আমাদের আবেগ-আক্রান্ত সমস্যার selective outcry (তনু হত্যা) সমাধানটা কি শুধুমাত্র এই একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হবে? সমাজ থেকে যাতে এই সমস্যাগুলো আর উঠে না আসে, আমাদের ওই ভাবে সচেতন হওয়া উচিত নয় কি? আমরা কি শুধু ক্যান্সার থেকে সৃষ্ট লক্ষণগলো তাড়ানোর জন্য সাময়িক হৈচৈ করব? নাকি পুরো ক্যান্সার দুরিকরণে সচেতন হয়ে চেষ্টা করব?
আমরা যখনই কতগুলো সমস্যা নিয়ে কথা বলি তার শুরুতেই আপনাকে ভাবতে হবে সমস্যাগুলো যেমন- ইভ টিজিং, ধর্ষণ, হত্যা, পরকিয়ার কারণে নিজ সন্তান-স্বামী/স্ত্রী হত্যা…… কেন হচ্ছে?
যার কারণে(মানুষ) এই সমস্যা গুলোর সৃষ্টি তার স্বভাবটাই (nature) বা কেমন?
মানুষের স্বভাব:
মানুষের মধ্যে সাধারনত দুটো রুপ বিদ্যমান; একটা organic needs বা জৈবিক চাহিদা যা ক্ষুধা এবং পিপাসার আবরণে প্রকাশ পায়। এ জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য তাকে খেতে হয়। জৈবিক চাহিদা তাকে ভিতর থেকে তাড়িত করে যেমন ক্ষুদা লাগা। এটি পূরণ না হলে সে মারা যায়। যেমন আপনি না খেলে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া না দিলে মারা পড়বেন। অর্থাৎ পূরণ হওয়া অপরিহার্য।
অপরটি প্রবৃত্তি বা instinct। প্রবৃত্তি বা instinct মানুষের মধ্যে সুপ্তভাবে থাকে যা পূরণ না হলে মানুষ মারা যায় না। কিন্তু সে চিন্তিত হয় প0ড়ে তাড়িত চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত। মানুষের instinct পূরণ না হলে সে মারা যায় না বরং চিন্তিত হয় ,এটি পূরণ হওয়া অপরিহার্য নয়।এটি মানুষের ভিতর থেকে আসেনা বরং বাহির থেকে আসে।
মানুষের আছে ‘টিকে থাকার প্রবৃত্তি’ (survival instinct), যার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, ক্রোধ, লালসা, ভয়, আক্রমণ, প্রতিরক্ষা, অহংবোধ প্রভৃতির মাধ্যমে।
আর আছে ‘আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তি'(religious instinct) – যার প্রকাশ ঘটে যখন মানুষ অসহায় বোধ করে। তখন সে চায় তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, ক্ষমতাধর, কারও নিকট আত্মসমর্পণ করতে, সাহায্য চায়, তার কাছে নিজেকে নিবেদিত করে। সারা জীবন নিজের ইচ্ছাধীন চলার পর বৃদ্ধবয়সে এসে যখন শরীরের দুর্বলতা কাছ থেকে অনুভব করে তখন তার মধ্যে মৃত্যু/ভয়ের জন্ম হয় ফলতঃ সে সৃষ্টার নিকট অসহায় প্রার্থনা করে।
প্রজনন প্রবৃত্তি (procreation instinct)- যার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়, মায়া, মমতা, ভালবাসা, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ এসবের মাধ্যমে।
যেমন- procreation বা প্রজনন প্রবৃত্তির কারণে বিপরীত লিঙ্গকে দেখে বিমোহিত হওয়া, তা হতে চিন্তার উদয় ঘটানো, সবশেষে চাহিদা পূরণ না হলে উদ্বিগ্ন হওয়া।
এগুলো মানুষের প্রবৃত্তিগত বৈশিষ্ট্য। প্রবৃত্তির তাড়না আসে চারপাশ বা REALITY হতে যেমন-প্রজনন প্রবৃত্তি মানুষের ভিতর থেকে আসেনা, আসে বাহিরের কোন ব্যক্তি, বস্তু বা চিন্তা তার ভিতর প্রবেশ করার মাধ্যমে। সুতরাং মানুষ এই প্রভৃত্তির তাড়না অনুভব করেনা যদি না তার সামনে ওই বাস্তবতা সৃষ্টি করা হয়। সেক্ষেত্রে সে উত্তেজিতও হবেনা।
তাহলে এত অনাচারের কারণ কী?
এক কথায় প্রবৃত্তিকে জাগানোর জন্য ওই বাস্তবতা সৃষ্টি করা। যখন একটি সমাজের সমস্ত পরিবেশকে ষড়যন্ত্র করে প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে দেওয়া হয় তখন ওই সমাজের মানুষের চিন্তা, চেতনা, ধারনা ও সময় ব্যস্ত থাকে ঐ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে।
এখন আপনি যদি আপনার চারপাশে তাকান দেখবেন একটা সেকুলার আইডিওলজি হতে উঠে আসা চিন্তা হতে ব্যবস্থা কিভাবে একটি সমাজকে ব্যস্ত করে রাখে শুধু কিছু প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে। যেমন আপনার হাটার পথে অর্ধনগ্ন বিলবোর্ড, উত্তেজক অশ্লীলতায় ভরা বিজ্ঞাপন, ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে পরিবারগুলোকে ভঙ্গুর করে তোলা, ফ্রি মিক্সিংকে স্বাভাবিক করে তোলা নাটক ও সিনেমা, পর্নগ্রাফি, অস্বাভাবিক সম্পর্ক, টেলিকম কোম্পানির-লাভ SMS রাত জেগে কথা বলার উৎসাহ, বিবাহ কঠিন করে ফেলা ইত্যাদি। অর্থাৎ একটা মানুষের স্বাভাবিক আচরন, চিন্তা, চেতনা, সময় সবকিছুকে ব্যস্ত রাখা প্রজনন প্রভৃত্তিকে জাগিয়ে রাখার মাধ্যমে।
ফলে যা ঘটে:
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের অর্থায়নে ICDDRB ২০১১ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, তাদের বয়স ১৯ বছর হওয়ার আগেই তারা নারী ধর্ষণ করেছে, ৫৭-৬৭ শতাংশ বলেছে, শুধু মজা করার জন্যই তারা নারীদেরকে যৌন হয়রানি করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৬ এই পাঁচ বছরে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ লাখ ৯ হাজার।(সুত্রঃপুলিশ সদর দপ্তর;৮/৪/১৬ by online AMAR DESH)
যারা জনগণের সম্পদ চুরি করে পশ্চিমা দেশে এক’পা দিয়ে রেখেছেন তারা জেনে খুশি হবেন-২০১৫ সালে নারী লাঞ্চনায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে ব্রিটেন, যেখানে প্রতি ১০০জনে ৮৪জন নারী লাঞ্চনার স্বীকার হয়েছেন। নারী স্বাধীনতার এত উন্মুক্ত প্রদর্শনী তারপরও এই অবস্থা কেনো?আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ধর্ষণ, হত্যা, নিরাপত্তাহীনতায় আতংকিত হয়ে উঠেছে সেখানে একটা তনু হত্যা অনেক গুলো ডটের মধ্যে একটি ডট মাত্র…………………।(প্রতিদিনকার পত্রিকার শিরোনাম)
আমাদের নিয়ে খেলছে কারা ?
পুঁজিবাদ (capitalism) যেকোন বিষয় হতেই পুঁজি সংগ্রহ করতে চায়। সেটা পুরুষের শুক্রাণু বিক্রি করেই হোক কিংবা নারীর জরায়ু ভাড়া দিয়ে। পুঁজি অর্জনই তার কাছে একমাত্র মুখ্য বিষয়। তাই নারীকেও সে পুঁজি অর্জনের একটি উপকরণ হিসেবে দেখে। নারী হতে পুঁজি অর্জন করতে হলে তার সৌন্দর্য, দেহ – এগুলোকে ব্যবসার পণ্য বানাতে হবে। এক্ষেত্রে কালো মেয়েকে বুঝাতে হবে, তাকে ফর্সা হতে হবে । সাদা মেয়েকে বুঝাতে হবে, তার চামড়া ফ্যাকাসে, তাই রোদে পুড়িয়ে তামাটে করতে হবে, বিক্রি হবে পণ্য, সেজন্য যেতে হবে সমুদ্র সৈকতে,উন্মুক্ত হবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ । নর-নারীর যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তার প্রকাশ ঘটবে শুধুমাত্র যৌনতার আবেশে। অর্থাৎ কিছু স্বাধীনতার কথা বলে পরিপূরকের এক অংশকে(নারী) অর্ধ বা পুরো উলঙ্গ করে অপর অংশের instinct বা প্রবৃত্তিকে উস্কিয়ে দেওয়া । ফলস্বরুপ, একটি মাদকাসক্ত করে রাখা সমাজ থেকে উঠে আসে- প্রতিদিনকার ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, হত্য, সার্বিক অনাচার এবং একটি ভুল আদর্শ পুঁজিবাদের পুঁজি সংগ্রহ। সমাজে বিদ্যমান একটি ভুল আদর্শ (capitalism) ও তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এসকল সমস্যা ও অরাজকতার একমাত্র কারণ ।
একজন মানুষকে এইভাবে আসক্ত করে রাখার উদ্দ্যেশ্য একটাই যাতে সে ;তার জীবনের সামগ্রিক লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্যর সন্ধান না করে। সে যাতে চিন্তা না করে তাকে কেও একজন পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি অবশ্যই একটি সুনিয়ন্ত্রিত জীবন পরিচালনার ব্যবস্থাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এবং তার স্রষ্টার পাঠানো ব্যবস্থাটাই বা কি?
একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাস হতে “জীবনব্যবস্থা” (ideology) ইসলাম যা একমাত্র সমাধান:
ইসলাম একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকিত চিন্তা(enlighten thought) যা মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা(idea) দেয়। যা মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দ্বারা প্রমানিত এবং ফিতরাত বা Instinct এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের যাবতীয় সকল সমস্যার বাস্তবায়ন যোগ্য একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি(method)। সৃষ্টা কতৃক প্রেরণ তাই বাস্তবায়নের ফলে সমস্যার উদ্ভব হয় না।
কেও যদি আমাদের না বলেন কোন উপায়গুলো অবলম্বন করলে তিনি খুশি হন, সে ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা চেষ্টা করে উনাকে খুশি করতে পারবনা। চেষ্টায় উল্টো রেগে যেতে পারেন। অনুরুপভাবে আমাদের জৈবিক চাহিদা ও instinct গুলো পরিপূর্ণ করতে একটা নির্দেশনা প্রয়োজন। তা অবশ্যই যার sanctify বা গুণগান করা হবে তিনি হতেই আসা জরুরী। যেমন আল্লাহ প্রদত্ত ইসলাম,নির্দেশনা রুপে কুরআন এবং হাদীস, কিভাবে তা পালন করতে হবে তার জন্য রাসূল (সা) দেখিয়ে দেন জৈবিক চাহিদা ও instinct গুলো কিভাবে পূরণ করতে হয়। এর বাইরে কোন উৎস হতে সমস্যার সমাধান করতে গেলেই অরাজকতার সৃষ্টি হবে যা বর্তমানে দৃশ্যমান।
ইসলাম মানুষের প্রজনন প্রবৃত্তি হতে উদ্ভুদ্ধ সমস্যাগুলোকে সুশৃংখল্ভাবে সমাধান করে বিবাহের মাধ্যমে। ইসলাম প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার উপায় উপকরণগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের চিন্তা,সময় ও মেধার সঠিক ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। নারী-পুরুষের মধ্যে অ-মাহরামগত (marriageable) সম্পর্ক সীমাবদ্ধ বা নিষিদ্ধ করে। কারণ এই অবৈধ সম্পর্কগুলো মানুষের প্রজনন প্রবৃত্তিকে উস্কিয়ে দেয় এবং তাকে সীমালংঘনের দিকে নিয়ে যায়। কারণ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ না হলে সে দুঃচিন্তাগ্রস্থ হয়ে উত্তেজিত হয় এবং সর্বশেষ আইন ভঙ্গ করে। ইসলামে সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যে কোন প্রকার সৌন্দর্য বা ভালবাসার প্রদর্শনী ও চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
যেমন রাসুল(সা) বলেন-
“তোমাদের কারো উচিত নয় কোন মহিলার সাথে একাকী দেখা করা, যদি না তার সাথে তার মাহরাম (not marriageable to her) কেও থাকে। “
এছাড়া যা কিছুই মানুষকে ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ ও উদ্যোগী করতে পারে, তার সবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের দ্বারা:
“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।”
ব্যভিচারকে উৎসাহিত করে এমন বিষয়, পরিবেশ, কথা ও কাজ এই আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
রাসূল(সা) বর্ণনা করেছেন:
“…চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে।”
দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার দ্বারা সংঘটিত যিনাই মূল ব্যভিচার সংঘটিত হওয়াকে বাস্তব রূপ দান করে, তাই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য সে সকল স্থান থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, যে সকল স্থানে দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার ব্যভিচারের সুযোগকে উন্মুক্ত করা হয়।
সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলাম।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন-
“আমি আপনার প্রতি এমন কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখা”[সুরা নাহলঃ৮৯]
ইসলামি আকীদা হতে উদ্ভূত, রাসুল (সা) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, ইসলাম বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি খিলাফত ব্যবস্থা। যা অন্যান্য সব ধরণের শাসন ব্যবস্থা হতে ভিন্ন। “খিলাফত” একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত বিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এটি ইসলামি আকীদার বাইরে যেকোন দূষিত চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করবে।
ফলতঃ মানুষের জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। সর্বোপরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত রাসূল (সা) বলেন-
“নিশ্চয়ই, খলীফা হচ্ছেন ঢাল স্বরুপ….”।