আক্বল সাদৃশ্যতাপূর্ণ ও তুলনীয় বস্তু সম্পর্কে একই ধরনের নিয়ম প্রদান করে। সেকারণে এমন দু’টি বিষয়ের মধ্যে স্বরূপতা আনা হয় যেগুলোর মধ্যে সাদৃশ্যতা রয়েছে। এবং আক্বল ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম প্রদান করে।
এ অবস্থা ক্বিয়াস শরী’আহ এর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ শরী’আহ একই ধরনের বিষয়ে ভিন্ন ধরনের হুকুম প্রদান করেছে এবং ভিন্ন ধরনের বিষয়ে একই হুকুম প্রদান করেছে। শরী’আহ একই বিষয়কে দু’ভাবে দেখেছে, যেমন: দু’টি ভিন্ন সময়কে। লাইলাতুল ক্বদরকে অন্যান্য রাতের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একই ধরনের স্থানকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছে, মক্কাকে মদীনার উপর এবং মদীনাকে অন্যান্য স্থানের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সালাতের ক্ষেত্রে চার রাকাআত এর নামাজ ও তিন রাকাআতের মধ্যে পার্থক্য করেছে, শরী’আহ চার রাকআতকে ছোট করে দুই রাকআত করবার অনুমতি দিলেও তিন বা দুই রাকআতকে সংক্ষিপ্ত করবার অনুমতি দেয়নি। আক্বল এ ধরনের তুলনা করতে সক্ষম নয়। বীর্য স্খলনের ক্ষেত্রে শরী’আহ গোসলের বিধান দিয়েছে যদিও এটা পবিত্র। অন্যদিকে মাজিহ বা বীর্য স্খলনপূর্ব তরল অপবিত্র হওয়া সত্তেও এর নিঃসরণের পর ওযুর বিধান প্রদান করেছে যদিও বীর্য ও মাজিহ একই স্থান হতে নিঃসৃত হয়। তালাকপ্রাপ্ত নারীদের জন্য ইদ্দত বা অপেক্ষমান সময় তিন মাসিক চক্র করেছে, অন্যদিকে বিধবা নারীর জন্য তা চারমাস দশদিন যদিও এক্ষেত্রে জরায়ুর অবস্থা একই থাকে। পরিষ্কারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা পানি ও ধুলাকে একই মর্যাদা প্রদান করেছে যদিও পানি ধুলা পরিষ্কার করে। এটা ব্যভিচার, ধর্মত্যাগ ও হত্যার বদলে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে যদিও তিনটি ভিন্ন ধরনের অপরাধ।
এছাড়াও শরী’আহ এমন সব বিষয়ে হুকুম প্রদান করেছে যে বিষয়ে আক্বলের ভিত্তিতে কিছু বলার নেই। যেমন: এটা স্বর্ণের দ্বারা স্বর্ণ বিক্রিকে নিষিদ্ধ করেছে, যদি সমভাবে অথবা বাকীতে না হয়। এটা ছেলেদের স্বর্ণ পরিধান করতে নিষেধ করেছে, কিন্তু মেয়েদের অনুমতি দিয়েছে। একই কথা রেশমী কাপড়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা সুদকে হারাম করেছে এবং ব্যবসাকে করেছে হালাল। এটা অসিয়তের সাক্ষী হিসেবে কাফেরদের অনুমোদন দিয়েছে কিন্তু আবার প্রত্যাহারকৃত তালাকের ক্ষেত্রে এ শর্ত জুড়ে দিয়েছে যে সাক্ষী হতে হবে মুসলিম।
এ কারণে আলী (রা) বলেছেন, ‘যদি দ্বীন কোন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে করা হত, তাহলে মাসহ করবার ক্ষেত্রে পায়ের উপরের চেয়ে নীচের অংশটিই বেশী পছন্দনীয় ছিল।’
সুতরাং যে দলটি ইসলামি জীবনধারা ফিরিয়ে নিয়ে আসবার জন্য কাজ করছে তাদের অবশ্যই এই মূলনীতিগুলোকে বুঝতে হবে। দলটি কীভাবে বাস্তবতা অনুধাবন করবে এবং তা তুলে ধরবে এটা অবশ্যই দলটি বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে উপস্থাপন করবে যাতে সদস্যগন বুঝতে পারে। এটা অবশ্যই শরীয়া উৎস ও উসুলী মূলনীতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং গ্রহণ করবে ও শাবাবদের এর ভিত্তিতে বিকশিত করবে। কারণ এসব মূলনীতির উপর ভিত্তি করে তাদের মনস্তত্বকে গঠন করতে হবে। এটা বিকাশ প্রক্রিয়ারও অংশ হবে। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উসুলী বিকাশ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা অপরিহার্য যা ওহীর বিশুদ্ধতা ও চিন্তার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং এমন বাহুল্যতাকে দূরীভূত করবে যা ওহীকে অ¯পষ্ট করে তোলে, যেমন: এরকম মূলনীতি, ‘এটা পরিত্যাজ্য নয় যে, সময় ও পাত্রভেদে হুকুম পরিবর্তন হয়’ এবং এর সার্বিক অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো ‘প্রয়োজন হারামকে জায়েয করে’ এবং ‘দ্বীন উদার ও বিবর্তনযোগ্য’ কিংবা ‘যেখানে সুবিধা পরিলক্ষিত হয় সেটাই হলো আল্লাহর বিধান।’
কাজের সাথে সম্পর্কযুক্ত শরীয়া হুকুম গ্রহণ ও পালন, এগুলোকে নির্দেশনা ও আলোকিত চিন্তা হিসেবে গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই দলটি তার নিজস্ব উসুলের মধ্যে এগুলোকে গ্রহণ করবে, যা এর দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রন করবে ও শরী’আহকে হৃদয়ঙ্গম করতে সহায়তা করবে এবং সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সুনিশ্চিত করবে।
একটি ইস্যূতে একাধিক ইজতিহাদ থাকতে পারে। বিতর্কিত ইস্যুগুলো থেকে দলিলের বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে দলটি তার জন্য শরীয় হুকুম গ্রহণ করবে এবং এগুলোর সাথে স্থির থাকবে। এরপর দলটি তার উসুলী মূলনীতি ও ফুরু বা শাখা সম্বন্ধীয় মূলনীতি ঘোষণা করবে। এর মাধ্যমে শাবাবদের বিকশিত করবে, জীবনকে এগিয়ে নিবে এবং এটা ব্যবহার করে আলোচনা করবে। নিজে গ্রহণ করেছে বিধায় এটি দলিল ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অন্যদের তা গ্রহণের জন্য হৃদয় জয় করবে। বিকাশ প্রক্রিয়া অনুসারে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করবে; অন্যথায় সে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে এবং পথিমধ্যে দিক হারিয়ে ফেলবে।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় শরীয়া হুকুম জানার আগে এ বিষয়ে শরীয়ার উৎস ও ঊসুল অধ্যয়ন করতে হবে। দলটি তার কাজ পরিচালনার সময় অনেক দূর্ভোগ ও জটিলতার সম্মুখীন হবে। যদি এটা শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে নিষ্ঠার সাথে কোন উসুল গ্রহণ না করে, তাহলে এটি দোদুল্যমান হবে এবং গৃহীত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে ক্রমাগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে। তারা বর্তমান দূষিত শাসনব্যবস্থার ভেতরে গিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে যা কিনা ছিল দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা ও প্রতিবন্ধক। যখন তারা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে তখন বর্তমান ব্যবস্থার সাথে ইসলামী শুরা ব্যবস্থার সাদৃশ্যতা খুজে পায়। ‘পূর্ববতীর্ নবীদের শরী’আহ তাদের জন্যও শরী’আহ’ এ যুক্তিতে তারা পূর্ববতীর্ নবীদের শরী’আহ থেকে গ্রহণ করে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করে। সঠিক শরীয়া পদ্ধতি অনুসরণ না করবার কারণে এভাবে ক্রমাগত পরিবর্তনের মত জটিলতায় উপনীত হয়। অথবা দলটি এমনও দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহন করতে পারে যে, বিভিন্ন সংস্থা গঠন করে তারা বাস্তবতা পরিবর্তনের সুযোগ পাবে, ফলে পদ্ধতির বদলে উপায়ের চিন্তায় তাদের মন আচ্ছন্ন থাকে। অথবা এমনকি তারা শরীয়া পদ্ধতির অনুসরণ না করে অস্ত্রধারণ করতে পারে; কারণ বাস্তবতা তাদের সেদিকে ধাবিত করে।
সুতরাং উসুল ও ঊৎস গ্রহণ, এবং ইজতিহাদের নির্ধারিত পদ্ধতির অনুসরণের মাধ্যমে দলটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাঙ্খিত পথে অটল থাকবে এবং বাস্তবতা, পরিস্থিতি কিংবা স্বার্থ যেদিকে উদ্দীপিত করে সেদিকে ধাবিত হবে না।
এভাবে দলটি আইনগত চিন্তার পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করবার পর এর কাজের পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করবে। অন্যথায় এটি বহুপথে বিচ্যুত হয়ে যাবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংস ডেকে আনে আল্লাহসুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেন না।
দলটি এর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণের উৎসকে সুনির্দিষ্ট করবার পর এইসব উৎস ও গৃহীত উসুলের ভিত্তিতে বিকাশের চিন্তাগুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে।
উৎস ও উসুল অধ্যয়নের ক্ষেত্রে দলটি অবশ্যই সুনিশ্চিত করবে যে, শরী’আহ উপলদ্ধির ক্ষেত্রে দলটি অবিশুদ্ধ চিন্তা ও অন্য চিন্তার সাথে গুলিয়ে ফেলার মত ভুল থেকে মুক্ত। ওহীকে অবিশুদ্ধ করে এমন সব কিছুকে দূরীভূত করবার জন্য এটা প্রচেষ্টা চালাবে এবং শরী’আহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়াল খুশীর অনুগামী না হবার জোর প্রচেষ্টা চালাবে এবং মনকে বিধি বিধান নিয়ন্ত্রনের কোন অনুমতি দিবে না। উসুল এবং উৎস অধ্যয়ন ছাড়া দলীয় বিকাশের চিন্তাগুলোর চর্চা সম্ভব নয়।
এরপর দলটিকে ফিরতে হবে ও অনুশীলন করতে হবে সেই বাস্তবতার প্রতি যেখানে উম্মাহ বসবাস করে, যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এইভাবে এটা বর্তমান চিন্তা, আবেগ, ও ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করবে, যাতে বুঝতে পারে, এ সম¯ত চিন্তা ও ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগনের গ্রহনযোগ্যতা ও প্রতিক্রিয়া কতটুকু। উম্মাহ কুফর চিন্তা দ্বারা আকর্ষিত, যেগুলোকে কাফেররা উম্মাহর স্বাস্থ্যের পূনরুদ্বারের শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। রাজনৈতিকভাবে উম্মাহ পুতুল শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যাদেরকে উপনিবেশবাদীরা মুসলিমদের উপর চাপিয়েছে, যাতে করে উম্মাহর সম্পদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা যায় এবং যে কোন আন্তরিক কর্মকান্ড যা তাদের উপনিবেশবাদীতাকে হুমকির মুখে ফেলবে তার প্রতিহত করা যায়। অধ্যবধি পশ্চিমা কাফির উপনিবেশবাদীরা সচেতন যে কোন সামষ্টিক আন্দোলনের ব্যপারে যা তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখোমুখি করবে, তাই সে জনগনের মধ্যে সামষ্ঠিক বা দলীয় কর্মকান্ড সম্পর্কে দূরে রাখার চিন্তা ছড়ায়। পরিবর্তে সে উৎসাহ প্রদান করে সমিতি মূলক কর্মকান্ডে যা চাক্রিক (peripheral) সমস্যার সমাধান দেয় যেমন দারিদ্র নিরসন ও মন্দ নৈতিকতা।
পশ্চিমা কাফিররা মুসলিমদের তাদের দীনই মানুষের সমস্যার একমাত্র সমাধান সেসম্পর্কে আত্নবিশ্বাসকেও সন্দিহান করে তুলেছে, যখন তারা (পশ্চিমা কাফিররা) আকীদাকে (মুসলিমদের) জীবন থেকে পৃথক করেছে, এই পৃথকীকরন তাদের উপর বল প্রয়োগ করে চাপিয়ে দিয়েছে এবং তাদেরকে এ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রেও বাধা দিেচ্ছে।
এজন্যই দলটি গভীর ও সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট উপায়ে বিরাজমান বাস্তবতা, চিন্তা, আবেগ এবং ব্যবস্থাসমূহ অধ্যয়নে বাধ্য। এটা এই কারনে যে, যে ভূমির উপর সে দাড়িয়ে আছে সেই ভূমিটির প্রকৃতি, কেমন করে এর উপর সে হাটবে ,বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কি কি হাতিয়ার প্রয়োজন, আর উর্বরতার জন্য কি কি জিনিস দরকার অথবা উর্বরতা ফিরিয়ে আনার জন্য কোন উপাদান প্রয়োজন, তা উপলদ্ধি করার জন্য। তাই অবশ্যই প্রথমে একজনকে বা¯তবতা বুঝতে হবে। এটা দলটির সংস্কৃতির (culture) গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে, কারন এটা দলটির নিকট পরিস্কার থাকতে হবে এবং এটা অবশ্যই শাবাব এবং জনগনের নিকট পরিস্কার থাকতে হবে যাতে তারা এ প্রসঙ্গে অজ্ঞ না থাকে, এবং তারা এরপরে এর সমাধানের সঠিকতা ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে।
যে বাস্তবতায় উম্মাহ রয়েছে তার বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনেতিক এবর্ং সামাজিক বা¯তবতা অনুধাবনের পর, দলটিকে পূর্বেলিখিত উৎস ও উসুল অনুসরন করে চিন্তা, মতামত এবং শরীয়া বিধানের দিকে অগ্রসর হতে হবে। যে পদ্ধতিতে দলটি এ চিন্তা, মতামত ও শরীয়া বিধানে (method) পৌছেছে তা শাবাব এবং জনগনের কাছে পরিস্কার থাকতে হবে। কারণ এটাই দলটির শাবাবদের মধ্যে দৃঢ়বিশ্বাস, সচেতন মনোভাব এবং ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরী করবে গভীরভাবে, যা সাধারনভাবে উম্মাহর মাঝেও তৈরী হবে।