মদীনায় হিজরত

মদীনায় হিজরত দাওয়াতের ক্ষেত্রে আলোচনা ও সহিষ্ণুতার পর্যায় থেকে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম বাস্তবায়নের পর্যায়ে উন্নীত হবার একটি ধাপ। এটা দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে উন্নিত হওয়া যা মদীনাতে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ইসলাম বহন করেছিলেন। আর তা করা হয়েছিল ইসলাম দ্বারা শাসিত একটি রাষ্ট্রের মাধ্যমে। এ রাষ্ট্র ইসলামকে বাস্তবায়ন করে এবং এর দিকে দলিল প্রমাণসহ আহ্বান করে ও দাওয়াতকে ক্ষমতার সাথে বহন করে যাতে করে বাতিলের অত্যাচার ও ক্ষতির হাত থেকে একে সুরক্ষা দেয়া যায়।

যখন রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনাতে পৌঁছলেন তখন সেখানকার অনেক লোক তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম একটি মসজিদ ণির্মাণ করেছিলেন। এ মসজিদে সালাত আদায় করা হত, পরামর্শ করা হত, লোকদের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা ও বিবাদ নিরসন করা হত। তিনি (সা) মদীনাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত করতে লাগলেন। তিনি মদীনার বাইরে অভিযান পরিচালনা করেন ও তাদের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে দেন। ইহুদীদের সাথে চুক্তি করেন। সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনাতে একজন শাসকের ভূমিকা পালন করেন অর্থাৎ তিনি ছিলেন সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান।

দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার আগে রাসূলুল্লাহ (সা) এ কাজগুলো করেছিলেন। সুতরাং এ থেকে আমরা কী বাধ্যবাধকতার নির্দেশ পাই?

আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) কে পুরোপুরি অনুসরণ করতে বাধ্য এবং তিনি যেভাবে অগ্রসর হয়েছেন আমরাও একইভাবে অগ্রসর হতে বাধ্য। যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ফরয, সেহেতু এক্ষেত্রেও তাঁর (সা) পদাঙ্ক আমাদের অনুসরণ করতে হবে। তার (সা) ব্যাখ্যামুলক কাযার্বলীতে যে হুকুম পাই তা একই ব্যাখ্যামুলক বিষয়ের জন্য বাধ্যতামুলক হুকুম। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ সম্পর্কে বললেন,

‘বলে দিন: এই আমার পথ। আমি আল্লাহ্‌র দিকে বুঝে শুনে দাওয়াত দেই— আমি এবং আমার অনুসারীরা।’
(সূরা ইউসুফ: ১০৮)

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা) এর সীরাত অনুসরণ করলে আমাদের কাজগুলোকে দুই ধাপে ভাগ করতে বাধ্য:

  • ব্যক্তিত্ব গঠন ও (দল) প্রতিষ্ঠার ধাপ
  • গণযোগাযোগ এবং সংগ্রামের ধাপ

প্রথম ধাপে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কর্মপন্থা আমরা অনুসরণ করতে বাধ্য। এ ধাপে যারা ইসলামী দাওয়াতের বোঝা বহন করবে তাদেরকে ইসলাম দিয়ে গভীরভাবে বিকাশের ব্যবস্থা ও বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে হবে। এটা সম্ভব হবে খুব ভাল ইসলামী আকলিয়া (মানসিকতা/ধ্যান-ধারনা) ও নাফসিয়া (ঝোঁক/প্রবণতা) গড়ে তুলবার মাধ্যমে। যা করতে হবে গভীরতাসমৃদ্ধ পাঠচক্র বা হালাকা প্রদানের মাধ্যমে, যা রাসূলুল্লাহ করেছিলেন। যার মাঝেই রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলাম গ্রহণের উপযোগীতা দেখতে পেতেন, তার বয়স, পদমর্যাদা, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে তিনি তাকে আহ্বান করতেন এবং তাদের একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্রমপ্রসারমান হিযবের মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদেরকে উপরোক্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে:  

  • বিকাশের পরিণত অবস্থা, অর্থাৎ তাদের মনস্তত্ত বা আকলিয়া এবং নাফসিয়াহ বা প্রবণতা গড়ে উঠেছে ইসলাম অনুসারে। সুতরাং তারা এখন সমাজের দূষিত চিন্তাগুলোর মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
  • কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যে গন্ডীভূত রাখবার জন্য তারা দাওয়াতকে গ্রহণ করবে না। সুতরাং তারা যাই জানে তাই ছড়িয়ে দিতে থাকবে। যার মধ্যেই তারা কল্যাণ (খায়ের) দেখতে পাবে তার কাছেই তারা এ দাওয়াত নিয়ে যাবে।
  • লোকেরা দাওয়াতকে হৃদয়ঙ্গম করবে, এর উপস্থিতি ও সামষ্টিকতাকে অনুভব করবে।

যখন সাহাবীদের মত এ তিনটি বৈশিষ্ট্য কোন হিজবের মধ্যে দেখা যাবে, তখন সেটি দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হবে ।

এ ধাপে রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত দাওয়াতকে জনগনের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং বর্তমান সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে ও তাদের চিন্তা, ঐতিহ্য ও ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাদের চিন্তার দেউলিয়াত্বের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে এবং বিকল্প ইসলামী চিন্তা, ধারণা ও ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত জড়তাহীনভাবে, অসম সাহসিকতা ও শক্তিমতার সাথে লোকদের আহ্বান করতে আমরা বাধ্য। আমরা এ দাওয়াত পরিত্যাগ করব না ও আত্নসমর্পণও করব না। আমরা তোষামোদ বা আপোষ করব না এবং রীতিনীতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, জীবনাদর্শ, শাসক অথবা জনতার ভয়কে উপেক্ষা করব। আমরা এমনভাবে দাওয়াহ বহন করব যাতে নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব ইসলামের জন্য হয়ে যায়। জনগন এর সাথে একমত বা দ্বিমত পোষণ করুক না কেন অথবা এটা তাদের ঐতিহ্যের সাথে যাক বা সাংঘর্ষিক হোক এবং জনগন গ্রহণ, প্রত্যাখান বা বিরোধিতা করুক। যতক্ষণ না আদর্শ অনুসারে কাঙ্খিতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত এর সাথে সংযুক্ত থাকব এবং ধৈর্যধারণ করব। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত এ সময়েও শাসকগন এ লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে সেহেতু এ দলটিকে এই শাসকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর এটা তখনই সংঘটিত হবে যখন তাদের মুখোশ, দুরভিসন্ধি ও দালালি ও ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া হবে এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত এসবকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। যেভাবে পবিত্র কুরআন আবু লাহাবকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল:  

‘আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজে, কোন কাজে আসেনি তার ধন—সম্পদ ও যা সে উপার্জন করেছে। সত্বরই সে প্রবেশ করবে লেলিহান অগ্নিতে।’
(সূরা লাহাব:১-৩)

বানু হাশিম গোত্রে সে সম্মানিত হওয়া সত্ত্বেও এ আয়াত নাজিল হয়েছিল। একইভাবে কুরআনে বানু মাখদুম আল ওয়ালিদ বিন মুগীরাকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, 

‘যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি, তাকে একাকী আমার হাতে ছেড়ে দিন। আমি তাকে বিপুল ধন-সম্পদ দিয়েছি।’
(সূরা আল মুদ্দাসির:১১—১২)

অতপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

‘আমি তাকে দাখিল করব প্রজ্জলিত জাহান্নামের আগুনে।’
(সূরা আল মুদ্দাসির: ২৬)

তার সম্পর্কে সূরা ক্বলমে বলা হয়েছে:

‘কঠোর স্বভাব, তদুপরি কুখ্যাত’
(সূরা ক্বলম:১৩)

যখন তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আবু জাহেলের ব্যাপারে বলেন,

‘কখনই নয়, যদি সে বিরত না হয়, তবে আমি মস্তকের সামনের কেশগুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবই— মিথ্যাচারী, পাপীর কেশগুচ্ছ।’
(সূরা আলাক:১৫—১৬)

আমাদের দাওয়াতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত লোকদের নির্দেশনা দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগুতে হবে। এ ধাপে তিনি (সা) ইসলাম যাতে তাদের জীবনাদর্শ হয়ে যায় ও মুহম্মদ (সা) মিশন যাতে তাদের মিশন হয়ে যায়— সে জন্য সর্বাত্মকভাবে তাদের কাছে ইসলামী আদর্শ ব্যাখা করেছেন। অর্থাৎ আমরা যা বুঝাতে চাই তা যেন লোকেরা গভীর উপলদ্ধির সাথে গ্রহণ করে।

রাসূলুল্লাহ (সা) এর মত আজকেও আমরা প্রত্যাখান, প্রতিবন্ধকতা, মিথ্যা অপবাদ, বিতাড়ন, প্রোপাগান্ডা, বয়কটের শিকার হতে পারি।

সাহাবাগন (রা) সেসময় অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন এবং তখন তিনি (সা) প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন,

‘আমি ক্ষমা করে দেবার জন্য আদিষ্ট হয়েছি; সুতরাং লোকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করো না।’

একইভাবে নুসরাহ খুঁজে পাবার পূর্বে আমরা অস্ত্রধারণ ও ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকব। 

রাসূলুল্লাহ (সা) যেমনিভাবে তৃতীয় ধাপে উন্নীত হবার জন্য নুসরাহর সন্ধান করেছিলেন তেমনিভাবে আমরাও ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন করবার জন্য নুসরাহ বা বস্তুগত সমর্থন অনুসন্ধান করতে বাধ্য। এ ধাপ হল ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসন করবার ধাপ।

Leave a Reply