নাম আকীল ডাক নাম আবু ইয়াযীদ। পিতা আবু তালিব ইবন আবদিল মুত্তালিব মাতা ফাতিমা। কুরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। চতুর্থ খলীফা হযরত আলীর সৎ ভাই এবং আলী অপেক্ষা বিশ বছর বড়।
আকীল পিতা আবু তালিবের কাছে প্রতিপালিত হন। রাসুলুল্লাহর সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে একবার মক্কায় দারুণ অভাব দেখা দেয়। কুরাইশদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা: ও আব্বাসের অবস্থা তুলনামূলকভাবে একটু ভালো চিল। একদিন রাসূলুল্লাহ সা: আব্বাসকে বললেন: চাচা, আপনার ভাই আবু তালিবের অবস্থা তো আপনার জানা। তার সন্তান সংখ্যা বেশি। চলুন না আমরা তার কিছু সন্তানের দায়িত্ব নেই। তারা দুজন আবু তালিবের কাছে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। আবু তালিব বললেন, আকীল ছাড়া আর যাকে খুশি তোমরা নিয়ে যেতে পার। রাসূলুল্লাহ সা: আলীকে এবং আব্বাস জাফরকে নিয়ে গেলেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৫৩০)।
আকীলের অন্তর প্রথম থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি দূবল ছিল। কিন্তু কুরাইশদের ভয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করতে পারেননি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরদার মুশরিকদের সাথে বদর যুদ্ধে যোগদান করেন এবং আরও অনেকের সাথে তিনিও মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হন। রাসূলুল্লাহ সা: স্বীয় খান্দানের কে কে বন্দী হয়েছে তা দেখার জন্য আলীকে নির্দেশ দেন। আলী খোজ খেবর নিয়ে বলেন: নাওফিল, আব্বাস, ও আকীল বন্দী হয়েছে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা: নিজেই তাদের দেখতে যান এবং আকীলের পাশে দাড়িয়ে বলেন: আবু জাহল নিহত হয়েছে। আকীল বললেন: এখন তিহামা অঞ্চলে মুসলমানদের কোন প্রতিপক্ষ নেই। আকীল ছিলেন রিক্তহস্ত। আব্বার তার মুক্তিপণ পরিশোধ করে তাকে ছাড়িয়ে নেন। বদরে তিনি হযরত উবাইদ ইবন আউসের হাতে বন্দী হন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৮৭)।
বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মক্কায় ফিরে যান। মক্কা বিজয়ের বছর মতান্তরে হুদাইবিয়ার সন্ধির পর যথারীতি ইসলাম গ্রহণ করে অষ্টম হিজরী সনের প্রথম দিকে মদীনায় হিজরাত করেন। (আল ইসাবা-২/৪৯৪)।
মূতা অভিযানে অংশগ্রহণের পর আবার মক্কায় ফিরে যান এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে মক্কা বিজয়, তায়েফ ও হুনাইন অভিযানে শরীক হতে পারেননি। (উসুদুল গাবা-৩/৪২২) তবে কোন কোন বর্ণনা মতে তিনি হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধে প্রথম দিকে যখন মুসলিম বাহিনীর পরাজয় হতে চলেছিল, এমনকি মুহাজির ও আনসাররাও পালাতে শুরু করেছিল, তখন যারা দৃঢ়পদ ছিলেন তাদের একজন তিনি (আল ইসাবা-২/৪৯৪)।
ইবন হিশাম বলেন: আকীল্ ইবন আবী তালিব হুনাইন যুদ্ধের দিন রক্তমাখা তরবারি হাতে স্ত্রী ফাতিমা বিনতু শাইবা ইবন রাবীয়ার তাবুতে প্রবেশ করেন। স্ত্রী বলেন: আমি বুঝেছি তুমি যুদ্ধ করেছো। তবে কী গণীমত (যুদ্ধলদ্ধ জিনিস) আমার জন্য নিয়ে এসেছ? আকীল বললেন: এই নাও একটি সুঁচ, কাপড় সেলাই করবে। তিনি সুঁচটি স্ত্রীর হাতে দিলেন। এমন সময় রাসুলুল্লাহর সা: ঘোষকের কন্ঠ শোনা গেল। তিনি ঘোষণা করছেন: কেউ কোন জিনিস নিয়ে থাকলে ফেরত দিয়ে যাও। এমনটি একটি সুঁচ-সুতো নিয়ে থাকলে ফেরত দিয়ে যাও। আকীল স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন: তোমার সুঁচটিও চলে গেল। এই বলে তিনি স্ত্রীর হাত থেকে সূঁচটি নিয়ে গণীমতের সম্পদের স্তুপে ফেলে দিলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪৯২)।
রাসুলুল্লাহর সা: ইনতিকাল তথা হুনাইন যুদ্ধের পর থেকে খলীফা উসমানের খিলাফতের শেষ পর্যন্ত হযরত আকীলের ভূমিকা ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে হযরত উমারের খিলাফতকালে বাইতুল মালে যখন প্রচুর অর্থ জমা হতে থাকে তখন তিনি এই অর্থের ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত আলী (রা) সকল অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। হযরত উসমান বললেন: প্রচুর অর্থ, সকলে পাবে। তবে কে পেল, আর কে পেল না তা হিসেব না রাখলে বিষয়টি বিশৃঙ্খলার রূপ নেবে। তখন ওয়ালীদ ইবন হিশাম ইবন মুগীরা বললেন: আমীরুল মুমিনীন। আমি শামে গিয়েছি। সেখানে রাজাদের দেখেছি, তারা দিওয়ান তৈরী করে সবকিছু পৃথকভাবে লিখে রাখেন। তার পরামর্শটি খলীফার পছন্দ হলো। তিনি আকীল, মাখরামা ও জুবাইর ইবন মুতয়িমকে নির্দেশ দিলেন মর্যাদা অনুযায়ী নাগরিকদের তালিকা তৈরী করার জন্য। এ তিনজন ছিলেন কুরাইশদের বিশিষ্ট বংশবিদ্যা বিশারদ। তারা তালিকা তৈরী করে দেন। (হায়াতুস সাহাবা-২২০)।
হযরত আলী (রা) ও হযরত মুআবিয়ার (রা) বিরোধের সময় হযরত আকীলকে আবার ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়। যদিও তিনি আলীর (রা) ভাই, তথাপি নিজের প্রয়োজনে আমীর মুআবিয়ার (রা) সাথে সম্পর্ক রাখতেন। আলী-মুআবিয়া বিরোধের সময় তিনি মদীনা ছেড়ে শামে মুআবিয়ার কাছে চলে যান। এর কারণ ইতিহাসে এভাবে উল্লেখ হয়েছে যে, আকীল ছিলেন ঋণগ্রস্ত অভাবী মানুষ, তার ছিল অর্থের প্রয়োজন। আর আমীর মুআবিয়ার (রা) খাযানা ছিল উন্মুক্ত। দারিদ্র ও অভাব তাকে হযরত মুআবিয়ার পক্ষাবলম্বনে বাধ্য করে।
হযরত মুআবিয়ার (রা) সাথে হযরত আলীর (রা) বিরোধ যখন তুঙ্গে তখন আকীল একবার ঋণ পরিশোধের আশায় হযরত আলীর (রা) কাছে যান। আলী তাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। তিনি পুত্র হাসানকে তার সেবার দায়িত্ব দেন। হাসান অত্যন্ত যত্নের সাথে তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। রাতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবারের জন্য ডাকা হলো। আকীল এসে দেখলেন, দস্তরখানে কিছু শুকনো রুটি, লবণ ও সামান্য কিছু তরকারি সাজানো। আকীল বললেন: খাবার শুধু এই? আলী বললেন: হা। এবার আকীল নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বললেন: আমার ঋণ সমূহ তুমি পরিশোধ করে দাও। আলী জিজ্ঞেস করলেন: কি পরিমাণ হবে? বললেন: চল্লিশ হাজার দিরহাম। আলী বললেন: এত অর্থ আমি কোথায় পাব? একটু অপেক্ষা করুন, আমার ভাতা চার হাজার হলে আপনাকে দিতে পারবো। আকীল বললেন: তোমার অসুবিধা কোথায়? বাইতুল মাল তো তোমার হাতে। তোমার ভাতা বৃদ্ধির অপেক্ষায় আমাকে কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে? আলী বললেন: আমি তো মুসলমানদের অর্থের একজন আমানতদার মাত্র। আপনি কি চান, আমি সেই অর্থ আপনাকে দিয়ে খিয়ানত করি? এ উত্তর শুনে আকীল সোজা শামে আমীর মুআবিয়ার কাছে চলে যান। মুআবিয়া (রা) আকীলকে জিজ্ঞেস করেন: তুমি আলী ও তার সাথীদের কেমন দেখলে? আকীল বললেন: তারা রাসুলুল্লাহর সা: সঠিক সাহাবী। শুধু এতটুকু অভাব যে, রাসুল সা: তাদের মাঝে নেই। আর তুমি ও তোমার সংগী সাথীরা ঠিক আবু সুফইয়ানের সংগী সাথীদের মত। এমন তুলনা দেওয়ার পরও আমীর মুআবিয়া (রা) পরের দিন আকীলকে ডেকে পঞ্চাশ হাজার দিরহাম তার হাতে তুলে দেন। (উসুদুল গাবা-৪২৩)।
হযরত আকীলের শামে উপস্থিতির পর হযরত মুআবিয়া (রা) তাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করে বলতেন: আমি যদি সত্যের ওপর না হতাম তাহলে আকীল তার ভাই আলীকে ছেড়ে আমার পক্ষাবলম্বন করলেন কিভাবে? একবার মুআবিয়া (রা) হযরত আকীলের (রা) উপস্থিতিতে মানুষের সামনে যুক্তি উপস্থাপন করলে আকীল প্রতিবাদ করে বললেন: আমার ভাই দীনের জন্য ভাল। আর তুমি দুনিয়ার জন্য। এটা ভিন্ন কথা যে, আমি দুনিয়াকে দ্বীনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছি। আর আখিরাতের ব্যাপার- তা তার উত্তম সমাপ্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করি (উসুদুল গাবা-৩/৪২৩)
হযরত মুআবিয়ার (রা) খিলাফতকালের শেষ দিকে অথবা ইয়াযীদের শাসনকালের প্রথম দিকে হযরত আকীল ইনতিকাল করেন। (আল ইসাবা-২/৪৯৪)।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রাসুলুল্লাহর সা: দীর্ঘ সাহচর্য লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এ কারণে রাসুলুল্লাহ সা: একান্ত আপন ও প্রিয়জন হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার যে পারদর্শিতা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। তথাপি হাদীদের গ্রন্থসমূহে তার বর্ণিত দু চারটি হাদীস পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ, হাসান বসরী, আতা প্রমূখ তাবেয়ী তার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়াও তিনি জাহিলী যুগের বিভিন্ন জ্ঞানে দক্ষ ছিলেন। ইলমুল আনসাব, আইয়্যামুল আরব- বংশবিদ্যা, প্রাচীন আরবের যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছিলেন সুবিজ্ঞ। এসব বিষয়ে জ্ঞান আহরণের জন্য মানুষ তার নিকট আসতো। তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের পর এসব বিষয়ের আলোচনা করতেন এবং লোকেরা তা বসে বসে শুনতো।
হিশাম আল কালবী বলেন: আকীল, মাখরামা, হুয়াইতিব ও আবু জাহম-কুরাইশদের এ চার ব্যক্তির নিকট মানুষ তাদের ঝগড়া বিবাদ ফায়সালার জন্য যেত। (আল ইসাবা-২/৪৯৪)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন: আবু যায়িদ, তোমার প্রতি আমার দ্বিগুণ ভালোবাসা। একটা আত্মীয়তা এবং অন্যটা আমার চাচা তোমাকে ভালোবাসতেন- এই দুই কারণে।
সুখে দুখে সর্বাবস্থায় হযরত আকীল (রা) রাসুলুল্লাহর সা: সুন্নাতের যথাযথ অনুসারী ছিলেন। একবার তিনি নতুন বিয়ে করেছেন। সকাল বেলা পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে স্বাগতম জানাতে এলো। তারা জাহিলী যুগে প্রচলিত দুটি শব্দ উচ্চারণ করে স্বাগতম জানালো। শব্দ দুটিতে ইসলাম বিরোধী কোন ভাবও ছিল না। তবে যেহেতু স্বাগতমের ইসলামী ভাষা বিদ্যমান ছিল তাই তিনি তাদের ভুল শুধরে দিয়ে বললেন: এমনটি নয় বরং এ কথা বলো: বারাকাল্লাহু লাকুম ওয়া বারাকাল্লাহু আলাইকুম। আমাদেরকে এভাবে বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত রাসূলে কারীম সা: তার জীবিকার জন্য খাইবরের উৎপন্ন শস্য থেকে বার্ষিক ১৪০ ওয়াসক নির্ধারণ করে দিয়ে যান। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৫০)।