খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজের মাধ্যমে যারা পূণার্ঙ্গ ইসলামকে বাস্তবায়ন করবে এরকম একটি দল থাকা শরীয়াগতভাবে বাধ্যতামূলক। নীচের প্রসিদ্ধ আয়াতের মাধ্যমে এটা অনুধাবন করা যায়:
‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকবে যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আল ইমরান: ১০৪)
উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলমানদের এটা সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা করে দিয়েছেন যে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে একটি ইসলামী দল থাকতে হবে যারা মানবজাতিকে কল্যাণের দিকে ডাকবে ও সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের ব্যাপারে নিষেধ করবে।
আদেশ সূচক নির্দেশটি হল:
‘এমন একটা দল থাকবে’ যা একটি বাধ্যবাধকতা, কারণ এটা কল্যাণের দিকে আহ্বান, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধের জন্য।
‘তোমাদের মধ্যে’ (মিনকুম) এখানে অংশগ্রহনকারী আদেশ (তাবিদ), শরঈ নির্দেশনা (ক্কারিনা) থাকবার কারণে যা বুঝায় যে, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ একটি সামষ্টিক বাধ্যবাধকতা। তবে এটা সবার জন্য প্রয়োগ হবে না। কেননা এর জন্য এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক—যা সবার মধ্যে বিদ্যমান নেই। তাই ‘উম্মাহ’ শব্দটি মুসলিমদের মধ্য হতে একটি দলের কথা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে—পুরো উম্মাহর কথা বলা হয়নি। নির্দেশটি হল মুসলিমদের মধ্য হতে অবশ্যই একটি ইসলামী দল থাকতে হবে। উম্মাহ শব্দটিকে পবিত্র কুরআনে ‘এক দল লোক’ অর্থে বুঝানো হয়েছে। যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসা (আ) সম্পর্কে বলেন:
‘যখন তিনি মাদইয়ানের কুপের ধারে পৌঁছলেন, তখন কুপের কাছে একদল লোককে (উম্মাতান) পেলেন তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর কাজে রত।’ (সূরা আল কাসাস: ২৩)
এখানে যে কোন দলের কথা বলা হয়নি বরং মুসলিমদের মধ্য হতে একটি দলের কথা বলা হয়েছে যাদের এই আয়াতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে খায়ের তথা ইসলামের দিকে আহ্বান জানাবার এবং সৎ কাজের (মারুফ) আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের (মুনকার) নিষেধের জন্য। এই বর্ণণার মধ্যে শাসকগনও রয়েছে। কারণ তারা সব মারুফ বা সব মুনকার কাজের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তারা হয় লোকদের ইসলাম বা শরীয়া দিয়ে শাসন করে অথবা এগুলোকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করে এবং তখন তাদের জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলটি রাজনৈতিক হবে। কারণ এর কাজ শাসকদের [জবাবদিহীতার] সাথে সংশ্লিষ্ট হবে। এই শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে শরীয়া প্রদত্ত পদ্ধতি অনুসারে যদি তা বিদ্যমান না থাকে এবং অতপর তাদের অবহেলা ও পথভ্রষ্টতার জন্য জবাবদিহী করতে হবে এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) অনেক হাদীসে এই ফরয ও শাসকদের মধ্যকার সম্পর্ক নিরূপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,
“ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অতি সত্বর আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) কর। অন্যথায় অচিরেই তোমাদের উপর আল্লাাহ্র শাস্তি আরোপিত হবে। অতঃপর তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা।” (আহমাদ ও তিরমিযী)
তিনি (সা) আরও বলেন,
‘অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক্ব কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’ (ইবনে মাজাহ ও নাসায়ী)
তিনি (সা) আরও বলেন,
“শহীদদের সর্দার হামযা এবং ঐ ব্যক্তিও, সে অত্যাচারী শাসকের সামনে দাড়িয়ে উপদেশ দেওয়ার পর (ঐ শাসক) তাকে হত্যা করে ফেলে।” (হাকিম)
এছাড়াও রাসূল (সা) বলেন,
“তোমরা আমর বিল মা’রূফ এবং নাহি আ’নিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ) কর। অন্যথায় তোমরা তাকে ডাকবে কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবেনা” ।
এবং তিনি বললেন,
‘‘দ্বীন হল নসীহা বা উপদেশ প্রদান’। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ’কার প্রতি, ইয়া রাসূলুল্লাহ!’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর প্রতি, তার রাসূল, মুসলিম শাসকগন ও তার অধীনস্ত জনগনের প্রতি।’ (মুসলিম)
একারণে দলটির কাজ হল কল্যাণের দিকে ডাকার পাশাপাশি সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। এর একটি অংশ হল শাসকদের জবাবদিহীতার মুখোমুখি করা এবং শরীয়া অনুসারে শাসন করতে বাধ্য করা। শাসকের সাথে কাজটি সম্পৃক্ত হওয়ায় এটি একটি রাজনৈতিক কর্মকান্ড। সেকারণে এই আয়াতটি ইসলামের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের উপস্থিতির কথা বলে
বাস্তবতা হল শরীয়ার নিয়মকানুনসমূহের অস্তিত্বের জন্য একজন খলিফার অপরিহার্যতা একটি শরীয়া নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা। একারণে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজটিও শরীয়া নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা। আর এই কাজের জন্য একটি দল বা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও একটি শরীয়া নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা। কারণ শরীয়ার মূলনীতি হল, ‘ওয়াজিব পালনের জন্য যা করতে হয় তাও ওয়াজিব।’ (মা লা ইয়াতিম্মুল ওয়াজিব ইল্লা বিহী ফাহু’ওয়া ওয়াজিব)
মূলত: উপরোক্ত মাদানী আয়াতে ইসলামের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া একটি রাজনৈতিক দল থাকবার অপরিহার্যতার কথা বলা হয়েছে। এই আয়াত কাজের প্রকৃতিকেও সংজ্ঞায়িত করেছে: যা হল দাওয়াত, সৎ কাজের আদেশ প্রদান ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। সে কারণে সুনির্দিষ্টকারী প্রত্যয় ‘আল’ শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। ‘আল খায়ের’, ‘আল মারুফ’ এবং ‘আল মুনকার’ হল সুনির্দিষ্টকারী প্রত্যয় যার সার্বজনীনতা উপলদ্ধি করতে হবে। আর, প্রকাশভঙ্গি অনুসারে এই নির্দেশ প্রত্যেক ব্যক্তিকে বুঝিয়েছে এবং বাস্তবায়ন অল্প বা অনেক লোকের মাধ্যমে হতে পারে। সুতরাং এর মধ্যে ব্যক্তি, দল ও শাসকগন তথা সংশ্লিষ্ট সবাই অন্তর্ভুক্ত । অল্প না অনেক—এটি নির্ধারিত হবে শরীয়া এবং দল যা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য কাজ করছে তা অনুসারে। ব্যক্তিগত ইচ্ছার অধীনে অস্পষ্টভাবে এটি হওয়া সম্ভব নয়। বরং এটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, যদি এটি পরিত্যক্ত হয় তাহলে কাজ হওয়া উচিত সংশোধনমূলক, দলকে উপদেশ দিতে হবে যাতে তারা ভ্রান্তিকে স্পষ্ট দেখতে পায় ও পরিত্যাগ করে। সুতরাং এই বিষয়টিও অন্যান্য বিষয়ের মতই শরীয়া দ্বারা নিরূপিত। প্রবৃত্তি, স্বেচ্ছাচারীতা, পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর এটি ছেড়ে দেয়া হয়নি।