কোনো আদর্শিক ফিকরাহ্’র (আক্বীদা ও সমাধান সম্বলিত চিন্তাসমূহ) উপরে প্রতিষ্ঠিত দল যখন বাস্তবতার মোকাবিলা করতে মাঠে নামে তখন তার উপর অনেক ঝড়-ঝাঁপটা আসে এবং তাকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে চায়। এই আন্দোলনটির প্রতি শাসকবর্গের আচরণ হবে অন্যান্য আন্দোলন থেকে পৃথক। কারণ অন্যান্য আন্দোলনগুলো আংশিক চিন্তা উপস্থাপন করে, যার ফলে তারা শাসকের জন্য মোটেও হুমকি হিসেবে কাজ করেনা। বরং শাসকবর্গ কতৃর্ক সংঘটিত বিভিন্ন ত্রুটি ও অপূর্ণতার খালি জায়গাগুলো পূরণ করে দেয়। কিন্তু আদর্শিক ফিকরাহ’র ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চরম আন্দোলনটি নিজস্ব ভিত্তির আলোকে বিভিন্ন বিষয়ের মোকাবিলা করে এবং কোনো জোড়াতালি দেওয়া সমাধানকে মেনে নেয়না অথবা পরিস্থিতির সাথেও তাল মেলায়না। না তারা কোনো আংশিক সমাধান মেনে নেয় আর না শাসকবর্গ কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার সংস্কার করে। সামগ্রিক পরিবর্তন অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই দাওয়াহ্ ত্যাগ করাকে তারা মেনে নেয় না। না তারা ভিত্তিকে বাদ দিয়ে ভিত্তি থেকে উৎসারিত পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করাকে মেনে নেয়। ফলে এটা স্বাভাবিক এমন সংগঠনকে একটি নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুক্ষীন হতে হবে। সামগ্রিক পরিবর্তনের পথকে সংগঠনটি যত বেশী অনুসরণ করবে এর প্রতি শাসকগোষ্ঠীর শত্রুতা ও বিরোধীতাও তত বেশী জোরালো হবে।
এই বিরোধিতার তীব্রতার পরিমান এতো বেশীও হতে পারে যা সহ্য করার ক্ষমতা দাওয়াহ্ বহনকারীগণ মাঝেমধ্যে হারিয়ে ফেলতে পারেন। এবং দাওয়াহ্’র বক্তব্যের তীব্রতাকে খানিকটা হালকা করার জন্য সংগঠনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। যখন সে প্রত্যক্ষ করবে সবাই তাকে ও তার এই আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে তখন এই দাওয়াহ্ অব্যাহত রাখার কাজ তার নিকট অত্যন্ত কঠিন মনে হবে এবং তার সংকল্প দুর্বল হয়ে পড়বে। সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে যখন তার পার্থিব স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তখন সে নিজেকে প্ররোচিত করবে এবং কাজ ছেড়ে দিতে চেষ্টা করবে। তখন সে দলের উপর চাপ প্রয়োগ করবে যাতে দল পরিবর্তনের আহবানের পরিবর্তে সংস্কারের আহবান জানায়। দল যদি তার আহ্বানে সাড়া দেয় তাহলে সে দলে সাথে থাকবে। এভাবে নিজের দাবি অনুযায়ী সে দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যই কাজ করবে এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও শাসকবর্গ উভয়কেই সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু দল যদি তার এই চাপ প্রত্যাখ্যান করে দলের সামগ্রিক এবং মৌলিক কাজে অটল থাকে তাহলে সে দল ছেড়ে যাবে। অতএব, দল এক্ষেত্রে দুটো বিপদের সম্মুখীন হবে; একটি আভ্যন্তরীণ যা আসবে সেসব শা’বাবদের তরফ থেকে যাদের মনোবল প্রচন্ড ঝড়-ঝাঁপটা আসার পূর্বেই ভেঙে পড়েছে এবং আরেকটি শাসকগোষ্ঠী তরফ থেকে যারা সামগ্রিক পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গী ধারণকারী দাওয়াহ্ বহনকারীদের সহ্য করতে পারে না।
একপর্যায়ে দল এবং শাসকবৃন্দের মধ্যে দরকষাকষি শুরু হবে। তখন দলের নিকট বিভিন্ন প্রস্তাব আসা শুরু করবে এবং ভয়-ভীতি আর প্রলোভন সমন্বিত একটি ‘মূলা ঝুলানো’ তত্ত্ব প্রয়োগ করা হবে। এটা সর্বজনবিদিত ব্যবসার ক্ষেত্রে দরকষাকষি প্রযোজ্য; সুতরাং দল যখন দর-কষাকষিতে নামে তখন তা হয় তার দায়িত্বকে বিক্রি এবং উম্মাহ্’কে অপমানিত করার মতো অবস্থা। অন্যথায় একে শাসকগোষ্ঠীর আগুনে দগ্ধ ও তার শিখায় ঝলসাতে হয়।
অতএব, সঠিক আদর্শিক ফিকরাহ্ এমন একটি আদর্শিক দলের দাবি করে যার নেতৃত্ব এবং সদস্যগণ শারী’আহ্’র কতৃর্ত্বকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়। স্পষ্টতা, বিশুদ্ধতা, ধৈর্য, ত্যাগ স্বীকার, পরার্থবাদ এবং এ সমস্ত বিষয়েও তারা সচেতন। পরিণতির আশংকায় যে কোন প্রলোভনের হাতছানিতে সাড়া দেওয়া থেকে তাদের অবশ্যই তাদেরকে বিরত থাকতে হবে যাতে তারা বিচ্যুত হয়ে না পড়ে এবং তাদের মনোবল না ভেঙে যায়। দলটি যদি এমন একটি সুরক্ষিত পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে চায় যাতে তার কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় এবং কোনোরূপ পরিবর্তনের জোয়ারে ভেসে না যায় অথবা দলটিকে নিয়ে লোকজন কোনোরকম খেলায় লিপ্ত হতে না পারে, সেজন্য দলটিকে অবশ্যই প্রতিটি চিন্তাকে বা শারী’আহ্ হুকুমকে দৃঢ়ভাবে ইসলামী আক্বীদাহ্’র সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। যদি কখনো লক্ষ্য অর্জনের পথে দাওয়াত বহনকারীর ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সুবিধার সাথে দাওয়াহ্’র দৃঢ়তা ও ধৈর্যে্যর সংঘাত বাঁধে তাহলে অবশ্যই দাওয়াহ্’কে সর্বাবস্থায় প্রাধান্য দিতে হবে। যার ফলে তখন এই চিন্তাটি দুষ্কর্মের দিকে ধাবিতকারী শয়তান ও নফসের প্ররোচনার পথে একটি দূর্বেধ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
কাঁদার মধ্যে সংগঠনটির তরী ডুবে যাওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক পরিণতির হাত হতে বাঁচাতে হলে, তার নিকট নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় কিছু মূলনীতি বিদ্যমান থাকতে হবে যা দলের চিন্তা ও চিন্তার প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করবে। যা দলটিকে তার গৃহীত হুকুম শারী’আহ্’র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে। নতুন ব্যাখ্যা বা মূল্যায়নের নামে এসব মূলনীতি থেকে সে কখনোই বিচ্যুত হতে পারবে না।
ফলে সঠিক নির্দেশনা, সঠিক অনুসরণ এবং সঠিক জ্ঞান দলটিকে পরিশুদ্ধ করবে এবং দলের সদস্যদের অন্তরকে যেকোনো ক্রটি-বিচ্যুতি এবং দোষ থেকে মুক্ত করবে এবং তাদের ঈমানকে মজবুত করবে।
এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী মুমিনগণ ছাড়া আর কারও পক্ষে দৃঢ় থাকা অসম্ভব। এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুক্ষীন হওয়ার পর যারা টিকে রইবে, তাদের ঈমান সেইভাবে খাদমুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধ হবে যেভাবে আগুন দ্বারা সোনা খাদমুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধ হয়।
দল যখন তার গৃহীত নিয়ম নীতিমালাকে হারিয়ে ফেলে তখন সে কর্মসূচী প্রত্যাহার, রদবদল, পিছু হটা, অসঙ্গতিতে ভুগবে। পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যের অস্পষ্টতা ও অস্বচ্ছতা কঠিন পরিস্থিতিতে কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে সংগঠনকে পরিবর্তন সাধনে তাড়িত করে অথবা জনগণের নিকট দলিল উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এসব পরিবর্তনের পক্ষে ন্যায্যতা কিংবা শারী’আহ্’র বাইরে গিয়ে ব্যাখ্যা উপস্থাপনের দিকে ধাবিত করে।
দল যখন আপোষ করবে, সত্যকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ না করে আংশিকভাবে গ্রহণ করবে এবং সামগ্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্খা ও মৌলিক কাজকে পরিত্যাগ করবে তখন সে তার ধারণকৃত একমাত্র শক্তিকে হারিয়ে ফেলবে। তখন সে আর কোনো অনন্য ও স্বতন্ত্র দল হিসেবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেনা। বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামে সে পরাজিত হবে এবং শত্রুপক্ষ বিজয়ী হবে যদিও তখন সে ইসলামের দিকে আহবান করে এবং ইসলামকে একমাত্র সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করে। এর কারণ তার আহ্বান বিকৃত এবং প্রচলিত ব্যবস্থার জন্য সুবিধাজনক হয়ে গেছে। এবং পরিবর্তনের রাস্তায় সহযোগী হওয়ার পরিবর্তে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এই ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, রাসূল (সা) এবং রাসূল (সা) পরবর্তী উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছেন:
“…এবং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ্ আপনার প্রতি নাযিল করেছেন।”
(সুরা মায়েদা: ৪৯)
তাছাড়া সাইয়্যিদুনা উমর (রা) তার নিযুক্ত বিচারক শুরায়হ্’কে বলেছেন : “কেউ যাতে তোমাকে নির্ধারিত এ পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।”
দলের মধ্যে বিদ্যমান সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র হচ্ছে তার ফিকরাহ্ (আক্বীদা ও সমাধান সম্বলিত চিন্তাসমূহ)। যদি দল একে সংরক্ষণ করে এবং আপোষের পরিবেশ থেকে রক্ষা করে, পরিস্থিতির তোয়াক্কা না করে এর উপরে অটল থাকে এবং রাসূল (সা) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাহলে রাসূল (সা) এর মতো তারাও মুমিনদের একটি দল প্রস্তুত করতে পারবে এবং আল্লাহ্’র নাযিলকৃত বিষয়াদি দিয়ে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা মেনে নিতে উম্মতকেও রাজি করাতে পারবে। এসব বিষয় প্রস্তুত করার পরে সে পরিস্থিতিকে দাওয়াহ্’র অনুকূলে নিয়ে আসতে পারবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
ইসলামী চিন্তাসমূহ সত্যের দাওয়াহ্ বহনকারী ব্যক্তিদের জন্য এমন এক নিয়ামত যা তাদেরকে পরিস্থিতি কতৃর্ক সৃষ্ট চাপ মোকাবেলায় আসল মৌলিক চিন্তাসমূহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইসলামী চিন্তাসমূহের উপর অটল থাকার দাবি জানায়। পরিস্থিতি সৃষ্ট চাপের মুখে ‘চাহিদানুযায়ী সবই গ্রহণযোগ্য’, ‘ততটুকুই উপস্থাপন কর যতটুকু বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ’, ‘দাবির আংশিক উপস্থাপন কর’, ‘আংশিক সমাধান গ্রহণ কর’ এ ধরনের মানসিকতা পোষণ করা দলের জন্য কোনভাবেই মানানসই না। এসব চিন্তাকে ব্যবহার করা নয় বরং এগুলোর মূলোৎপাটনের জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এগুলো পাশ্চাত্যের চিন্তার ধরণ যা দ্বারা তারা আমাদের চিন্তার উপর আগ্রাসন চালিয়েছে। এসব চিন্তার সাথে সামগ্রিকভাবে ভিন্নমত পোষণকারী ইসলামী চিন্তা এসব কুফর চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করে ও এগুলোকে সমূলে উপড়ে ফেলার জন্য কাজ করছে, এবং ইসলাম ও ইসলামের চিন্তার প্রক্রিয়া বলবৎ করার জন্য কাজ করছে। অতএব যে পরিবর্তন চায় এবং পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে তাকে অবশ্যই প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হবে।
ফিকরাহ্’র বিশুদ্ধতা ও স্পষ্টতার উপরে জোর দিতে এবং তা বজায় রাখতে কোন কোন বিষয়ের দিকে দলটিকে নজর দিতে হবে সেগুলো উপস্থাপনের পর এবার আমরা পাশ্চাত্যের কাফিরদের কতৃর্ক প্রস্তাবিত দুটি চিন্তা নিয়ে আলোচনা করব। এসব চিন্তার প্রতি আমাদের শাসকবর্গ প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ এবং এগুলোর মাধ্যমেই তারা মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালায়। দুর্ভাগ্যবশত ইসলামের জন্য কাজ করে এমন কিছু ইসলামী দল এবং পাশ্চত্য চিন্তা গ্রহণের জন্য সবসময় উৎসাহ যোগায় এমন কিছু মুসলিম লেখক এসব চিন্তাকে দ্রুত গ্রহণ করে ফেলেছে। চিন্তা দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে গণতন্ত্র এসেছে ইসলাম থেকে এবং গণতন্ত্রই শূ’রা। এমনকি শব্দের পুনর্মিলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার দরুন একজন লেখক একে শূ’রাক্রেসি বা শূ’রাতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। অপর চিন্তাটি হচ্ছে কতিপয় মুসলিম এবং ইসলামী আন্দোলন কতৃর্ক কুফর শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার পক্ষে সাফাই গাওয়া। উপরোক্ত আলোচনাটিতে অগ্রসর হওয়ার শুরুতেই আমরা যেসব মূলনীতি উল্লে¬খ করেছি তার আলোকে আমরা যাচাই করবো কোন বাস্তবতায় গণতন্ত্র প্রয়োগযোগ্য, গণতন্ত্রের বাস্তবতা কী এবং শারী’আহ্’তে এমনকোনো বাস্তবতা আছে কিনা যা গণতন্ত্রের বাস্তবতার সাথে সদৃশপূর্ণ।