান হুনাইন যুদ্ধের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তার পিতা উসমান ইবন আবী তালহা উহুদ যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। আর তার মা উহুদ যুদেধ শাহাদত বরণকারী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুসআব ইবন উমাইরের বোন উম্মু জামীল হিন্দা বিনতু উমাইর। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর একটি বর্ণনা মতে হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা বিজয়ের দিন কাবার চাবিটি শাইবা ও উসমান উভয়ের হাতে এক সাথে অর্পণ করেন। চাবিটি তখন উসমান ইবন তালহা ইবন আবী তালহার হাতে থাকে। তার মৃত্যুর পর উসমানের চাচাতো ভাই শাইবা ইবন উসমান ইবন আবী তালহা গ্রহণ করেন। তখন থেকে তার অধ:স্তন পুরুষদের হাতে কাবার চাবি বিদ্যমান। (আসাহুস সিয়ার, পৃ. ৩০৫)।
মক্কা বিজয়ের পর হযরত উসমান ইবন তালহা মদীনায় চলে যান এবং রাসূল সা: এর জীবদ্দশা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। রাসূলুল্লাহর সা: ইনতিকালের পর কাবার চাবি রক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য্ আবার মক্কায় ফিরে যান এবং এখানে হিজরী ৪২ সনে ইনতিকাল করেন। অবশ্য অন্য একটি বর্ণনামতে তিনি খলীফা হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালের প্রথম দিকে আজনাদাইনের যুদেধ শাহাদত বরণ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১, টীকা-৩, পৃ. ৪৭০)।
হযরত উসমান ইবন তালহার শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও উন্নত নৈতিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় হযরত উম্মু সালামার হিজরাতের ঘটনার মধ্যে। হযরত উম্মু সালামা তার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, তার চেয়ে অধিকতর কোন ভদ্র লোক আমি আরবে আর কখনও দেখিনি। যখন তিনি আমাকে সংগে নিয়ে কোন মানযিলে পৌঁছতেন, আমার নামার জন্য উট বসিয়ে দূরে সরে যেতেন। আমি উটের হাওদা থেকে নেমে একটু দুরে সরে গেলে তিনি আবার ফিরে এসে উটটি গাছের সাথে বাধতেন এবং আমার নিকট থেকে একটু দূরে কোন গাছের তলায় শুয়ে পড়তেন। আবার যাত্রার সময় হলে উট প্রস্তুত করে আমার কাছাকাছি নিয়ে এসে তিনি সরে যেতেন এবং বলতেন; উটে আরোহন কর। আমি উটের পিঠে ঠিকমত বসার পর তিনি ফিরে আসতেন এবং লাগামটি ধরে নিয়ে চলা শুরু করতেন। এভাবে তিনি আমাকে মদীনায় পৌঁছে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৯-৭০) (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৫৮-৩৫৯) এই ছিল হযরত উসমান ইবন তালহার (রা) ইসলাম পূর্ব জীবনে নৈতিকতার বাস্তব রূপ।