নাম আমের, কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ এবং পিতা রাবীয়া। তার খান্দান হযরত উমারের (রা) পিতা খাত্তাব এর হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ ছিল। খাত্তাব তাকে এত ভালোবাসতেন যে, তাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। এ কারণে প্রথম জীবনে আমের ইবনুল খাত্তাব (খাত্তাবের পুত্র আমের) নামে পরিচিত হন। কিন্তু কুরআন যখন প্রথা বাতিল করে প্রত্যেক মানুষকে তার জন্মদাতা পিতার নামে পরিচয় গ্রহণের নির্দেশ দেয়, তখন হযরত আমেরও খাত্তাবের পরিবর্তে নিজের জন্মদাতা পিতা রাবীয়ার নামে পরিচিত হন।
উল্লিখিত সম্পর্কের কারণে হযরত আমের ও হযরত উমারের মধ্যে শেষ জীবন পর্যন্ত অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। হযরত উমারের ‘বাইতুল মাকদাস’ সফরের সময় হযরত আমের তার সফরসঙ্গী ছিলেন। যে বছর হযরত উসমানকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে হযরত উমার হজ্জে যান, সঙ্গে আমেরও ছিলেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়ার পূর্বে ইসলামের সেই সূচনাপর্বে রাসূলুল্লাহর সা: আহবানে সাড়া দিয়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, হযরত আমের সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন। শিরক ও তাওহীদের সংঘাত সংঘর্ষ এবং কাফিরদের যুলুম নির্যাতনে তিনিও শান্তিতে মক্কায় বসবাস করতে পারেননি। তিনি স্ত্রী হযরত লায়লাকে সংগে করে শান্তিও নিরাপত্তার সন্ধানে দুইবার হাবশায় হিজরাত করেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন: আমেরের স্ত্রী বলেন: আমরা হাবশায় হিজরাতের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমের কোন প্রয়োজনে বাড়ীর বাইরে যান। এমন সময় উমার আমার সামনে এসে দাড়ায়। তখনও সে শিরকের ওপর। আমরা তার হাতে নিগৃহীত হতাম। উমার আমাকে বললো: আবদুল্লাহর মা, এ কি! তোমাদের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি? বললাম: হাঁ, আমরা আল্লাহর এক যমীন হতে অন্য যমীনের দিকে যাব। তোমরা আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছ, আমাদের ওপর যুলুম করেছো। দেখা যাক, আল্লাহ কোন উপায় বের করে দেন কি না। উমার বললো: আল্লাহ তোমাদের দিনটি মঙ্গলময় করুন। আমেরের স্ত্রী বলেন: আমি সেদিন উমারকে এত নরম দেখলাম যা আর কখনও দেখিনি।উমার চলে গেল। আমাদের দেশত্যাগে সে অত্যন্ত কষ্ট পায়। আমের বাড়ী ফিরলে আমি তাকে বললাম: আবদুল্লাহর বাপ, এই মাত্র তুমি যদি উমারের বিষন্নতা ও আমাদের প্রতি তার দরদ দেখতে! আমের বললেন: তুমি তার ইসলাম গ্রহণের আশা করছো? বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: খাত্তাবের গাধা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে, তবে তুমি যাকে দেখেছো সে ইসলাম গ্রহণ করবে না। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৫৬)।
হযরত আমের (রা) হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে এসে সস্ত্রীক আবার মদীনায় হিজরাত করেন। ইবন ইসহাক বলেন: মুহাজিরদের মধ্যে সাবু সালামার পর সর্বপ্রথম মদীনায় আসেন আমের ইবন রাবীয়া ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৬৩)। অনেকের মতে এটা সঠিক নয়। তার পূর্বে আরও কতিপয় ব্যক্তি মদীনায় পৌঁছেন। তবে এ কথা সত্য যে, তার স্ত্রী হযরত লায়লা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতকারী প্রথম মহিলা।
বদর, উহুদ, খন্দক সহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসুল সা: সংগে ছিলেন। তাছাড়া ছোট ছোট অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। জীবন বাজি রেখে আল্লাহর বাণী বা কালেমা প্রচারের দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করেন। স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইবন আমেরের কাছে প্রায়ই নিজের গৌরবজনক কর্মকান্ডের কথা গর্বের সাথে বর্ণনা করতেন। একবার কথা প্রসঙ্গে বলেন: রাসুল সা: আমাদেরকে অভিযানে পাঠাতেন। দারিদ্রের কারণে পাথেয় হিসেবে সামান্য কিছু খেজুর দিতেন। প্রথম প্রথম আমরা এক এক মুট করে পেতাম, তারপর কমতে কমতে একটি মাত্র খেজুরে এসে ঠেকতো। হযরত আবদুল্লাহ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করেন: একটা খেজুরে কিভাবে চলতো? জবাবে তিনি বললেন: প্রিয় বৎস! এমনটি বলো না। যখন খেজুর শেষ হয়ে যেত, তখন আমরা এই একটি খেজুরের জন্যও কাতর হয়ে পড়তাম।
হযরত উসমানের খিলাফতের শেষ দিকে যখন ফিতনা ও আত্মকলহ চরমরূপ ধারণ করে তখন হযরত আমের (রা) নির্জন বাস গ্রহণ করেন। রাত দিন সব সময় রোযা, নামায ও ইবাদাতে মাশগুল থাকতেন। একদা গভীর রাত পর্যন্ত ইবাদাতে মগ্ন ছিলেন, এ অবস্থায় একটু তন্দ্রাভাব আসে। তিনি স্বপ্নে দেখেন, কেউ যেন তাকে বলছেন, ‘উঠো, আল্লাহর কাছে দুআ কর, তিনি যেন তোমাকে এই ফিতনা থেকে বাঁচান- যিনি তার অন্য নেক বান্দাদের রক্ষা করেছেন।’ হযরত আমের সংগে সংগে উঠে বসেন। এই ঘটনার পর তার নির্জনতা অবলম্বন ও ইবাদাতের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এরপর থেকে কেউ আর তাকে ঘর থেকে বের হতে দেখেনি। এ অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হযরত উসমানের শাহাদাতের কয়েকদিন পর ইনতিকাল করেন। অতিরিক্ত নির্জনতা অবলম্বনের জন্য কেউ জানতে পারেনি তিনি কবে অসুস্থ হন এবং কবেই বা মৃত্যুবরণ করেন। হঠাত তার জানাযা দেখে লোকেরা অবাক হয়ে যায়।
মুসয়াব ইবন যুবাইর বলেন: আমের হিজরী ৩২ সনে মারা যান। আবু উবাইদার মতে তার মৃত্যুসন হিজরী ৩৭ হিজরী সন। ওয়াকিদী বলেন, হযরত উসমানের শাহাদাতের অল্প কিছুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (আল ইসাবা-২/ ২৪৯)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার, আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর, আবু উমামা ইবন সাহল প্রমূখের সূত্রে তিনি রাসূল সা: এর হাদীস বর্ণনা করেছেন যা বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
আমের ইবন রাবীয়া থেকে বর্ণিত। আরবের এক ব্যক্তি তার নিকট আসে। আমের তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন। লোকটি সে কথা রাসূল সা: এর কাছে বর্ণনা করে। সে আবার ফিরে এসে আমেরকে বলে, আমি রাসূল সা: এর কাছে এমন একটি উপত্যাকার মালিকানা চেয়েছি, যার থেকে উত্তম উপত্যকা আরবে দ্বিতীয়টি নেই। আমি ইচ্ছা করেছি তার কিছু অংশ আপনাকে দান করবো। যা আপনার ও আপনার পরবর্তী প্রজন্মের কাজে আসবে। আমের বললেন: তোমার ঐ জমির কোন প্রয়োজন আমার নেই। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে কুরআনের এ আয়াতটি নাযিল হয়: মানুষের হিসাব নিকাশ নিকটবর্তী হয়েছে অথচ এখনও তারা অমনোযোগী হয়ে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। (সূরা আল আম্বিয়া-১) আমের বলেন, এ আয়াত আমাদেরকে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ করে তোলে। (আল ইসাবা-২/২৫১-৫২)।