নাম তুলাইব, ডাকনাম আবু আদী। পিতা উমাইর ইবন ওয়াহাব, মাতা রাসুলুল্লাহর (মা) ফুফু আরওয়া বিনতু আবদুল মুত্তালিব। কুরাইশ বংশের বনী আবদী শাখার সন্তান। (আনসাবুল আশরাফ-১/৮৮)।
হযরত তুলাইবের জন্ম ও ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ইসলামের সূচনা পর্বেই যে তিনি এক কাফিলায় শরিক হন সে কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইতিহাসে বর্ণিত কিছু কিছু ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়, তার মামাতো ভাই মুহাম্মাদ ও তার দ্বীনের প্রতি ছিল তার সীমাহীন ভক্তি ও ভালোবাসা। রাসূল সা: প্রতি কুরাইশদের বৈরী আচরণে তুলাইব ছিলেন সব সময় ক্রুব্ধ। রাসূল সা: এর প্রতি কুরাইশদের রূঢ় আচরণের কঠিন জবাবও তিনি মাঝে মাঝে দিতেন। আর এসব কাজে তার নেককার মা তাকে সব সময় সমর্থন জানাতেন।
আল হারেস আত তাঈমী বলেন, রাসূল সা: মক্কার দারুল আরকাম বা আরকামের গৃহে অবস্থানকালে ‘তুলাইব’ ইবন উমাইর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর সেখান থেকে বের হয়ে সোজা মা আরওয়া বিনতু আবদুল মুত্তালিবের নিকট উপস্থিত হন। মাকে বলেন: মা, আমি মুহাম্মাদের অনুসরণ করেছি, আল্লাহর নিকট নিজেকে সমপর্ণ করেছি। মা বললেন: তোমার সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন তোমার মামার ছেলে। পুরুষদের যে শক্তি ও ক্ষমতা আছে আমার তা থাকলে আমি অবশ্যই মানুষের হাত থেকে তাকে বাঁচাতাম। তুলাইব বললেন: মা, ইসলাম গ্রহণ করে তার অনুসারী হতে আপনার সামনে কিসের বাধা? আপনার ভাই হামযা, তিনি তো ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মা বললেন: আমার অন্য বোনেরা কি করে, আমি সেই প্রতীক্ষায় আছি। আমি তাদের সাথে সাথেই থাকবো।
তুলাইব বললেন: যতক্ষণ আপনি তার নিকট গিয়ে তাকে সালাম করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর সাক্ষ্য না দেবেন, আমি ততক্ষণ আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দুআ করতে থাকবো। সন্তানের এই অনুরোধ ভাগ্যবতী মা প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন: আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বা প্রেরিত বান্দা। এই দিন থেকে তিনি তার যবান দ্বারা রাসূলুলুল্লাহকে সা: সব রকম সহায়তা করতে শুরু করেন এবং পুত্র তুলাইবকে সর্ব অবস্থায় রাসূলুল্লাহর সা: পাশে দাড়ানোর নির্দেশ দেন। (তাবাকাত-৩/১২৩, আল ইসাবা-২ ২৩৩-২৩৪)।
মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তারা নানাভাবে কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত হন। একদিন তুলাইব ও হাতেব ইবন আমর মক্কার ‘আজ ইয়াদে আসগার’ এলাকায় নামায আদায় করছেন। মক্কার ততকালীন চরম দুই সন্ত্রাসী ইবনুল আসদা ও ইবনুল গায়তালা তা দেখে ফেলে। তারা তুলাইব ও হাতেবের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে আক্রমণ চালায়। হাতেব ও তুলাইব প্রায় এক ঘন্টা যাবত সে আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং প্রাণ বাঁচিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান। (আনসাবুল আশরাফ-১/১১৭)।
মক্কার উকবা ইবন আবী মুয়াইত ছিল রাসুলুল্লাহর সা: চরম দুশমন। তাছাড়া সে ছিল অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির। নানাভাবে সে রাসুলুল্লাহকে সা: কষ্ট দিত। একদিন সে এক ঝুড়ি ময়লা নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহর সা: বাড়ীর দরযায় ফেলতে শুরু করে। ব্যাপারটি তুলাইবের নজরে পড়ে। তিনি ছুটে গিয়ে উকবার হাত থেকে ঝুড়িটি ছিনিয়ে নিয়ে তার দুটি কান মলে দেন। উকবা খুব ক্ষেপে গিয়ে তুলাইবের পিছু পিছু তার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ জানায় এই বলে: তুমি কি দেখনা, তোমার ছেলে মুহাম্মাদের পক্ষ নিয়েছে?আব্দুল মুত্তালিবের ভাগ্যবতী মেয়ে জবাব দিলেন: আচ্ছা তুমিই বল, তার পক্ষ নেওয়ার জন্য তুলাইবের চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত ব্যক্তি আর কে আছে? মুহাম্মাদ তো তার মামাত ভাই। আমাদের অর্থ কড়ি, জীবন সবই তো মুহাম্মাদের জন্য নিবেদিত। তারপর তিনি একটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। যার অর্থ: তুলাইব তার মামাতো ভাইকে সাহায্য করেছে, সে তার রক্ত ও অর্থের ব্যাপারে সমবেদনা জানিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এই উকবা বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং রাসূল সা: বিশেষ নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪৭)।
হযরত তুলাইব (রা) ইসলাম গ্রহণের পর বেশ কিছুদিন কুরাইশদের সকল অত্যাচার নিপীড়ন প্রতিরোধ করে মক্কায় অবস্থান করেন। কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা চরম রূপ ধারণ করে এবং মক্কায় টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন হাবশাগামী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থানের পর মক্কাবাসীদের সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন একটি গুজব শুনে যারা হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে আসেন তাদের মধ্যে তুলাইবও ছিলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩২৪, ৩৬৬)।
হাবশা থেকে ফিরে কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করেন। তারপর আবার মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন সালামা আল আজলানীর অতিথি হন। রাসুল সা: মুনজির ইবন আমর আস সায়েদীর সাথে তার মুওয়াখাত বা ইসলামী ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।
মুহাম্মাদ ইবন উমারের বর্ণনা মতে হযরত তুলাইব বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। তাবারী বলেন: বদর যুদ্ধে তার যোগদানের ব্যাপারটি প্রমাণিত সত্য। অবশ্য মূসা ইবন উকবা, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ও আবূ মাশার বদর যুদ্ধে যারা যোগদান করেন তাদের নামের তালিকায় তুলাইবের নামটি উল্লেখ করেননি। (তাবাকাত-৩/১২৩)
বদর যুদ্ধের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার কর্মকান্ডের আর কোন তথ্য সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায়, তার মত এমন তেজোদীপ্ত পুরুষ কখনও চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। আমরণ সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
হিজরী ১৩ সনে জামাদিউল উলা মাসে আজনাদাইন যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তবে মুসয়াব ইবন আবদিল্লাহ বলেন: তিনি ইয়ারমুক যুদ্ধে শহীদ হন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তিনি কোন সন্তানাদি রেখে যাননি। (তাবাকাত-৩/১২৪, আল ইসতীয়াব)।