নাম তাঁর হামযা, আবু ইয়ালা ও আবু ’আম্মারা কুনিয়াত এবং আসাদুল্লাহ উপাধি। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. আপন চাচা। হযরত হামযার জননী হালা বিনতু উহাইব রসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার চাচাতো বোন। তাছাড়া হামযা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. দুধ ভাই। আবু লাহাবের দাসী ‘সুওয়াইবা’ তাঁদের দু’জনকে দুধ পান করিয়েছিল। বয়সে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অপেক্ষা দু’বছর মতান্তরে চার বছর বড়। ছোট বেলা থেকেই তরবারি চালনা, তীরন্দাযী ও কুস্তির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ভ্রমণ ও শিকারে ছিল তাঁর সীমাহীন আকর্ষণ। জীবনের বিরাট এক অংশ তিনি এ কাজে ব্যয় করেন।
বেশ কিছুকাল যাবত মক্কার অলি গলিতে তাওহীদের দাওয়াত উচ্চারিত হচ্ছিলো। তবে হামযার মত সিপাহী-স্বভাব মানুষের এ দাওয়াতের প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না।
একদিন তিনি শিকার থেকে ফিরছিলেন। সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি এলে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের এক দাসী তাঁকে ডেকে খবরটি দিল। বললোঃ ‘আবু আম্মারা, ইস্, কিছুক্ষণ আগে এসে আপনার ভাতিজার অবস্থা যদি একটু দেখতেন! তিনি কা’বার পাশে মানুষকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু জাহল তাঁকে শক্ত গালি দিয়েছে, ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ কোন প্রত্যুত্তর না করে নিতান্ত অসহায়ভাবে ফিরে গেছে।’ একথা শুনে তাঁর সৈনিকসুলভ রক্ত টগবগ করে উঠলো। দ্রুত তিনি কা’বার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল, শিকার থেকে ফেরার পথে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে দু’চারটি কথা বলা। কিন্তু আজ তিনি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মাদ হয়ে পড়লেন। রাস্তায় কারো দিকে কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা কা’বার কাছে গিয়ে আবু জাহলের মাথায় ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত বসিয়ে দিরেন। আবু জাহলের মাথা কেটে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বনু মাখযুমের কিছু লোক আবু জাহলের সাহায্যে ছুটে এলো। তারা বললোঃ ‘হামযা, সম্ভবতঃ তুমি ধর্মত্যাগী হয়েছো।’ জবাবে বললেনঃ ‘যখন তার সত্যতা আমার নিকট প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখন তা থেকে আমাকে বিরত রাখবে কে? হ্যাঁ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। যা কিছু তিনি বলেন সবই সত্যি। আল্লাহর কসম আমি তা থেকে আর ফিরে আসতে পারিনে। যদি তোমরা সত্যবাদী হও, আমাকে একটু বাধা দিয়েই দেখ।’ আবু জাহল তার সাহায্যে এগিয়ে আসা লেকাদের বললোঃ ‘তোমরা আবু আম্মারকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম, কিছুক্ষণ আগেই আমি তাঁর ভাতিজাকে মারাত্মক গাল দিয়েছি।’
পরবর্তীকালে হযরত হামযা বলেছেন, আমি ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলি তো বলে ফেললাম; কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ ও গোত্রের ধর্মত্যাগের জন্য আমি অনুশোচনায় দগ্ঘিভূত হতে লাগলাম। একটা সন্দেহ ও সংশয়ের আবর্তে পড়ে সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। কা’বায় এসে অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, যেন আমার অন্তর-দুয়ার সত্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, অন্তর থেকে সংশয় বিদূরিত হয়। দুআর পর আমার অন্তর দৃঢ় প্রত্যয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে আমার অবস্থা বর্ণনা করলাম। তিনি আমার অন্তরের স্থিতির জন্য দুআ করলেন।
এটা মুসলমানদের সেই দুঃসময়ের কথা যখন রাসূল সা. আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নিয়ে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। মুসলমান বলতে তখন ছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু নিরাশ্রয় মানুষ। এ অবস্থায় আকস্মিকভাবে হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণে অবস্থা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মুমিনদের সাথে কাফিরদের অহেতুক বাড়াবাড়ি ও বেপরোয়া ভাব অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তাঁর দুঃসাহস ও বীরত্বের কথা মক্কার প্রতিটি লোকই জানতো।
হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের পর একদিন হযরত উমার রা. তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দানের জন্য গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। তিনি তখন হযরত আরকামের গৃহে কতিপয় সাহাবীর সাথে অবস্থান করছেন। হযরত হামযাও তখন সেখানে। হযরত উমার ছিলেন সশস্ত্র। তাঁকে দেখেই উপস্থিত সকলে প্রমাদ গুণলো। কিন্তু হযরত হামযা বলে উঠলেনঃ ‘তাকে আসতে দাও। যদি সে ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে, আমরাও তার সাথে ভালো ব্যবহার করবো। অন্যথায় তারই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করা হবে।’ হযরত উমার ভেতরে ঢুকেই কালেমা তাওহীদ পাঠ করতে শুরু করেন। তখন উপস্থিত মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। এই দুই মনীষীর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। মক্কার মুশরিকরা উপলব্ধি করে, মুহাম্মাদের সা. গায়ে আঁচড় কাটা আর সহজ হবে না।
মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর প্রিয় খাদেম যায়িদ ইবন হারিসার সাথে হামযার ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। যায়িদের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা এত প্রগাঢ় হয় যে, যখন তিনি বাইরে কোথাও যেতেন তাঁকেই সব ব্যাপারে অসীয়াত করে যেতেন।
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরে আরো অনেকের সঙ্গে হযরত হামযাও মদীনায় হিজরাত করলেন। এখানে তাঁর খোদা প্রদত্ত শক্তি ও সাহসিকতা প্রকাশ করার বাস্তব সুযোগ এসে যায়।
হিজরাতের সপ্তম মাসে রাসূল সা. ‘ঈস’ অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দিকে তিরিশ সদস্যের মুহাজিরদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠান। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। এ বাহিনীতে আনসারদের কেউ ছিল না। এখানে তাঁরা সমুদ্র উপকূলে আবু জাহলের নেতৃত্বে মক্কার তিনশো অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হন। তারা সিরিয়া থেকে ফিরছিল। কিন্তু মাজদী ইবন ’আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় এ যাত্রা সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। মাজদীর সাথে দু’পক্ষের সন্ধিচুক্তি ছিল। মদীনা থেকে যাত্রার প্রাক্কালে রাসূল সা. হযরত হামযার হাতে ইসলামী ঝাণ্ডা তুলে দেন। ইবন আবদিল বারসহ কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, এটাই ছিল রাসূল সা. কর্তৃক কোন মুসলমানের হাতে তুলে দেওয়া প্রথম ঝাণ্ডা। (সীরাতু ইবন হিশাম)
দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সা. নিজে ষাট জন সশস্ত্র সাহাবী নিয়ে কুরাইশদের বাণিজ্য চলাচল পথে ‘আবওয়া’ অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা ছিলেন পতাকাবাহী এবং গোটা বাহিনীর কমাণ্ডও ছিল তাঁর হাতে। মুসলিম বাহিনী পৌঁছার আগেই কুরাইশ কাফিলা অতিক্রম করায় এ যাত্রাও কোন সংঘর্ষ ঘটেনি। এমনিভাবে হিজরী দ্বিতীয় সনের ‘উশায়রা’ অভিযানেও হযরত হামযা মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর গৌরব লাভ করেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষ কাতারবন্দী হওয়ার পর কুরাইশ পক্ষের উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ সারি থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম বাহিনীর কাউকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। দ্বীনের সিপাহীদের মধ্য থেকে তিনজন আনসার জওয়ান তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু উতবা চিৎকার করে বলে উঠেঃ ‘মুহাম্মাদ, আমাদের সমকক্ষ লোকদের পাঠাও। এসব অনুপযুক্ত লোকদের সাথে আমরা লড়তে চাই না। রাসূলুল্লাহ সা. আদেশ দিলেনঃ হামযা, আলী ও উবাইদা ওঠো, সামনে এগিয়ে যাও।’ তাঁরা শুধু আদেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। এ তিন বাহাদুর আপন আপন নিযা ও বর্শা নিয়ে তাঁদের প্রতিপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথম আক্রমণেই হযরত হামযা জাহান্নামে পাঠালেন উতবাকে। হযরত আলীও বিজয়ী হলেন তাঁর প্রতিপক্ষের ওপর। কিন্তু আবু উবাইদা ও ওয়ালিদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধস্তাধস্তি চলতে লাগলো। অতঃপর আলীর সহযোগিতায় আবু উবাইদা তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। শত্রুপক্ষের এ বেগতিক অবস্থা দেখে তুয়াইমা ইবন আদী’ তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। হামযার সহযোগিতায় আলী রা. তরবারির এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। এরপর মুশরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। মুসলিম মুজাহিদরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন। তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধে হযরত হামযা পাগড়ীর ওপর উটপাখির পালক গুঁজে রেখেছিলেন। এ কারণে যে দিকে তিনি যাচ্ছিলেন সুস্পষ্টভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল। দু’হাতে বজ্রমুষ্টিতে তরবারি ধরে বীরত্বের সাথে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ করে দিচ্ছিলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. দুশমনরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। উমাইয়্যা ইবন খালাফ হযরত আবদুর রহমান ইবন ’আউফকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ উটপাখির পালক লাগানো এ লোকটি কে? তিনি যখন বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. চাচা হামযা, তখন সে বলেছিলঃ ‘এ ব্যক্তিই আজ আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ করেছে।’
মদীনার উপকণ্ঠেই ছিল ইয়াহুদী গোত্র বনু কাইনুকা’র বসতি। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আসার পর তাদের সাথে একটি মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভে তাদের হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ চুক্তি ভংগের কারণে রাসূল সা. দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালন করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা পতাকাবাহীর দায়িত্ব পালন করেন।
বদরের শোচনীয় পরাজয়ে কুরাইশদের আত্ম অভিমান দারুণভাবে আহত হয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত বিশাল কুরাইশ বাহিনী হিজরী তৃতীয় সনে মদীনার দিকে ধাবিত হলো। আল্লাহর রাসূল সা. সঙ্গীদের নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের গতিরোধ করেন। শাওয়াল মাসে যুদ্ধ শুরু হয়। কাফিরদের পক্ষ থেকে ‘সিবা’ নামক এক বাহাদুর সিপাহী এগিয়ে এসে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। হযরত হামযা কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ময়দানে এসে হুংকার ছেড়ে বললেনঃ ওরে উম্মে আনমারের অপবিত্র পানির সন্তান, তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়তে? এ কথা বলে তিনি এমন প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন যে, এক আঘাতেই সিবার কাজ শেষ। তারপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত হামযার ক্ষিপ্র আক্রমণে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ হয়ে গেল। এ যুদ্ধে তিনি একাই তিরিশ জন কাফির সৈন্যকে হত্যা করেন।
যেহেতু হযরত হামযা বদর যুদ্ধে কুরাইশদের বাছাবাছা নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছিলেন, এ কারণে কুরাইশদের সকলেই তাঁরই খুনের পিয়াসী ছিল সবচেয়ে বেশী। হযরত হামযার হত্যাকারী ওয়াহশী উহুদ ময়দানে হামযার হত্যা ঘটনাটি পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন। ইবন হিশাম তাঁর ‘সীরাত’ গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন। ওয়াহশী বলেনঃ ‘আমি ছিলাম জুবাইর ইবন মুতয়িমের এক হাবশী ক্রীতদাস। বদর যুদ্ধে জুবাইরের চাচা তুয়াইম ইবন ’আদী হামযার হাতে নিহত হয়। মক্কায় ফিরে জুবাইর আমাকে বললোঃ যদি তুমি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করে আমার চাচার হত্যার বদলা নিতে পার, আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। আমাকে সে বিশেষভাবে ট্রেনিং দিল। আমি শুধু হামযাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই উহুদের দিকে রওয়ানা হলাম। যুদ্ধ শুরু হলো। একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে হামযার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমার কাছাকাছি উপস্থিত হলে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করলাম। তারপর আমার স্বপক্ষ সৈন্যদের নিকট ফিরে এসে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলাম। যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করলাম না। কারণ, আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি মক্কায় ফিরে এলে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।’
এ মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি। হযরত হামযার বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি।
হযরত হামযার শাহাদাত লাভের পর কুরাইশ রমণীরা আনন্দ সঙ্গীত গেয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু উতবা হামযার নাক-কান কেটে অলংকার বানিয়েছিল, বুক, পেট চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। একথা শুনে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে কি তার কিছু অংশ খেয়েও ফেলেছে? লোকেরা বলেছিলঃ না। তিনি বলেছিলেনঃ হামযার দেহের কোন একটি অংশও আল্লাহ জাহান্নামে যেতে দেবেন না।
যুদ্ধ শেষে শহীদের দাফন-কাফনের পালা শুরু হলো। রাসুল সা. সম্মানিত চাচার লাশের কাছে এলেন। যেহেতু হিন্দা তাঁর নাক-কান কে বিকৃত করে ফেলেছিল, তাই এ দৃশ্য দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেনঃ কিয়ামাতের দিন হামযা হবে ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ বা সকল শহীদের নেতা। তিনি আরো বললেনঃ তোমার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার জানামতে তুমি ছিলে আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে অধিক সচেতন, অতিশয় সৎকর্মশীল। যদি সাফিয়্যার শোক ও দুঃখের কথা আমার মনে না থাকতো তাহলে এভাবেই তোমাকে ফেলে রেখে যেতাম, যাতে পশু-পাখী তোমাকে খেয়ে ফেলতো এবং কিয়ামাতের দিন তাদের পেট থেকে আল্লাহ তোমাকে জীবিত করতেন। আল্লাহর কসম, তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমার ওপর ওয়াজিব। আমি তাদের সত্তর জনকে তোমার মত নাক-কান কেটে বিকৃত করবো।’ রাসূলুল্লাহর সা. এ কসমের পর জীবরীল আ. সূরা নাহলের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টি নিয়ে অবতীর্ণ হলেনঃ
‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঠিক ততখানি করবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্যধারণ করলে, ধৈর্যশীলদের জন্য তাই-ই তো উত্তম। ধৈর্য ধারণ কর। তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহরই সাহায্যে। তাদের জন্য দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়োনা।’ (সূরা নাহল/১২৬–২৭)
এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল সা. কসমের কাফ্ফারা আদায় করেন। (তাবাকাতে ইবন সাদ)
হযরত সাফিয়্যা ছিলেন হযরত হামযার সহোদরা। ভায়ের শাহাদাতের খবর শুনে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য দৌড়ে আসেন। কিন্তু রাসূল সা. তাঁকে দেখতে না দিয়ে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। ভায়ের কাফনের জন্য হযরত সাফিয়্যা দু’খানি চাদর পাঠান। কিন্তু হযরত হামযারই পাশে আরেকটি লাশও কাফনহীন অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই চাদর দু’খানি দু’জনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। হযরত খাব্বাব ইবনূল আরাত রা. বলেন, একটি চাদর ছাড়া হামযাকে কাফন দেওয়ার জন্য আর কোন কাপড় আমরা পেলাম না। তা দিয়ে পা ঢাকলে মাথা এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা চাদর দিয়ে মাথা এবং ‘ইজখির’ ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দিলাম। (হায়তুস সাহাবা– ১/১৩৬) সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত হামযাকে উহুদের ময়দানে দাফন করা হয়। ইমাম বুখারী হযরত জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. উহুদ যুদ্ধের শহীদদের দু’জন করে একটি কবরে দাফন করেছিলেন। হামযা ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশকে এক কবরে দাফন করা হয়।
ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে ‘ফাওয়ায়েদে আবিত তাহিরের’ সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত জাবির রা. বলেনঃ মুয়াবিয়া যে দিন উহুদে কূপ খনন করেছিলেন সেদিন আমরা উহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করেছিলাম। শহীদদের আমরা সম্পূর্ণ তাজা অবস্থায় পেয়েছিলাম। এক ব্যক্তি হযরত হামযার পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে পড়ে।
হযরত হামযার হত্যাকারী হযরত ওয়াহশী রা. মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. খেদমতে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি ওয়াহশী? জবাব দিলেনঃ হাঁ। ‘তুমিই কি হামযাকে হত্যা করেছো?’ জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহর রাসূল যা শুনেছেন, তা সত্য।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘তুমি কি তোমার চেহারা আমার নিকট একটু গোপন করতে পার?’ তক্ষুনি তিনি বাইরে বেরিয়ে যান এবং জীবনে আর কখনো রাসূলুল্লাহর সা. মুখোমুখি হননি। রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিকের রা. খিলাফত কালে ভণ্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয। তিনিও সে অভিযানে অংশ নিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, মুসাইলামাকে হত্যা করে হযরত হামযার হত্যার কাফ্ফারা আদায় করবেন। তিনি সফল হলেন। এভাবে আল্লাহতাআলা তাঁকে দিয়ে ইসলামের যতটুকু ক্ষতি করেন তার চেয়ে বেশী উপকার সাধন করেন।
হযরত হামযার মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর তখনকার অনুভূতি তিনি কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। সীরাতে ইবনে হিশামে ‘‘হামযার ইসলাম গ্রহণ’’ অধ্যায়ের টীকায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হয়েছে।